Breaking

Tuesday 9 August 2022

গ্রিসের স্বাধীনতা যুদ্ধ।। Greek War of Independence


 গ্রিসের স্বাধীনতা যুদ্ধ
(Greek War of Independence)

 (১৮২১-১৮৩২) 

                                                                                                     


১৮২১ এবং ১৮৩০ সালের মধ্যে অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে  গ্রিক বিপ্লবীদের দ্বারা পরিচালিত একটি সফল যুদ্ধ ছিল গ্রিসের স্বাধীনতা যুদ্ধ। সার্বিয়া ১৮০৪ সালে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তাদের স্বায়ত্তশাসন আদায় করলেও গ্রিস ই সর্ব প্রথম দেশ যা তুরস্ক সা¤্রাজ্য থেকে সম্পূর্ণভাবে স্বাধীনতা লাভ করতে সক্ষম হয়। এর মাধ্যমে তুরস্ক সাম্রাজ্যের বিশাল অংশ হাতছাড়া হয়ে যায়। তুরস্ক সা¤্রাজ্যের দুর্বলতা হেতু সৃষ্ট পাচ্য সমস্যা, তুরস্ক কর্তৃক গ্রিস বাসীকে নানাবিধ সুবিধা প্রদান, খ্রিস্টান ধর্মের মাধ্যমে গ্রিক বাসীকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা এবং রাশিয়ার তুরস্ক বিরোধী নীতি ও সর্বাত্মক সাহায্য দানের মাধ্যমেই গ্রিস স্বাধীনতা যুদ্ধ তরান্বিত হয়।






ক. গ্রিসের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি: 

গ্রিস ইউরোপ মহাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশের একটি রাষ্ট্র যা বলকান উপদ্বীপের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত। এর সীমান্তবর্তী রাষ্ট্রগুলো হচ্ছে উত্তরে বুলগেরিয়া, প্রাক্তন যুগোশ্লাভিয়া, মেসিডোনিয়া এবং আলবেনিয়া; পূর্বে তুরস্ক। গ্রিসের মূল ভূমির পূর্বে ও দক্ষিণে এজিয়ান সাগর অবস্থিত, আর পশ্চিমে রয়েছে আইওনিয়ান সাগর। পূর্ব ভূমধ্যসাগরের উভয় অংশে গ্রিসের অনেকগুলো দ্বীপ রয়েছে। বর্তমান গ্রিকদের পূর্বপুরুষ হচ্ছে এক সময়ের পৃথিবী বিজয়ী প্রাচীন গ্রিক সভ্যতা, বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য এবং প্রায় ৪ শতাব্দীর অটোমান সাম্রাজ্য। ১৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এখানে রোমান সাম্রাজ্যের সূচনা হয় যা ১৪৫৩ সালে কনস্টান্টিনোপলের পতনের পূর্ব পযন্ত টিকে ছিলো। এরপর তা অটোমানদের হাতে চলে যায়। ১৮৩২ সালে অটোমান সা¤্রাজ্য থেকে গ্রিস স্বাধীন হয়। এই দেশ পশ্চিমা বিশ্বের জ্ঞান বিজ্ঞানের সূতিকাগার এবং গণতন্ত্রের জন্মদাতা স্থান হিসেবে সুপরিচিত। গ্রিসের আরও কিছু বৃহৎ অবদান হচ্ছে পশ্চিমা দর্শন, অলিম্পিক গেম্স, পশ্চিমা সাহিত্য, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এবং নাটক। সব মিলিয়ে গ্রিসের সভ্যতা সমগ্র ইউরোপে এক সময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী সভ্যতা হিসেবে পরিগণিত হত। এ জন্যই গ্রিসের প্রতি পশ্চিমা সমাজের আছে আবেগ মিশ্রিত স্বার্থহীন ভালোবাসা।


আরও পড়ুন-

সুয়েজ খাল (Suez Canal) ।। সুয়েজ খালের ইতিহাস ।। মিসরের স্বাধীনতা ও জাতীয় জীবনে সুয়েজ খালের প্রভাব


                            

খ. গ্রিসের স্বাধীনতা যুদ্ধের কারণ:


  1. সার্বিয়ার স্বায়ত্তশাসন লাভ: 

১৮০৪ সালে বলকান অঞ্চলের প্রথম দেশ হিসেবে সার্বিয়া বিদ্রোহ ঘেষণা করে এবং স্বায়ত্তশাসন আদায় করতে সক্ষম হয়। তাদের এই সফলতা এ অঞ্চলের অন্যান্য শক্তিগুলোকে উৎসাহিত করেছিলো। গ্রিসের স্বাধীনতা আন্দোলন তারই ধারাবহিকতা।


  1. গ্রিকদের স্বাধীনতা স্পৃহা বৃদ্ধি: 

তুরস্ক কর্তৃক গ্রিকরা অত্যাচারিত হইতেছিলো বলে তারা স্বাধীনতা লাভের চেষ্টা করেছিলো বিষয়টি এ রকম নয়। গ্রিকগণ তুরস্ক সা¤্রাজ্যের অধীনে থেকে যে পরিমান স্বায়ত্তশাসন ও ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করত, তা খ্রিস্টান শাসিত দেশ আয়ারল্যান্ডের ক্যাথলিকরা বা অস্ট্রিয়ার প্রোটেস্টানরাও ভোগ করত না। তারা ধর্ম পালন, সম্পত্তি সঞ্চয়, বড় বড় সরকারি দায়িত্বশীল পদ লাভ এবং ব্যবসা বানিজ্যে অবাধ সুবিধা ভোগ করত। তাদের স্বাধীনতা স্পৃহা প্রশমিত করার জন্যই তুর্কি সুলতান তাদেরকে এসব সুবিধা দিয়েছিলেন। এরূপ সুবিধা ভোগ করার ফলেই তাদের স্বাধীনতা স্পৃহা বৃদ্ধি পেল।


  1. গ্রিসের প্রাচীন গৌরব ও স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার:  

গ্রিক চার্চ মুসলিমদের প্রতি ঘৃনা পোষনে এবং গ্রিক জাতিকে ধর্মের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ  করতে সাহায্য করে।

গ্রিক প্রাচীন সভ্যতার সূতিকাগার হিসেবে এর রয়েছে বিরাট ঐতিহ্য। সেজন্য প্রাচীন গ্রিক ভাষা ও সাহিত্য চর্চার মাধমে গ্রিসের পুরাতন গৌরব ও ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে তারা যত্নশীল হয়। যা স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমেই সম্ভব।  


  1. মোরিয়া বিদ্রোহ: 

১৮২০-২১ সালে মোরিয়াতে বিদ্রোহ দেখা দিলে তা ব্যাপকভাবে গ্রিসে বিস্তার লাভ করে এবং গোটা ইউরোপে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। তুর্কি সুলতান কঠোরভাবে এ বিদ্রোহ দমন করলে ইউরোপজুড়ে গ্রিসের প্রতি সহানুভূতি ও সমর্থন তৈরি হয় যা বিদ্রোহীদের আরও অনুপ্রাণিত করে। মোরিয়া বিদ্রোহ ই গ্রিস স্বাধীনতা যুদ্ধের সুত্রপত করেছিলো। 


  1. গুপ্ত সমিতি প্রতিষ্ঠা:

গ্রিসের স্বাধীনতা যুদ্ধকে তরান্বিত করেছিলো ফিলকি হোটাইরিয়া নামক গুপ্ত সমিতি। ১৮১৪ সালে রাশিয়ার ইউক্রেনের ওডিসাতে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। গ্রীসের সর্বত্র এর শাখা ছড়িয়ে পড়ে। এর সভাপতি ছিলেন আলেকজান্ডার ইপসিলান্টি। বৃটেন ও আমেরিকাতে নির্বাসিত ধনী গ্রিকদের সমর্থন এবং রাশিয়া ও পশ্চিম ইউরোপিয়ানদের সহায়তায় তারা এই বিদ্রোহের পরিকল্পনা করে। সচেতন গ্রিকমাত্রই এই সংগঠনের সদস্য ছিলেন। এই সংগঠনের মাধ্যমে গোপন প্রচারনা চলে এবং সংগঠিত আন্দোলন শুরু হয়। 


  1. জাতীয়তাবাদী ধারনার বিকাশ: 

আঠারো শতাব্দীতে অটোমান সা¤্রাজ্যের অভ্যন্তরে ও বাইরে অর্থনৈতিক উন্নতির কারণে গ্রিক বণিক এবং নাবিকেরা যথেষ্ট ধনী হয়েছিলো। তরুনদের উচ্চ শিক্ষার জন্য তারা পশ্চিম ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে প্রেরণ করে। সেখানে তারা ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান, ফরাসী বিপ্লব এবং রোমান্টিক জাতীয়তাবাদের মূল ধারণাগুলির সংস্পর্শে আসে। ফরাসী বিপ্লবের প্রভাবের কারণে ১৮ এবং ১৯ শতকের  বলকান অঞ্চল সহ সমগ্র ইউরোপ জূড়ে বিপ্লবী জাতীয়তাবাদ বৃদ্ধি পেয়েছিল। এ ছাড়া গ্রিক জাতীয়তাবাদের ধারণা বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল রুশো-তুর্কি যুদ্ধসমূহ । অটোমান সা¤্রাজ্যের শক্তি হ্রাস পাওয়াার সাথে সাথে গ্রিক জাতীয়তাবাদ বিকশিত হতে থাকে।


  1. ফিলহেলিনিজম (Philhellenism): 

চযরষযবষষবহরংস (ফিলহেলিনিজম) বা গ্রিস এবং গ্রিসের সব কিছুর প্রতি ভালোবাসা। এটি ছিলো একটি ইনটেলেকচুয়াল মুভমেন্ট। প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি হওয়ায় গ্রিক সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি কিছু ধনাঢ্য এমেরিকান এবং পশ্চিমা অভিজাতদের ছিলো গভীর ভলোবাসা। যারা গ্রিস থেকে তুর্কিদের বিতাড়নে বিদ্রোহীদেরকে নানাভাবে সহায়তা করেছেন এবং উৎসাহ উদ্দিপনা দিয়েছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- লর্ড বায়রন,স্যামুয়েল হগ,চার্লস নিকোলাস ফেভভিয়ার, জর্জ জার্ভিস প্রমুখ। লর্ড বায়রন সরাসরি গ্রিক স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেন এবং রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যান।



গ.যুদ্ধের সুত্রপাত:

তুর্কি সুলতানের ইরান, হেজাজ ও মিসর নিয়ে ব্যস্ততার সুযোগে ১৮২১ সালে মোলদাভিয়া ও ওয়ালাসিয়াতে প্রথম বিদ্রোহ শুরু হয়। আলেকজান্ডার ইপসিলান্টি এখানে নেতৃত্ব দেন। তাৎক্ষনিক রুশ সাহায্য না পেয়ে এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়। কিন্তু মোরিয়া দ্বীপে ব্যাপক বিদ্রোহ দেখা দেয় যা এক বিরাট স্বাধীনতা যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়। মোরিয়াতে বহু মুসলিমকে হত্যা করা হয়। তুর্কি সরকার প্রতিশোধ হিসেবে কনস্টান্টিনোপলের চার্চের অধিকর্তা পেট্রিয়ার্ককে হত্যা করেন এবং মাইনরের বহু খ্রিস্টানকে নিধন করা হয়। এ ভাবে ১৮২১-২৫ সাল যুদ্ধ চলতে থাকে।



ঘ. ইউরোপীয় পরাশক্তিদের প্রতিক্রিয়া:


  1. রাাশিয়া:

বলকান অঞ্চল অশান্ত হয়ে উঠলে রাশিয়া,ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া ও বৃটেন সর্তক অবস্থান গ্রহণ করে। রাশিয়া বরাবরই গ্রিকদের সাহায্য দানে এগিয়ে আসে। কেননা তুর্কি সা¤্রাজ্য দুর্বল ও গ্রাস করা এবং বলকান অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করাই ছিলো রাশিয়ার নীতি। 


  1. অস্ট্রিয়া:

অস্ট্রিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী মেটারনিক বিদ্রোহীদের বিপক্ষে অবস্থান নেন। তাঁর বিরোধীতার কারনে রাশিয়া প্রথম দিকে গ্রিসকে সাহায্য করতে পারেনাই। মেটারনিক এই বিদ্রোহকে অবৈধ বলে আখ্যায়িত করেন এবং সমূলে তা বিনাস করতে চান।


  1. বৃটেন: 

অন্যদিকে বৃটিশ নেতা ক্যানিং মনে করেন রাশিয়া বিদ্রোহীদের সাহায্য দেওয়ার নামে গ্রিস গ্রাস করতে পারলে তুরস্ক ও গ্রাস করবে। আর তুরস্কের ক্ষতি হলে বৃটিশ স্বার্থ নষ্ট হবে।বৃটেন বরাবরই তুরস্কের অখন্ডতার পক্ষে। সুতরাং বৃটেন রাশিয়ার বিপক্ষে অবস্থান নেয়।


  1. ফ্রান্স: 

তুরস্কের আধুনিকায়নের বিভিন্ন সেক্টরে ফ্রান্স জড়িত ছিলো। ফলে বৃটেনের মত ফ্রান্স ও নিরপেক্ষতা নীতি অবলম্বন করে।


ঙ. মুহাম্মদ আলী পাশাকে আমন্ত্রণ: 

গ্রিসের স্বাধীনতা আন্দোলন চুড়ান্তভাবে দমন করতে ব্যর্থ হয়ে তুর্কি সুলতান মিসরের মুহাম্মদ আলী পাশাকে সাহায্যের জন্য আমন্ত্রণ জানান। মুহাম্মদ আলী পাশা তার পুত্র ইব্রাহিম পাশাকে প্রেরণ করেন। ইব্রাহিম পাশা তার বাহিনী নিয়ে ক্রীট দখলের পর মোরিয়া বিদ্রোহ কঠোর ভাবে দমন করেন। তিনি মিসলঙ্গি দখল করেন এবং ১৮২৭ সালে তুর্কি সুলতান এথেন্স দখল করেন।

  

চ. যুদ্ধ বিরতির চাপ:

গ্রিসে তুর্কিদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকলে এবং বিদ্রোহীরা কোনঠাসা হয়ে পড়লে ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলো তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে। গ্রিকদের সাহায্যে রাশিয়া যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণ করে। তুরস্ক এথেন্স দখল করলে রাশিয়া,ফ্রান্স ও বৃটেন ঐক্যবদ্ধ হয়ে ১৮২৭ সালের ৬ জুলাই লন্ডন চুক্তি সম্পাদন করে। তারা সুলতানকে যুদ্ধ বিরতির এবং গ্রিসকে স্বায়ত্তশাসন প্রদানের জন্য চাপ প্রয়োগ করে।


ছ. নাভারিনের যুদ্ধ ১৮২৭:

লন্ডন চুক্তি অনুযায়ী মিত্র বাহিনীর দেয়া যুদ্ধ বিরতি ও স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাবে সুলতান রাজি না 

হলে  রাশিয়া, ফ্রান্স ও বৃটেন ঐক্যবদ্ধ ভাবে তুরস্কের বিরুদ্ধে গ্রিসের পক্ষে করার যুদ্ধ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৮২৭ সালের ২০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত নাভারিনের নৌ যুদ্ধে মিত্র বাহিনী তুর্কি নৌ বহর ধ্বংস করে। তুরস্ক পরাজিত হয় এবং গ্রিসের স্বাধীনতার পথ প্রসস্ত হয়। গ্রিকরা জাতীয় সরকার গঠন করতে শুরু করে। 


 

জ. পোরস কনফারেন্স:

১৮২৮ সালের সেপ্টেম্বওে পোরোস সম্মেলন গ্রিসের সীমানা কী হওয়া উচিত তা নিয়ে আলোচনা শুরু করে। ১৮২৮ সালের ২১ শে ডিসেম্বর বৃটেন, রাশিয়া এবং ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূতরা পোরোস দ্বীপে মিলিত হন এবং একটি প্রোটোকল প্রস্তুত করেন। এতে তুর্কি সুলতানের অধিনে একটি রাজকীয় ফরমানের মাধ্যমে একজন রাজা দ্বারা শাসিত একটি স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়। কিন্তু সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ বলেছিলেন যে তিনি কখনই গ্রিসকে স্বাধীনতা দান করবেন না এবং তিনি সমস্ত গ্রিসকে পুনরায় বিজয় না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন। 


ঝ. রুশ-তুর্কি যুদ্ধ(১৮২৮-২৯): 

তুরস্কের বিরুদ্ধে নাভারিনের যুদ্ধে রাশিয়ার অংশ গ্রহণের কারণে তুরস্ক র্দাদানালিস প্রণালিতে রাশিয়ার জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দেয়। এর প্রেক্ষিতে রাশিয়ার জার নিকোলাস তুরস্কের বিরুদ্ধে ১৮২৮ সালের মাঝামাঝি একক ভাবে যুদ্ধ ঘোষনা করেন। বৃটেন ও ফ্রান্সের প্রতিবাদ তিনি গ্রহণ করেননি। পরপর কয়েকটি ফ্রন্টে তুর্কি বাহিনী যুদ্ধে পরাজিত হয়। শেষ পযর্ন্ত তুর্কি সুলতান ১৮২৯ সালে এড্রিয়ানোপলের চুক্তি করতে বাধ্য হন।


ঞ. লন্ডন প্রটোকল ১৮২৯:

এদিকে রূশ-তুর্কি যুদ্ধ চলাকালিন তিন পরাশক্তি লন্ডনে আরেকটি চুক্তি সম্পাদন করে। বৃটেন ও ফ্রান্স রাশিয়ার সাহায্য নিয়ে গ্রিস সম্পূর্ণ স্বাধীন হোক এমনটা চায়নি। কেননা এতে সেখানে রুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। এজন্য ১৮২৯ সালে লন্ডন প্রটোকলে তারা পোরোস চুক্তির আদলে গ্রিসকে আভ্যন্তরীণভাবে সম্পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গঠনের প্রস্তাব করে তবে সেটি হবে একটি তুর্কি করদ রাজ্য, অর্থ্যাৎ সুলতানকে কর দিতে হবে। কিন্তু যুদ্ধে তুরস্ক হেরে গেলে সব কিছু রাশিয়ার ইচ্ছানুযায়ী সম্পন্ন হয়।


ট. এড্রিয়ানোপলের চুক্তি ১৮২৯:

১৮২৮-২৯ সালের রুশ-তুর্কি যুদ্ধে তুরস্কের হেরে যাওয়ার পর তুর্কি সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ এড্রিয়ানোপলের চুক্তি করতে বাধ্য হন। এতে --

  1. তুরস্ক গ্রিসের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেয়।

  2. মোলদাভিয়া ওয়ালাসিয়াকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়।

  3. বসফরাস ও র্দাদানালিস প্রণালিতে অবাধ চলাচলের অধিকার পায় রাশিয়া।

  4. রাশিয়া বলকান এলাকায় খ্রিস্টানদের রক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করে।



ঠ. গ্রিসের স্বাধীনতা: 

১৮২৮-২৯ সালের রুশ-তুর্কি যুদ্ধে হেরে গিয়ে তুরস্ক এড্রিয়ানোপলের চুক্তি করলে তিন পরাশক্তি ১৮৩০ সালে লন্ডনে আরেকটি চুক্তি সম্পাদন করে। এতে গ্রিসকে তুর্কি করদ রাজ্য করার পরিবর্তে একটি পরিপূর্ণ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বৃটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়া গ্রিসকে পরিপূর্ণ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয়। 


ড.লন্ডন কনফারেন্সে-1932:

তবে কিছু সীমান্ত চুড়ান্তরূপে নির্ধারিত না হওয়ার কারনে এই চুক্তিটি আবার সংশোধন করা হয়। ১৮৩২ সালের লন্ডন কনফারেন্সে গ্রিসের চুড়ান্ত সীমানা নির্ধারিত হয়, এর অংশ হিসেবে অটোমানদের সাথে কনস্টান্টিনোপলের চুক্তির মাধ্যমে সীমানা নির্ধারিত হয়। আনুষ্ঠানিক ভাবে রাজতান্ত্রিক স্বাধীন গ্রিসের যাত্রা শুরু হয়। 





ঢ. গ্রীস স্বাধীনতা যুদ্ধের ফলাফল:

  1. গ্রীসের স্বাধীনতা অর্জন:

গ্রিসের স্বাধীনতা যুদ্ধের সবচেয়ে বড় ফলাফল হচ্ছে গ্রিসের স্বাধীনতা লাভ। দীর্ঘ এবং রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর, অবশেষে 1832 সালের জুলাই মাসে কনস্টান্টিনোপল চুক্তির মাধ্যমে গ্রীসের চুড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জিত। 


  1. জাতীয়তাবাদের বিস্তৃতি:

গ্রীক জাতীয়তাবাদী চেতনার মাধ্যমেই গ্রিসের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। গ্রিসের স্বাধীনতা অর্জনের ফলে এই জাতীয়তাবাদী চেতনা শুধূ গ্রীসে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ইউরোপের তুর্কি সাম্রাজ্য ভুক্ত অন্যান্য অঞ্চলেও জাতীয়তাবাদী চেতনার বিস্তার ঘটে।

 

  1. রাশিয়ার আধিপত্য বিস্তার:

ব্রিটেন এবং ফ্রান্স গ্রীসের স্বাধীনতা চাইলেও তারা শুধুমাত্র গ্রিসের একক প্রচেষ্টায় সেটা হোক এরকম মনোভাব পোষণ করতো। ফলে ফ্রান্স এবং বৃটেনের ভূমিকার মাধ্যমে গ্রিসের স্বাধীনতা সম্ভব হচ্ছিল না। এককভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করে অটোমান সুলতান কে পরাজিত করার মাধ্যমে রাশিয়া গ্রীসের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। ফলে  তুরস্ককে  কোণঠাসা করার পাশাপাশি এই অঞ্চলে রূশ আধিপত্যের বিস্তার ঘটেছে। 


  1. অটোমান সাম্রাজ্যের সংকোচন:

সর্বপ্রথম সার্বিয়া স্বায়ত্তশাসন লাভ করলেও গ্রিস ই প্রথম দেশ যারা অটোমান সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীনতা লাভ করেছে। গ্রিসের স্বাধীনতার ফলে এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল অটোমান সাম্রাজ্যের হাতছাড়া হয়ে যায়। ফলে অটোমান সাম্রাজ্য সংকুচিত হয়ে পড়ে । 


  1. অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের সুচনা:

গ্রিসের স্বাধীনতা যুদ্ধে অটোমানদের পরাজয় তাদের সামগ্রিক দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। 

একদিকে অটোমানদের দুর্বলতা অন্যদিকে অটোমান সাম্রাজ্যের ইউরোপীয় অংশে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ত্বরান্বিত করেছে। বস্তুত গ্রিসের স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের সূচনা হয়। 


আধুনিক ইউরোপের ইতিহাসে গ্রিসের স্বাধীনতা অর্জন বলকান অঞ্চলের অন্যন্যা দেশগুলোর জন্য ছিলো অনুসরণীয় ঘটনা। এটা আলেকজান্ডারের পবিত্র চুক্তি এবং মেটারনিকের প্রতিক্রিয়াশীল নীতিতে চরম আঘাত হানে। এর ফলে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বেগবান হয় এবং ইউরোপের পরাধীন রাষ্ট্রগুলোতে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। পাচ্য সমস্যায় রাশিয়া গুরুত্বপূর্ণ স্থানে চলে আসে। আর ইউরোপের রুগ্ন মানব তুরস্ক আরো বেশি রুগ্ন হয়ে পরে।




আরও পড়ুন-

তানজিমাত কী ? তানজিমাত যুগে  অটোমান  তুরস্কে গৃহীত সংষ্কারাবলী কী ছিল


মুহাম্মদ আলী পাশা এবং  আধুনিক মিসর     



Md. Billal Hossain

B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka

BCS General Education

Lecturer

Department of Islamic History & Culture

Chandpur Govt. College, Chandpur.








No comments:

Post a Comment