Breaking

Tuesday, 23 August 2022

হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর জীবন ও কর্ম: নবুয়ত লাভের পূর্ব পর্যন্ত

 হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর জীবন ও কর্ম: নবুয়ত লাভের পূর্ব পর্যন্ত

[ The Life of Prophet Muhammad (PBUH): Before Prophethood]


জাহিলিয়্যা যুগে যখন আবর ভূখন্ডে চরম উচ্ছৃঙ্খলতা, পাপাচার, দুরাচার, ব্যাভিচার, মিথ্যা, হত্যা, লুন্ঠন, মদ্যপান, জুয়ায় ছিল। যখন অন্যায়-অপরাধ, দ্বন্ধ-সংঘাত, সন্ত্রাস-নৈরাজ্য, নৈরাশ্য আর হাহাকার বিরাজ করছিল ঠিক এমন সময় 570 সালে মানবতার মুক্তির দিশারী সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব ও সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সারা জাহানের হিদায়েতের জন্য আবির্ভূত হলেন। রাসুল (সাঃ) হলেন বিশ্ব মানতার জন্য আল্লাহর এক অনন্য রহমত স্বরুপ প্রেরিত। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন ”আর আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্যে রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি ।” [1]





কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়-

(মরু ভাস্কর, কাজী নজরুল ইসলাম)


পিতৃ-মাতৃ পরিচিতি:

তাঁর মায়ের নাম আমিনা এবং পিতার নাম আব্দুল্লাহ। জন্মের পূর্বে পিতা, ৬ বছর বয়সে মা মারা যান। মুত্তালিবের আব্দুল মুত্তালিবের 10 ছেলের মধ্যে আব্দুল্লাহ অনিন্দ্য সুন্দর ও সুপুরুষ ছিলেন। তার চেহারায় সব সময় একটি ঔজ্বল্য ভাব পরিলক্ষিত হতো।  জাহেলিয়া যুগেও তিনি উত্তম নৈতিক চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। তার চারিত্রিক মাধুর্য, বিনয়, সদাচার, পরোপকার ইত্যাদি কারণে তিনি সবার অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। যৌবনে আব্দুল মুত্তালিব মানত করেছিলেন যে তার যদি দশটি পুত্র সন্তান হয় তাহলে তিনি একটি পুত্র সন্তান কাবা শরীফের আঙ্গিনায় কুরবানী দিবেন৷ সৌভাগ্যক্রমে তার সেই আশা পূর্ণ হয়৷ এক সময় আব্দুল মুত্তালিব তার ওয়াদা পূর্ণ করার জন্য লটারি করেন এবং প্রথমেই আব্দুল্লাহ নাম উঠে৷ কিন্তু মক্কার অন্যান্য নেতৃবৃন্দ এতে বাধা প্রদান করে৷ অতঃপর আব্দুল  মুত্তালিব ১০ বার লটারি করেন, কিন্তু দশবারই আব্দুল্লাহর নাম উঠে৷ শেষ পর্যন্ত প্রতিবারের বিনিময়ে দশটি করে উট হিসেবে মোট ১০০ টি উট কোরবানি করার বিনিময়ে আব্দুল্লার জীবন রক্ষা পায়৷ ৫৬৯-৭০ খ্রিস্টাব্দে আব্দুল মুত্তালিব বনু জোহরা গোত্রের নেতা আব্দুল ওয়াহাবের কন্যা আমিনার সঙ্গে প্রিয় কনিষ্ঠতম পুত্র আব্দুল্লাহর বিয়ে সম্পন্ন করেন৷ হযরত আমিনা ছিলেন তার সমকালীন আরবের বিদুষী নারীদের অন্যতম৷। বংশ মর্যাদা, চরিত্র, ও শিক্ষায় তার জুড়ি ছিল না ৷ কিন্তু আমিনার সাথে আব্দুল্লাহর দাম্পত্য জীবন ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত।


আরও পড়ুন:

বিদায় হজ্বের ভাষণ এবং   হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কর্তৃক ঘোষিত সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংস্কারাবলী 


জন্ম ও শৈশবঃ

মুহাম্মাদ (স.) পবিত্র মক্কা নগরীর কুরাইশ বংশের বনু হাশিম গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন।  অধিক প্রচলিত ধারনা মতে তিনি আরবি রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ,বা ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। ইউলিয়াম  মন্টগোমারি ওয়াট তাঁর জন্ম ৫৭০ সাল উল্লেখ করেছেন।তবে প্রকৃত তারিখ উদ্‌ঘাটন সম্ভবপর হয় নি। তাছাড়া মুহাম্মাদ (স.) নিজে তাঁর জন্ম সোমবার বলে উল্লেখ করেছেন কিন্তু তারিখের ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নি। ফলে রাসুল (স.) জন্ম তারিখ নিয়ে ব্যাপক মতবিরোধ রয়েছে। এমনকি মাস নিয়েও ব্যাপক মতবিরোধ পাওয়া যায়। সাইয়েদ সোলাইমান নদভী, সালমান মনসুরপুরী এবং মোহাম্মদ পাশা ফালাকির গবেষণায় এই তথ্য বেরিয়ে এসেছে যে, মহাম্মদ (স.) এর জন্ম ৫৭১ সালের ৯ রবিউল সোমবার।তবে তার জন্মের বছরেই সম্রাট নরশেরওয়ার সিংহাসনে আরোহণের ৪০ বছর পূর্তি ছিল এবং  হস্তী যুদ্ধের ঘটনা ঘটেছিল এ বিষয়ে সবাই একমত।

 

নামকরণঃ 

1. মুহাম্মদ:

হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম হওয়ার পরই মা আমেনা এ সংবাদ দাদা আব্দুল মুত্তালিবকে পাঠান। সংবাদ পাওয়ার পরেই তিনি ছুটে আসেন। পরম স্নেহে শিশুকে কোলে তুলে নিয়ে কাবাগৃহে প্রবেশ করেন। অতঃপর আল্লাহর প্রশংসা করত দোয়া করেন এবং শিশুর নাম রাখেন মোহাম্মদ তথা প্রশংসিত।

2. আহমদ:

বিবি আমিনা গর্ভাবস্থায় স্বপ্নযোগে প্রাপ্ত নাম অনুসারে ‘আহমদ’ (উচ্চ প্রশংসিত’) নাম রাখেন। বাল্যকাল হতে মুহাম্মদ ও আহমদ উভয় নামি প্রচলিত ছিল। উভয় নামই পবিত্র কুরআনে উল্লেখ রয়েছে।

দুগ্ধ পান কাল:

জন্মের পর মা সর্ব প্রথম মা আমিনা অতঃ আবু লাহাবের দাসী সুয়ায়বা তাঁকে দুধ পান করান। অতঃপর তৎকালিন রীতি অনুযায়ী তাঁর পরিবার ধাত্রীর সন্ধান করতে থাকেন। ‘হাওয়াযিন’ গোত্রের বানী সা’দ এর মহিলা হালীমাতু চ্ছাদিয়া এই বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী হন। এমন ভাবে যে, অন্য কোন ধাত্রী শিশু মুহাম্মদকে গ্রহণ করল না অন্যদিকে হালীমাও অন্য কোন শিশু পেলেন না।। ফলে বাধ্য হয়ে তারা মুহাম্মদ (স.)কে গ্রহণ করলেন। গ্রহণ করার পর থেকেই হালীমার ঘরে অবারিত বরকতের ধারা শুরু হল। দুবছর দুগ্ধ পানের পর বিবি হালীমা শিশু মুহাম্মদকে নিয়ে তাঁর মায়ের নিকট হাজির হন এবং সাথে সাথে এই আকাঙ্খাও ব্যক্ত করেন যে, শিশুকে আরো কিছু দিনের জন্য তাঁর নিকট যেন থাকতে দেয়া হয়। এদিকে মক্কায় তখন মহামারী চলছিল। উভয় দিক চিন্তা করে বিবি আমেনা তাঁর শিশুকে হালীমার নিকট ফিরিয়ে দেন। এমনি ভাবে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত হযরত মুহাম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলেহি ওয়া সাল্লাম বানী সাদে লালিত পালিত হন। সেখানে তিনি তাঁর দুধ ভাইদের সঙ্গে জঙ্গঁলে ছাগল চরাতেন।

রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পবিত্র বক্ষ বিদীর্ণ করণঃ

সহিহ বর্ণনা মেতে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পবিত্র বক্ষ মোবারক দুইবার বিদীর্ণ করা হয়।

প্রথমবার, চার বছর বয়সে দুধভাই আবদুল্লাহর সাথে চারণভূমিতে থাকাবস্থায়। হালীমার নিকটে আসার পর জন্মের চতুর্থ কিংবা পঞ্চম বছরে শিশু মুহাম্মাদ (সঃ)-এর সীনা চাক বা বক্ষ বিদারণের বিষ্ময়কর ঘটনা ঘটে। ব্যপারটি ছিল এই যে, মুহাম্মাদ (সঃ) অন্যান্য সাথীদের সাথে খেলছিলেন। এমন সময় জিবরাঈল ফেরেশতা এসে তাকে অনতিদূরে নিয়ে বুক চিরে ফেলেন। অতঃপর কলিজা বের করে যমযমের পানি দিয়ে ধুয়ে কিছু জমাট রক্ত ফেলে দিলেন এবং বললেন, 'শয়তানের যে অংশ তোমার মধ্যে ছিল, সেটা এই'। অতঃপর বুক পূর্বের ন্যায় জোড়া লাগিয়ে দিয়ে তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। পুরা ব্যপারটা খুব দ্রুত সম্পন্ন হয়ে যায়। সাথী বাচ্চারা ছুটে গিয়ে হালিমাকে খবর দিল যে, মুহাম্মাদ নিহত হয়েছে। হালিমা এবং তাঁর স্বামী এ কথা শুনে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ও অস্থির হয়ে দৌড়ে সেখানে এলেন। উপস্থিত হয়ে মুহাম্মদের মুখমণ্ডলে মালিন্য এবং পেরেশানির ভাব লক্ষ করলেন। এ অবস্থায় তাঁরা তাঁকে বাড়িতে নিয়ে এলেন। দ্বিতীয়বার বক্ষ বিদীর্ণ করা হয় মি'রাজের রাতে হাতিমে কা'বায়। 

[2]. বুখারী হা/৩৮৮৭, ৩৪৯; মুসলিম হা/১৬৪, ১৬৩; মিশকাত হা/৫৮৬২, ৫৮৬৪, ‘মি‘রাজ’ অনুচ্ছেদ। (সিরাতে ইবনে হিশাম)

আরও পড়ুন:

জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য,সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে মামলুকদের অবদান


নিজ গৃহে মুহাম্মদ (স.):

ধাত্রী মা হালিমার গৃহে বক্ষবিদারণের ঘটনায় হালিমা ও স্বামী ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। যদিও শিশু মুহাম্মদ (স.) এর মধ্যে এ ঘটনায় তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি বা কোন তিনি অসুস্থও হননি।  তিনি হালিমা এবং স্বামী  ঘটনাটির কোনো ব্যাখ্যাও দ্বার করাতে  পারেননি। তারা মোহাম্মদ (স.) নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে  শিশু মুহাম্মদকে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে যান। ছয় বছর পর্যন্ত মুহাম্মদ (স.) মায়ের কাছেই ছিলেন।

মুহাম্মদ (স.) এর মাতৃবিয়োগ:

ধাত্রী মা হালিমার গৃহে 4/5 বছর থাকার পর মোহাম্মদ (স.) আপন মায়ের কাছে ফিরে আসেন। পিতৃহারা সন্তানকে মা আমিনা সবটুকু উজাড় করে দিয়ে ভালোবাসতেন। এসময় মা আমিনা ছেলেকে নিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা করার জন্য এবং স্বামীর কবর জিয়ারত করার উদ্দেশ্যে মদিনা গমন করেন। মদিনায় তিনি মুহাম্মদ (স.) কে নিয়ে বেশ কিছুদিন অবস্থান করেন । এই সফরে তাদের যাত্রাসঙ্গী ছিলেন দাসী উম্মে আয়মান। ছাবির কবর জিয়ারত করে দাসি উম্মে আয়মান কে নিয়ে তিনি যখন মক্কার দিকে রওনা দেন তখন মক্কা এবং মদিনায় মধ্যবর্তী আবহাওয়া নামক স্থানে আসার পর মা আমিনা আকস্মিকভাবে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। 576  খ্রিস্টাব্দে ওই স্থানেই মুহাম্মদ (স.) এর 6 বছর বয়সে ঐ স্থানেই মা আমিনা ইন্তেকাল করেন। অতঃপর মাতৃ-পিতৃহীন শিশু মুহাম্মদ (স.) দাসী উম্মে আয়মানের সাথে মক্কায় ফিরে আসেন। 

দাদার তত্ত্বাবধানে মোহাম্মদ সালাহ সালাম 

জন্মের পূর্বে পিতৃহারা এবং ছয় বছর বয়সে মাতৃহারা শিশুর মুহাম্মদ (স.) এর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন  মক্কার তৎকালীন প্রধান নেতা দাদা আবদুল মুত্তালিব। পুত্রবধূর মৃত্যুর শোকে মুহ্যমান আব্দুল মুত্তালিব দৌহিত্র মুহাম্মদ (স.) কে অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং পরম মমতায় লালন পালন করতে থাকেন । কিন্তু এই আশ্রয়টুকুও বেশি দিন স্থায়ী হল না 578 খ্রিস্টাব্দে মোহাম্মদ সাল্লালাহ সালামের আট বছর বয়সে দাদা আবদুল মুত্তালিব ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পূর্বে আব্দুল মুত্তালিব পুত্র আবু তালেবকে ভাতুষ্পুত্র ভাতুষ্পুত্র ভ্রাতুষ্পুত্র মুহাম্মদ(স.) দায়িত্ব গ্রহণের জন্য ওসিয়ত করে যান।

চাচা আবু তালিবের তত্ত্বাবধানে মুহাম্মদ (স.)

পিতা-মাতা এবং দাদার ইন্তেকালের পর এবার মোহাম্মদ সাল্লালাহ সালামের তত্ত্বাবধানে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন চাচা আবু তালিব চাচা আবু তালেব মোহাম্মদ সাল্লাহ সালামকে কার্যত সন্তানদের চেয়ে অনেক বেশি আদর-যত্ন করতেন এবং তার নিরাপত্তার ব্যাপারে সজাগ ছিলেন আবু তালিব ছাত্র ছিলেন না আবু তালেব আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ছিলেন না তারপরেও তিনি ভাতিজার দায়িত্ব গ্রহণে কোনো প্রকার অবহেলা করেন নি৷ চাচার আর্থিক অসচ্ছলতা বালক মুহাম্মদ সাল্লাম বুঝতে পেরেছিলেন সেজন্যই তিনি অতি অল্প বয়সেও চাচার পারিবারিক ও ও ব্যবসায়ের কাজোসহায়তা করতেন, মাঠে বকরি চরাতেন, কখনো কখনো পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তিনি অন্যের বকরি চরাতেন৷ 

শৈশবের অলৌকিক ঘটনা:

ইবনে আসাকের জুলহামা ইবনে আরফাতা থেকে বর্ণনা করেন, আমি মক্কায় এলাম৷ মানুষ দুর্ভিক্ষের কারণে চরমভাবে সংকটাপন্ন ছিল৷ কোরাইশ বংশের লোকেরা আবু তালেব কে বললো, মক্কা উপত্যকা দুর্ভিক্ষের শিকার হয়ে আছে৷ আমাদের সন্তানাদি দুর্ভিক্ষ কবলিত৷ চলুন, বৃষ্টির জন্য দোয়া করুন৷ আবু তালিব একটি বালককে সঙ্গে নিয়ে বের হলেন৷ বালকটিকে দেখে মেঘে ঢাকা সূর্য মনে হচ্ছিল৷ আশেপাশে অন্যান্য বালকও ছিল৷ আবু তালেব বালকের হাত ধরে নিয়ে তাকে কাবা ঘরের দেয়ালের সাথে পিঠ লাগিয়ে বসিয়ে দেন৷ বালক আবু তালেবের আঙ্গুল ধরে রেখেছিল৷ সে সময় আকাশে এক টুকরো মেঘও ছিল না, কিন্তু দেখতে দেখতে এদিক-ওদিক থেকে মেঘ আসতে শুরু করে এবং এমন মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয় যাতে সমগ্র উপত্যকা সয়লাব হয়ে যায় এবং শহর প্রান্তর সজীব হয়ে ওঠে৷ পরবর্তীকালে আবু তালেব এ ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছিলেন 'তিনি সুদর্শন, তার চেহারার বরকতে বৃষ্টি প্রত্যাশা করা হয়৷ তিনি এতিমদের আশ্রয় এবং বিধবাদের রক্ষাকারী৷'

পাদ্রী  জারজিস বা বুহাইরার ভবিষ্যৎ বানীঃ

অভিভাবক দাদা আবদুল মুত্তালিব এর মৃত্যুর পর এবার মোহাম্মদ (স.) এর দায়িত্বভার অর্পিত হয় চাচা আবু তালিবের উপর। চাচা আবু তালিবের গৃহে বেড়ে উঠতে থাকেন শিশু মুহাম্মদ (স.)। চাচা আবু তালেব মুহাম্মদ (স.) কে তার সন্তানের চেয়েও বেশি আদর করতেন এবং তার নিরাপত্তার ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন থাকতেন। বালক মুহাম্মদ (স.) চাচার বিভিন্ন কাজে সহায়তা করতেন। আবু তালিব ব্যবসায়ীক কাজে সিরিয়া গমনকালে 12 বছর বয়সে মুহাম্মদ (স.) সিরি আগমন করেন।

 আরও পড়ুন:

বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান, সীমানা ও ভূপ্রকৃতির বৈশিষ্ট্যসমূহ

 



মুহাম্মদ (স.) এই প্রথমবারের মতো আরবের বাইরে গমন করলেন। সিরিয়া যাওয়ার পথে পাদ্রী বুহাইরা মক্কা থেকে আগত এই কাফেলার প্রতি বিশেষভাবে মনোযোগী হলেন। তিনি এই কাফেলাকে আমন্ত্রণ জানালেন। আবু তালিব পাদ্রির আমন্ত্রণ রক্ষা করলে মুহাম্মদ (স.) এর সাথে পাদ্রি জারজিস ওরফে বুহাইরার সাথে সাক্ষাত ঘটে।

পাদ্রী বুহাইরা/জারজিস বালক মুহাম্মাদ (সা) কে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে থাকেন। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন পাদ্রী বালক মুহাম্মাদ (সা) কে দেখে এবং তার সাথে কথা বলে তিনি চিনতে পারেন এই বালকই বহু প্রতিক্ষীত শেষ নবী হবেন। আরবসহ সমগ্র বিশ্ব থেকে পৌত্তলিকতার ধ্বংস সাধন করবেন। বিশ্বময় মহান আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করবেন।পাগড়ী বুহাইরা মোহাম্মদ সালাহ সালাম কে সিরিয়ায় না নিতে চাচা আবু তালিবকে পরামর্শ দেন তিনি এও বলেছেন যে সেখানকার ইহুদি খ্রিস্টানরা তার ক্ষতিসাধন করতে পারে তাদের উপদেশ মত চাচা আবু তালিবের আসমানকে একজন ক্রীতদাসের মাধ্যমে মক্কায় পাঠিয়ে দেন ।

 

হরবুল ফুজ্জার

উকায মেলাকে কেন্দ্র করে মক্কার কুরাইশ ও কায়েস গোত্রের মধ্যে সংঘটিত হরবুল ফোজ্জার যুদ্ধের ভয়াবহতা মহানবী (সাঃ) কে অস্থির করে তোলে। তিনি গরিব, দুর্বল, অসহায় এবং মজলুম জনগণকে জালিম ও সবল ধনীদের হাত হতে রক্ষা করার জন্য এবং আরবে শান্তি বজায় রাখার জন্য একটি শান্তি কমিটি গঠন করেন। ইতিহাসে এটাই "হিলফুল ফুজুল" বা শান্তি সংঘ নামে পরিচিত, মুহাম্মাদের (সা) বয়স তখন ১৫/২৫ বছর। কুরাইশ ও কাইস গোত্রের মাঝে পুরানো শত্রুতার কারণে যুদ্ধ বাঁধে। এই যুদ্ধে কুরাইশগণ ন্যায়ের উপর ছিলো। মুহাম্মাদ (সা) কুরাইশদের পক্ষে যুদ্ধে যান। কিন্তু তিনি কারো প্রতি আঘাত হানেন নি। যুদ্ধে কুরাইশদের জয়ী হয়। এই যুদ্ধেরই নাম ফিজারের যুদ্ধ।

 

হিলফুল ফুজুল:

হিলফুল ফুজুল একটি সংঘ বিশেষ। এর অর্থ হলো কল্যাণের শপথ। হিলফ অর্থ শপথ, প্রতিজ্ঞা, চুক্তি ইত্যাদি। ফুযুল শব্দটি ফযিলত এর বহুবচন। অর্থ মঙ্গল, কল্যাণ ইত্যাদি।"হিলফুল ফুজুল" শব্দের অর্থ হল "শান্তিসংঘ"। কারো মতে যারা এই সংগঠন প্রতিষ্ঠায় যুক্ত ছিলেন তাদের অনেকের নাম ছিল ফজল, ফজল এর বহুবচন ফুজুল, এই সুত্র ধরে সংগঠনটির নাম করণ করা হয় হিলফুল ফুজুল বা ফজল নামীয় ব্যক্তিদের সংঘ/সমিতি ।

এটি হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) ২০/২৫ বছর বয়সে বা ৫৯০/৯৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন। আবার কেও কেও বলেন, এটি ৫৮৭ সালে রাসুল (সঃ) এর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত  হয়। রাসুল (সঃ) সমাজের কল্যাণ বয়ে আনার জন্য এটি প্রণয়ন করেন।

এটির মূল উদ্দেশ্য ছিলোঃ

  1. গরিব-দুঃখী,অসহায়দের ও এতিমদের সাহায্য করা;

  2. সামাজিক শান্তি-শৃংখলা প্রতিষ্ঠা করা;

  3. রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করা;

  4. বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি স্থাপন;

  5. বিদেশী বনিক ও পর্যটকদের নিরাপত্তা বিধান করা;

  6. জালিমকে বাধা দেয়া 

  7. মাজলুমদের সাহায্য করা, ইত্যাদি। 

হাজরে আসওয়াদ নিয়ে বিরোধের মীমাংসাঃ  

একবার পাহাড় থেকে বয়ে আসা ঢলের পানির কারণে কাবা ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এর দেয়াল ভেঙে যায়৷ কয়েক বছর সেটা মেরামত না হওয়ার কারণে কাবা ঘর জরাজীর্ন হয়ে পড়ে৷ সেটাকে জরুরী ভিত্তিতে মেরামতের প্রয়োজন দেখা দিলে কুরাইশরা কাবা ঘর মেরামত শুরু করে৷ এ সময় হাজারে আসওয়াদকে সরিয়ে এক পাশে রাখা হয় কাবা ঘরের সংস্কার শেষ হওয়ার পর হাজরে আসওয়াদ টি যথাস্থানে রাখার বিষয়ে প্রত্যেক গোত্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়৷ কারণ এই সম্মানিত পাথরটিকে যথাস্থানে রাখার কাজটি করার জন্য প্রত্যেকটি গোত্রই আগ্রহী ছিল এ সময় এ সময় আবু উমাইয়া ইবনুল মুগীরা একটি প্রস্তাব দেন যে, আগামীকাল প্রত্যুষে সর্বপ্রথম যে কাবাঘরে প্রবেশ করবে তাকেই এই সমস্যা মীমাংসার দায়িত্ব দেওয়া হবে৷ এতে সবাই সম্মতি জ্ঞাপন করে৷ অতঃপর দেখা গেল অতি প্রত্যুশে  ধীর পদে এগিয়ে আসছেন যুবক মোহাম্মদ (সা.)৷ এতে সবাই অত্যন্ত খুশি হলো, তারা সমস্যার সমাধানের জন্য যোগ্য ব্যক্তিকেই পেয়েছেন৷ পাথর স্থাপন সংক্রান্ত বিরুধ নিষ্পত্তির দায়িত্ব দেওয়া হল মুহাম্মদ (স.) কে৷ এবার মুহাম্মদ সাল্লাম একটি চাদর আনার নির্দেশ দিলেন৷ অতঃপর চাদর আনা হলে তিনি নিজ হাতে হাজারে আসওয়াদটি চাদরের মাঝখানে রাখেন৷ অতঃপর বিবদমান প্রত্যেকটি গোত্রের প্রধানকে চাদরের চারপাশ ধরে পাথরটিকে যথাস্থানে নিয়ে যাওয়া নির্দেশ দেন৷ সকল গোত্রপতি মিলে যখন পাথরটিকে নিয়ে যাওয়া হল তখন মোহাম্মদ সালাহ সালাম নিজ হাতে পাথরটি কাবা শরীফের যথাস্থানে স্থাপন করেন৷ এতে সবাই খুশি হল এবং একটি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ থেকেও তারা রক্ষা পেল৷ 

আল আমিন উপাধি লাভ:

ছোটবেলা থেকেই মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সততা, ন্যায়পরায়ণতা, মানবতাবাদ, আমানতদারী ছিল প্রশ্নাতীত৷ তার ছোটবেলা থেকেই আরবরা লক্ষ্য করেছেন যে মুহাম্মদ (স.) কখনো মিথ্যা বলেন না, কোন আমানত গচ্ছিত রাখা হলে তা  বিশ্বস্ততার সাথে তিনি সংরক্ষণ করেন৷ তিনি কখনোই ওয়াদা ভঙ্গ করেন নি ৷ তার এ সমস্ত গুণাবলীর কারণে এই উশৃংখল আরববাসীও হযরত মুহাম্মদ সাঃ কে আল-আমিন বা বিশ্বস্ত উপাধি দিয়েছিল৷ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর আমানতদারী এবং বিশ্বস্ততার একটি জ্বলন্ত প্রমাণ রয়েছে তার  হিজরতকালিন রাত্রে৷ সেই রাত্রে তিনি তার কাছে গচ্ছিত আমানত সমূহ মাবিককে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য হযরত আলীকে তার বিছানায় শুয়ে রেখেছিলেন৷ এবং আমানতগুলো পরের দিন যথাযথভাবে পৌঁছে দেওয়া নির্দেশ দিয়েছিলেন৷ জীবন মৃত্যুর এই কঠিন মুহূর্তেও তাঁর আমানতদারির বিন্দুমাত্র ঘাটতি হয়নি৷

রাখাল বালক ও ব্যবসায়ী হিসেবে মুহাম্মদ (স:)

তরুণ বয়সে মুহাম্মাদের তেমন কোনো পেশা ছিল না। তবে তিনি বকরি চরাতেন বলে অনেকেই উল্লেখ করেছেন। সাধারণত তিনি যে বকরিগুলো চরাতেন সেগুলো ছিল বনি সা'দ গোত্রের। কয়েক কিরাত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তিনি মক্কায় বসবাসরত বিভিন্ন ব্যক্তির বকরিও চরাতেন। এরপর তিনি ব্যবসায় শুরু করেন। মুহাম্মাদ অল্প সময়ের মধ্যেই একাজে ব্যাপক সফলতা লাভ করেন। ব্যবসায় উপলক্ষে তিনি সিরিয়া, বসরা, বাহরাইন এবং ইয়েমেনে বেশ কয়েকবার সফর করেন। অভিজাত সতী, ধনবতী, মহিলা খাদিজা বিভিন্ন লোককে পণ্য দিয়ে ব্যবসা করাতেন এবং তিনি লাভের একটা অংশ গ্রহণ করতেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর সততা, সত্যবাদীতা ও বিশ্বস্ততা তখন সুবিদিত ছিল। আল-আমীন, আসসাকিন এর প্রশংসা শুনে তিনি তার কাছে ব্যবসার প্রস্তাব পাঠান। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) রাজী হন এবং মুহাম্মাদ এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং খাদিজার পণ্য নিয়ে সিরিয়ার অন্তর্গত বসরা পর্যন্ত যান।ব্যবসা শেষে অনেক বেশি লাভসহ তার সব কিছু বুঝিয়ে দেন।


খাদীজা (রাঃ) এর সঙ্গে বিবাহঃ

খাদিজা তার ব্যবসায়ীক কর্মচারী মাইসারার মুখে মুহাম্মদ (স.) এর সততা ও ন্যায়পরায়ণতা ও ভূয়সী প্রশংসা শুনে অভিভূত হন। এছাড়া ব্যবসায়ের সফলতা দেখে তিনি তার যোগ্যতা সম্বন্ধেও অবহিত হন। এক পর্যায়ে তিনি মুহাম্মাদকে বিবাহ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি স্বীয় বান্ধবী নাফিসা বিনতে মুনব্বিহরের কাছে বিয়ের ব্যাপারে তার মনের কথা ব্যক্ত করেন। নাফিসার কাছে শুনে মুহাম্মাদ বলেন যে তিনি তার অভিভাবকদের সাথে কথা বলে জানাবেন। মুহাম্মাদ তার চাচাদের সাথে কথা বলে বিয়ের সম্মতি জ্ঞাপন করেন। বিয়ের সময় খাদিজার বয়স ছিল ৪০ আর মুহাম্মাদের বয়স ছিল । যতদিন তিনি জীবিত ছিলেন রাসূল (সা:) আর কোনো বিয়ের প্রয়োজন অনুভব করেননি। এরপর আদর্শিক প্রয়োজনে এবং নারী সমাজের বিভিন্ন উপকারের জন্য তিনি মোট ১১টি বিয়ে করেন। দু’জন তার মৃত্যুর পূর্বে মারা যান আর ৯ জনের সাথে তিনি বৈবাহিক জীবন অতিবাহিত করেন।

খাদিজার গর্ভে মুহাম্মাদ (সঃ)এর ছয় জন সন্তান জন্মগ্রহণ করে, যার মধ্যে চার জন মেয়ে এবং দুই জন ছেলে। তাদের নাম যথাক্রমে কাসিম, জয়নাব, রুকাইয়া, উম্মে কুলসুম, ফাতিমা এবং আবদুল্লাহ। ছেলে সন্তান দুজনই শৈশবে মারা যায়। মেয়েদের মধ্যে সবাই ইসলামি যুগ পায় এবং ইসলাম গ্রহণ করে ও একমাত্র ফাতিমা ব্যতীত সকলেই তার জীবদ্দশায়ই মৃত্যুবরণ করে। 

আরও পড়ুন:

বাংলাদেশের সমাজ ও জনজীবনে ভূ প্রকৃতির প্রভাব




Md. Billal Hossain

B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka

BCS General Education

Lecturer

Department of Islamic History & Culture

Chandpur Govt. College, Chandpur.

No comments:

Post a Comment