Breaking

Sunday 31 July 2022

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৈচিত্রে ঐক্য।। Unity In Diversity of South-East Asia।।


 দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার  বৈচিত্রে ঐক্য

(Unity In Diversity)



প্রাচীনকাল থেকেই ভূ রাজনীতির ক্ষেত্রে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। কালের আবর্তনে এবং ভৌগোলিক কারণে বিভিন্ন অঞ্চলের লোক এখানে জনবসতি গড়ে তোলে। ফলে এখানকার জাতিগোষ্ঠীগুলোর ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বৈচিত্র বিদ্যমান । এ কারণে গবেষকগন এ অঞ্চলকে Paradise of the Anthropologist বা ‘নৃবিজ্ঞানীদের স্বর্গ’ বলে অভিহিত করেন থাকেন। এই বৈচিত্রের পাশাপাশি এখানকার জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে এবং ভৌগলিক বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের মধ্যে বিভিন্ন দিক থেকে সুনিবিড় ঐক্য বিদ্যমান । সেজন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ক্ষেত্রে  Unity In Diversity বা ‘বৈচিত্রে ঐক্য’ একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচিত বিষয়। 








দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পরিচিতি ও অবস্থান:

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৈচিত্রে ঐক্য বৈচিত্র জানার পূর্বে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অবস্থান জানা আবশ্যক। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া কর্কটক্রান্তি রেখা ও বিষুবরেখার দক্ষিনে অবস্থিত এর উত্তরে চীন-জাপান, পশ্চিমে ভারত মহাসাগর, দক্ষিনে অস্ট্রেলিয়া এবং পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগর। অন্যভাবে বলা যায়, ভারত এবং চীনের দক্ষিণ-পূর্বে যে ভূখণ্ডের অবস্থান সেটাই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। অথবা এশিয়া থেকে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পথে মধ্যখানে যে ভূভাগ রয়েছে সে অঞ্চল দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া নামে পরিচিত। বর্তমানে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় মোট 11 টি দেশে রয়েছে। 


দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে প্রধানত দুটি অংশে বিভক্ত:

১. মেইনল্যান্ড বা মহাদেশীয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া: 

যা এশিয়া মহাদেশের মূল ভূ-খণ্ডের দক্ষিণ-পূর্ব কোণায় অবস্থিত একটি উপদ্বীপ। একে ঐতিহাসিকভাবে ইন্দোচীন নামেও ডাকা হয়। এটি কম্বোডিয়া, লাওস, মিয়ানমার, উপদ্বীপীয় মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম রাষ্ট্রগুলি নিয়ে গঠিত।


২. আইল্যান্ড বা সামুদ্রিক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া: 

যা এশিয়া মহাদেশের মূল ভূখণ্ডের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে সমুদ্রে অবস্থিত বিভিন্ন দ্বীপপুঞ্জ ও একটি বৃত্তচাপাকৃতি দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে গঠিত। এটিকে ঐতিহাসিকভাবে নুসান্তারা, পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, কিংবা মালয় দ্বীপপুঞ্জ নামেও উল্লেখ করা হয়।



প্রাচীনকাল থেকেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সংযোগস্থল হিসেবে পরিচিত। এজন্য একে Meeting Grounf of 3Cs বলা হয়।  Here 3Cs means-
  1. Commerce

  2. Civilization &

  3. Culture 



পূর্ব এশিয়ার বৈচিত্রে ঐক্য: 


পণ্ডিতরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে Region of Unity in Diversity   "বৈচিত্রে ঐক্য" হিসাবে বর্ণনা করেছেন, এই অর্থে যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে ভিন্নতা এবং  একতার বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান রয়েছে । যেমন:যদিও দেশগুলি প্রতিবেশী, কিন্তু তাদের মধ্যে কিছু মূল ভূখণ্ডে এবং অন্যগুলি বৃহৎ পরিমাণে দ্বীপপুঞ্জের সমন্বয়ে গঠিত। তদুপরি, পর্বত দ্বীপগেলো কিছু দেশকে পৃথক করেছে আবার   নদীগিুলো বিভিন্ন জলরাশীকে সংযুক্ত করে বিভিন্ন ধরনের সমাজ গঠনের সহায়তা হরেছে। ; ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্মীয় অনুশীলন ইত্যাদির মধ্যে মিলের পাশাপাশি পার্থক্যও রয়েছে। এর উপরে, ক্রমবর্ধমান একীকরণ এবং বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া এবং সমাজে ক্রমবর্ধমান আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া আজ আগের চেয়ে বেশি একত্রিত এবং অভিন্নতা প্রদর্শন করছে। 



দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ক্ষেত্রে ইউনিটি ইন ডাইভারসিটি বা বৈচিত্র ঐক্য  বিষয়টি বেশ আলোচিত। যাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় `Bhinneka Tunggal Ika’ মূল ভূখন্ডের বাইরে হাজার হাজার দ্বীপপুঞ্জ গঠিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপাঞ্চল জলভাগ দ্বারা একত্রিত এবং ছোট ছোট দ্বীপ এবং পাহারা পারস্পরিক ভাবে বিভক্ত। তাই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ক্ষেত্রে Sea Unites, land devides কথাটি প্রযোজ্য। নিচে  দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৈচিত্রে ঐক্য সংক্রান্ত বিষয়টির বিভিন্ন দিক আলোচনা করা হলো। 



বৈচিত্র 


        A. ভূগোলিক বৈচিত্র: 

এখানে ভৌগলিক বৈচিত্র বিদ্যমান।এই এলাকাটি দুটি স্বতন্ত্র অঞ্চলে বিভক্ত। মেইনল্যান্ড এবং আইল্যান্ড তথা মূল ভূখণ্ড ও দ্বীপপুঞ্জ। গুলোকে একসাথে বলা হয় স্টেপিং স্টোন টু অস্ট্রেলিয়া। রাষ্ট্রগুলো জলরাশি পাহাড়-পর্বত দ্বারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন। ভৌগোলিক ও প্রকৃতিক বৈশিষ্ট্য এখানে নানা সংস্কৃতি ও জাতির জন্ম দিয়েছে। 


DGE Hall বলেন-

"South East Asia today is an anthropologist`s Paradise. In its mountains and jungles live the remnants of a great variety of peoples representing early stages of its anthropological history". (See-A history of Southeast Asia, Hall, D.G.E, P-5 )



       B. জাতিগত বৈচিত্র:

        এখানে চারটি ভিন্ন জাতির অস্তিত্ব পাওয়া যায়

  1. Australoid (Veddoid)

এরা আফ্রিকা থেকে এসেছে,কারো মতে অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছে। বর্তমানে এখানে এদের কোন অস্তিত্ব নেই । তবে কিছু সংখ্যক অস্ট্রেলিয়াতে দেখা যায়।  এছাড়া সিলেবিস দ্বীপপুঞ্জ, সিলন দ্বীপ, দক্ষিণ Senay  এবং Sakai  এ দেখা যায় । এরা আকৃতিতে খাটো, নাক বোচা, দাঁত তীক্ষ্ণ, কোকড়ানো চুল তবে পশমী নয়। 


            Brain Harrison বলেন-

"The Australoid and the very similar to it Veddoid people were probably the first widespread human inhabitants of Southeast Asia". (See- Southeast Asia: A short history, P- 4)


  1. নেগ্রিটো

এরা পশমী চুলের অধিকারী। এদের সংখ্যা খুবই কম।  Aetas নামে ফিলিপাইনে, Pagan নামে Kelantan এ এবং Perak ও Kedak  নামে মালয়েশিয়াতে এদের দেখা যায়। তবে ঐতিহাসিক বুকাননের মতে নেগ্রিটোরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম অধিবাসী।


K. Buchanon বলেন-

"In racial terms, the earliest Inhabitants of the Southeast Asian world appeared to have been negritos."  (See- South East Asian world, P-26)



  1. Melonesoid: 

এই ধরনের নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর অস্তিত্ব বর্তমানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে নেই । এদের চুল ও মাথার খুলি পাওয়া যায়।  বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া এবং গিনীতে তাদের কিছু সংখ্যক লোক দেখা যায়। 


  1. Indonesian:

এরা Jakun নামেও পরিচিত ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ার বর্তমান জনগোষ্ঠী এরা মূলত এই সম্প্রদায় থেকে এসেছে এদের সম্পর্কে ব্রেইন হ্যারিসন বলেন-




এই জনগোষ্ঠীর দুটি ভাগে বিভক্ত

  1. Proto Malaya (প্রটো মালয়): 

এদের অবস্থান দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মূল ভূখণ্ডে

  1. Deutero Malaya (দুতারো মালয়), এদের অবস্থান উপকূলে এবং দ্বীপপুঞ্জে।


        C. ভাষাগত বৈচিত্র: 

বিভিন্ন জাতির লোক হওয়ার বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর থেকে উদ্ভূত হওয়ার কারণে স্বভাবতই এই এলাকার লোকদের মধ্যে ভাষাগত বৈচিত্র বিদ্যমান ছিল ব্রেইন হ্যারিসন  তিনটি ভাষার কথা বলেছেন আর লি উইলিয়ামচারটি ভাষার কথা বলেছেন। 

  1. Malayo-Polynessian

ভাষা ঠিক ছিল সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ভাষা একটা সেমিটিক ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত এই অঞ্চলের অধিকাংশ লোক এই ভাষাতেই কথা বলে

  1. Austro Asian

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মেইনল্যান্ড তথা মূল ভূখণ্ডে যে রাষ্ট্রগুরু ছিল তারা এ ভাষায় কথা  বলতো তবে থাইল্যান্ড এবং বার্মা ব্যতীত 

  1. Sino-Tibrtan/ Tibeto-Chinise

থাইল্যান্ড এবং বার্মার লোকেরা এই ভাষা ব্যবহার করে

  1. Ti-Sakai 

থাইল্যান্ডের একটি গোষ্ঠী এই ভাষা ব্যবহার করে



        D. ধর্মীয় বৈচিত্র: 

বাণিজ্যিক কারণে এখানে বহু ধর্মের মানুষের আগমন ও বিস্তার ঘটেছে।  চিনা প্রভাবের সময় বৌদ্ধ ধর্ম, ভারতীয় প্রভাবের সময় হিন্দু ধর্ম, পরবর্তীতে ইসলাম ধর্মের প্রাধান্য দেখা যায়।  ইউরোপীয়দের আগমনের ফলে  সেখানে খ্রিস্টান ধর্মের প্রসার ঘটে । 


আরও পড়ুন-  দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস রচনার উৎসসমূহ



ঐক্য 


বিভিন্ন ক্ষেত্রেবৈচিত্র থাকার পাশাপাশি এখানে নানা বিধ ক্ষেত্রে ঐক্য বিদ্যমান ছিল


        A. ভৌগলিক ঐক্য :

এই অঞ্চলটি এশিয়া থেকে আলাদা বিষুব রেখা এবং মকর ক্রান্তি রেখা এখান দিয়ে যাওয়ার ফলে এখানে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয় এ কারণে এখানে প্রচুর ধান জন্মে এবং নিবিড় অরণ্য আচ্ছাদিত অঞ্চল রয়েছে গোটা এলাকা তে মৌসুমি বায়ুর প্রভাব রয়েছে একটি দক্ষিণ-পশ্চিমে অন্যটি উত্তর-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয় আবহাওয়া এক হওয়ার কারণে এখানে ফসল উৎপাদনের ঐক্য দেখা যায় ।


V. Purcell বলেন-

"Although there are hundreds of racial types in Southeast Asia, the Great majority of the people have a strong racial similarity". (See- Southeast Asia Since 1800, P-9


        B. জাতিগত ও জাতিগত ঐক্য:

বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও এখানকার জাতিগত একটি বৃহৎ তো একটু হলেও এখানকার জনগণ সবাই আকৃতিতে খাটো এরা মঙ্গোলীয় থাকার লোক মঙ্গোলীয় রক্তের ধারা এদের মধ্যে প্রবাহিত এর আমার্জিত স্বভাবের রুক্ষ মেরাজের নয় রুচিশীল ও কৌতুকপ্রিয় স্বভাবের এরা অনেকটা আরামপ্রিয় তবে জাপান ব্যতীত


       C. ভাষাগত ঐক্য:


ভাষার ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও এখানকার অধিকাংশ লোকই একটি প্রধান ভাষা তথা Malayo-Polynessian ভাষায় কথা বলে। 


        D. ধর্মীয় ঐক্য

  1. সর্বপ্রাণবাদ তাদের ধর্মীয় সাধারণ ঐক্য পরবর্তীতে তারা নানা ধর্মে দীক্ষিত হয় 

  2. 7 এবং 5 সংখ্যার প্রতি তাদের বিশেষ বিশ্বাস ছিল

  3. কুসংস্কার তাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল 

  4. তারা পুরুষদের পূজা করত 

  5. মানুষ মারা গেলে ঘরের ভিতরে বা পাত্রে পুতে রাখতো 

  6. রূপকথার কিছু বিশ্বাস পাহাড়ের মানুষের সাথে উপকূলের মানুষের এবং উপরের পাখির সাথে জলের প্রাণীর দ্বন্দ্ব ছিল বলে তারা বিশ্বাস করতো 

  7. এছাড়া স্থল এবং জলে তারা দ্বৈত সত্তায় বিশ্বাস করত। অর্থাৎ স্থলে একজন অধিকর্তা রয়েছেন এবং জলে একজন অধিকর্তা রয়েছেন। 


        E. সাংস্কৃতিক ঐক্য:

  1. তাদের নবান্ন অনুষ্ঠান একই রকমের হয়ে থাকে।

  2. একই ধরনের সেচ ব্যবস্থা তারা আয়ত্ত করেছে।

  3. কৃষি ক্ষেত্রে তারা প্রয়োজনে ষাড় ও মহিষ পোষ মানাতে শিখেছে ।

  4. তাদের মানসিক  ঐক্য ছিল সুনিবিড়।

  5. ধাতব পদার্থ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে ঐক্য ঐক্য দেখা যায় ।

  6. সামাজিক ঐক্য প্রকট

  7. নারীর মর্যাদা এবং মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ছিল এখানে প্রতিষ্ঠিত বিষয়

  8. কৃষিনির্ভর বহু সংগঠন এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে



V. Purcell বলেন-

জাতিগত বৈচিত্র্যের চেয়ে এখানে সাংস্কৃতিক মিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে কিছু ক্ষেত্রে প্রকট বৈচিত্র এবং কিছু ক্ষেত্রে ঐক্য লক্ষণীয় এ বিষয়টি এই এলাকার একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য । 


আরও পড়ুন-

Md. Billal Hossain

B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka

BCS General Education

Lecturer

Department of Islamic History & Culture

Chandpur Govt. College, Chandpur.



No comments:

Post a Comment