খলিফা আব্দুল মালিক
(Abdul Malik:The Uamyyad Caliph)
(685-705)
উমাইয়া সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা খলিফা আব্দুল মালিক। উমাইয়া সাম্রাজ্য সুদৃঢ়করণ, সম্প্রসারণ, আরব জাতীয়তাবাদের বিকাশ, খাঁটি আরবের মুদ্রার প্রচলন এবং প্রশাসনিক ও রাজস্ব সংস্কারে আব্দুল মালিক অনন্য কৃতিত্বের দাবিদার। আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান উমাইয়া বংশের পঞ্চম খলিফা। খলিফা হওয়ার পূর্বে আব্দুল মালিক একজন বিচক্ষণ ফকিহ এবং ধার্মিক ব্যক্তি হিসেবে প্রসিদ্ধ থাকলেও খিলাফত গ্রহণ করার পর তার চারিত্রিক গুণাবলি সম্পূর্ণ ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হয়। তার নেতৃত্বে মুসলিম সাম্রাজ্যের ব্যাপক উন্নতি সাধিত হলেও বিরোধী মতকে দমন করার ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। এ সময়ের পূর্বাঞ্চলের শাসনকর্তা হাজ্জাজ বিন ইউসুফ বিরোধী পক্ষের উপর নিষ্ঠুরতার জন্য মুসলিম বিশ্বে বিশেষ কুখ্যাতি অর্জন করেন। আব্দুল মালিকের পরে তার চার পুত্র খলিফা হয়েছিলেন, সেজন্য তাকে Father of Kings বা ‘রাজেন্দ্র’ বলা হয়। আব্দুল মালিক ও তার উত্তরাধিকারী চার পুত্রের শাসনামলে দামেস্ক শৌর্যবীর্য ও গৌরবের চরম শিখরে আরোহন করে ।
আব্দুল মালিক:
পরিচিতি ও ক্ষমতায় আরোহন:
আব্দুল মালিক উমাইয়া বংশের হারবীয় বা মারওয়ানি শাখার উত্তরাধিকারী। তিনি ৬৪৪/৬৪৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। আব্দুল মালিকের পিতা মারওয়ানের ক্ষমতা গ্রহণের মাধ্যমে এই শাখার রাজত্বের সূচনা ঘটে। ৬৮৫ সালে মারওয়ানের মৃত্যুর পর আব্দুল মালিক পিতার মনোনয়ন অনুযায়ী উমাইয়া খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কথিত আছে যে, আব্দুল মালিকের কাছে যখন খেলাফতের সংবাদ পৌঁছে তখন কোরআন মাজিদ তাঁর কোলে ছিল। অতঃপর তিনি সেটা বন্ধ করে বললেন ‘তোমার সাথে আমার এটাই শেষ দেখা’। আব্দুল মালিক 685 থেকে 705 পর্যন্ত খেলাফতের দায়িত্বে ছিলেন। আব্দুল মালিক শিক্ষিত ছিলেন এবং খলিফা হওয়ার পূর্বে কোরান-সুন্নাহ ও ফিকাহ সম্পর্কে তার জ্ঞানের গভীরতা জন্য তিনি মদিনায় সুপরিচিত ছিলেন। কিন্তু খলিফা হিসাবে তার কর্মকান্ডের সাথে তার পূর্ববর্তী জীবনের মিল খুঁজে পাওয়া যায় না।
আব্দুল মালিকের প্রাথমিক সমস্যাবলী:
খিলাফত আব্দুল মালিকের জন্য নিরাপদ ছিল না। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই তিনি চারদিকে নিজেকে শত্রু পরিবেষ্টিত দেখতে পান। তিনজন ব্যাক্তি সিংহাসনের দাবিদার ছিলেন। শুরুতেই যে সমস্ত সমস্যাগুলো তাকে মোকাবেলা করতে হয়েছে-
সিরিয়ায় খালিদ ইবনে ইয়াজিদ ও
আমর বিন সাঈদ এর বিদ্রোহ;
হেজাজে আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইরের বিদোহ;
ইরাকে মুসআবের বিদ্রোহ;
পারস্য ইরাক ও মদিনায় খারিজি বিদ্রোহ;
কুফায় আলীপন্থী মুখতারের শক্তিশালী অবস্থান;
সাম্রাজ্যের উত্তরে রোমানদের অপতৎপরতা।
বিদ্রোহ দমন:
এসমস্ত সমস্যায় আব্দুল মালিক মোটেই বিচলিত হননি। তিনি কৌশল ধৈর্য ও সাহসের সাথে পরিস্থিতির মোকাবেলা করেন এবং সমস্ত বিদ্রোহ দমন করে সাম্রাজ্যের সংহতি বিধান করেন।
মুখতারের বিদ্রোহ দমন:
মুখতার হযরত আবু বকরের সেনাপতি আবু উবায়দার পুত্র ছিলেন। তিনি ইমাম হুসাইনের বন্ধু ছিলেন। কারবালার হত্যাকান্ডের প্রেক্ষাপটে তিনি ইমাম হুসাইনের হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ গ্রহণের লক্ষ্যে শিয়া অনুশোচনাকারীদের দলে যোগ দেন। তিনি অত্যন্ত চালাক ও ফন্দিবাজ ছিলেন। শিয়াদের সহযোগিতায় মুখতার ইরাকে বেশ শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেন যা আব্দুল মালিকের জন্য ছিল অত্যন্ত হুমকিস্বরূপ। তিনি এ সময় হিজাজে খিলাফতের দাবিদার আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর এর সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনের চেষ্টা করেন, কিন্তু তার অবিশ্বস্ততা ও ফন্ধিবাজী চরিত্রের কারণে আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর তার বন্ধুত্ব গ্রহণ করেননি।
আব্দুল মালিক মুখতারের বিরুদ্ধে উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদকে প্রেরণ করেন। ৬৮৬ সালে যাব নদীর তীরে প্রথম জাবের যুদ্ধ আব্দুল মালিকের বাহিনী পরাজিত হয় এবং উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদ নিহত হন। এভাবে মুখতার কারবালা হত্যাকাণ্ডের মূলহোতা ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদকে হত্যা করে প্রতিশোধ গ্রহণ করেন। এর ফলে ইরাকে মুখতারের কর্তৃত্ব আরো শক্তিশালী হয় ।
মুখতার এসময় আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইরের মিত্রতা কামনা করছিলেন। তিনি পুনরায় আব্দুল্লাহ ইবনে জুবেইর এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে তার বন্ধুত্ব কামনা করেন। কিন্তু আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর মুখতার কে বিশ্বাস করেন নি। তিনি তার ভাই বসরার আমীর মুসাবকে মুখতারের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। ৬৮৭ সালের এক যুদ্ধে মুসাব মুখতার কে পরাজিত করে হত্যা করেন। এতে শত্রুর দ্বারা শত্রু নাশ হওয়ায় আব্দুল মালিক স্বস্তিপান এবং শক্তিশালী এক শত্রুর মোকাবেলা থেকে তিনি রক্ষা পান। আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর এবং মুখতারের মধ্যে বন্ধুত্ব হলে হয়তোবা উমাইয়াদের ইতিহাসটি অন্যরকম হতে পারতো, কিন্তু আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর এর অদূরদর্শিতার কারণে সেটি আর হয়নি।
খালিদ ও আমর বিন সাঈদ এর বিদ্রোহ দমন:
৬৮৪ সালে সংঘটিত জাবিয়া সম্মেলনে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল যে, ইয়াজিদের পুত্র খালিদ নাবালক বিধায় মারওয়ান খলিফা নিযুক্ত হবেন। মারওয়ান এর পর প্রথমে খালিদ বিন ইয়াজিদ এবং তারপর আমর বিন সাঈদ আল-আস পর্যায়ক্রমে খলীফা হবেন।কিন্তু ৬৮৫ সালে মারওয়ান জাবিয়া সম্মেলনের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে তার ছেলে আব্দুল মালিক এবং আব্দুল আজিজকে পরবর্তী খলিফা হিসেবে মনোনয়ন দেন। এরই সূত্র ধরে আব্দুল মালিক ক্ষমতায় আসলে খালিদ এবং সাঈদ আল-আস তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। খালিদ বিন ইয়াজিদকে আব্দুল মালিক কৌশলে তার দলভুক্ত করেন। কিন্তু মারওয়ান এর চাচাতো ভাই সাইদ আল-আস 689 সালে নিজেকে খলিফা বলে ঘোষণা করেন। আব্দুল মালিক সাঈদ আল আসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করলে তিনি বশ্যতা স্বীকার করেন।কিন্তু ভবিষ্যতে বিপদজনক হতে পারে এই ভেবে আব্দুল মালিক তাকে কৌশলে রাজপ্রাসাদের ডেকে এনে নিজ হাতে হত্যা করেন। এভাবে খালিদ বিন ইয়াজিদ এবং আমর বিন সাঈদের বিদ্রোহের পরিসমাপ্তি ঘটে।
বাইজান্টাইনদের সাথে শান্তিচুক্তি:
আভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের সময় উমাইয়া সাম্রাজ্যের উত্তর দিক থেকে বাইজান্টাইনদের অপতৎপরতা শুরু হয়। সাম্রাজ্যে এই বিপদ সংকুল সময়ে আব্দুল মালিক বাইজান্টাইনদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতে চাইলেন না। আভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমনের জন্য আব্দুল মালিক কৌশলগত কারণে সাময়িক সময়ের জন্য সাপ্তাহিক 1000 স্বর্ণমুদ্রা দেওয়ার অঙ্গীকার করে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের সাথে সন্ধি করেন। বাইজান্টাইনদের পক্ষ থেকে নিরাপদ হয়ে আব্দুল মালিক সমগ্র মুসলিম জাহানে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেন।
মুসাবের বিরুদ্ধে অভিযান:
আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর এর ভাই মুসাব আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর কর্তৃক বসরার ওয়ালি নিযুক্ত হয়েছিলেন। আব্দুল মালিক স্বয়ং কুফায় উপস্থিত হয়ে মুসআবের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। মুসআব তার সেনাপতি আল-আশতার কে সাথে নিয়ে আব্দুল মালিকের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। কিন্তু আব্দুল মালিক কৌশলে গোপন পত্রের মাধ্যমে সেনাপতি আশতারকে কে নিজ দলভুক্ত করলে আশতার মুসাবের পক্ষ ত্যাগ করেন। এদিকে আব্দুল মালিক নানা প্রলোভন দেখিয়ে কুফাবাসীর সমর্থন আদায় করেন। 691 সালে সংঘঠিত আব্দুল মালিক ও মুসাবের মধ্যকার যুদ্ধে মুসাব পরাজিত ও নিহত হন । ফলে সমগ্র ইরাকজুড়ে আব্দুল মালিকের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইরের বিরুদ্ধে অভিযান:
ঐতিহাসিক পি কে হিট্টির মতে আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর হোসাইনকে ইয়াজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে প্ররোচিত করেছিলেন। কেননা তিনি খলিফা হওয়ার বাসনা পোষণ করতেন। ইমাম হোসাইন এর শাহাদাতের পর আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর সমগ্র হিজাজ প্রদেশে নিজেকে খলিফা হিসেবে ঘোষণা করেন। মদিনাকে কেন্দ্র করে আব্দুল্লাহ শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেন যা আব্দুল মালিকের জন্য বিপদজনক ছিল। খলিফা আব্দুল মালিকের নির্দেশ মোতাবেক হাজ্জাজ বিন ইউসুফ আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর এর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান করেন । 692 সালে সংঘটিত আরাফাতের যুদ্ধে আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের পরাজিত ও নিহত হন।
ঐতিহাসিক পি.কে হিট্টির মতে -
With the death of Ibn-Zubayer the last Champion of the old faith passed away, Uthman was fully avenged. [2]
অর্থাৎ আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইরের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে পুরাতন ধর্ম বিশ্বাসের সাথে সর্বশেষ যোগসুত্র তিরোহিত হল এবং উসমান হত্যার চূড়ান্ত প্রতিশোধ সম্পন্ন হল।
আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর এর পতনের মাধ্যমে আব্দুল মালিক মুসলিম বিশ্বের একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম। গোটা মুসলিম সাম্রাজ্যে খলিফা হিসেবে প্রতিটি মসজিদে আব্দুল মালিকের নাম খুৎবায় উচ্চারিত হতে থাকে।
খারিজি বিদ্রোহ দমন:
চরমপন্থী খারিজীরা এ সময় ইরাকের বসরা, কুফা এবং মসুলে শাবীব ইবনে ইয়াজিদের নেতৃত্বে বিদ্রোহ-বিশৃংখলার সৃষ্টি করে। তারা হাজ্জাজের সমর্থক লোকদেরকে বিতাড়িত করে। মহাল্লিব ইবনে আবি সুফরার মাধ্যমে হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ এই খারিজি বিদ্রোহ দমন করেন। বহু খারিজি পলায়ন করে কিরমানে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং 695-97 সালে তারা নাফি বিন আজরাকের নেতৃত্বে পুনরায় বিদ্রোহ করে। হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ পুনরায় তাদের বিরুদ্ধে 698-99 সালে সামরিক অভিযান প্রেরণ করেন এবং চূড়ান্তরূপে এই খারিজি বিদ্রোহ দমন করেন।
মুহাম্মদ ইবনে আসাতের বিদ্রোহ দমন:
699 সালের সিজিস্তানের এর গভর্নর মোহাম্মদ ইবনে আসাতের বিদ্রোহ আব্দুল মালিকের জন্য ছিল এক বড় সংকট । ইবনে আসাত সিজিস্তান এর গভর্নর ছিলেন। কাবুলের রাজা যুনবিল খলিফাকে কর দিতে অস্বীকার করলে তার বিরুদ্ধে হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ খলিফার নির্দেশক্রমে সামরিক বাহিনী প্রেরণ করেন। কিন্তু প্রেরিত বাহিনী পরাজিত হয়। এই পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য পুনরায় মুহাম্মদ ইবনে আসাত এর নেতৃত্বে আরও একটি বাহিনী গঠন করা হয়। বাহিনীটি অন্তত্য জমকালো ও সজ্জিত ছিল বিধায় ইতিহাসে তা ‘ময়ূর বাহিনী' নামে পরিচিত। যুদ্ধ পরিচালনা সংক্রান্ত বিষয়ে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ও আসাতের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত তা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে মুহাম্মদ ইবনে আসাত 699 সালে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। শেষ পর্যন্ত হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ ও ইবনে আসাতের মাঝে 701 সালে ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে পরাজিত হয় ইবনে আসাত কাবুলের রাজা জানবিলের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করেন। কিন্তু হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কৌশলে জানবিলকে স্বপক্ষে নিয়ে আসেন। হাজ্জাজ নির্মমভাবে ইবনে আসাতকে হত্যা করেন।এভাবে কাবুলে আব্দুল মালিকের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
আব্দুল মালিকের সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ:
রোমানদের সাথে যুদ্ধঃ
আভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ-বিশৃঙ্খলা এবং গৃহযুদ্ধে ব্যস্ত থাকার কারণে আব্দুল মালিক বাইজানটাইনদের সাথে সাপ্তাহিক 1000 স্বর্ণমুদ্রা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে একটি অপমানজনক সন্ধি স্বাক্ষর করেছিলেন। খিলাফতের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের কে পরাস্ত করার পর 692 সালে আব্দুল মালিক রোমানদের সাথে করা চুক্তি বাতিল করেন। ফলে গ্রিকদের সাথে আব্দুল মালিকের যুদ্ধ শুরু হয়। এশিয়া মাইনর ও আর্মেনিয়াতে রোমানদের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ চলতে থাকে। কয়েক বছর যাবৎ যে যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। এ যুদ্ধে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের বিশাল এলাকা আব্দুল মালিকের অধিকারে আসে।
আফ্রিকা পুনরুদ্ধার
হযরত মুয়াবিয়া (রা.) এর সময়ে বিখ্যাত সেনাপতি উকবা ইবনে নাফি সমগ্র উত্তর আফ্রিকা জয় করে আটলান্টিক পর্যন্ত উপনীত হন। কিন্তু 683 সালে রোমান ও বার্বারদের যৌথ আক্রমণে তিনি নিহত হন। ফলে একমাত্র মিসর ব্যতিত আটলান্টিকের তীর পর্যন্ত উত্তর আফ্রিকার বাকি অঞ্চল মুসলিমদের হাতছাড়া হয়ে যায়। উকবাহ ইবনে নাফির সরকারী জুহাইরের নেতৃত্বে প্রেরিত সামরিক বাহিনী উত্তর আফ্রিকা পুনরুদ্ধার করে এবং বারবার নেতা কুসাইলা নিহত হন। কিন্তু পরবর্তীতে বারবার ও রোমানদের অতর্কিত আক্রমণে জুহায়ের পরাজিত হন এবং নিহত হন ফলে আবারও আফ্রিকা হাতছাড়া হয়ে যায়।
আব্দুল মালিক 698 সালে সেনাপতি হাসান বিন নোমানের নেতৃত্বে পুনরায় উত্তর আফ্রিকায় সামরিক অভিযান করেন। হাসান বিন নোমান বিদ্রোহীদের পরাস্ত করে কায়রোয়ান, কার্থেজ, বার্কা প্রভৃতি স্থান দখল করেন এবং আটলান্টিকের তীর পর্যন্ত উমাইয়া সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটান ।
কাহিনার পতন:
এসময় উত্তর আফ্রিকায় কাহিনা নামে এক অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন নারীর আবির্ভাব ঘটে। তার অলৌকিক গুণে মুগ্ধ হয়ে অনেকে তার আধিপত্য স্বীকার করে। কাহিনা বার্রবাদেরকে নতুন সাহসও উদ্দীপনায় অনুপ্রাণিত করে তোলেন। এই নারী সেনাপতির নেতৃত্বে উত্তর আফ্রিকার বার্বাররা হাসান বিন নোমানকে পরাস্ত করে দীর্ঘ এবং পাঁচ বছর যাবত মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকে। 703 সালে আব্দুল মালিক সেনাপতি হাসান বিন নোমান সাহায্যার্থে আরো নতুন বাহিনী প্রেরণ করেন। অবশেষে মুসলিম বাহিনীর কাছে কাহিনা পরাজিত ও নিহত হন। ঐতিহাসিক পি কে হিট্টির মতে প্রতারণা ও চাতুরির মাধ্যমে অবশেষে কাহিনা কে একটি কুয়ার কাছে হত্যা করা হয়। সেটি এখনো ‘বীর আল কাহিনা’ নামে পরিচিত।
উত্তরাধিকারী মনোনয়ন ও মৃত্যু:
মারওয়ান তার দুই পুত্র আব্দুল মালিক অতঃপর আব্দুল আজিজকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেছিলেন কিন্তু আব্দুল মালিক আব্দুল আজিজ কে বাদ দিয়ে তার পুত্র আল ওয়ালিদ কে উত্তরাধিকারী মনোনীত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে আব্দুল আজিজ এর বিরোধিতা করেন। কিন্তু ইতিমধ্যে আব্দুল আজিজ মারা গেলে 704 সালে আল ওয়ালিদ কে খলিফা হিসেবে মনোনীত করা হয়। মদীনাবাসী এর বিরোধিতা করলেও ভয়-ভীতির প্রদর্শনপূর্বক আল ওয়ালিদের পক্ষে তাদের সমর্থন আদায় করা হয়। 705 খ্রিস্টাব্দে 62 বছর বয়সে আব্দুল মালিক মৃত্যুবরণ করেন।
আরও পড়ুন-
বিদায় হজ্বের ভাষণ এবং হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কর্তৃক ঘোষিত সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংস্কারাবলী
আব্দুল মালিকের শাসনতান্ত্রিক সংস্কার
আব্দুল মালিকের আরবীয় করণ নীতি:
আরব-অনারব গোটা সাম্রাজ্যের প্রশাসনকে শক্তিশালীকরণে আব্দুল মালিক যে বিশেষ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন তাদের মধ্যে আরবীরকরণ নীতি অন্যতম। এটি তার একটি প্রশাসনিক পদক্ষেপ। রাজ্য বিস্তারের সাথে সাথে রাষ্ট্রীয় কার্যাবলী তে বিভিন্ন ভাষা ও মুদ্রার অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। সে সময়ে আব্দুল মালিকের আরবিতে নীতি একটি যুগোপযোগী এবং যথার্থ সিদ্ধান্ত।
পি,কে হিট্টি বলেন-
The Arabicization of the state under Abd-al- Malik and al-Walid consisted in changing the language of the public registers (diwan) from Greek to Arabic in Damascus and from pahlawi to Arabic in al-Iraq and the Eastern provinces and in the creation of an Arabic coinage. [3]
আরবীয়করণ নীতি কী ?
আব্দুল মালিকের আরবীয়করণ নীতি একটি প্রশাসনিক পদক্ষেপ । আব্দুল মালিক তার সমগ্র সাম্রাজ্যে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা, আর্থিক লেনদেনে স্বচ্ছতা আনয়ন,এবং বিভিন্ন ভাষাভাষী ও সংস্কৃতির মানুষকে একই প্রশাসনিক ফ্রেমে আবদ্ধ করার লক্ষ্যে ভাষা এবং মুদ্রার ক্ষেত্রে যে বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন ইতিহাসে তাই আব্দুল মালিকের আরবীয়করণ নীতি নামে পরিচিত।
আরবিয়করণ নীতির আলোকে আব্দুল মালিক নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন-
রাষ্ট্রভাষা আরবি করণ
অফিস আদালতে আরবির প্রচলন
সরকারী দলিলপত্র আরবিকরণ
রাজকীয় ফরমান আরবিকরণ
আরবদের নিয়োগদান
খাঁটি আরবি মুদ্রার প্রচলন (দিনার, দিরহাম, ফুলুস)
টাকশাল স্থাপন
আরবি ভাষা ও বর্ণমালার উৎকর্ষ সাধন (কোরআনে নুকতা ও হরকত প্রদান)
3. ডাক ও গোয়েন্দা বিভাগ:
মুয়াবিয়া কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ডাকব্যবস্থা আব্দুল মালিক আরো উন্নত করেন। তিনি সাম্রাজ্যের বড় বড় রাস্তার পাশে ডাক চৌকি স্থাপন করেন। ডাক পরিষেবায় তিনি ঘোড়ার ব্যবহার করেন।। ডাক বিভাগের প্রধানকে বলা হতো ‘দিওয়ান আল বারিদ’। ডাক বিভাগের কাজ ছিল-
সরকারি চিঠিপত্র আদেশ-নিষেধ আদান-প্রদান;
সরকারি কর্মচারীদের ডাক গাড়ির মাধ্যমে স্থানান্তর;
প্রয়োজনে যুদ্ধ ক্ষেত্রে দ্রুত সৈন্য ও রসদ সরবরাহ করা;
ডাক বিভাগের কর্মকর্তাদের একই সাথে খলিফার গুপ্তচর হিসেবে কাজ করা ।
4. দিওয়ান আল-রাসায়েল/ পত্র রচনা বিভাগ :
আব্দুল মালিক দেওয়ান আল রাসায়েল বা পত্ররচনা বিভাগ ( সরকারি মোহাফেজ খানা) চালু করেন।
এ বিভাগের কাজ ছিল সরকারি চিঠিপত্র তৈরি করা, ভাষা মার্জিত ও সৌন্দর্যমন্ডিত করা, তাছাড়া অন্যান্য বিভাগের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা এবং যাবতীয় সরকারি নথিপত্র সংরক্ষণ করা। এর এই বিভাগের প্রধানকে বলা হতো দিওয়ান আল রাসায়েল।
বিচার বিভাগের উন্নয়ন (দিওয়ান আল কাযা):
আব্দুল মালিক ন্যায় বিচারক ছিলেন, যতক্ষণ না তা নিজের বংশের স্বার্থের প্রতিকূলে হত। দিওয়ানুল কাজা বা বিচার বিভাগকে তিনি শক্তিশালী করেন এবং প্রাদেশিক বিচার কার্য সম্পাদনের জন্য তিনি কাজী নিয়োগ করতেন। কেন্দ্রীয় বিচারালয়ে ছিলেন কাজী-উল-কুজ্জত বা প্রধান বিচারপতি। খলিফা স্বয়ং প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করতেন।
আব্দুল মালিকের রাজস্ব সংস্কার:
প্রথমদিকে আভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ বিশৃংখলার সময়ে আব্দুল মালিকের রাজকোষ সমৃদ্ধ ছিল না। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের পর হাজ্জাজ বিন ইউসুফের পরামর্শে আব্দুল মালিক রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন-
মাওয়ালী তথা নব মুসলিমদের কে তিনি শহর ছেড়ে গ্রামে গিয়ে স্ব স্ব পেশায় নিযুক্ত হওয়ার নির্দেশ দেন।
সহরে চলে আসা নব মুসলিমদেরকে তিনি ভাতার তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেন।
তিনি মাওয়ালী তথা নব মুসলিমদের জমির উপরে খারাজ ধার্য করেন। যদিও খারাজ ছিল অমুসলিমদের উপর আরোপিত কর।
আরবের যে সমস্ত লোকেরা অমুসলিমদের ভূমির ক্রয় করে ভূমির মালিক হয়েছিল সে সমস্ত ভূমির উপরও খারাজ আরোপ করা হয়।
আব্দুল মালিক নব মুসলিমদের উপর জিজিয়া কর আরোপ করেন। যদিও জিজিয়া কর ছিল অমুসলিমদের নিরাপত্তাজনিত কর।
ঐতিহাসিক আল মাকরিযী বলেন-
‘জিম্মিদের মধ্য থেকে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল তাদের নিকট থেকে হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ ই সর্বপ্রথম জিজিয়া আদায় করেন’
7. কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়ন:
মালিক গ্রাম থেকে নব মুসলিমদের শহরে আসা নিষিদ্ধ করেন।
অনাবাদি জমি চাষ যোগ্য করলে তিন বছরের জন্য তিনি সে জমির রাজস্ব মওকুফ করেন।
কৃষিতে সেচ সুবিধা বৃদ্ধির জন্য নতুন নতুন খাল খনন করেন এবং ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর মধ্যকার সংযোগসমূহ খালসমূহ সংস্কার করেন।
গরীব ও ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মাঝে তিনি কৃষিঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
8. টাকশাল স্থাপন ও খাঁটি আরবি মুদ্রার প্রচলন:
তখন পর্যন্ত আরবে এক মুদ্রা চালু ছিল না। আব্দুল মালিকের সময়ও আরবে তিন ধরনের মুদ্রা চালু ছিল। বাইজান্টাইন,পারসিক, এবং ইয়ামেনি মুদ্রা চালু ছিল। মুদ্রার ছাপ, আকার-আকৃতি ও মূল্যমান নির্ধারিত না থাকায় প্রচুর জাল মুদ্রার অনুপ্রবেশ ঘটে। অন্যদিকে প্রাদেশিক শাসকরা স্বাধীনভাবে মুদ্রা চালু করার কারণে প্রদেশে ও কেন্দ্রের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ছিল। এসব অসুবিধা দূর করার জন্য আব্দুল মালিক 695 সালে দামেস্কে কেন্দ্রীয় টাকশাল স্থাপন করেন এবং রাজকীয় টাকশাল থেকে দিনার দিরহাম নামে কালিমা খচিত স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা চালু করেন।হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ ৬৯৬ সালে রৌপ্য মুদ্রা ফুলুস চালু করেন। মুসলিম সাম্রাজ্যে একক ও খাঁটি মুদ্রা চালু হওয়াতে জাল-জালিয়াতি দূর হয় এবং লেনদেনে সুবিধা হয়।
9. স্থাপত্য:
স্থাপত্য শিল্পের আব্দুল মালিকের অনন্য কৃতিত্ব হচ্ছে Dom of the Rock নির্মান। মালিক আব্দুল রাজনৈতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকসহ বিভিন্ন কারণে (Dom of the Rock) কুব্বাতুস সাখরা নির্মান করেন। মক্কার বড় প্রতিদ্বন্দ্বী আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের এর সাথে দ্বন্দ্বে জয়ী হওয়ার জন্য এবং হজ্বযাত্রীদেরকে জেরুজালেমের দিকে আকৃষ্ট করার জন্য তিনি 691 খ্রিস্টাব্দে এটি নির্মাণ করেন। মুহাম্মদ (স:) মিরাজ রজনীতে মদিনা থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস এ যাওয়ার পর সর্বশেষ যে পাথরে পা রেখে উর্ধ্বাকাশে গমন করেছিলেন সেই পাথরকে কেন্দ্র করে অষ্ট কোনাকার এই স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। এছাড়া তিনি মসজিদুল আকসা সংস্কার করেন এবং আল ওয়াসিত শহরের গোড়াত্তন করেন।
10. শিল্প ও সাহিত্য:
আব্দুল মালিক শিক্ষিত এবং সংস্কৃতিমনা ছিলেন। কাব্য তিনি সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর দরবারে বিভিন্ন ধর্মের কবি-সাহিত্যিকরা কাব্য রচনা করতেন এবং আব্দুল মালিক তাকে পুরস্কৃত করতেন। কবি জারির, আল-আখতাল, আল ফারাজদাক,কুসাইর প্রমুখ আব্দুল মালিকের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন। আল-আখতারকে আব্দুল মালিক ‘আমিরুল মুমিনীনের কবি’ এবং ‘আরবদের কবি’ উপাধিতে ভূষিত করেছেন।
11. অমুসলিমদের প্রতি উদারতা:
আব্দুল মালিক পরধর্ম সহিষ্ণুতা এবং উদার দৃষ্টিভঙ্গি শাসক ছিলেন তিনি মুসলিম মুসলিম ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে তিনি মূল্যায়ন করতেন। তিনি রাজপ্রাসাদ সহ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক তাবায়ুক এবং তার দরবারের সভাকবি আখতাল ছিলেন খ্রিস্টান। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে তিনি গীর্জা নির্মান করার অনুমতি দিয়েছিলেন ।
এভাবে আব্দুল মালিক তার 20 বছরের খেলাফতকালে উমাইয়া সাম্রাজ্যকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। তার নীতি অনুসরণ করেই তার চার ছেলে পরবর্তীতে দীর্ঘকাল যাবত উমাইয়া খিলাফত আসীন ছিলেন। আব্দুল মালিক উমাইয়া সাম্রাজ্যের গৌরব-উজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করেন।
ঐতিহাসিক পি কে হিট্টি বলেন-
“Under Abd-al-Malik’s rule and that of the four sons who succeeded him the dynasty at Damascus reached the meridian of its power and glory” (Hitti,1946) [6]
685 সালে উমাইয়া খিলাফত ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন ছিল। আব্দুল মালিক তার যোগ্যতা, দক্ষতা, চতুরতা, বিশ্বাসঘাতকতা, নিষ্ঠুরতা এবং শক্তিশালী প্রশাসন ইত্যাদির প্রয়োগ না করলে হয়তোবা উমাইয়া খিলাফতের বিভক্ত বা পতন হত পারতো।
W.Muir বলেন-
“Upon the whole, the verdict on Abd al Melik must be in his favor” (Muir,1891). [ 7]
আরও পড়ুন;
বাঙ্গালি জাতির নৃতাত্ত্বিক পরিচিতি, Ethnographic identity of the Bengali nation
Md. Billal Hossain
B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka
BCS General Education
Lecturer
Department of Islamic History & Culture
Chandpur Govt. College, Chandpur.
No comments:
Post a Comment