জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য,সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে মামলুকদের অবদান
মিসরের মামলুকগণ প্রায় ২৫০ বছর সগৌরবে রাজত্ব করেছে। তাদের এই সুদীর্ঘ রাজত্বকাল জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিক উন্নতির জন্য কীর্তিমান হয়ে রয়েছে। রাজনৈতিক বিশৃংখলার জন্য ত্রয়োদশ শতকের শুরু থেকে আরব জগত জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়েছিলো। সৌভাগ্যবশত মিসরে মামলুকদের উত্থানের ফলে মুসলিমদের গৌরবোজ্জল জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ধারা অব্যাহত ভাবে চলতে থাকে। এ যুগে চিকিৎসা বিজ্ঞান, ইতিহাস বিদ্যা, জীবন চরিত, সাহিত্য, ধর্মশাস্ত্র, শিল্পকলা. স্থাপত্য প্রভৃতি মানবজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিশেষ উন্নতি সাধিত হয়। এ সময় আবুল হাসান আলী, ইবনে খালদুন,আল-বাইতার, আল-সুয়ূতি, আল-মাকরিজি, আবুল ফিদা, ইবনে খালিকান, ইবনে তাইমিয়াহ প্রমুখ মনীষীবৃন্দ মামলুক রাজত্বকালকে ইতিহাসে গৌরবোজ্জল করে রেখেছেন।
মামলুকদের আড়াইশ বছরের শাসনামলে মামলুক শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং মামলুক যুগের বিশিষ্ট মনীষীদের প্রচেষ্টায় যেসব ক্ষেত্রে তাদের অবদান লক্ষণীয় সেগুলো হচ্ছে-
চিকিৎসা বিদ্যা
ইতিহাস চর্চা ও ভুগোল
জীবন চরিত
সমাজ বিজ্ঞান
সাহিত্য
ইসলাম ও ধর্মতত্ত্ব
নাট্যকলা
স্থাপত্য শৈলী
শিল্পকলা ও কারুকার্য
গৃহসজ্জা ও ক্যালিগ্রাফি
হস্ত ও কুটির শিল্প
জীবন যাত্রায় আভিজাত্য
চিকিৎসা বিদ্যা:
সুলতান কালাউন এবং আল নাসিরের সময়ে চিকিৎসা বিদ্যার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছিলো। সুলতান কালাউন এক বিশাল হাসপাতাল নির্মাণ করেছিলেন, যার নাম ছিলো ‘‘আল মারিস্তান আল মানসুরি” । এটি একাধারে হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ, মসজিদ এবং সমাধিসৌধ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এর প্রধান ছিলেন আবুল হাসান আলী।
রক্ত সঞ্চালন পক্রিয়ার উপর আবুল হাসান আলীর লিখিত বিখ্যাত গ্রন্থ “শরাহ তাশরিহুল কানুন”।
পশু রোগ, বিশেষ করে ঘোড়ার বিভিন্ন রোগের উপর গবেষনা করে গ্রন্থ লেখেন আল বাইতার ও আল দিমিয়াতি।
এই আমলে স্ত্রী রোগের উপর গবেষণা ও প্রতিকার বিষয়ে ইয়াহুদি চিকিৎসকগণ অবদান রাখেন।
চক্ষু চিকিৎসায় মিসর ছিলো তৎকালিন বিশ্বে সর্বাধুনিক। বিখ্যাত চক্ষু চিকিৎসক আবুল ফাজাইল চক্ষু বিজ্ঞানের উপর “মুজাররাবাত” নামক বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন।
চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেন মুয়াফফাক উদ্দিন। “ইয়ুন আল আনবা ফি তাবাকাত আল আতিক” নামক এই গ্রন্থে চার শত গ্রিক ও আরব চিকিৎসকের জীবনী লিপিবদ্ধ করা হয়।
এ সময়ে ভেষজ চিকিৎসায় অবদান রাখেন মিসরীয় ভেষজজ্ঞ আল কুহিন আল আত্তার। ভেষজ ব্যবহার ও প্রয়োগ বিধির উপর তাঁর রচিত গ্রন্থ “মিনহাজ আদ-দুক্কান ওয়া দস্তরুল আয়ান”।
ইতিহাস চর্চা ও ভুগোল:
ভূগোল ও ইতিহাস চর্চায় এ সময়ে অবদান রাখেন ঐতিহসিক ও ভূগোলবিদ আবুল ফিদা। তার বিখ্যাত গ্রন্থ “মুখতাছার তারিখুল বাশার” বা মানব জাতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। এ সময়ে ভৌগোলিক বিবরণ সহ মিসরের ইতিহাস রচিত হয়। এ ক্ষেত্রে আরো যারা অবদান রেখেছেন তারা হলেন-
ইবনে তাগরিবিরদি
আল সুয়ূতি
আল মাকরিজি
ইবনে খালদুন
জীবন চরিত:
মামলুক আমলে মিসর জীবন চরিত রচনার ক্ষেত্রে বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার। ইবনে খালিকান এ সময়ের বিখ্যাত জবিনীকার। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “ওফাইয়াতুল আইয়ান ওয়া আনবা আবনাউজ্জামান”; এতে প্রায় ৮৬৫ জন মুসলিম ঐতিহসিকের নির্ভুল জীবনী রয়েছে।
সমাজ বিজ্ঞান:
বিখ্যাত সমাজ বিজ্ঞানি ও ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন সুলতান বারকুকের কাজি ও অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “আল মুকাদ্দিমা” সমাজ বিজ্ঞানের এক অমুল্য সম্পদ।
সাহিত্য:
আরবি সাহিত্য,কাব্য চর্চা ও কাহিনী রচনার ক্ষেত্রেও মামলুকরা কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে। আরবি ভাষার বিখ্যাত মহাকবি “আল বুসিরি”, যিনি “কাসিদাতুল বুরদা” নামক কাব্য লিখে বিখ্যাত হয়ে আছেন। আনতারা ও বাইবার্সের রোমান্টিক কাহিনী মধ্যপ্রাচ্যে আজও জনপ্রিয়।
ইসলাম ও ধর্মতত্ত্ব:
ইসলাম ধর্ম,ইসলামি আইনশাস্ত্র, দর্শন, কোরআন ও হাদিস, ফিকাহ ইত্যাদি বিষয়ে বহু মূল্যবান গ্রন্থ রচিত হয়েছে মামলুক আমলে। ইসলামি বিশ^কোষ রচিত হয়েছে এ সময়ে। এ সকল গ্রন্থ মুসলিম বিশে^ ব্যাপক ভাবে সমাদৃত। এ ক্ষেত্রে যারা অবদান রেখেছেন তারা হলেন-
ইবনে তাইমিয়াহ (সালাফি স্কলার,যুক্তিবিদ; তাঁর রচিত গ্রন্থেন সংখ্যা প্রায়-৭০০), ফতওয়া-ই- ইবনে তাইমিয়াহ তাঁর বিখ্যাত রচনা।
আল সুয়ূতি (মুফাসিসর,মুফতি,মুহাদ্দিস,কবি; বিখ্যাত গ্রন্থ: তাফসিরে জালালাইন, আল ইতকান ফি উলুমিল কোরআন)
ইবনে হাজর আসকালানি (হাদিস বিশারদ; বিখ্যাত গ্রন্থ:“ ফাতহুল বারি”,এটি বুখারি শরিফের ব্যাখ্যা।
আহমদ আল-নুয়াইরি (বিশ্বকোষ প্রনেতা)
আহমদ আল-কালকাশান্দি (বিশ্বকোষ প্রনেতা)
নাট্যকলা:
মিসরে নাট্য সাহিত্যের উদ্ভব হয় ত্রয়োদশ শতকের শেষদিকে। আল মাওসিলি ছিলেন মামলুক আমলের একজন বিখ্যাত নাট্যকার। আনতারা ও বাইবার্সের বীরত্বগাথা নিয়ে বহু নাটক রচিত হয়েছে। আলিফ লায়লা ওয়া লায়লা র পরিমার্জিত রূপ মামলুকদেরই অবদান।
আরও পড়ুন-
বিদায় হজ্বের ভাষণ এবং হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কর্তৃক ঘোষিত সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংস্কারাবলী
স্থাপত্য শৈলী:
স্থাপত্য শিল্পে মামলুক সুলতানগণ অক্ষয় কীর্তি রেখে গেছেন। বাহরি মামলুক সুলতান কালাউন,নাসির ও আল-
হাসানের এবং বুরুজি মামলুক সুলতান বারকুক, কাইতবে ও আল ঘোরির সময়ে নির্মিত মসজিদ, হাসপাতাল, বিদ্যালয় ও সমাধিসৌধগুলি মুসলিম স্থাপত্য শিল্পের উৎকৃষ্ট নিদর্শন স্বরূপ আজও বিদ্যমান রয়েছে। এগুলোতে জ্যামিতিক নকশা ও কুফিক লিপি লক্ষনীয়।
শিল্পকলা ও কারুকার্য:
মোঙ্গলদের আক্রমনের ফলে মসুল, বাগদাদ ও দামেস্ক হতে শিল্পি ও কারিগর মিসরে আশ্রয় নেয়। তাদের মাধ্যমে মিসরে শিল্প কলার বিকাশ ঘটে। প্রাসাদে, মসজিদের ভিতরে ও বাহিরে, কুলঙ্গিতে, জানালা ও চেরাগদানিতে, কোরআন রাখার স্থানে এবং নগর দুর্গ ইত্যাদিতে শৈল্পিক অলংকরনের ছোঁয়া লক্ষনীয়।
গৃহসজ্জা ও ক্যালিগ্রাফি:
ক্যালিগ্রাফি বা নানা রঙ ও ডিজাইনের অক্ষর দিয়ে গৃহ সজ্জার বিষয়টি মামলুক আমলে নতুন মাত্রা পেয়েছিলো। তেমন বড় মাপের না হলেও মামলুক শিল্পের এক অসাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিলো পান্ডুলিপির অলংকরণ। তবে এ অলংকরন প্রায় সবক্ষেত্রেই কুরআনের পাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তবে এটা ছিল খুবই সুক্ষ্ম ও সময় সাপেক্ষ কাজ।
হস্ত ও কুটির শিল্প:
মামলুক আমলে হস্ত ও কুটির শিল্পের বিশেষ প্রসার লাভ করে। ব্রোঞ্জ ও কাঠের উপর খোদাই ও কারুকার্য, পুস্তক বাধাই,ও কুফিক লিখন পদ্ধতি এ যুগে বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করে।
জীবন যাত্রায় আভিজাত্য:
মামলুক আমলে মানুষের জীবন যাত্রায় এসেছিল আভিজাত্য। এর প্রমান পাওয়া যায় এ যুগের কারুকার্যময় বিলাস সামগ্রীর নিদর্শণ থেকে। একদিকে রয়েছে পেয়ালা, পাত্র, বারকোশ, ধুপদানি ইত্যাদির ব্যবহার অন্যদিকে আছে মামলুক রমণীদের ব্যবহৃত কানের দুল, বাজুবন্ধ, গলার হার, চুড়ি ও গহনা যা আজো মিসরীয় রমণীদের কাছে আকর্ষনীয়। মামলুকরা অনেকটা উৎসবমুখর জীবনে অভ্যস্ত ছিল। উৎসব ও বিনোদনে তারা যথেষ্ট গুরুত্ব দিত। প্রতিটি ভোজসভার পরেই নাচ,গান, ভোজবাজি বা ছায়া নাটিকার আয়োজন করা হতো। তুর্কি সুলতান সেলিম মিসর দখলের পর মিসর থেকে যে স্থপতি, শিল্পি, কারিগর, মূলবান পাথর তুরস্কে নিয়ে গিয়েছিলেন তাতে এসব ক্ষেত্রে মামলুকদের উৎকর্ষতারই প্রমান মিলে।
আরও পড়ুন-
বাঙ্গালি জাতির নৃতাত্ত্বিক পরিচিতি, Ethnographic identity of the Bengali nation
Md. Billal Hossain
B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka
BCS General Education
Lecturer
Department of Islamic History & Culture
Chandpur Govt. College, Chandpur.
No comments:
Post a Comment