শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী
Shah Wali Ullah
(১৭০৩-১৭৬২)
শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী ভারতীয় উপমহাদেশের একজন ইসলামি পন্ডিত,সংস্কারক,এবং আধুনিক ইসলামি চিন্তার প্রতিষ্ঠাতা। মুঘলদের পতনের যুগে ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটিয়ে ইসলামি রেনেসাঁর সুত্রপাত করেছিলেন তিনি। ভারতে মুসলিম নেতৃবৃন্দকে ঐক্যবদ্ধ করা, ইসলামি শিক্ষার বিস্তার, এবং কুসংস্কার দূর করার জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন । তাঁর ছিলো অসাধারণ লেখনি শক্তি। তিনি কোরআন ও হাদিসের উর্দু ও ফার্সি অনূবাদ করা সহ বহু গ্রন্থ প্রনয়ণ করেছেন। মুসলিম সমাজে তার দারুন প্রভাব ছিলো।
ক. জন্ম ও পরিচয়:
শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভীর আসল নাম কুতুবুদ্দিন আহমদ ইবনে আব্দুর রহিম। তিনি মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর চার বছর পূর্বে ১৭০৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দিল্লির এক সমভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মাওলানা আব্দুর রহিম যিনি দিল্লির রহিমিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা। পিতা এবং দাদা উভয়েই বড় মাপের আলেম ছিলেন। তিনি হযরত উমর এর বংশধর ছিলেন।
খ. শিক্ষা জীবন:
শাহ ওয়ালিউল্লাহ পারিবারে ও মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি কোরআন হিফজ করেন। এরপর তিনি পিতা প্রতিষ্ঠিত রহিমিয়া মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। পনের বছর বয়সে তিনি আরবি ও ফার্সি ভাষা সমাপ্ত করেন। এছাড়া তিনি তাফসির,হাদিস,ফিকাহ,উসুল,মানতিক,কালাম,তাসাউফ, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেন।
গ. কর্ম জীবন:
১৭১৯ সালের দিকে পিতার মৃত্যুর পর শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহিমিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন এবং মাদ্রাসার প্রধান ও পরিচালনার দায়িত্ব পান। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি তাঁর অধ্যাবসায় চালিয়ে যান। শিক্ষক হিসেবে তার সম্মান ও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে এবং শিক্ষার্থীরা তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয় ।
ঘ. হজ্বে গমন ও উচ্চতর শিক্ষা লাভ:
১৭২৪ সালে তিনি হজ¦ পালনের জন্য মক্কা গমন করেন। সেখানে তিনি আট বছর আতিবাহিত করেন। এ সময় তিনি তৎকালিন বিখ্যাত পন্ডিতদের কাছে কোরআন,হাদিস ও ফিকাহ শিক্ষা লাভ করেন। তিনি মুসলিম বিশ্বের সকল প্রান্তের লোকদের সংস্পর্শে আসেন এবং বিভিন্ন মুসলিম দেশের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হন। মূলত ইলমে হাদিসের উপর উচ্চতর দক্ষতা লাভের জন্যই তিনি সেখানে দীর্ঘকাল অবস্থান করেন।
ঙ. একটি স্বপ্ন:
মক্কা মদিনায় অবস্থান কালে তিনি স্বপ্নে দেখেন যে, হাসান ও হুসাইন (রা:) তাকে কলম উপহার দিচ্ছেন। তখন সেখানকার আলেমগন ব্যাখ্যা দিলেন যে; অচিরেই তিনি উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ আলেম হিসেবে খ্যাতি লাভ করবেন । বাস্তবেও তা ই হয়েছে। হাসান ও হুসাইন (রা:) এর কলম উপহার দেওয়ার অর্থ ছিলো মূলত তাঁর লেখনি শক্তির প্রমান। ১৭৩২ সালে তিনি দিল্লি ফিরে আসেন এবং ১৭৬২ সালে মৃত্যুও আগ পর্যন্ত জীবনের বাকি সময় এখানে অতিবাহিত করেন ও লেখালেখি চলিয়ে যান।
চ. ইসলামের খেদমতে শাহ ওয়ালিউল্লাহ এর অবদান:
কোরআনের ফার্সি অনূবাদ:
শাহ ওয়ালিউল্লাহ বুঝতে পারেন যে, এদেশের মানুষকে ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হলে তাদের সামনে সহজ সাবলীল ভাবে কোরআন হাদিস উপস্থাপন করতে হবে। তিনি কয়েক বছর পরিশ্রম করে আল কোরআনের ফার্সি অনূবাদ করেন। কিন্তু তৎকালিন কায়েমি স্বার্থবাদী মোল্লা শ্রেণী এটাকে অনাসৃষ্টি ও পাপ বলে আখ্যায়িত করে এবং শাহ ওয়ালিউল্লাহকে কাফের বলে ফতোয়া দেয়।
উর্দূ তাফসির ও ব্যাখ্য গ্রন্থ:
শাহ ওয়ালিউল্লাহ তার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। তাঁর কাজে তাঁকে সাহায্য করেন তার ছেলে আব্দুল কাদির ও আব্দুল আজিজ। তাঁর দিক নিদেশনায় ছেলে আব্দুল কাদির আল কোরআনের উর্দু তাফসির করেন। আর আব্দুল আজিজ ওয়ালিউল্লাহর লেখা বই গুলোর ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থ লেখেন।
হাদিস গ্রন্থের স্তর বিন্যাস:
কোরআনের পাশাপাশি তিনি হাদিসের দরস দেয়া শুরু করেন। তিনি হাদিসের কিতাবগলোকে বিশুদ্ধতার দিক থেকে পাঁচটি স্তরে ভাগ করেন।
১ম স্তর:
শুধু সহিহ হাদিস রয়েছে এমন কিতাব। এ স্তরে আছে বুখারি মুসলিম এবং মুয়াত্তা মালেক।
২য় স্তর:
এ স্তরে প্রধানত সহিহ ও হাসান হাদিস রয়েছে। এগুলো হলো সুনানে আরবা, দারেমি ও মুসনাদে, আহমাদ।
৩য় স্তর:
সহিহ,হাসান,জইফ,মারফু ও মুনকার সকল প্রকার হদিসই এ স্তরে রয়েছে। এগুলো হলো মুসনাদে আবি ইয়ালা, মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, বায়হাকি, তাহাবি ও তাবরানি।
৪র্থ স্তর:
এ স্তরে সাধারণত জইফ ও জাল হাদিস ই রয়েছে। হাদিস বিশেষজ্ঞদের বাছাই ব্যতিত এসকল কিতাবের হাদিস গ্রহণ করা যায় না। ইবনে যাওযির কিতাব আল মাওযুয়াত, ইবনে হিব্বানের কিতাবুয জুয়াফা, আল্লামা সাগানি এর আল মাওযুয়াত।
৫ম স্তর:
উল্লেখিত চারটি স্তরে যা নেই তা ৫ম স্তরে পরবে।
রহিমিয়া মাদ্রাসার সম্প্রসারণ:
কোরআন সুন্নার জ্ঞানকে বিকশিত করার জন্য তিনি দিল্লিতে রহিমিয়া মাদ্রাসার কতগুলো শাখা চালু করেন। এগুলোর মাধ্যমে তিনি তাঁর জ্ঞান ও মতাদর্শ শিক্ষাদান ও প্রচার করতে থাকেন। যার ফলশ্রুতিতে সহিহ আকিদা সম্পন্ন একটি উদার মধ্যমপন্থি ইসলামি অনুসারীর দল তৈরি হয়ে যায়।
গ্রন্থ রচনা:
শাহ ওয়ালিউল্লাহর বড় হাতিয়ার ছিলো তাঁর লেখনি শক্তি। তিনি প্রায় দুই শত বই বা প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর সকল লেখা প্রকাশিত হয়নি। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থগুলো হলো-
হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা (ইসলামি আইনশাস্ত্র)
ফাতহুর রহমান ফি তরজমাতুল কোরআন (কোরআনের ফার্সি অনূবাদ)
ফতহুল খাবির ((কোরআনের ব্যাখ্যা গ্রন্থ)
আল ফাওযুল কাবির ফি উসুলুত তাফসির।
ইযালাতুল খিফা আন খিলাফাতুল খোলাফা
বুদুরুল বাজিগাহ
ফুয়ুদুল হারামাইন ( মক্কা মদিনার অভিজ্ঞতা )
আল কাওলুল জামিল
আত তাফহিমাতুল ইলাহিয়্যাহ
আল আকিদাতুল হাসানাহ
শরহে মুয়াত্তা (আরবি ও ফর্সি)
মিশনারিদের তৎপড়তা মোকাবেলা:
১৭৫৭ সালে বাংলায় ইংরেজরা প্রতিষ্ঠিত হলে এখানে খ্রিস্টান মিশনারিদের তৎপড়তা বেড়ে যায়। খ্রিস্টধর্ম প্রচারের পাশাপাশি তারা মুসলমানদেরকে নানাবিধ ভাবে বিভ্রান্ত করতে থাকে। এ সময় শাহ ওয়ালিউল্লাহ এবং তাঁর দুই পুত্র তাদের মোকাবেলায় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে এবং মুসলিমদের জাগরনে বুদ্ধিভিত্তিক আন্দোলন শুরু করেন। মিশনারিদের মোকাবেলায় শাহ ওয়ালিউল্লাহ,আব্দুল আজিজ ও আব্দুল কাদিরের জ্ঞানগর্ভ ও যুক্তিপূর্ণ অবদানের কারনে তৎকালে তারা ইমামে ছালাছা বা ‘তিন ইমাম’ বলে স্বীকৃতি পান।
মাজহাবের মূলনীাত ব্যাখ্যা:
শাহ ওয়ালিউল্লাহ উদারপন্থি এবং হানাফি মাজহাবের অনুসারি ছিলেন। ফিকহি মাসয়ালার ক্ষেত্রে তিনি মধ্যম পন্থা অবলম্বন করেন। তিনি মাজহাবের মূলনীতি ব্যাখ্যা করেন। আলেমদের মধ্যকার ছোটখাট মতবিরোধ মিটিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন। হিংসা, বিদ্বেষ,সংকীর্ণতা,গোড়ামী পরিহার এবং অন্ধ আনুগত্য না করার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন।
রাজনৈতিক অঙ্গনে শাহ ওয়ালিউল্লাহ:
মুঘলদের পতনের যুগে তিনি রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও কিছু কাজ করেন। তিনি আমির উমরাদের প্রকৃত মুসলিম হওয়ার জন্য চিঠি লিখতেন। সাধারন সৈনিকদেরকে তিনি ইসলামি অনুশাসনের দিকে আহবান করতেন। তিনি সুজাউদ্দৌলা ও নাজিবুদ্দৌলার মধ্যকার বিবাদ মিটিয়ে ফেলার আহবান জানিয়ে পত্র লেখেন। মারাঠদের আক্রমন থেকে মুসলমানদের রক্ষার জন্য তিনি কয়েকবার আহমদশাহ আবদালির নিকট পত্র লিখেন। তিনি ভারতে মুসলিম শাসন টিকিয়ে রাখতে চিঠি-পত্র,উপদেশ এবং লেখনির মাধ্যমে প্রাণপন চেষ্টা করেছেন।
শিয়া সুন্নি দন্দ্ব নিরসন:
মুসলিম বিশে^ শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব এক স্থায়ী সমস্যা। ভারতের তৎকালিন ক্ষমতাশীল অনেকেই শিয়া ছিলেন। যেমন সিরাজউদ্দৌলা,সুজাউদ্দৌলা সহ অনেকেই শিয়া ছিলেন। শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব ও ছিলো প্রকট। তিনি এই দ্বন্দ্ব নিরসনে কাজ করেছেন।
ওহাবি আন্দোলনের প্রাণ পুরুষ:
আমরা আগেই বলেছি যে, কোরআনের অনূবাদ করার কারনে শাহ ওয়ালিউল্লাহকেই এক দল তথাকথিত আলেম কাফের ফতোয়া দিয়েছিলো। আর তিনি যে নির্ভেজাল সংস্কার আন্দোলন শুরু করেছিলেন তার পক্ষে বিপুল অনুসারি তৈরি হয়েছিলো। তথাকথিত আলেমদের প্ররোচনায় বৃটিশ সরকার এদেরকে ওহাবি বলে গালি দিতে শুরু কলে। শাহ ওয়ালিউল্লাহর একজন উচু মানের অনুসারি ছিলেন সৈয়দ আহমদ বেরেলভী,যিনি এই সংস্কার আন্দোরনকে রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপদান করেন। যা ওহাবি আন্দোলনে হিসেবে পরিচিতি পায়। সুতরাং ভারতে ওহাবি আন্দোলন একটি নির্ভেজাল ইসলামি আন্দোলন, যে আন্দোলনের প্রাণ পুরুষ ছিলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ আরবের মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব নয়।
ছ.শাহ ওয়ালিউল্লাহ যাদেরকে অনুসরণ করেছিলেন:
শাহ ওয়ালিউল্লাহ তার জ্ঞান সাধনায় যে সকল মনীষীর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন তারা হলেন;
ইমাম মালিক ইবনে আনাস
ইমাম আবু হানিফা
ইমাম শাফেয়ী
মুহাম্মদ আল সাইবানি
আবু ইউসুফ
আল তাহাবি
ইমাম বুখারি
মীর সাইয়েদ আলী হামাদানি
আহমদ শিরহিন্দি
ইবনে তাইমিয়াহ
ইবনে হাজর আসকালানি
ইবনে রুশদ
ইবনে কাছির
আল গাজ্জালি
জ.শাহ ওয়ালিউল্লাহ এর অনুসারিবৃন্দ:
রহিমিয়া মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে এবং এর বাহিরে শাহ ওয়ালিউল্লাহ এর মতাদর্শ ও লেখনি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাঁর একটি বিশাল অনুসারি দল তৈরি হয়ে যায়, যারা তার মতাদর্শ ও ইসলামি শিক্ষার ধারাকে অব্যাহত রাখে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন;
শাহ আব্দুল কাদির
শাহ আব্দুল আজিজ
শাহ ইসমাইল
সৈয়দ আহমদ বেরেলভী
হাজি শরিয়ত উল্লাহ
মীর নিসার আলী ওরফে তিতুমীর
সৈয়দ নাজির হুসাইন
ইমদাদুল্লাহ মুহাজির মক্কী
কাশিম নানতুবি
রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী
মাহমুদুল হাসান
খলিল আহমদ শাহানপুরি
আশরাফ আলী থানভি
আনোয়ার শাহ কাশ্মিরি
হুসাইন আহমদ মাদানি
আবুল আ’লা মওদুদি
ইলিয়াস কান্ধলভী
জাকারিয়া কান্ধলভী
আল্লামা ইকবাল
ওবাইদুল্লাহ সিন্ধি
দেলওয়ার হোসাইন সাঈদী
শাহ আহমাদ শফি
ঝ.ইনতেকাল:
১৭৬২ সালের ২০ আগস্ট (২৯ মুহাররম ১১৮৬ হিজরি) জোহরের সময় ৫৯ বছর বয়সে তিনি পুরাতন দিল্লিতে ইনতেকাল করেন।
আরও পড়ুন-
ভারতীয় মুসলমানদের নবজাগরণে এবং আধুনিক শিক্ষার বিস্তারে সৈয়দ আমীর আলীর অবদান
Md. Billal Hossain
B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka
BCS General Education
Lecturer
Department of Islamic History & Culture
Chandpur Govt. College, Chandpur.
No comments:
Post a Comment