Breaking

Sunday 28 August 2022

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বৃহৎ শক্তিবর্গের ভূমিকা

                  

                  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বৃহৎ শক্তিবর্গের ভূমিকা

(The role of the big powers in the liberation war of Bangladesh)


1971 সালে বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের আবির্ভাব বিশ্ব ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। সেই সাথে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তৎকালীন বিশ্ব রাজনীতিকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে। বাহ্য দৃষ্টিতে বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধ হলেও ভারতসহ বিশ্বের পরাশক্তি গুলো এতে জড়িয়ে পড়ে। ভারত এবং পরাশক্তির রাশিয়ার ভূমিকা ছিল স্বাধীনতার পক্ষে, অন্যদিকে চীন ও পুঁজিবাদী পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে। তবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পেছনে তাদের আলাদা আলাদা উদ্দেশ্য ছিল। তাই বাংলাদেশ পাকিস্তান যুদ্ধ হলেও প্রকৃতপক্ষে তা পাক-ভারত যুদ্ধে পরিণত হয়। সর্বোপরি রুশ-আমেরিকান ঠান্ডা যুদ্ধের উত্তাপ বিকিরণ করে। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাশিয়ার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা পাকিস্তানের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের গৃহীতসকল পদক্ষেপকেই নস্যাৎ করে দেয়। তাই রাশিয়ার কূটনৈতিক তৎপরতা এবং যুদ্ধে ভারতের সর্বাত্মক সহযোগিতা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করে। 





মুক্তিযুদ্ধে প্রভাব বিস্তারকারী পরাশক্তিসমূহ:


ক্রম

পরাশক্তির নাম

তৎকালীন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীন নেতা

1 .

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (USA)

প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন

3.

সোভিয়েত ইউনিয়ন (USSR)

প্রধানমন্ত্রী নিকোলাই পদগর্নি

4.

গণচীন (PRC)

প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই 

5.

ভারত

ইন্দিরা গান্ধী

6.

জাতিসংঘ (বিশ্ব সংস্থা)

মহাসচিব, উথান্ট (মায়ানমার)



বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তিনটি দিক

  1. বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধ

  2. ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ

  3. যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া যুদ্ধ



আরও পড়ুন-
বাঙ্গালি জাতির নৃতাত্ত্বিক পরিচিতি,  Ethnographic identity of the Bengali nation


পরাশক্তিগুলোর উদ্দেশ্য

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পরাশক্তিগুলোর ভূমিকা মূল্যায়ন এর পূর্বে তাদের উদ্দেশ্য জানা আবশ্যক। বিশ্ব তখন দুটি প্রধান বলয়ে বিভক্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পুঁজিবাদী ব্লক আর রাশিয়ার নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক ব্লক। 



মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য:

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ছিল তার ব্লকের রাষ্ট্র পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষা করা। ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার পরাজয় এবং রাশিয়ার কূটনৈতিক বিজয় ঘটেছিল। তাই এখানে যেন আরেকটি পরাজয় না ঘটে সেজন্য বাংলাদেশ ইস্যুতে স্নায়ুযুদ্ধের অংশ হিসেবেই পাকিস্তানের পক্ষ নয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যেহেতু ভারত-রাশিয়ার ব্লকে আছে তাই বাংলাদেশ ইস্যুতে রাশিয়ার কাছে হারতে চাইল না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সাথে বিভিন্ন সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ ছিল। ফলে রাজনৈতিক মিত্র এর পাশাপাশি সামরিক মিত্র হিসেবে পাকিস্তানকে সহায়তা করা তারা দায়িত্ব মনে করে। 



রাশিয়ার উদ্দেশ্য:

রাশিয়ার উদ্দেশ্য ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর আরেকটি যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পরাজিত করা। বাংলাদেশ ইস্যু রাশিয়ার হাতে চলে আসে। ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করছে, আর ভারত-রাশিয়ার অন্যতম মিত্র। ভারতের পরাজয় মানে রাশিয়ার পরাজয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে জয়ী হলে এখানে মার্কিন আধিপত্য বিস্তার ঘটবে যা রাশিয়ার জন্য ছিল হুমকিস্বরূপ। তাই ভারতের মাধ্যমে রাশিয়া বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করে। 


চীনের উদ্দেশ্য: 

চীন তখন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ লাভের দ্বারপ্রান্তে ছিল। চীন-আমেরিকান ব্লকে থাকায় পাকিস্তান তার অন্যতম মিত্র ছিল। তাছাড়া রাশিয়া ও ভারতের সাথে তার সম্পর্কের পটভূমির কারণেই চীন পাকিস্তানকে সমর্থন করে এবং যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে থেকে ছিল। 


ভারতের উদ্দেশ্য: 

ভারত পাকিস্তানের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর।মুহাম্মদ ঘুরীর ভারত অভিযানের পর থেকে ভারতীয় কোন হিন্দু নেতৃত্ব ক্ষমতাশীল মুসলিমদের বিরুদ্ধে কোন যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারেনি।স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধও ছিল অমীমাংসিত। তাই 1971 সালের যুদ্ধের মাধ্যমে ভারত সে সুযোগ কাজে লাগাতে চাইল।বল ছিল ভারতের কোর্টে। ভারতের দুই দিকে  পাকিস্তান থাকায় এটা ছিল ভারতের জন্য একটা বড় ধরনের অস্বস্তির কারণ । পাকিস্তানের এইরকম ভৌগলিক অবস্থানের ফলে ভারত তেমন শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারেনি পাকিস্তানের বিপক্ষে। তাই ভারতের মূল উদ্দেশ্য ছিল বহুকাল পর একটি যুদ্ধে জয়লাভ করা। পাকিস্তানকে একটি সমুচিত শিক্ষা দেওয়া এবং পাকিস্তানের একটি হাত তথা পূর্ব পাকিস্তানকে স্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা।


আরও পড়ুন-

বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান, সীমানা ও ভূপ্রকৃতির বৈশিষ্ট্যসমূহ



বাংদেশের মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা:


মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল খুবই হতাশাব্যঞ্জক ও বিতর্কিত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির চারটি পর্যায়ে ছিল। 


প্রথম পর্যায়: (মার্চ-জুলাই)

এ সময় মার্কিন নীতির প্রকৃতি ছিল কৌশলগত নিরপেক্ষতা। এ সময় মার্কিন সরকার বাংলাদেশের সমস্যাকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হিসেবে অভিহিত করে। কিন্তু ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং ওয়াশিংটনের এই নীতির বিরোধিতা করেন। পত্রপত্রিকার প্রতিবাদে ও প্রবল জনমতের চাপে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্য সমরাস্ত্র ও অর্থসাহায্য স্থগিত করে এবং নিক্সন প্রশাসন সমস্যাটির রাজনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানান। তবে গোপনে অস্ত্র পাকিস্তানের যাচ্ছে বলে অভিযোগ করলে এগুলো আগের চুক্তির ভিত্তিতে সরবরাহ করা হচ্ছে বলে যুক্তরাষ্ট্র জানায়। এদিকে মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র ভারতে শরণার্থীদের জন্য 30 লক্ষ মার্কিন ডলার সাহায্য বরাদ্দ দেয়। 


দ্বিতীয় পর্যায়:(জুলাই-আগস্ট )

এ পর্যায়ে মার্কিন নীতির দুটি দিক লক্ষণীয়। রাশিয়াকে প্রতিরোধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। হেনরি কিসিঞ্জারের হঠাৎ করে বেইজিং সফরের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তান ঘেষা নীতি সক্রিয় হয়ে উঠে। হেনরি কিসিঞ্জার ঘোষণা দেন যে, ভারত পাকিস্তানের আগ্রাসন চালালে চীন হস্তক্ষেপ করবে।


দ্বিতীয়তঃ যুক্তরাষ্ট্র ধারণা করেছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে জুলাই মাসে রুশ ভারত পরিকল্পনা চূড়ান্ত হতে পারে তাই এ পরিকল্পনা মোকাবেলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তৎপর হয়। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য ছিল অখণ্ড পাকিস্তানের অধীনে একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করা এবং যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়া । কিন্তু এর কোনোটি সম্ভব হয়নি।


তৃতীয় পর্যায়: (সেপ্টেম্বর- 3 ডিসেম্বর) 

এই পর্যায়ে নিক্সন প্রশাসন আরো বেশি পাকিস্তানপন্থী নীতি অবলম্বন করে। ভারতে অবস্থানকারী বাঙালি নেতৃবৃন্দের একাংশের সঙ্গে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে পাকিস্তানের সাথে সমঝোতার চেষ্টা করা হয়  এবং পাকিস্তান সরকারকে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানে চাপ দেয়। কিন্তু মুজিবনগর সরকার ও ভারত সরকার উভয়ই এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। এদিকে ইন্দিরা গান্ধীও যুক্তরাষ্ট্র সফর করে যুক্তরাষ্ট্রকে পাকিস্তানপন্থি নীতি থেকে সরিয়ে আনতে ব্যর্থ হন। এতে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে গেলেও বেসরকারিভাবে মার্কিন সংবাদপত্র, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদসহ সর্বস্তরের মার্কিন জনগণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ভূমিকা পালন করে। অনেক আমলাও বাঙালির প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত জর্জ হ্যারিসনের ‘বাংলাদেশ কনসার্ট’ ছিল মুক্তিযুদ্ধের এক বিরাট অনুপ্রেরণা।



চতুর্থ পর্যায়: (3 ডিসেম্বর- স্বাধীনতা)

3 ডিসেম্বরপাক ভারত যুদ্ধ শুরুর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র প্রচন্ড ভারতবিরোধী ও পাকিস্তান ঘেষা নীতি অনুসরণ করতে থাকে। পাকিস্তানকে যাবতীয় নৈতিক ও কূটনৈতিক এবং সামরিক সমর্থন দানের  জন্য প্রেসিডেন্ট নিক্সন হেনরি কিসিঞ্জার কে নির্দেশ দেন। তারে নীতিকে বলা হয় Tilt Policy।  এবং 6 ডিসেম্বর আমেরিকা ভারতে অবস্থিত শরণার্থীদের জন্য বরাদ্দকৃত 86.6 মিলিয়ন ডলার সাহায্য সাময়িক স্থগিত করে। ভারতকে আক্রমনকারী উল্লেখ করে দিল্লী ও মস্কোর প্রতি চাপ প্রয়োগ করতে যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর USS Enterprise  বঙ্গোপসাগরে পাঠায়। এ সময় 4 ও 12 ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ও দ্বিতীয় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করে, কিন্তু রাশিয়ার ।ভেটোর কারণে দুটি প্রস্তাবই নাকচ হয়ে যায়। যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব বাতিল হওয়ার অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া। 


আরও পড়ুন-

বাংলাদেশের সমাজ ও জনজীবনে ভূ প্রকৃতির প্রভাব



বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে রাশিয়ার ভূমিকা:

মুক্তিযুদ্ধে রাশিয়ার নীতির তিনটি পর্যায়ে ছিল



প্রথম পর্যায়:  (মার্চ-জুন)

বাঙালি গণহত্যাকে রাশিয়া প্রথমে নিন্দা জানায়। প্রথমদিকে রাশিয়ার সর্তকতা লক্ষণীয় ।1971 সালের 30 মার্চ কমিউনিস্ট পার্টির 24 তম কংগ্রেসে ব্রেজনেভ ভাষণে পূর্ব বাংলার জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকারের ভিত্তিতে রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছার কথা উল্লেখ করেন রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোলাই পদগর্নি। এ সময় তিনি 2 এপ্রিল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে পাঠানো একটি চিঠিতে রক্তপাত ও নির্যাতন বন্ধ করে শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করার জন্য আহ্বান জানান।


দ্বিতীয় পর্যায় (জুলাই-নভেম্বর)

9-10 জুলাই কিসিঞ্জারের চীন সফর উপমহাদেশ কূটনৈকি বিল্পব ঘটে। তিনি পিকিং থেকে ফিরেই ঘোষণা করেন, ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করলে চীন হস্তক্ষেপ করবে এবং আমেরিকা ভারতের সাহায্যে নাও এগিয়ে আসতে। এরপর ভারত ও রাশিয়া পারস্পারিক নিরাপত্তার অভাব রোধকল্পে অন 1971 সালের 9 আগস্ট রুশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তি পাকিস্তানকে নৈতিকভাবে দুর্বল দুর্বল করে ফেলে । রাশিয়া শান্তিপূর্ণ নীতি থেকে সরে এসে ভারতের পক্ষে সক্রিয় নীতি গ্রহণ করে।


শেষ পর্যায়:  (3 ডিসেম্বর-স্বাধীনতা পর্যন্ত)

পাকিস্তান শান্তিপূর্ণ সমাধানে ব্যর্থ হওয়ায় রাশিয়াভারতীয় কর্মকাণ্ডকে সরাসরি সমর্থন দেয়। 3 ডিসেম্বর চূড়ান্ত চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হলে রাশিয়া যুদ্ধের জন্য সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করে। রাশিয়া জাতীয় স্বার্থে নিষ্ক্রিয় থাকবে না বলেও হুমকি দেয়। তবে রাশিয়া একটি বড় যুদ্ধে জড়াতে চায়নি। এই পর্যায়েও রাশিয়া বাংলার মানুষের ইচ্ছা অনুযায়ী নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর কে প্রাধান্য দেয়। কিন্তু পাকিস্তান তা প্রত্যাখ্যান করে। যুদ্ধ ভয়াবহ রূপ নিলে রাশিয়া যুদ্ধবিরতি বিলম্ব করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, যেন ভারতীয় বাহিনী সামরিক বিজয়ের প্রয়োজনীয় সুযোগ পায়। তাই নিরাপত্তা পরিষদে যতবার যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ বিরোধী প্রস্তাব উত্থাপন করে রাশিয়ার ততবার ভেটো প্রয়োগ করে সেটাকে বানচাল করে দেয়।  ভারতীয় বাহিনীর ঢাকা দখলের পূর্ব পর্যন্ত যেকোনো যুদ্ধবিরতি বানচাল করাই ছিল রাশিয়ার এই নীতির মূল লক্ষ্য। 16 ডিসেম্বর পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করলে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। তাই মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস গণহত্যার বিরুদ্ধে ও বাঙালির ন্যায় সঙ্গত দাবীর পক্ষে রাশিয়া কার্যকরি ভূমিকা রাখে।



বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চীনের ভূমিকা: 

মুক্তিযুদ্ধে চীনের  নীতির দুটি পর্যায় ছিল


প্রথম পর্যায়:  (এপ্রিল-নভেম্বর)

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পরই চীন কট্টর পাকিস্তান ঘেষা  নীতি অনুসরণ করে। চীন শুরু থেকেই রাশিয়ার সাথে ভারতের সম্পর্কের ভিত্তিতে বাংলাদেশ বিষয়ে তার নীতি নির্ধারণ করে। ভারত ভারত এবং রাশিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে এখানে ভারতের আধিপত্যের বিস্তার ঘটবে, সেজন্যই চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেয়। 1971 সালের 25 মার্চ গণহত্যার 15 দিন পর ইয়াহিয়া খানকে দেওয়া এক পত্রে চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই পাকিস্তানে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ এর বিরুদ্ধে এবং পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব, জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষায় চীনের সমর্থনের আশ্বাস দেন। তিনি বাংলাদেশ সমস্যাকে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যা বলে উল্লেখ করে পাকিস্তানের ঐক্যের' উপর জোর দেন। যদিও চীন মুক্তিযুদ্ধে অত্যন্ত কৌশলী ভূমিকা নেয়। বারবার পাকিস্তানের অনুরোধ সত্বেও চীন কোন সামরিক চুক্তি করতে রাজী হয়নি।


দ্বিতীয় পর্যায়: (13-16 ডিসেম্বর)

3 ডিসেম্বর চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হলে চীন জাতিসংঘে সরাসরি রাশিয়া,ভারত ও বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান নেয়।ভারত কে আক্রমণকারী বলা হয়। 5 ও 6 ডিসেম্বর রাশিয়ার  দুটি প্রস্তাবে চীনই প্রথম ভেটো প্রদান করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে চীন এক বিবৃতিতে বাংলাদেশকে রুশ-ভারতের সৃষ্টি বলে মন্তব্য করে এবং তথাকথিত বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য রাশিয়া ও ভারতের তীব্র সমালোচনা করে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সক্রিয় চীনপন্থী কমিউনিস্টরা মুক্তিযুদ্ধকে দুই কুকুরের কামড়া কামড়ি বলে আখ্যায়িত করে। পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর যেসব অস্ত্র উদ্ধার হয় সেগুলোর 60% চীনের এবং 40% মার্কিন ছাপ ছিল। এর মাধ্যমে তথাকথিত নিপীড়িত জনগণের বন্ধু হিসেবে দাবিদার চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হীন ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে উঠে।


আরও পড়ুন-

খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজ।। ইসলামের পঞ্চম খলিফা



বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা:

মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় নীতির  তিনটি পর্যায়ে ছিল


মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা ছিল সবচাইতে মুখ্য। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন তাদের মানবিক, আর্থিক, সামরিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ভূমিকায মুক্তিযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করেছে। মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় নীতির  তিনটি পর্যায়ে ছিল-


প্রথম পর্যায়: (মার্চ-জুলাই)

এই পর্যায়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা বা বাংলাদেশকে সরাসরি সাহায্য দেওয়ার ব্যাপারে ভারতের সরকারি মহল আগ্রহী ছিল না।এ সময় ভারত সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেয়, বাংলাদেশ সরকারকে অবাধে ভারতীয় এলাকায় রাজনৈতিক তৎপরতা চালানোর সুযোগ দেয়। এসময় প্রতিদিন গড়ে 20 25 হাজার শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করে। মে মাসে RAW এর তত্ত্বাবধানে গঠিত হয় মুজিব বাহিনী।বাংলার চার দিক দিয়ে ভারতের অভ্যন্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেওয়া হয়, কলকাতায় প্রবাসী সরকার গঠন ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপনে সহায়তা করে ভারত। হেনরি কিসিঞ্জার ইন্দিরা গান্ধীকে মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সহায়তা প্রত্যাহারের অনুরোধ করে ব্যর্থ হন। 


দ্বিতীয় পর্যায়: (আগস্ট-নভেম্বর)

জুলাই মাস থেকে ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানের বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটি নিয়মিত ধ্বংস করতে থাকে। এ মাসে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তান সমঝোতায় পৌঁছলে ভারত রাশিয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়ে এবং 9 আগস্ট রুশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর ফলে ভারত বাংলাদেশের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেয়। গান্ধী মস্কো সফর করলে তাকে সহায়তার আশ্বাস দেওয়া হয়। ভারত-রাশিয়া সামরিক চুক্তি পাকিস্তান,চীন ও যুক্তরাষ্ট্র কে নৈতিকভাবে দুর্বল করে ফেলে। যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন পাকিস্তানকে সমর্থন দিলেও চীন এই সময়ে পাকিস্তানের সাথে সরাসরি কোনো সামরিক চুক্তি করতে রাজী হয়নি।


তৃতীয় পর্যায়:(3-16 ডিসেম্বর)

3 ডিসেম্বর ভারতের বিমান ঘাঁটিতে পশ্চিম দিক দিয়ে পাকিস্তান হামলা চালালে চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হয়। পাকিস্তানের মনে হয়েছিল পশ্চিম দিক দিয়ে ভারত কে ব্যস্ত রাখলে তারা হয়তো পূর্ব পাকিস্তান থেকে সরে যাবে কিন্তু তাদের ধারণা ছিল ভুল।ভারত উভয় ফ্রন্টেই যুদ্ধ করে। 6 ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ভারতীয় বাহিনী স্থল ও নৌ ও বিমান পথে যুদ্ধ শুরু করে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। পাকিস্তান প্রতিটি ক্ষেত্রেই পরাজিত হয়। সম্মিলিত বাহিনী 15 ডিসেম্বর ঢাকা দখল করে নেয়। 16 ডিসেম্বর পাক বাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি যৌথ বাহিনীর প্রধান জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেন।


সুতরাং মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ যা করতে পারেনি ভারত তাই করেছে। 70 সালের নির্বাচনে জয়লাভ পর্যন্ত বাঙালিদের অবদান। 25 মার্চ পর্যন্ত অস্থির অবস্থা। এরপর বাংলাদেশের কোন নেতার পক্ষে বিদেশীদের কাছে যাওয়ার সুযোগ ছিলনা। বিদেশিদের কাছে ধরনা ধরেছে ভারত, ঢাকার হয়ে কাজ করেছে কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গ, আর ভারত করতে পেরেছে রাশিয়ার কারণে।এখানে প্রতিটি পরাশক্তির স্বার্থ রয়েছে। তো কিছু স্বার্থ জড়িত থাকলেও একমাত্র দেশ ভারত যে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা রেখেছে । ভারতের উদ্দেশ্য এবং স্বার্থ যা-ই থাকুক না কেন ভারত সরকার সে সময়ে যে ভূমিকা রেখেছে তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ত্বরান্বিত করেছে। 


আরও পড়ুন-

বিদায় হজ্বের ভাষণ এবং হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কর্তৃক ঘোষিত সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংস্কারাবলী 




Md. Billal Hossain

B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka

BCS General Education

Lecturer

Department of Islamic History & Culture

Chandpur Govt. College, Chandpur.

No comments:

Post a Comment