খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজ
(Caliph Omar Ibn Abdul Aziz, The Saint of the Umayyad)
(715-720)
উমাইয়া যুগের ইসলামের ইতিহাসে ওমর ইবনে আবদুল আজিজ একজন ব্যতিক্রমী অসামান্য ব্যক্তিত্ব। তার শাসনকাল উমাইয়া যুগের ইতিহাসকে করেছে উজ্জ্বল ও গৌরাবান্বিত। তিনি একজন আদর্শ সংস্কারক রূপে নিজেকে প্রমাণ করতে পেরেছিলেন। রাজ্যশাসনে তিনি খোলাফায়ে রাশেদীনের অনুসৃত নীতি অবলম্বন করেছিলেন। সেজন্য ইসলামের ইতিহাসে তিনি পঞ্চম খলিফা হিসেবে খ্যাত। এতদভিন্ন তার কর্মকাণ্ড এবং চরিত্র ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমরের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাথে মিল থাকায় ইতিহাসে তিনি দ্বিতীয় ওমরও নামে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। এছাড়া তিনি উমাইয়াদের সাধু পুরুষ (The Saint of the Umayyad) নামেও পরিচিত। খিলাফতের মসনদে আরোহন করে তিনি শাসন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন সাধন করেন। তিনি আপামর জনসাধারণের কল্যাণ, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সংহতি বিধান করত সাম্রাজ্যকে খোলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শের উপর দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। বস্তুত তার গৃহীত সুষ্ঠ প্রশাসনিক পদক্ষেপ, সংস্কার, জনহিতকর কার্যাবলী এবং শান্তি-শৃঙ্খলা বিধানের দ্বারা তার শাসনকাল ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে এবং থাকবে।
ওমর ইবনে আবদুল আজিজ এর পরিচিতি:
ওমর ইবনে আবদুল আজিজ ছিলেন উমাইয়া বংশের মারোয়ানী শাখার প্রতিষ্ঠাতা মারওয়ানের দৌহিত্র এবং আব্দুল আজিজ এর পুত্র। আব্দুল আজিজ ছিলেন আব্দুল মালিকের ভ্রাতা আর ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ এর মাতা ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমরের দৌহিত্রী। সুতরাং মায়ের দিক থেকেও তিনি সম্ভ্রান্ত বংশের ছিলেন। তিনি আব্দুল মালিকের কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। এই হিসেবে তিনি আব্দুল মালিকের জামাতা ছিলেন। খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করার পূর্বে এক সময় তিনি হেজাজের (মক্কা-মদীনার) প্রাদেশিক শাসনকর্তা ছিলেন। মক্কা-মদিনায় তিনি একজন জনপ্রিয়, উদার এবং ন্যায়পরায়ন শাসক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তিনি ইতিহাসে পঞ্চম খলিফা এবং দ্বিতীয় ওমর হিসেবে পরিচিত। এ ছাড়া তাকে বলা হয় উমাইয়াদের সাধু পুরুষ।
ওমর ইবনে আবদুল আজিজ এর ক্ষমতায় আরোহন:
খলিফা সোলায়মান ইবনে আব্দুল মালিক স্বীয় পুত্রকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি জ্যেষ্ঠপুত্র আইয়ুবকে উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পূর্বেই আইয়ুব এর মৃত্যু হয়। এদিকে দ্বিতীয় পুত্র দাউদ রোমানদের সাথে কনস্টান্টিনোপল অভিযানে যুদ্ধরত ছিলেন। পরিস্থিতি এতটা নাজুক ছিল যে সে মৃত না জীবিত আছে তাও খলিফার জন্য জানা সম্ভব ছিল না। খলিফা ছিলেন খুবই অসুস্থ। অসুস্থ অবস্থায় সোলায়মান উত্তরাধিকার মনোনয়নের সংকটে পতিত হন।এ সংকট নিরসনে এবং বিরোধ দূর করার জন্য তিনি মৃত্যুশয্যায় তার পিতৃব্য পুত্র সদাশয় ওমরকে এবং তারপর আব্দুল মালিকের অপর পুত্র ইয়াজিদকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। দুটি নাম একটি কাগজে লিখে তা আইয়ুবের পুত্র রাজা নামক এক বিশ্বস্ত সভাসদদের হাতে অর্পণ করেন। রাজ পরিবারের সবাই ওই মনোনয়নের উপর আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করে। ফলে 717 সালে 99 হিজরীতে ওমর ইবনে আবদুল আজিজ উমাইয়া খিলাফতের সিংহাসনে আরোহন করেন।
শুভেচ্ছা বক্তব্য:
খলিফা ঘোষিত হওয়ার পর ওমর ইবনে আবদুল আজিজ জনসাধারণের সামনে একটি শুভেচ্ছা ভাষণ দিলেন। তিনি এক পর্যায়ে বললেন এতদিন পর্যন্ত একজন খলিফা মনোনীত করে তোমাদের উপর আনুগত্যের শৃংখল পরিয়ে দেওয়া হতো। আজ আমি তোমাদেরকে সেই শৃংখল থেকে মুক্ত করে দিলাম, এখন তোমরা তোমাদের ইচ্ছা মত অন্য কাউকে খলিফা নির্বাচিত করতে পারো। তখন উপস্থিত সবাই বলে উঠলেন আমরা আপনাকে আমাদের সম্মানিত খলিফা নির্বাচিত কলাম। এভাবেই তিনি তার গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তার সনদ প্রাপ্ত হন।
ওমর ইবনে আবদুল আজিজ এর সংস্কারসমূহ
খেলাফতে রাশেদার পুনঃপ্রতিষ্ঠা:
ওমর ইবনে আবদুল আজিজ যদিও রাজতন্ত্রের ভিত্তির উপর ক্ষমতায় আরোহণ করেছিলেন, কিন্তু তিনি শাসন ব্যবস্থায় খোলাফায়ে রাশেদীনের নীতিকে গ্রহণ করেছিলেন। ইসলামী আদর্শের প্রতি পূর্ণ নিষ্ঠা এবং আল্লাহর রাসূলের প্রতি আনুগত্যশীল হয়ে তিনি বংশানুক্রমিকভাবে খেলাফত লাভকে যেমন অস্বীকার করেছেন তেমনি বংশীয় শাসন নীতি ও তার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তিনি ইতিপূর্বে উমাইয়াদের অনুসৃত নীতি-আদর্শ অনুসরণ করেননি। তিনি ইসলামের উপর সমাচ্ছন্ন স্বেচ্ছাচারিতার এবং জাহিলিয়াত কে পরাভূত করে খেলাফতে রাশেদার অনুসৃত নীতির আলোকে তার শাসন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজান। সম্পূর্ণ বৈরী পরিবেশে উমাইয়াদের স্বেচ্ছাচারী রাষ্ট্রব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে খোলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শ বাস্তবায়ন শুরু করেন। এ কারণে তাকে ইসলামের পঞ্চম খলিফা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
প্রাদেশিক গভর্নর পরিবর্তন:
ওমর ইবনে আবদুল আজিজ যেমন স্বজনপ্রীতির বিরোধী ছিলেন তেমনি তিনি অযোগ্যদের কে মেনে নিতে পারতেন না। অভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থার পুনর্গঠনে তিনি অত্যাচারী লোভী দুর্নীতি পরায়ন এবং অযোগ্য প্রাদেশিক শাসনকর্তা দের বরখাস্ত করেন। তিনি জনসাধারণের কল্যাণে ন্যায়পরায়ন, বিশ্বস্ত এবং যোগ্য লোকদের নিয়োগ দান করেন। এক্ষেত্রে তিনি দলীয়, বংশীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে হিমারীয় এবং মুদারীয় বংশের মধ্য থেকে যোগ্যদের বাছাই করে নিয়োগ দেন। তিনি বসরা কুফা মেসোপটেমিয়া এবং খোরাসানে মুদারীয় শাসক নিয়োগ দেন। অন্যদিকে হিমারীয় সামাহ বিন মালিক কে স্পেনের এবং ইসমাইল ইবনে আব্দুল্লাহ কে কায়রোয়ানের শাসন কর্তা নিযুক্ত করেন।
ন্যায় পরায়ণতা ও জবাবদিহিতা:
তার প্রশাসন ছিল ন্যায়-নীতির ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি কোনো ভয়-ভীতি আশঙ্কা না করে ন্যায়-নীতির ভিত্তিতে যেমনি ভাবে শাসনকর্তাদের নিয়োগ ও বরখাস্ত করতেন, তেমনি নিয়োগকৃতদেরকেও জবাবদিহিতার জন্য বাধ্য করতেন। সকল শাসনকর্তার কর্মকান্ডের উপর তিনি সর্তক দৃষ্টি রাখতেন। কোন প্রকার দুর্বলতা তার নীতি জ্ঞানকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি। খোরাসানের শাসনকর্তা ইয়াজিদকে তিনি অত্যাচার এবং সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে বরখাস্ত করেন এবং কারাবন্দি করেন। অযোগ্যতার জন্য তিনি স্পেনের ত্রাণকর্তা আল হুর কে পদচ্যুত করেন।
আরও পড়ুন-
ইসলামী শরীয়তের বাস্তবায়ন:
ওমর ইবনে আবদুল আজিজ খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর পরই উমাইয়া বংশীয় রীতি-নীতি উপেক্ষা করে শাসন ব্যবস্থায় ইসলামী শরীয়তের বাস্তবায়নকল্পে আত্মনিয়োগ করেন। উমাইয়াদের মধ্যে একমাত্র তিনিই মজলিসে শুরার পরামর্শ মোতাবেক শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। এই সফলতার কারণ তিনি ইতিহাসে দ্বিতীয় ওমর উপাধি লাভ করেন। এছাড়া তিনি উমাইয়াদের সাধু পুরুষ (The Saint of the Umayyad) নামেও খ্যাতি লাভ করেন। কিন্তু তার এইসব নীতিকে উমাইয়াগণ কখনো ভালো চোখে দেখেনি।
জাতীয় ফরমান জারি:
শাসন ব্যবস্থাকে তার গৃহীত নীতি অনুযায়ী সর্বত্র বাস্তবায়নকল্পে তিনি নবনিযুক্ত প্রাদেশিক প্রশাসকদের প্রতি তাঁর বিশেষ নসিহতসহ রাজকীয় ফরমান জারি করেন। তার লিখিত আদেশে তিনি প্রাদেশিক শাসনকর্তাদেরকে সকল অন্যায় বিধি-নিষেধ প্রত্যাহার করতে এবং জনসাধারণের অভিযোগের সকল কারণ দূরীভূত করতে উৎসাহ প্রদান করেছিলেন।
অপচয় রোধ নীতি গ্রহণ:
এতোকাল যাবত উমাইয়াদের প্রশাসনিক সকল প্রতিষ্ঠান ছিল জমকালো এবং খলিফাসহ সকলের জীবনে ছিল আড়ম্বরপূর্ণ। প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনকারী সবাই ছিল প্রচুর সম্পদের অধিকারী। ওমর ইবনে আবদুল আজিজ এসব কে ঘৃণা করতেন এবং সরল জীবনযাপন করতেন। তিনি ক্ষমতা লাভের পূর্বে অনেক সম্পত্তির মালিক ছিলেন। কিন্তু খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর তিনি 200 দিরহাম মূল্যের সম্পদ রেখে বাকি সকল অর্থ-সম্পদ, এমনকি স্ত্রীর মণিমুক্তা খচিত মূল্যবান অলঙ্কার, আস্তাবলের ঘোড়াসহ সকল সম্পত্তি বিক্রি করে সে অর্থ বাইতুল মালে জমা দেন। তার এই নীতি প্রশাসনকে করেছে স্বচ্ছ এবং বায়তুল মাল কে করেছে সমৃদ্ধ।
আরও পড়ুন-
জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য,সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে মামলুকদের অবদান
বায়তুলমাল রাষ্ট্রীয়করণ:
উমাইয়া আমলে বায়তুল মালের উপর জনগণের অধিকার এর পরিবর্তে খলিফাদের একচ্ছত্র অধিকার বা মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। খলিফাগণ তাদের ইচ্ছামতো বায়তুল মাল কে ব্যবহার করতেন। কিন্তু ওমর ইবনে আবদুল আজিজ পুনরায় বায়তুল মাল কে রাষ্ট্রীয়করণ অর্থাৎ জনগণের সম্পত্তিতে পরিণত করেন।
মাওয়ালী নীতির সংস্কার:
আযাদকৃত ক্রীতদাস যারা পরবর্তীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে অথবা অনারব নওমুসলিমদেরকে বলা হতো মাওয়ালী। উমাইয়াদের সময় তাদের সংখ্যা ছিল লাখ লাখ। এই মাওয়ালীরা উমাইয়াদের সাম্রাজ্য বিস্তার এবং উন্নতিতে বিশেষভাবে অবদান রাখে। কিন্তু তাদের প্রতি উমাইয়াদের নীতি ছিল নেতিবাচক। রাজনৈতিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তারা ছিল অবহেলিত উপেক্ষিত। জাহিলিয়াতের বংশীয় আভিজাত্যের কারণে উমাইয়ারা এদের প্রতি হিংসা বিদ্বেষ পোষণ করতো। এ পরিস্থিতিতে তাদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে। তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পরেও তাদের উপরে জিজিয়া এবং খারাজ বহাল রাখা হয়। তাদের ভতাও দেওয়া হতো না। তাদেরকে সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হতো না। ওমর ইবনে আবদুল আজিজ এদের উন্নতির দিকে মনোযোগ দেন। তিনি তাদের ভাতার ব্যবস্থা করেন এবং সাধারন আরবদের মতো তাদের মর্যাদা দান করেন। প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের কাছে লিখিত আদেশ পাঠিয়ে তিনি এদের প্রতি জুলুম, অবিচার ও অবহেলা বন্ধ করার নির্দেশ দেন। ফলে তারা তাদের অধিকার ভোগ করতে শুরু করে। তিনি মাওয়ালিদের উপর আরোপিত অবৈধ জিয়া এবং খারাজ রহিত করেন।
গোত্র রেষারেষির মূলোৎপাটন:
উমাইয়া এবং হাশমি গোত্রের মধ্যে জাহেলী যুগ থেকে কলহ-বিবাদ এবং শত্রুতা চলে আসছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ দ্বারা তা অনেকটা প্রশমিত হলেও উমাইয়াদের আমলে ভয়ানক আকার ধারণ করে। ওমর ইবনে আবদুল আজিজ এই চলমান সংঘাত নির্মূলের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। মারওয়ান কর্তৃক আত্মসাৎকৃত মহানবীর বাগানটি ওমর মুহাম্মদ সাল্লাম এর বংশধর এর নিকট ফিরিয়ে দেন। আব্দুল মালিক কর্তৃক বাজেয়াপ্তকৃত হযরত তালহার সম্পত্তি তার উত্তরাধিকারীদের নিকট ফিরিয়ে দেন। এভাবে তিনি তাদের মধ্যকার পারস্পারিক শত্রুতা ও রেষারেষি মূলোৎপাটনের চেষ্টা করেন।
খারিজি নীতি:
উমাইয়াদের হটকারীতার কারণেই সিফফিনের যুদ্ধে হযরত আলীর একটি দল খারিজি হয়ে যায়। এই খারিজীরা ছিল উমাইয়াদের চরম দুশমন এবং একটি ভয়ানক চরমপন্থী শক্তি। সকল উমাইয়া শাসকদের সাথে তাদের লড়াই হয়েছে কিন্তু ওমর ইবনে আবদুল আজিজ এর সময়ে তারা শান্তিকামী ছিলো। এর পিছনে কারণ হলো ওমরের সুষ্ঠু এবং দূরদর্শী নীতি। তিনি জানতেন এরা চরমপন্থী শক্তি, তাই তিনি তাদের বিরুদ্ধে যেমন কোন আক্রমণ করেননি তাই তারাও খলিফার রাজ্যে শান্তি বিনষ্ট করেনি। এদের প্রতি খলিফা নীতি ছিল এই যে; কুফার গভর্নর কে তিনি লিখেছেন- যদি খারিজীরা গোলযোগ না করে তাহলে তাদেরকে আক্রমণ করোনা। তার উদার মনোভাবের কারণে তার সময়ে খারিজিয়া কোন আক্রমণ করেনি বরং তারা দ্রুত পাঠিয়ে বলেছিল যে; তার শাসনে তাদের কোন আপত্তি নাই।
আরও পড়ুন-
বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান, সীমানা ও ভূপ্রকৃতির বৈশিষ্ট্যসমূহ
খুৎবা পাঠের রীতি পরিবর্তন:
উমাইয়া বংশের প্রতিষ্ঠায় হযরত আলীর প্রতিবন্ধকতার কারণে তারা সর্বদাই আলী বংশীয়দের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতো। ওমর এর পূর্ববর্তী সকল উমাইয়া খলিফা হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং তার বংশধরদের প্রতি জুম'আর খুৎবায় অভিশাপ বর্ষণ করতো। আব্দুল আজিজ এই রীতি রহিত করেন।
অমুসলিমদের প্রতি উদার নীতি:
একটি রাজ্যে যখন অন্য জাতির লোকদের ধর্মীয় স্বাধীনতা না থাকে সেখানে শান্তি স্থাপন করা বড়ই কঠিন। ওমর ইবনে আবদুল আজিজ ধর্মীয় ব্যাপারে ছিলেন অত্যন্ত উদার। অন্য ধর্মালম্বীদের প্রতি তিনি ছিলেন স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। খ্রিস্টানরা তাদের নিজস্ব ধর্ম আচার-আচরণ পালন করতে পারত, ইতোপূর্বে খ্রিস্টান ইহুদীদের যেসব মন্দির দখল করা হয়েছিল তিনি তা তাদের হাতে ফিরিয়ে দেন।তিনি ইয়াহুদি এবং খ্রিস্টানদের উপাসনালয় পুন:নির্মান করেন। সাইপ্রাস ও নাজরানের খ্রিস্টানদের করভার তিনি লাঘব করেন।
তবে ঐতিহাসিক পি কে হিট্টি এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন ওমরের কৃতিত্বকে স্বীকার করলেও ওমর খ্রিস্টানদের সাথে অপমানজনক বিধি-নিষেধ জারি করেছেন বলে তিনি মন্তব্য করেন।
আরব-অনারব বৈষম্য দূরীকরণ:
উমাইয়া যুগে যেমন ছিল বংশীয় বিরোধ তেমনি আরব মুসলমান এবং মুসলমানদের মধ্যেও ছিল দারুণ বৈষম্য। বিশেষ করে পারসিকরা ছিল আরবদের প্রতি বিরূপ ভাবাপন্ন। আব্দুল মালিকের আরবীয়করনীতির প্রতিক্রিয়ায় পারসিকরা শুয়োবিয়া আন্দোলন শুরু করেছিল। মাওয়ালীদের মতোই তাদের সাথে আচরণ করা হতো। সরকারি কোনো কাজে তারা ছিল বৈষম্যের শিকার। ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ রাষ্ট্রের কাঠামোকে সুসংহত করার লক্ষ্যে আরব-অনারব বৈষম্য দূর করে তাদের মধ্যে সমতা বিধান করার চেষ্টা করেন। যোগ্যদের কে তিনি বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেন। তাছাড়া মুদারীয় এবং হিমারীয়দের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিরসনে তিনি যথেষ্ট চেষ্টা করেন।
বৈদেশিক নীতির সংস্কার:
বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে ওমর ইবনে আবদুল আজিজ সম্পূর্ণ বিপরীত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি সমর নীতি, রক্তপাত ও সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণ কে পছন্দ করতেন না। তিনি রাজ্য বিস্তার অপেক্ষা বিজিত রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বিধানকে প্রধান কর্তব্য কর্তব্য বলে স্থির করেন। সেজন্য তিনি সকল সীমান্ত অভিযান স্থগিত করেনএবং কনস্টান্টিনোপল অভিযানে থাকা মুসলিম সৈন্যবাহিনীকে দ্রুত রাজধানীতে প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দেন। সাম্রাজ্যের এই অবস্থায় তিনি যুদ্ধ এবং তরবারি ব্যতীত সবার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন এবং সম্পর্ক রক্ষার বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করেন। যুদ্ধ এবং তরবারী পরিচালনাতে তেমন কোন মঙ্গল আছে বলে তিনি মনে করতেন না।
আরও পড়ুন-
খলিফা আব্দুল মালিক।। Abdul Malik the Umayyad Caliph.রাজস্ব সংস্কার
সে সময়ে মুসলমানদেরকে খারাজ দিতে হতো না বরং উৎপন্ন দ্রব্য হতে এক-দশমাংশ উশর দিতে হেতো। খারাজ থেকে মুক্তি লাভের আশায় বহু অমুসলমান ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে, এর ফলে তারা জিজিয়া এবং খারাজ এই দুটি কর থেকে মুক্তি পেত। অন্যদিকে তারা শহরে এসে সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেন তাদেরকে ভাতা দিতে হতো। এর ফলে রাজকোষে অর্থ সমাগম কমে যাওয়ার আশঙ্কায় পূর্ববর্তী উমাইয়া খলিফাগন মুসলিম হওয়ার পরেও তাদের প্রতি জিজিয়া এবং খারাজ বহাল রেখেছিলেন। কিন্তু ওমর ইবনে আবদুল আজিজ ক্ষমতায় আসার পরে তিনি মাওয়ালিদের কে জিজিয়া এবং খারাজ থেকে অব্যাহতি দেন। আর এই নীতির ফলে রাজকোষে অর্থের ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে এ বিষয়ে তিনি তিনটি নীতি গ্রহণ করেন-
অমুসলিমদের জমি ক্রয় নিষিদ্ধকরণ:
অমুসলিমদের খারাজী জমি মুসলমানরা করার করার ফলে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ঘাটতি হয়। এই অবস্থা প্রতিরোধের জন্য ওমর ইবনে আবদুল আজিজ মদিনার আলেমদের পরামর্শে 100 হিজরীর (718-19) সালের পর মুসলমানদের কাছে অমুসলিমদের জমি বিক্রয় নিষিদ্ধ করেন।
খারাজ আদায়:
বহু মুসলমান খারাজ ফাঁকি দেওয়ার জন্য ইসলাম গ্রহণ করেছে এ বিষয়টি বুঝার পর ওমর ইবনে আবদুল আজিজ মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে ভূমি দখলকারী প্রত্যেকের জমির উপর খাড়ার আরোপ করেন।
জিজিয়া আদায়:
মুসলিম নাগরিকরা তাদের জীবন সম্পদ ও সম্মানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিনিময়ে জিজিয়া নামে একটি নিরাপত্তা কর প্রদান করত। নানা কারণে ইতিপূর্বে এক্ষেত্রে শৈথিল্য দেখা দিয়েছিল। আব্দুল আজিজ নিয়মিত জিজিয়া কর আদায়ের ব্যবস্থা করেন।
সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করণ:
হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর সময়কাল থেকেই উমাইয়ারা নানাভাবে অর্থ-সম্পদের মালিক হয়। অনেকে অন্যায় ভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ভোগ দখল করে আসছিল। শাসন ক্ষমতা লাভের পর ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ নিজের 50 হাজার দিরহাম মূল্যের সম্পদবাইতুল মালে জমা দেন। তার স্ত্রীর সূত্রে প্রাপ্ত যেসব মূল্যবান রত্ন ছিল সেগুলো তিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেন। রাজকীয় ঘোড়াগুলো অযথা ব্যয় বাড়াচ্ছিল বলে তিনি সেগুলো বিক্রি করে সেঅর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেন। এরপর তিনি উমাইয়াদের মধ্যে যারা রাষ্ট্রীয় অর্থ সম্পদ আত্মসাৎ করেছে তিনি তাদেরকে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন; যদি তারা রাষ্ট্রের আত্মসাৎকৃত অর্থ-সম্পদ বায়তুল মালে ফেরত না দেয় তাহলে তিনি মদিনায় গিয়ে হাশিমীয়দের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। এই ঘোষনার পর তাদের অনেকেই অন্যায় ভাবে জমানো অর্থ-সম্পদ কোষাগারে জমা করেদেন। ওমর বিন আব্দুল আজিজ এভাবে রাজকোষকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করেন এবং রাষ্ট্রের আর্থিক অবস্থার সুদৃঢ় করে তোলেন।
আরও পড়ুন-
বাংলাদেশের সমাজ ও জনজীবনে ভূ প্রকৃতির প্রভাব
অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা:
খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজ ছিলেন শান্তিপ্রিয় এবং সাম্রাজ্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে। তিনি সামরিক অভিযান বন্ধ করে আভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা বিধানে মনোনিবেশ করেন। ঐতিহাসিক খোদা বক্স এর মতে-
‘দ্বিতীয় ওমরের সময়ে রাজ্য বিস্তারের প্রয়োজনীয়তা ছিল না , দ্বিতীয় ওমরের রাজত্বের পূর্বেই প্রথম ওমর সুষ্ঠুভাবে সামরিক সংগঠনের কার্য সমাধা করেন, প্রথম ওয়ালিদের খিলাফতকালে আরব বিজয় এত সুবিস্তৃত হয় যার অধিক সম্প্রসারণ বা ব্যাপকতা সম্ভবপর ছিল ন ’তাই ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তার সর্বাত্মক প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তা বিধান করতে সক্ষম হন’
হাদীস সংকলন
ইসলামের ইতিহাসে ওমর ইবনে আবদুল আজিজ যে বিশেষ কাজের জন্য চির স্মরণীয় হয়ে আছেন তা হল- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু সালামের হাদিস সংকলন। তৎকালীন সময়ে সাহাবীদের ইন্তেকাল এবং বহু বানোয়াট হাদিস তৈরি হলে বিশুদ্ধ হাদিস নির্ধারণে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তাই হাদিসের বিকৃতি ও বিলুপ্তির আশঙ্কায় তিনি সরকারি ব্যবস্থাপনায় হাদিস সংকলনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তার এই মহৎ অবদানের কারণে মুসলিম জাতি আজকে বিশুদ্ধ হাদিস সমূহ জানতে পেরেছে। তিনিই প্রথম সরকারিভাবে এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।
জনকল্যাণমূলক কার্যাবলী:
ওমর ইবনে আবদুল আজিজ তার শাসনামলে জনহিতকর কার্যাবলীর দ্বারা সর্বত্র সমৃদ্ধির জোয়ার এনেছিলেন। তিনি ভূমি জরিপ, আদমশুমারিট, সেতু নির্মাণ, কৃষি বিপনন, বাণিজ্যকেন্দ্র, সরাইখানা নির্মাণ ইত্যাদি বহুবিধ কার্যাবলী সম্পাদন করেন। জনগণের শান্তি কামনা ও মঙ্গল সাধনই ছিল তার শাসনের মূল বৈশিষ্ট্য। তাঁর শাসনকাল অল্প হলেও উমাইয়া যুগের সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয় এবং উল্লেখযোগ্য ছিল তার শাসনকাল।
মূল্যায়ন ও সমালোচনা
ঘন আধার ভেদ করে প্রভাতবেলার সূর্য যেমন আলোক রশ্মি বিকিরণ করে ঠিক তেমনি ওমর ইবনে আবদুল আজিজ উমাইয়া শাসনামলের কালো আঁধার অধ্যায় ভেদ করে ক্ষণিকের তরে ইসলামের আলোকে জ্বলে ওঠা এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। যিনি উমাইয়া আমলে এক অনুপম শাসনব্যবস্থা উপহার দিয়েছিলেন। যদিও ঐতিহাসিক ব্রাউন তাকে রক্ষণশীল বলে মন্তব্য করেছেন, আর পি কে হিট্টি বলেছেন তার কার্যক্রম সফল হয়নি। বস্তুত ঐতিহাসিকদের এসব মন্তব্যের সাথে একমত হওয়া যায়না। তিনি কোনোভাবেই রক্ষণশীল ছিলেন না আর উমাইয়াদের পতনেও তিনি দায়ী ছিলেন না। কেননা তার গৃহীত নীতির মোতাবেক পরবর্তী খলিফাগণ রাজ্য শাসন করলে এত তাড়াতাড়ি হয়তো উমাইয়াদের পতন হতো না। তার কর্মকান্ড এবং সংস্কারাবলী মূল্যায়ন শেষে একথা বলতে পারি যে, সত্যিকার অর্থেই তিনি উমাইয়াদের সাধু পুরুষ (The Saint of the Umayyad), ২য় ওমর এবং ইসলামের পঞ্চম খলিফা।
Md. Billal Hossain
B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka
BCS General Education
Lecturer
Department of Islamic History & Culture
Chandpur Govt. College, Chandpur.
No comments:
Post a Comment