চেঙ্গিস খান (1162-1227)
চেঙ্গিস খানের পরিচয়:
চেঙ্গিস খানের জন্ম ১১৬২ সালে, মঙ্গোলিয়ার ওনোন নদীর তীরবর্তী ডাইলিউন বুলদাঘা নামক স্থানে। তার-
পিতার নাম : ইসুজাই এবং
মাতার নাম : হেলুন।
বাল্য নাম : তেমুচিন (তেমুচিন অর্থ ইস্পাত কঠিন)
স্ত্রীর নাম : বুরতাই
পিতা ইসুজাই মোঙ্গলদের তেরোটি গোত্রের নেতা ছিলেন। তেমুচিনের জন্মের বছর তাহার পিতা ইসুজাই তাতার গোত্র আক্রমণ করেন এবং তাতার গোত্রের দলপতি তেমুজদিন উজিকে পরাজিত ও হত্যা করেন। অতঃপর পরাজিত শত্রুর নামানুসারে তিনি তাঁর পুত্রের নাম রাখেন তেমুচিন। উনগির গোত্রের দেশাই চান নামক ব্যাক্তির ১০ বছর বয়স্ক কন্যা বুরতাই এর সাথে ১৩ বছর বয়সে তেমুচিনের বিবাহ হয়।
তেমুচিনের পিতৃহত্যা:
পুত্রের বিবাহ কার্য সম্পন্ন করিয়া প্রচলিত প্রথা অনুসারে তার পুত্রকে শ্বশুরালয়ে রাখিয়া পিতা ইসুজাই দেশে ফিরতেছিলেন। কিন্তু পথিমধ্যে তাতার গোত্রের লোকেরা তাকে আমন্ত্রণ জানায় এবং তাহার খাদ্যে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে তাকে হত্যা করে। এইভাবে তাতার গোত্র তাকে হত্যা করে তাদের পরাজয় ও দলপতি হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করে।
গোত্রের নেতৃত্বে তেমুচিন:
পিতার মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর। অল্প বয়সেই তিনি গোত্রপতির আসনে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু দুর্ধর্ষ মঙ্গলরা এই বালকের নেতৃত্ব সহজে মানতে রাজি ছিল না। বাধ্য হয়ে তিনি গোত্রীয় কলহে লিপ্ত হর। স্বীয় প্রতিভায় ও মাতার সুযোগ্য অভিভাবকত্বে তেমুচিন সমস্ত প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে নিজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।
স্ত্রী অপহরণ ও পুনরুদ্ধার:
এ সময় মেরকাইট গোত্রের লোকেরা তার স্ত্রীকে জোরপূর্বক অপহরণ করলে তার এক নতুন বিপদ এসে উপস্থিত হয়। এতে তিনি ক্ষুব্ধ ও অপমানিত বোধ করেন। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে এ সময় তিনি কেরাইট গোত্রপতির বন্ধুত্ব এবং সহযোগিতা লাভ করেন। ফলে কেরাইট গোত্রপতি তুঘরিলের সহায়তায় মেরকাইট গোত্রকে এক যুদ্ধে পরাজিত করে তেমুচিন তার স্ত্রীকে উদ্ধার করতে সক্ষম হন। স্ত্রী-উদ্ধারপর্ব তেমুচিনের প্রাথমিক জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা, এর মাধ্যমে তিনি অদূর ভবিষ্যতে বৃহত্তর সামরিক সংঘর্ষের জন্য বিরাট অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। এ সময় তিনি উত্তর চীনের কীন সাম্রাজ্যের রাজার বন্ধুত্ব অর্জন করতে সক্ষম হন।
সম্মিলিত শক্তিকে পরাস্তকরণ
তেমুচিন এর ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি এইভাবে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে দেখে নাইমান, মেরকাইট ও অন্যান্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তার বিরুদ্ধে জামুকা নামক জনৈক শক্তিশালী নেতার অধীনে এক সামরিক ঐক্যজোট গড়ে তোলে। কিন্তু ১২০৪ সালে মেতুচিন এই সম্মিলিত শক্তিকে পরাজিত করতে সক্ষম হন। সম্মিলিত শক্তির নেতা জামুকা যুদ্ধক্ষেত্রে বন্দী হন এবং পরে তাকে হত্যা করা হয় ।এরপর থেকে মোঙ্গল জাতির মধ্যে তেমুচিন এর বিরোধিতা করার মত আর কোন শক্তি অবশিষ্ট ছিল না।
চেঙ্গিস খান উপাধি ধারণ:
তেমুচিন মোঙ্গল জাতির একচ্ছত্র নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেন। অতঃপর উচ্চাভিলাষী তেমুচিন সকল গোত্রের স্বীকৃতি লাভের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং ১২০৬ সালে রাজধানী কারাকোরামে ’কুরিলতাই’ এর এক মহাসম্মেলন আহ্বান করেন। এই সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে তিনি ’চেঙ্গিস খাঁন’ (মহান খান) উপাধি ধারণ করেন। এরপর থেকে তিনি ইতিহাসে চেঙ্গিস খান নামেই প্রসিদ্ধ।
চেঙ্গিস খানের রাজ্য বিস্তার
চীন অভিযান
দিগ্বিজয়ে বের হয়ে চেঙ্গিস খান সর্বপ্রথম চীনের প্রতি তার দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। চীন সময় দুটি স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত ছিল যথা কীন বংশ ও সাঙ্গ বংশ।
সাঙ্গ বংশের বিরুদ্ধে অভিযান 1211:
চেঙ্গিস খান ১২১১ সালে সাঙ্গ বংশের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। উপর্যুপরি কয়েকটি সফল অভিযানের পর এই রাজ্যের অধিকাংশ স্থান মোঙ্গলবাহিনীর অধিকারে আসে
কীন বংশের বিরুদ্ধে অভিযান ১২১৪
অতঃপর চেঙ্গিস খান কীন বংশের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন এবং ১২১৪ সালে রাজধানী পিকিং অবরোধ করেন। কীন রাজা চেঙ্গিস খানের আগমনে ভীত হয়ে তার বশ্যতা স্বীকার করেন এবং তাকে বহু নগদ অর্থ ও মূল্যবান পাথর উপঢৌকন হিসেবে প্রেরণ করেন। এছাড়া জনৈকা চীনা রাজকুমারীকে তিনি চেঙ্গিস খানের স্ত্রী হিসেবে তার নিকট অর্পণ করেন। ফলে সে বছর চেঙ্গিস খান পিকিং অধিকার না করে রাজধানী কারাকোরামে ফিরে আসেন। কিন্তু পরবর্তী বছর তিনি পুনরায় চীনে প্রবেশ করেন এবং ১২১৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি পিকিং বিজয় সম্পন্ন করেন অর্থাৎ কীন বংশ কে পরাস্ত করে তিনি পিকিং জয় করেন।
কারাখিতাই এর বিদ্রোহ দমন:
চেঙ্গিস খানের চীন অভিযানে ব্যস্ত থাকার সুযোগে কারাখিতাই এর তাতার অধিপতি গুরখান বিদ্রোহ করেন । চেঙ্গিস খান এই বিদ্রোহ দমন করার জন্য তার অন্যতম সুযোগ্য সেনাপতি জেবিকে প্রেরণ করেন । কারাখিতাই এর বিদ্রোহী নেতা জেবির হাতে পরাজিত ও নিহত হন এবং ১২১৮ সালে এই অঞ্চল চেঙ্গিস খানের অধিকারে আসে।
খাওয়ারিজম অধিকার:
কারাখিতাই অধিকারের ফলে চেঙ্গিস খানের রাজ্য মুসলিম সাম্রাজ্য খাওয়ারিজম শাহ এর রাজ্যের সাথে এক মিলে যায়। খাওয়ারিজম শাহকে চেঙ্গিস খান ভীতির চোখে দেখতেন। অন্যদিকে মোহাম্মদ শাহ মধ্যপ্রাচ্যের সাথে চীনের বাণিজ্য সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করতেন। কিন্তু মাঝপথে মোঙ্গলদের উত্থানের ফলে তার বিশেষ অসুবিধা হয়ে দাঁড়ায়। তা সত্ত্বেও প্রথমদিকে উভয়ের মধ্যে ভাল সম্পর্ক বজায় ছিল। কিন্তু মোহাম্মদ শাহের অদূরদর্শিতার ফলে এ সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। প্রথমত তিনি চেঙ্গিস খান কর্তৃক প্রেরিত উপঢৌকন প্রত্যাখ্যান করেন এবং তার দুত কে হত্যা করেন। দ্বিতীয়তঃ এ সময় খিবা ও বোখারা থেকে চারশত পঞ্চাশ জনের একটি মুসলমান দলকে তিনি চেঙ্গিস খানের গুপ্তচর সন্দেহে বন্দী করেন এবং তাদেরকে পরে হত্যা করা হয়। এর প্রতিকার এবং ক্ষতিপূরণ দাবি করে চেঙ্গিস খান মোহাম্মদ শাহ এর নিকট দ্বিতীয়বার দূত প্রেরণ করেন। কিন্তু এবারও চেঙ্গিস খানের দুত কে তিনি হত্যা করেন। ফলের তাদের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায় । ১২১৯ খ্রিস্টাব্দের চেঙ্গিস খান এক বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে খাওয়ারিজম শাহ এর বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। এদিকে খাওয়ারিজম শাহ তার নিজের সাফল্য সম্বন্ধে অত্যন্ত আশাবাদী ছিলেন এবং তার সৈন্যসংখ্যা ছিল মোঙ্গলদের চেয়ে বেশি। কিন্তু ইহা সত্বেও তিনি নানা কারণে চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন । উসের নিকটবর্তী স্থানে সংগঠিত যুদ্ধে মোঙ্গলদের হাতে তিনি পরাজিত হন। এবং চেঙ্গিস খান দ্রুত গতিতে ওতরার, বোখারা ও সমরকন্দ অধিকার করেন। অতঃপর তিনি আমু দরিয়া অতিক্রম করে 1221 খ্রিস্টাব্দে বলখ, খোরাসান, হিরাট ও মার্ভ অধিকার করেন । খাওয়ারিজম শাহ নিশাপুর পলায়ন করলে মোঙ্গলবাহিনীর তার পশ্চাদ্ধাবন করে নিশাপুর অধিকার করে। অতঃপর খাওয়ারিজম শাহ কাস্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী কোনো এক অজ্ঞাতনামা স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং এইখানে কিছুদিন পর ভগ্নহৃদয় মোহাম্মদ শাহ এর মৃত্যু হয়।
জালাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ:
মোহাম্মদ শাহ এর মৃত্যুর পর তার সুযোগ্য পুত্র জালাল উদ্দিন জালালউদ্দিন মাঙ্গবারানী পিতৃ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তিনি অত্যন্ত যোগ্য একজন নরপতি ছিলেন। জালালউদ্দিন স্বীয় বংশের গৌরব পুনরুদ্ধারের সচেষ্ট হন এবং গজনির নিকট অনুষ্ঠিত একটি খণ্ডযুদ্ধে মোঙ্গল বাহিনীকে পরাজিত করেন। এটাই ছিল সম্ভবত মোঙ্গলবাহিনীর প্রথম পরাজয়। কিন্তু জালাল উদ্দিনকে নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে এক দুর্ধর্ষ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়েছিল, ফলে সিন্ধু নদীর তীরে ১২২১ সালে চেঙ্গিস খানের সাথে অপর এক যুদ্ধে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেও অবশেষে জালালুদ্দিন পরাজিত হন। চতুর্দিক থেকে শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে পড়লে তিনি নিরুপায় হয়ে ৩০ ফুট উঁচু পর্বত থেকে সিন্ধু নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং অসীম বীরত্বের সাথে তিনি নদী অতিক্রম করেন। অতঃপর পলায়নরত শাহ তৎকালীন দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিসের দরবারে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। কিন্তু জালালউদ্দিনকে আশ্রয় দূরদর্শী ইলতুৎমিস চেঙ্গিস খানের মতো শত্রুর বিরাগভাজন হতে চাইলেন না।দিল্লির আবহাওয়া তার জন্য উপযোগী নয় বলে তিনি তাকে আশ্রয় দিতে অস্বীকার করেন। পরে পলায়নরত জালালউদ্দিন ১২৩১ সালে এক আততায়ীর হাতে নিহত হন । তাঁর মৃত্যুতে খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের পতন ঘটে ।
রাশিয়া ও উত্তর-পশ্চিম পারস্য বিজয়:
চেঙ্গিস খান যখন মধ্য এশিয়ার খাওয়ারিজম শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ছিলেন তখন তিনি সুবাত-ই এবং জেবি নামক তার দুজন সেনাপতিকে দক্ষিণ রাশিয়া এবং উত্তর পশ্চিম পারস্যে প্রেরণ করেন। কালকা নদীর তীরে অনুষ্ঠিত এক প্রচণ্ড যুদ্ধে মোঙ্গলবাহিনী রুশ বাহিনীকে পরাজিত করে এবং খিবা মঙ্গলদের হস্তগত হয় এছাড়া উত্তর পশ্চিম এছাড়া উত্তর-পশ্চিম পারস্যের রাই, রুম, হামাদান ও সাবাহ প্রভৃতি প্রধান শহর গুলি মঙ্গলদের অধিকারে আসে।
চেঙ্গিস খানের ভারত অভিযান:
খাওয়ারিজম শাহ জালালউদ্দিনকে পরাস্ত করার পর চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মোঙ্গলবাহিনীর মূল শাখা সিন্ধু প্রদেশের মুলতান পর্যন্ত অগ্রসর হয় । কিন্তু তারা আর সামনে অগ্রসর না হয়ে প্রত্যাবর্তন করে এবং রাজধানীর কারাকোরামে ফিরে যায়। পথিমধ্যে ১২২৩ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গলবাহিনীর হস্তে
পেশোয়ার সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়। প্রতিকূল আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতার কারণে চেঙ্গিস খানের পক্ষে সিন্ধু নদী অতিক্রম করে ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা সম্ভব ছিল না। ফলে মুলতান ছিল তাদের অগ্রাভিযানের শেষ সীমা। এর ফলে মোঙ্গলদের ভয়াবহ আক্রমণ ও ধ্বংস থেকে রক্ষা পায়।
ধ্বংসযজ্ঞ:
মোঙ্গল বাহিনী যেসব এলাকায় হামলা চালাত সেগুলো হয়ে পড়ত জনশূন্য। হাজার হাজার বর্গমাইল জুড়ে বিস্তৃত সভ্যতা পরিণত হত ভূতুড়ে নগরীতে। আজও সেন্ট্রাল এশিয়ার বেশ কিছু শহরের ধ্বংসাবশেষ টিকে আছে মোঙ্গল আক্রমণের ভয়াবহতার সাক্ষী হিসাবে। ধারণা করা হয় চেঙ্গিস খানের বিভিন্ন অভিযানে মারা পড়েছিল প্রায় ৪ কোটির মত সাধারণ মানুষ যা তৎকালীন পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ১১ শতাংশ। খাওয়ারিজম সাম্রাজ্য বিরুদ্ধে এই বিজয় গৌরব অর্জন করতে চেঙ্গিস খানের মাত্র তিন বছর সময় লেগেছিল কিন্তু এর ফলে এই সকল বিজিত অঞ্চলের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছিল তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না এ বিষয়ে বলেন এই বিপর্যয়ের ফলে উক্ত অঞ্চল জনসংখ্যার এক বিরাট অংশকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় মধ্য এশিয়ার ইসলামিক সভ্যতা শহরগুলিতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে যে বিরাট ক্ষতি সাধিত হয়েছিল তা এখনো অপূরণীয় রয়ে গেছে
চীন অভিযান ও মৃত্যু:
মধ্য এশিয়া বিজয় সম্পন্ন করে ১২২৫ সালে চেঙ্গিস খান রাজধানী কারাকোরামে ফিরে যান। কিন্তু তার এই বিজয় গৌরব তিনি বেশি দিন ।ভোগ করতে পারেননি। এসময় দক্ষিণ চীনের মাঙ্গ বংশ বিদ্রোহ ঘোষণা করলে সে বিদ্রোহ দমন করার জন্য তিনি চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করেন। কিন্তু পথিমধ্যে মঙ্গোলিয়ার ছালি নদীর তীরে ১২২৭ সালে চেঙ্গিস খান মৃত্যুমুখে পতিত হন । মৃত্যুকালে চেঙ্গিস খান সাফল্য ও গৌরবের স্বর্ণশিখরে সমাসীন ছিলেন। তার সাম্রাজ্য পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে পশ্চিমে কৃষ্ণসাগর এবং উত্তরের তুর্কিস্তান থেকে দক্ষিনে সিন্ধু নদী পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল।
চেঙ্গিস খানের চরিত্র ও কৃতিত্ব
মোঙ্গল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা
পৃথিবীর যে সকল নরপতি ইতিহাসের ধারায় বিরাট পরিবর্তন এনেছেন চেঙ্গিস খান তাদের অন্যতম। তিনি ছিলেন মোঙ্গল জাতির জনক এবং মোঙ্গল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। চেঙ্গিস খানের আবির্ভাবের পূর্বে মোঙ্গল জাতি ইতিহাসের পাতায় তেমন কোন উল্লেখযোগ্য অধ্যায়ের সংযোজন করতে পারেনি। মোঙ্গলরা বহুগোত্রে বিভক্ত ছিল এবং তারা সর্বদা আত্ম থাকতো। কিন্তু চেঙ্গিস খান তার অসাধারণ প্রতিভা সাংগঠনিক শক্তি বলে অসভ্য বর্বর জাতিকে শক্তিশালী ও সুসংহত করে এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
মহান সমর বিজেতা:
মাত্র ১৩ বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহন পর থেকেই তার সামরিক প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। খুব অল্প সময়ে গোটা মোঙ্গল জাতির নেতৃত্ব লাভ এবং চেঙ্গিস খান উপাধি ধারণ অতঃপর পর চীন ও মধ্য এশিয়া তে সাম্রাজ্যঃ বিস্তার একজন বিজেতা হিসেবে তাকে উচ্চ আসনে সমাসীন করেছে এজন্য ঐতিহাসিক ঐতিহাসিক লালপুর কাকে এশিয়ার আলেকজান্ডার বলে অভিহিত করেছেন ঐতিহাসিক জে কার্টিন বলেন, ”সামান্য কয়েকটি কুড়ে ঘর হইতে আরম্ভ করিয়া গোত্রের পর গোত্র এবং দেশের পর দেশ জয় করিয়া অবশেষে মৃত্যুকালে চেঙ্গিস খান পৃথিবীর যে কোন নরপতি অপেক্ষা বেশি ভূ-ভাগের অতীতে পারিয়াছিলেন”।
সুযোগ্য প্রশাসক:
চেঙ্গিস খান একজন সুযোগ্য প্রশাসক ও ন্যায় বিচারক ছিলেন। ঘোড়ার পিঠে চড়ে তিনি রাজ্য জয় করেছিলেন বটে কিন্তু ঘোড়ার লাগাম ধরে রাজ্য শাসনের চেষ্টা করেননি। শাসনকার্যে তিনি জ্ঞানী-গুণীদের পরামর্শ শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করতেন। সামরিক ও বেসামরিক শাসন ব্যবস্থায় চেঙ্গিস খানের উপর চীনা প্রভাব পরিলক্ষিত হয় । তার শাসন ব্যবস্থায় সুদক্ষ প্রশাসক ইয়েলো-চুৎশাই তাকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিলেন। চীন অভিযানের সময় চেঙ্গিস খানইয়েলো-চুৎশাইকে সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন।
ন্যায় বিচারক:
চেঙ্গিস খান ন্যায় বিচারক ছিলেন । তার আমলে চোর ও দুষ্কৃতিকারীদেরকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হতো। বিশেষ করে কেউ ঘোড়া চুরি করলে তার দ্বন্ড স্বরূপ তাকে বৃষ্টি ঘোড়া দিতে হতো অথবা তার পুত্রদিগকে রাজদরবারে জামিন হিসেবে রাখতে হতো অথবা মৃত্যুদণ্ড ভোগ করতে হতো।। চেঙ্গিস খানের আমলে রাজ্যে নিরবিচ্ছিন্ন শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় ছিল।
গোয়েন্দা বিভাগ:
চেঙ্গিস খান একটি সুদক্ষ গোয়েন্দা বিভাগ গঠন করেছিলেন এ বিভাগের দ্বারা তিনি রাজ্যের বিভিন্ন গোপন সংবাদ সংগ্রহ করতেন।
ডাক বিভাগ ও নিরাপত্তা চৌকী:
চেঙ্গিস খানের আমলে রাজ্যের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে দ্রুত সংবাদ আদান-প্রদানের জন্য ডাক বিভাগের প্রচলন করা হয়। পথিক ও ব্যবসায়ীরা নিরাপদে যাতায়াত করতে পারতো এবং বিশেষ প্রহরার মাধ্যমে সকলের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হতো। এশিয়ার ইতিহাসে খুব সম্ভবত এই প্রথমবারের মতো তুর্কিস্তানের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দিয়ে পথিকরা সম্পূর্ণ নিরাপদে চলাচল করতে পারত।
চেঙ্গিস খানের সামরিক সংস্কার:
চেঙ্গিস খান সেনাবাহিনীর আমূল সংস্কার সাধন করেন। তার সেনাবাহিনীর দশ, একশত, এক হাজার, দশ হাজার সৈন্যের বিভিন্ন ইউনিটে বিভক্ত ছিল এবং তিনি প্রতিটি ইউনিটকে সুযোগ্য সেনানায়কের অধীনে ন্যস্ত করেন। শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা ছিল তার সামরিক সংস্কারের মূল চাবিকাঠি। সৈন্যদের সামান্যতম অবাধ্যতা অবহেলা অথবা ভীরুতা তিনি সহ্য করতেন না এবং এগুলোর শাস্তি ছিল বেত্রাঘাত, চাকরি থেকে বরখাস্ত অথবা মৃত্যুদণ্ড। যুদ্ধবিরতির দিনগুলোতেও সৈন্যরা অলস ভাবে কাটাতে পারতো না । চেঙ্গিস খান বিপুল আয়োজনে শিকারে বের হতেন এবং সৈন্যদের তার সাথে যেতে হতো । এতে যেমন তাদের চিত্রবিনোদন হত অপরদিকে তাদের শরীর চর্চাও হতো। চেঙ্গিস খানের কৃতিত্ব প্রশংসা করে জহরলাল নেহেরু বলেন,
“চেঙ্গিস নিঃসন্দেহে ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সামরিক প্রতিভা ও নেতা। আলেকজান্ডার এবং সিজারকেও তাঁর সম্মুখে নিষ্প্রভবলিয়া মনে হয়” ।
চেঙ্গিস খানের আইন/ উলাঙ্গ ইয়াছা:
চেঙ্গিস খানের কৃতিত্ব কেবল তার চমকপ্রদ সামরিক বিজয় ও প্রশাসন ব্যবস্থার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, একজন আইন প্রণেতা হিসেবেও তার বিশেষ কৃতিত্ব রয়েছে। তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একটি আইন কাঠামো প্রণয়ন করেছিলেন। এই আইন উলাঙ্গ-ইয়াছা নামে পরিচিত।। সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন বিভাগের জন্য বিভিন্ন ধরনের আইনি এত লিপিবদ্ধ ছিল। মোঙ্গল যুবকদেরকে বিদ্যালয়ে এই আইন বাধ্যতামূলক ভাবে পড়ানো হতো।
অর্থনৈতিক সংস্কার:
চেঙ্গিস খান সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কতগুলো মৌলিক সংস্কার সাধন করেন। তাঁর নির্দেশে কেবল চাষ উপযোগী জমির উপর খাজনা ধার্য করা হতো এবং জমির উর্বরতা ও ফলের উপর ভিত্তি করে খাজনা দিতে হতো। এর ফলে রাজ্যে বিশেষ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সাধিত হয় । চেঙ্গিস খানের গঠনধর্মী ও সৃজনশীল প্রতিভার প্রতি লক্ষ্য রেখে ঐতিহাসিক হেনরি হোয়ার্থ বলেছেন-
”সমাজনীতি, রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রতিটি খুঁটিনাটি ব্যাপারে চেঙ্গিস খান ছিলেন স্রষ্টা এবং তার আইন ও শাসনবিধি ইতিহাঁসের পাঠকমাত্রই প্রশংসার উদ্রেক করে” ।
শিক্ষানুরাগী
চেঙ্গিস খান নিজে নিরক্ষর হলেও শিক্ষা ও শিক্ষিতের প্রতি ছিলেন তিনি বিশেষভাবে শ্রদ্ধাশীল। তিনি যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে পন্ডিত, শিল্পী ও জ্ঞানী - গুণী ব্যক্তিদের বাছাই করে বের করতেন এবং তাদেরকে মুক্তি দিয়ে যথোপযুক্ত পেশায় নিয়োগ করতেন। সকল ধর্মের পুরোহিত ও সম্পদের উপর হতে তিনি কর মওকুফ করেছিলেন। এছাড়া জোতিষি ও চিকিৎসকগণ তার দরবারে বিশেষ সমাদর লাভ করতেন।
ধর্মবিশ্বাসঃ
চেঙ্গিস খান খ্রিষ্টধর্মের সামানীয় শাখার অনুসারী ছিলেন । এই ধর্মালম্বীরা চিরন্তন নীল আকাশের উপাসনা করত। সেজন্য বিপদের সময় চেঙ্গিস খানকে প্রায়ই উন্মুক্ত আকাশের পানে তাকিয়ে করজোড়ে শক্তিও সাহায্য প্রার্থনা করতে দেখা যেত।
পরধর্ম সহিষ্ণুতা
ধর্ম সম্বন্ধে চেঙ্গিস খানের সম্যক ধারণা অথবা ঔৎসুক্য না থাকলেও তিনি পরধর্মের প্রতি উদার মনোভাব পোষণ করতেন । তার দরবারে খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও মুসলমান সকলেই সমান ব্যবহার পাইতেন। ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড গিবন চেঙ্গিস খানের পরধর্ম সহিষ্ণুতার ভূয়শী প্রশংসা করেছেন।
সমালোচনা:
পৃথিবীর অন্যান্য আদর্শ-বিহীন সাম্রাজ্যের মতো তার আদর্শহীন জুলুমের সাম্রাজ্য মাত্র ১৫০ বছরে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। বিভিন্ন গুণাবলীর সমাবেশ থাকা সত্ত্বেও চেঙ্গিস খানের চরিত্র নিষ্ঠুরতা ও বিশ্বাসঘাতকতাকে অস্বীকার করা যায় না। বীভৎস ধ্বংসলীলা ও নিষ্ঠুরতার মধ্য দিয়ে তার প্রতিটি আক্রমণ ও বিজয় পরিচালিত হয়েছিল। এই কারণে ইউরোপীয় ঐতিহাসিকগণ তাকে ‘আল্লাহর অভিশাপ' হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে, মধ্যযুগের কোনো নরপতি বা বিজেতাই অনুরূপ নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতার ঊর্ধ্বে ছিলেন না। বস্তুত, এটা ছিল তখনকার যুগ-বৈশিষ্ট্য। অতএব অন্য কোনো নরপতি যখন ‘আল্লাহর অভিশাপ' হন নাই, তখন চেঙ্গিস খানকে এ নামে অভিহিত করা যুক্তিযুক্ত নয়। তিনি শিক্ষা ও শিক্ষিতের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তার দরবারে শিল্পী, সাহিত্যিক, গণিতজ্ঞ প্রমুখ গুণীদের সমাবেশ হতো। ধর্মীয় ক্ষেত্রে তিনি সহিষ্ণু ছিলেন।
চেঙ্গিস খানের সমাধি আজও অজানা:
চেঙ্গিস খাঁন তার জীবদ্দশায় ওসিয়ত করে গিয়েছিল- কাক-পক্ষীও যেন তার দাফনের যায়গা জানতে না পারে। এজন্য যারা তার দাফনে নিয়োজিত ২৯১৬ জন মানুষের, সবাইকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করা হয়েছিল। চেঙ্গিস খানের সমাধিক্ষেত্র আজও রয়েছে অধরা, অনাবিষ্কৃত। মধ্যযুগীয় ধনসম্পদের সবচেয়ে বড় গুপ্তধনটি কেউ ছুঁতেও পারেনি। রয়ে গেছে তা শত শত বছর পরেও সব চোখের আড়ালে। যুগে যুগে মানুষ এই মঙ্গোলীয় সম্রাটের সমাধিক্ষেত্র খুজে গেছে। বছরের পর বছর নষ্ট করেছে এই সমাধি খোঁজার পিছে। সমাধি মেলেনি। মানুষ তবুও হাল ছাড়ে না। বলা হয়, চেঙ্গিস খানের সমাধিটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অনাবিষ্কৃত এবং অক্ষত,অর্ধেক পৃথিবীর ধনসম্পদে ঠাসা একটি রত্নভাণ্ডার! এটি মোটামুটি নিশ্চিত যে চেঙ্গিস খান সারাজীবনে যে পরিমান ধনসম্পদ এবং রত্ন লুট করেছেন, তার পুরোটুকুই সমাধিক্ষেত্রে চেঙ্গিস খানের সাথে রেখে দেওয়া আছে। জয় করা ৭৮ জন রাজার মুকুট সেখানেই আছে বলে ধারনা করেন অনেকে।
আরও পড়ুন-
Md. Billal Hossain
B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka
BCS (General Education)
Lecturer
Department of Islamic History Culture
No comments:
Post a Comment