দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস রচনার উৎসসমূহ
ইতিহাস সাহিত্য, চলচ্চিত্র বা নাটক নয় যে গল্পকার বা পরিচালক যেভাবে চাইবেন সেভাবেই সেটি তৈরি হবে। ইতিহাসের প্রতিটি কথার তথ্যপ্রমাণ থাকতে হবে। অথেন্টিক সোর্স ব্যতীত ইতিহাস রচিত হলে ইতিহাস তত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে সেটাকে বটতলার পুঁথি বা গরুর রচনার মত মনে করা হয়। সেজন্য বলা হয় History based on Sources অর্থাৎ উৎসের ভিত্তিতে ইতিহাস রচিত হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মুসলমানদের ইতিহাস প্রায় হাজার বছরের বেশি পুরানো। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রেও ঐতিহাসিকগণ বেশকিছু নির্ভযোগ্য তথ্য প্রমাণের আশ্রয় নিয়েছেন ।
দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস যে সমস্ত প্রধান উপকরণ এর ভিত্তিতে রচিত হয়েছে সেগুলো নিম্নরূপ-
সরকারি দলিল দস্তাবেজ
বিদেশি বণিক ও পর্যটকদের বিবরণ
সমসাময়িক ঐতিহাসিকদের রচনাবলী
বিভিন্ন ভাষায় উৎকীর্ণ মুদ্রা ও শিলালিপি
সমসাময়িক সাহিত্য
স্মৃতিস্তম্ভ ও অট্টালিকা
সমাধি সৌধ
বিভিন্ন সংস্থার গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ
আধুনিককালে রচিত ঐতিহাসিক গ্রন্থ
উপরিউক্ত প্রধান উপকরণ গুলোর ভিত্তিতে দক্ষিণ -পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস রচনায় আমরা যে সমস্ত উৎসের সন্ধান পেয়েছি সেগুলো নিম্নরূপ-
পেরিপ্লাস অফ দি এরিথ্রিয়ান সি:
এই গ্রন্থটির লেখক অজ্ঞাত, এতে সুবর্ণভূমি ও সুবর্ণ দ্বীপ এর বর্ণনা রয়েছে।
টলেমি রচিত জিওগ্রাফিয়া:
এই গ্রন্থে মালয় উপদ্বীপের কথা উল্লেখ আছে।
মালয় এনালাস বা সেজারা/সেসা মেলয়ূ:
এর লেখকের অজ্ঞাত, অনেক লোকশ্রুতি গল্প ও কাহিনী এতে স্থান পেয়েছে। পেরাক রাজ্যের ইতিহাস পাওয়া যায় এই গ্রন্থে।
কেদা কাহিনী:
এতে কেদার ইতিহাস পাওয়া যায়।
মিসা মেলয়ূ:
রাজা চুলন রচিত গ্রন্থ, এতে রাজপ্রাসাদের আদব-কায়দা, বিবাহের নিয়মকানুন, রাজকীয় শোভযাত্রা, শব সমাধির নিয়মকানুন ইত্যাদির বর্ণনা রয়েছে।
হিস্ট্রি অফ দা লিয়াং ডাইনেস্টি:
এই গ্রন্থে চীনা ইতিহাসের উপাদান পাওয়া যায়।
গাইড টু জিওগ্রাফিয়া:
এতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক পরিচয় পাওয়া গেলেও বইটি বিতর্কিত।
অজি শক:
লেখক অজ্ঞাত, এই গ্রন্থে জাভার ইতিহাস উল্লেখ আছে।
লিউ সং হিস্ট্রি ও নিউ টাং হিস্ট্রি,
এটি চৈনিক ভাষায় লেখা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিষয়ক একটি গ্রন্থ ,
তুহফাতুল নাফিস:
রাজা আলী রচিত। এই গ্রন্থটিতে মধ্যযুগের সিঙ্গাপুর ও মালাক্কার বর্ণনা রয়েছে।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র:
এতে এক ভারতীয় ব্রাহ্মণের বানারসি থেকে সুবর্ণভূমি যাত্রার বিবরণ আছে।
রামায়ণে যবদ্বীপ ও সুবর্ণ দ্বীপের উল্লেখ পাওয়া যায়, এখানে যবদ্বীপ বলতে মূলত জাভা এবং সুবর্ণ দ্বীপ বলতে মূলত সুমাত্রাকে বুঝানো হয়েছে । সুতরাং রামায়ণেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প:
প্রাচীন ভারতীয় এ গ্রন্থটিতে কর্মরঙ্গ, নারীকের, বালি দ্বীপ ও যবদ্বীপের কথা উল্লেখ আছে।
তোমেপিরেস রচিত সোমা ওরিয়ান্টাল:
এই গ্রন্থটিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যের বিশদ বর্ণনা রয়েছে।
A History of the South East Asia:
D.G.E Hall রচিত এটি একটি আধুনিক বিশ্লেষণধর্মী ঐতিহাসিক গ্রন্থ। এই গ্রন্থে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু ঐতিহাসিক তথ্যের বিশ্লেষণধর্মী বিবরণ রয়েছে।
রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটি মালয় শাখা যা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস নির্ভর বহু তথ্যবহুল লেখা প্রকাশ করেছে।
মার্কোপোলো ও ইবনে বতুতা সুমাত্রা ও পসেই এসেছিলেন। তারা এখানে ইসলাম ধর্মের উপস্থিতির কথা বলেছেন। আরবি ভাষায় উৎকীর্ণ লেখ এখানে পাওয়া গেছে।
লেইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ পাওয়া গেছে যেগুলোতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু তথ্য রয়েছে।
হিমাংশু ভুষন সরকার ইন্দোনেশিয়ার ঐতিহাসিক উপকরণ কে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। যথা-
কুলপুঞ্জি ও অর্ধ পৌরাণিক কাহিনী
শিলালিপি ও তাম্রশাসন
ঐতিহাসিক সাহিত্য
শিলালিপি তাম্রশাসন:
D.G.E Hall এর মতে এখানকার ইতিহাসের এক প্রধান উপকরণ হলো অনেকগুলো ভাষায় উৎকীর্ণ শিলালিপি বা লেখ। অনেকগুলো লেখতে ভারতীয় দেবতাদের নাম পাওয়া যায়। সংস্কৃত ভাষায় অনেকগুলো লেখ পাওয়া গেছে । পরে আরবি ভাষায় উৎকীর্ণ লেখা পাওয়া গেছে। এগুলো গবেষণা করে ঐতিহাসিকগণ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস রচনার নির্ভরযোগ্য উপাদান সংগ্রহ করেছেন।
সাহিত্যিক উপাদান:
দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস রচনার উৎস সমূহের মধ্যে সাহিত্যিক উপাদান হিসেবে রয়েছে -
ব্রাহ্মণ ও বৌদ্ধ সাহিত্য
পুরান
চীনের ইতিহাস ও
আরবি ভাষায় লিখিত বিবরণ
চীনের ইতিহাস নির্ভর সাহিত্য থেকে এই এলাকা রাজনীতি ও বাণিজ্যিক উত্থান উত্থান পতনের ইতিহাস পাওয়া যায়।
ভারতীয় সাহিত্য কাহিনী থেকে এ অঞ্চলের আদি রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা জানা যায়।
আরবি ভাষায় লিখিত বিবরণ ও লেখ থেকে এখানে মুসলমানদের উপস্থিতি, মুসলমানদের বাণিজ্য এবং তাদের ধর্ম প্রচার বিষয়ক তথ্য পাওয়া যায়।
এখানকার স্থানীয় ইতিহাস ব্রাহ্মণ ও বৌদ্ধ সাহিত্যের পরিপূরক উপাদান হিসেবে তথ্য যুগিয়েছে । এখানকার সবদেশে স্থানীয় কাহিনী কারেরা কল্পনা, জনশ্রুতি ও লোককাহিনী মিশিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন এগুলো ইতিহাসের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
আরও পড়ুন-
প্রাক-মুসলিম মালয় জগতের উপর ভারতীয় ও চৈনিক প্রভাব: স্বরূপ ও তাৎপর্য
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নামকরণ, অবস্থান, গুরুত্ব, প্রধান ও সাধারণ বৈশিষ্ট্যসমূহ
Md. Billal Hossain
B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka
BCS (General Education)
Lecturer
Department of Islamic History Culture
No comments:
Post a Comment