খলিফা আব্দুল মালিকের আরবীয়করণ নীতি
(Arabicization policy of Abdul Malik)
আরব-অনারব গোটা সাম্রাজ্যের প্রশাসনকে শক্তিশালীকরণে আব্দুল মালিক যে বিশেষ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন তাদের মধ্যে আরবীরকরণ নীতি অন্যতম। এটি তার একটি প্রশাসনিক পদক্ষেপ। রাজ্য বিস্তারের সাথে সাথে রাষ্ট্রীয় কার্যাবলী তে বিভিন্ন ভাষা ও মুদ্রার অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। সে সময়ে আব্দুল মালিকের আরবিকরণ নীতি একটি যুগোপযোগী এবং যথার্থ সিদ্ধান্ত ছিল।
আরবীয়করণ নীতি কী ?
আব্দুল মালিকের আরবীয়করণ নীতি একটি প্রশাসনিক পদক্ষেপ । আব্দুল মালিক তার সমগ্র সাম্রাজ্যে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা, আর্থিক লেনদেনে স্বচ্ছতা আনয়ন,এবং বিভিন্ন ভাষাভাষী ও সংস্কৃতির মানুষকে একই প্রশাসনিক ফ্রেমে আবদ্ধ করার লক্ষ্যে ভাষা এবং মুদ্রার ক্ষেত্রে যে বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন ইতিহাসে তাই আব্দুল মালিকের আরবীয় করণ নীতি নামে পরিচিত।
আরও পড়ুন-
বিদায় হজ্বের ভাষণ এবং হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কর্তৃক ঘোষিত সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংস্কারাবলী
আরবিয়করণ নীতি গ্রহনের কারণ/ উদ্দেশ্য/ প্রয়োজনীয়তা:
মোহাম্মদ (স.) এর জীবদ্দশায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র শুধু আরবের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। চার খলিফা এবং আব্দুল মালিকের শাসন কাল পর্যন্ত নতুন নতুন রাজ্য বিজিত হলে তারা নতুন নতুন ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হয়। দামেস্ক গ্রীক, সিরিয়াতে সিরিয় এবং বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন ভাষা প্রচলিত ছিল। এর ফলে রাষ্ট্রীয় কার্যাবলীতে একটি ভাষাগত সমস্যা দেখা দেয়। সরকারি দলিলপত্র এবং স্থানীয় ভাষায় লেখা হতো । কিন্তু তাতেও নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়।
তৎকালীন মুসলিম সাম্রাজ্যে বিভিন্ন ধরনের মুদ্রা চালু ছিল যা একটি রাষ্ট্রের জন্য নিরাপদ ছিল না। আব্দুল মালিক গোটা সাম্রাজ্যে একক মুদ্রা চালু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
রাজস্ব খাত ছিল সরকারের আয়ের প্রধান উৎস ।ভাষার ভিন্নতার কারণে এই সেক্টরে প্রবল দুর্নীতির সম্ভাবনা ছিল।
আরবি ছিল আরবদের জাতীয় এবং মাতৃভাষা। বিজিত অঞ্চলে আরবি ভাষাকে প্রাধান্য দেয়া, এবং গোটা সাম্রাজ্যে আরবি ভাষার প্রচলন ও আরবি ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য আব্দুল মালিক আরবীয়করণ নীতির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।
আরবীয়করণ নীতির প্রবর্তন প্রত্যক্ষ কারণ কারণ হিসেবে আলবালাজুরিতে উল্লেখ করা হয়েছে-
একবার কোন একটি বিষয়ে লেখার জন্য মার্জুন নামীয় এক গ্রিক করণিক পানির পরিবর্তে দোয়াতের কালির মধ্যে প্রস্রাব মিশ্রিত করেন। খলিফা তা জানতে পারেন এবং তাকে শাস্তি প্রদান পূর্বক সোলায়মান ইবনে সাদিকে ভাষা পরিবর্তনে দায়িত্ব প্রদান করেন।
উপরিউল্লিখিত কারণে প্রশাসনের সর্বত্র এবং রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের মধ্যে ভাষাগত সমস্যা দূরীকরণ,ভাষাগত উন্নয়ন, মুদ্রার জাল-জালিয়াতি এবং অন্যান্য দুর্নীতি রোধকরণ এবং বিশুদ্ধ আরবী প্রশাসন প্রবর্তনের লক্ষ্যে আব্দুল মালিক আরবীয়করণ নীতির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন এবং এবং কার্যকর নির্দেশনা প্রদান করেন ।
আরও পড়ুন-
বাঙ্গালি জাতির নৃতাত্ত্বিক পরিচিতি, Ethnographic identity of the Bengali nation
আব্দুল মালিকের আরবিকরণ নীতির আলোকে গৃহীত পদক্ষেপসমূহ:
রাষ্ট্রভাষা আরবিকরণ:
আব্দুল মালিকের সময় পর্যন্ত মুসলিম সাম্রাজ্য যে পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে তাতে একেক দেশে একেক রকম ভাষা প্রচলিত ছিল। সিরিয়াতে সিরীয়, এশিয়া মাইনরে রোমান ও গ্রীক, পারস্যে পাহলভীসহ নব অধিকৃত অঞ্চলসমূহে স্থানীয় ভাষা প্রচলিত ছিল। প্রাদেশিক প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সেই এলাকার আঞ্চলিক ভাষায় সংরক্ষিত হতো। এর ফলে প্রশাসনিক কার্যাবলিতে কিছুটা ফারাক ও দুর্বলতা দেখা দেয়। এ বিশেষ অসুবিধা দূর করার জন্য আব্দুল মালিক সকল ভাষার উপর আরবি ভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে আরবি রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন এবং বাস্তবায়নে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করলে।
অফিস আদালতে আরবির প্রচলন:
সাম্রাজ্যের সর্বত্র অফিস-আদালতে একক ভাষা চালু ছিল না। আব্দুল মালিক কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক দপ্তরসমূহের ভাষার ভিন্নতা লক্ষ্য করেন এবং এতে রাজস্ব ও যাকাত আদায়ে ফাঁকি দেয়া ও দুর্নীতির সম্ভাবনা ছিল। তাই তিনি কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রণালয়ের ভাষাগত অসামঞ্জস্য দূর করার লক্ষ্যে এবং প্রশাসনকে স্বচ্ছ ও সুসংহত করার লক্ষ্যে সকল অফিস-আদালতে আরবি ভাষা প্রচলন করার আদেশ জারি করেন।
সরকারী দলিলপত্র আরবি করণ:
আব্দুল মালিক কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক নথিপত্র আরবিতে লিপিবদ্ধ করা এবং আরবিতে সংরক্ষণ করার আদেশ জারি করেন।
রাজকীয় ফরমান আরবিকরণ:
কেন্দ্র থেকে প্রদেশে এবং প্রদেশ থেকে কেন্দ্রে প্রেরিত সকল সরকারি চিঠিপত্র ও দলিল দস্তাবেজ আরবি ভাষায় লিখা ও সংরক্ষণের নির্দেশ দেন। এর ফলে সকল প্রদেশে একই নির্দেশ হুবহু পৌছানা যেত এবং ভাষাগত কোনো জটিলতা তৈরি হতো না।
আরবীয়দের নিয়োগদান:
আব্দুল মালিকের আরবিকরণ নীতি কার্যকর করার জন্য আরবীয় কর্মচারীর প্রয়োজন ছিল। সেজন্য তিনি প্রশাসনের সর্বত্র আরবি ভাষাভাষী লোকদের নিয়োগ দেন। গ্রীক, পাহলভী ভাষার লোকদের চাকরি ছাড়তে হয় । প্রশাসনে চাকরি করতে হলে তাদের আরবি শিখার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। আরবি ভাষাভাষী লোকদের নিয়োগ দেওয়ার কারণে একটি স্বচ্ছ খাঁটি আরবি প্রশাসন গড়ে ওঠে। যদিও এর বিপরীতে পারসিকরা ক্ষিপ্ত হয় এবং এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে শুয়ুবিয়া তথা পারসিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত হয়।
টাকশাল স্থাপন:
আব্দুল মালিকের অন্যতম কার্যকরী পদক্ষেপ হচ্ছে জাতীয় টাকশাল স্থাপন । আব্দুল মালেক 695 সালে জাতীয় একক মুদ্রা প্রণয়নের লক্ষ্যে সিরিয়াতে রাজকীয় টাকশাল স্থাপন করেন।
আরও পড়ুন-
খাঁটি আরবি মুদ্রার প্রচলন:
এতোকাল যাবত আরবদের নির্দিষ্ট কোন মুদ্রা বা টাকশাল ছিল না। সেখানে প্রাচীন বাইজানটাইন এবং পারসিক মুদ্রা প্রচলিত ছিল। প্রাদেশিক শাসকরাও কখনও কখনও মুদ্রা তৈরি করতেন এবং আকার-আকৃতি অনির্ধারিত ছিল। এর কারণে বাজারে অবলীলায় প্রচুর জাল মুদ্রা ঢুকে পড়ে। এগুলোতে ক্রস, উড়ন্ত বাজপাখি, চিল, কিংবা পেঁচা ইত্যাদির ছবি থাকতো । আব্দুল মালিক সাম্রাজ্যে প্রচলিত সকল প্রকারের মুদ্রা উঠিয়ে নিয়ে তার জাতীয় টাকশাল থেকে আরবি অক্ষর ও কালিমা খচিত সম্পূর্ণ খাঁটি আরবি মুদ্রা চালু করেন। এগুলো ছিল-
দিনার- স্বর্ণমুদ্রা
দিরহাম-রৌপ্য মুদ্রা
ফুলুস- তাম্রমুদ্রা
আরবি ভাষা ও বর্ণমালার উৎকর্ষ সাধন:
মুসলিম সাম্রাজ্য বিস্তারের বিস্তারের সাথে সাথে অনারব লোকেরা ইসলামের সংস্পর্শে আসে। আনারব অঞ্চলে কোরআন পাঠে এক বিশেষ সমস্যা দেখা দেয় । তখনও আল কুরআনে নুক্তা ও হরকত ছিল না এবং কোন স্বরবর্ণ ছিল না। খাটি আরবীয় লোকেরা নুকতা ও হরকত বিহীন আরবী পাঠ করতে পারলেও অনারব লোকের জন্য একা ছিল অসম্ভব। ফলে তারা কোরআন পাঠ এবং উচ্চারণে বিশেষ অসুবিধার সম্মুখীন হয়। লোকেরা প্রায়ই কোরআন পাঠে ভুল উচ্চারণ করে এবং এতে অর্থ বিকৃতি ঘটে। আব্দুল মালিকের অন্যতম বিশ্বস্ত সহযোগী হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ কে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ইয়াহইয়া ইবনে ইয়ামার. ও নাসর বিন আসেম (র.) এর মাধ্যমে কুরআনে কারীমে নুকতা ও হরকত সংযোজন করেন। এর ফলে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ পার্থক্য করা যেত। নুকতা প্রদানের মাধ্যমে উচ্চারণ সহজ হয়, আর হরকত প্রদানের মাধ্যমে অর্থের পার্থক্য নির্ধারণ করা হয়।
মুসলিম প্রশাসন ব্যবস্থার পূর্ণতা দানে আব্দুল মালিকের আরবীয়করণ নীতি অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছে। তার প্রশাসনিক ভিত্তির উপর ভর করেই পরবর্তী শাসকরা বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। নব অধিকৃত রাজ্যগুলো ইসলামাইজ হওয়ার ক্ষেত্রে আরবীয় করণ নীতি দারুন ভূমিকা রেখেছে। মূলত আরবীয়করণ নীতি ইসলামেরই উন্নতি ও অগ্রগতি বিধান করেছে।
আরও পড়ুন-
বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান, সীমানা ও ভূপ্রকৃতির বৈশিষ্ট্যসমূহ
বাংলাদেশের সমাজ ও জনজীবনে ভূ প্রকৃতির প্রভাব
Md. Billal Hossain
B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka
BCS General Education
Lecturer
Department of Islamic History & Culture
Chandpur Govt. College, Chandpur.
No comments:
Post a Comment