আমির দোস্ত মুহাম্মদ খান
[Amir Dost Mohammad Khan]
(1826-1863)
আমির দোস্ত মোহাম্মদ আফগানিস্তানের ইতিহাসে এক খ্যাতিমান পুরুষ এবং দুররানি বংশের বারাকযায়ী বা মুহাম্মদযায়ী শাখার প্রতিষ্ঠাতা । শুভাষী, সুযোগ্য এবং নানাবিধ গুণাবলীর অধিকারী দোস্ত মোহাম্মদ স্বীয় দক্ষতা বলে ,1826 সালে বিশৃংখল আফগানিস্থানে আহমদ শাহ দুররানী প্রতিষ্ঠিত সাদুযায়ী রাজবংশের ধ্বংস স্তুপের উপর বারাকযায়ী শাখার গোড়াপত্তন করেন। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া রাজ্য গুলোর উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে তিনি আফগানিস্থানে একটি স্থিতিশীল কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি পরাশক্তি রাশিয়া এবং বৃটেনের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু পরাশক্তিগুলোর সাম্রাজ্যবাদী নীতি এবং দোস্ত মুহাম্মদ এর কিছু দুর্বলতার কারণে 1838-42 সাল পর্যন্ত তিনি রাজ্যহারা হন। স্বাধীনচেতা আফগানদের সমর্থন নিয়ে 1842 সালে তিনি পুনরায় ক্ষমতায় আসেন এবং 1863 সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ছিলেন। ধীরে ধীরে সকল রাজ্য গুলির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে তিনি বারাকজায়ী রাজবংশকে একটি সুদৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে সক্ষম হন।
আমির দোস্ত মোহাম্মদ এর পরিচিতি:
দোস্ত মুহাম্মদ খান ছিলেন আফগানিস্তানের বারাকজাই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা এবং আফগানিস্তানের একজন আমির।তিনি দুররানি রাজবংশের পতনের পর আফগানিস্তানের আমির হন। ১৮২৬সাল থেকে ১৮৩৯সাল এবং ১৮৪৫সাল থেকে ১৮৬৩সাল এই দুই মেয়াদে তিনি আমিরের দায়িত্বপালন করেছেন। তিনি জাতিগতভাবে একজন পশতুন ছিলেন। তিনি তার পিতা এবং বারাকজাই গোত্রের প্রধান সর্দার পায়েন্দা খানের একাদশ পুত্র। পায়েন্দা খান ১৭৯৯ সালে জামান শাহ দুররানি কর্তৃক নিহত হয়েছিলেন।দোস্ত মুহাম্মদ খানের দাদা ছিলেন হাজি জামাল খান।দোস্ত মুহাম্মদ খান ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ ডিসেম্বর কান্দাহারের একটি প্রভাবশালী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার বাবা পায়েন্দা খান ছিলেন বারাকজাই গোত্রের প্রধান এবং দুররানি সাম্রাজ্যের একজন বেসামরিক কর্মচারী।
তার বড় ভাই এবং বারাকজাই প্রধান ফাতেহ খান 1800 খ্রিষ্টাব্দে মাহমুদ শাহ দুররানির ক্ষমতা লাভ এবং ১৮০৯সালে পুনরায় ক্ষমতা লাভে সহায়তা করেছিলেন। আক্রমণকারী শিখদের বিরুদ্ধে আটোকের যুদ্ধে দোস্ত মুহাম্মদ খান তার বড় ভাই এবং কাবুলের প্রধানমন্ত্রী উজির ফাতেহ খানের সাথে ছিলেন। ১৮১৮ সালে মাহমুদ শাহ দুররানি কর্তৃক ফাতেহ খান নিহত হন। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর মাহমুদ শাহ হেরাত ছাড়া তার শাসনাধীন বাকি অংশের নিয়ন্ত্রণ হারান এবং সে সকল অংশ ফাতেহ খানের ভাইদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। সে সকল অংশের মধ্যে দোস্ত মুহাম্মদ খান গজনি অধিকার করেছিলেন। ১৮২৬ সালে তিনি সে সময়ের সবচেয়ে সম্পদশালী প্রদেশ কাবুলকে এর সাথে যুক্ত করেন। ক্ষমতারোহণের সময় থেকে তার সাথে পাঞ্জাবের শিখ শাসক রণজিৎ সিঙের দ্বন্দ্ব ছিল।
বারাকযায়ীদের ক্ষমতায় আসার প্রেক্ষাপট:
1747 সালে আহমদ শাহ আবদালী স্বাধীন আফগানিস্তান জাতিরাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন এবং দুররানি রাজবংশের শাখার সূত্রপাত করেন। 1773 সালে তাঁর পুত্র তৈমুর ক্ষমতায় আসলে আফগান রাষ্ট্রের ভিত্তি দুর্বল হতে থাকে। তিনি প্রচণ্ড রকমে হেরেম মুখী হয়ে পড়েছিলেন। তৈমুর শাহ মারা গেলে তার 36 পুত্রের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এ সময় বারাকযায়ী শাখার প্রধান পায়েন্দা খানের সহায়তায় জামান শাহ ক্ষমতা দখল করেন। এই পায়েন্দাখানের সময় থেকেই বারাকযায়ীরা রাজনীতি ও প্রশাসনের শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আর দোস্ত মোহাম্মদ ছিলেন পায়েন্দা খানের কনিষ্ঠপুত্র। এ সময় গোত্রপতিদের সহায়তায় পায়েন্দা খানের পুত্র ফতেহ খান বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেন। 1801 সালে ফতেহ খান জামান শাহকে বিতাড়িত করে মাহমুদ শাহকে ক্ষমতায় বসান। 1803 সালে মাহমুদ শাহকে সরিয়ে শাহসুজাকে ক্ষমতায় বসানো হয়। 1809 সালে আবার মাহমুদকে ক্ষমতায় বসানো হয়। সুতরাং সাদুযায়ী শাসকগণ বারাকজায়ী গোত্রপতিদের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছিলেন। মূল ক্ষমতায় ছিল পায়েন্দা খান ও শের মোহাম্মদ খান। কোন শাসকই কেন্দ্রীয় সরকার শক্তিশালী করতে পারেননি। গোত্রপতিরাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। ক্ষমতার দ্বন্ধে 1818 সালে মাহমুদ শাহ নিহত হলে আফগানিস্তানে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। আফগানিস্তান বহুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
ফতেহ খান মারা গেলে তার ভাইদের মাঝে ও দ্বন্দ্ব শুরু হয়। হিরাত কাবুল কান্দাহার পেশোয়ার জালালাবাদ ইত্যাদি রাজ্যগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়।1826 সাল পর্যন্ত এই গৃহযুদ্ধ বিরাজমান ছিল।
এই অবস্থায় 1826 সালে আফগানিস্তানে রাজনীতিতে দোস্ত মোহাম্মদ এর আবির্ভাব ঘটে। গৃহযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি নিজেকে শক্তিশালী করেন এবং 1826 সালে তিনি কাবুল দখল করেন। এর মাধ্যমেই আফগান রাজনীতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে বারাকজায়ীদের উত্থান ঘটে। আর এজন্য সাদুযায়ীদের বিশৃঙ্খলা ই দায়ী।
আমির দোস্ত মোহাম্মদের সমস্যাবলী
1826 সালে দোস্ত মোহাম্মদ যখন কাবুল দখল করেন তখন কাবুলের অবস্থা মোটেও নিষ্কণ্টক ছিল না।তিনি আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক মারাত্মক রাজনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হন। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাঁর বহু প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। হিরাতে মাহমুদ শাহ ও তারপুত্র কামরান এবং কান্দাহারে দোস্ত মোহাম্মদের ভাই ক্ষমতায় ছিলেন। তাছাড়া জালালাবাদ, গজনী ও বলখ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। কোন শহরের উপরই কাবুলের নিয়ন্ত্রণ ছিল না। দোস্ত মোহাম্মদ এর রাজ্য সীমা কাবুল এর আশেপাশে 100 মাইলের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল।
শিখ নেতা পাঞ্জাব কেশরী রনজিৎ সিং ছিলেন দোস্ত মোহাম্মদ এর বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। মুলতান ও কাশ্মীর দখল করে সিন্ধু নদের তীর পর্যন্ত তারা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। পূর্বদিকে আফগান সীমান্ত অনেক কমে গিয়েছিল। ব্রিটিশ ভারতে আশ্রিত শাহ সুজা ছিল তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী। সর্বোপরি ব্রিটিশ ভারত এবং রাশিয়া ছিল তার বড় প্রতিপক্ষ। আফগানিস্তানকে অস্থিতিশীল করে রাখতে তারা সর্বদা তৎপর ছিল।
দোস্ত মুহাম্মদ এর ভূমিকা /অবদান /কর্মকাণ্ড /কৃতিত্ব
সামরিক শক্তি বৃদ্ধি:
দোস্ত মোহাম্মদ এর প্রধান লক্ষ্য ছিল সকল রাজ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। আর এজন্য দরকার ছিল সামরিক শক্তি। তাই কাবুলের প্রতিষ্ঠিত হয়ে তিনি সামরিক শক্তি বৃদ্ধির সব প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তিনি জাতীয় সেনা বাহিনী গঠন করেন, কাবুলে অস্ত্র কারখানা স্থাপন করে অস্ত্র তৈরি করেন, আধুনিক লং ব্যারেল বন্দুক তৈরি করেন, যা তৎকালীন ব্রিটিশ বাহিনীতেও ছিলনা। সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী সুসংগঠিত ও অস্ত্রসজ্জিত করে তিনি অভিযান পরিচালনার প্রস্তুতি নেন।
রাজ্য পুনরুদ্ধার ও কেন্দ্রীয় সরকার গঠন:
সেনাবাহিনী পুনর্গঠন করে তিনি একে একে অভ্যন্তরীণ রাজ্য গুলোর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। 1833 সালের মধ্যে কান্দাহার, জালালাবাদ, গজনি, বলখ ইত্যাদি বড় বড় শহরগুলো নিয়ন্ত্রণে আনেন। তার ভাইদের নিয়ন্ত্রিত রাজ্যগুলো নামমাত্র হলেও তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। সকল রাজ্যগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি একটি কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। 1834 সালে শাহ সুজা শিখ ও ব্রিটিশদের প্ররোচনায় কাবুল দখলের চেষ্টা করলে দোস্ত মোহাম্মদ এর পুত্র আকবর খান তা নস্যাৎ করে দেয়। কুলাই আজমের যুদ্ধে শাহ সুজা পরাজিত হন।
শিখদের বিরুদ্ধে অভিযান
1834 সালে দোস্ত মোহাম্মদ শিখদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধের ডাক দেন। এর মাধ্যমে তিনি আফগানদের একত্রিত করার প্রয়াস পান। এজন্য তিনি ধর্মবেত্তাদের মাধ্যমে নিজেকে আমিরুল মুমিনিন বা আমির হিসেবে ঘোষণা দেন। কেননা ধর্মীয় কর্তৃত্ব ছাড়া ধর্মযুদ্ধের ডাক দেওয়া যায় না। তার ডাকে আফগানরা দলে দলে শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেয়। পুত্র আকবর খানের নেতৃত্বে জামরুদ যুদ্ধে শিখরা পরাজিত হতে থাকে।সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও চূড়ান্ত বিজয় লাভ করার পূর্বে তিনি রণে ভঙ্গ দেন। চূড়ান্ত বিজয় লাভ করার পূর্বেই হঠাৎ করে রণেভঙ্গ দেয়া ছিল তার তাঁর চরিত্রের একটি বৈশিষ্ট্য।
ব্রিটিশদের মধ্যস্থতা কামনা
সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার পরেও বিজয় অর্জন না করে রণেভঙ্গ দিয়ে দোস্ত মোহাম্মদ মারাত্মক ভুল করেছিলেন। অতপর তিনি শিখদের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন এবং এজন্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর অকল্যান্ডের সহায়তা কামনা করে চিঠি দেন। পন্ডিতমহল মনে করেন এই চিঠি আফগানিস্তানে ব্রিটিশ হস্তক্ষেপের দ্বার উন্মোচন করে দেয়। কারণ এই আবেদনের প্রেক্ষিতে ব্রিটিশরা আফগানিস্তানের রাজনীতিতে প্রবেশ করার সুযোগ পায়।
পররাষ্ট্র নীতির পরিবর্তন
দোস্ত মোহাম্মদ সরল প্রাণে অকল্যান্ডে চিঠি দিয়েছিলেন কিন্তু অকল্যান্ড এটাকে সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি চিঠি পাওয়ার পর আলেকজান্ডার বার্নসকে কাবুলে পাঠান। কিন্তু এর পেছনে মিত্রতা ছিল না বরং তাদের অন্য উদ্দেশ্য ছিল। তাই আশানুরূপ সাড়া না পেয়ে দোস্ত মুহাম্মদ রাশিয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়েন। জার প্রথম নিকোলাসের সাথে আলাপ-আলোচনা হয়। রাশিয়া ক্যাপ্টেন ভিকোভিসকে প্রতিনিধি হিসেবে কাবুলে প্রেরণ করে। এসময় দোস্ত মুহাম্মদ পারস্যের সাথেও সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করেন, পারস্য আগ্রহী হয়।
ব্রিটিশ আফগান সম্পর্কের টানাপোড়ন
পররাষ্ট্রনীতির এই পরিবর্তন ব্রিটিশ ভারতকে চিন্তত করে। রাশিয়ার সাথে ভালো সম্পর্ক হোক এবং আফগানিস্থান শক্তিশালী হোক এটা তারা চাইত না। তাই এই অবস্থায় আলেকজান্ডার বার্নস এর নেতৃত্বে একটি ব্রিটিশ মিশন আফগানিস্থানে পাঠানো হয় যেন আফগানিম্তান রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করতে না পারে। সে দায়িত্ব বার্নসকে দেয়া হয়। তাকে আরো বলে দেয়া হয়েছে; পারস্য রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন না করলে-
পেশোয়ার পুনরুদ্ধারে আফগানিস্তানকে কোন সাহায্য করা হবে না;
এমনকি রঞ্জিত সিং যদি আফগানিস্তান আক্রমন করে তবে ব্রিটিশরা তাকে সাহায্য করবে;
দোস্ত মোহাম্মদ যেন পারস্য ও রাশিয়ার প্রতিনিধিদের বহিষ্কার করেন এবং
ব্রিটিশদের অনুমতি ব্যতীত তারা আসতে পারবেনা।
এসমস্ত প্রস্তাব নিয়ে বৃটিশ প্রতিনিধি আফগানিস্থানে গমন করে। কিন্তু আমির এসব প্রস্তাব নাকচ করে দেন। ফলে মিশন ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। এদিকে দোস্ত মোহাম্মদ 1837 সালে রাশিয়ার সাথে মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। কিন্তু রাশিয়ার প্ররোচনায় পারস্য হিরাত আক্রমণ করলে এবং বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বৃটিশ-রাশিয়া সর্ম্পক ভালো হলে রাশিয়া আফগান মৈত্রী চুক্তি বাতিল করে দেয়। ফলে রাশিয়ার প্রতি দোস্ত মুহাম্মদের নীতির পরিবর্তন হয়।
ত্রিপক্ষীয় চুক্তি:
বার্নস মিশন ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসলে ব্রিটিশরা আফগানিস্থান আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। কোম্পানি সরকার, রঞ্জিত সিং এবং আশ্রিত শাহ সুজা এর মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে স্থির করা হয় যে;
কোম্পানির সরকার শাহ সুজা কে আফগানিস্তানের শাহ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে;
বিনিময় শাহ সুজা সিন্ধু ব্রিটিশদের ছেড়ে দিবেন এবং পেশোয়ার; মুলতান; পাঞ্জাব ও কাশ্মীরের উপর থেকে চিরকালের জন্য সকল দাবি প্রত্যাহার করবেন;
তিনি কখনো হেরাতকে তার রাজ্যভুক্ত করবেন না;
তিনি ক্ষমতায় গেলে তার সেনাবাহিনীর জন্য সকল সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে।
প্রথম ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধ (1838):
এই চুক্তি মোতাবেক 1838 সালে ব্রিটিশরা আফগানিস্তান আক্রমণ করে, যদিও শিখরা সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। দোস্ত মুহাম্মদ কোয়েটার যুদ্ধে পরাজিত হন। ব্রিটিশ বাহিনী কাবুল দখল করে এবং শাহ সুজা কে ক্ষমতায় বসায়। দোস্ত মুহাম্মদ পালিয়ে বোখারার আমির নসরুল্লাহ এর কাছে আশ্রয় নেন। এই দখলদারিত্বের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ব্রিটিশরা আফগানিস্থানে সরাসরি রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে।
দোস্ত মুহাম্মদ এর নির্বাসন:
1840 সালের দিকে দোস্ত মুহাম্মদ একবার ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু এবারও তিনি চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছার পূর্বে রণেভঙ্গ দেন। তিনি বৃটিশদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। ভারতের কোম্পানির সরকার 1840 সালে তাকে ভারতে নির্বাসনে পাঠায়।
আফগানিস্থানে বৃটিশদের দুর্দশা:
আফগান জনগণ ছিল স্বাধীনচেতা ও গোত্রীয় প্রীতির লোক। দোস্ত মুহাম্মদের অপসারণ তারা মেনে নিতে পারেনি। শাহ সুজা কে সামনে রেখে অল্পদিনের মধ্যেই ব্রিটিশরা কার্যত ক্ষমতা দখল করে নেয় যা জনগণ মানতে পারেনি। ব্রিটিশ বাহিনীর অবিচার এবং শাহ সুজা কর্তৃক উপজাতীয় সরদারদের ভাতা হ্রাস ও অযথা করারোপ ইত্যাদি কারণে আফগানরা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় আফগানরা দোস্ত মোহাম্মদ এর পুত্র আকবর খানের নেতৃত্বে 1841 সালে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। জনগণ নির্বিচারে ব্রিটিশদের হত্যা করতে শুরু করে এবং অস্ত্র লুট করে। এ অবস্থায় বৃটিশ রেসিডেন্ট আকবরের সাথে একটি চুক্তি করে। এতে ব্রিটিশ সৈন্য প্রত্যাহার, বন্দীদের মুক্তি এবং দোস্ত মোহাম্মদ কে ফিরিয়ে এনে ক্ষমতায় বসানোর প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। কিন্তু চুক্তির প্রতি ব্রিটিশদের কোন শ্রদ্ধা ছিল না বরং তারা সময়ক্ষেপন এবং বিদ্রোহ দমনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আকবর খান এটা বুঝতে পেরে ম্যাগনাগেটেনকে বন্দি করার চেষ্টা করেন। কিন্তু গণবিদ্রোহে বিদ্রোহীদের হাতে ম্যাগনা গেটেন এবং শাহ সুজা নিহত হলে ব্রিটিশরা আরো বেশি বিপদে পড়ে।
দোস্ত মুহাম্মদের ২য় বার ক্ষমতা লাভ:
এই পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশরা 1842 সালে বাধ্য হয়ে আকবর খানের সাথে আরেকটি চুক্তি সম্পাদন করে। চুক্তি অনুযায়ী 16000 ব্রিটিশ সৈন্য প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু পথিমধ্যে চোরাগোপ্তা হামলায় বহু ব্রিটিশ সৈন্য প্রাণ হারায়। অল্প কিছু সৈন্য প্রাণ নিয়ে ভারতে ফিরতে সক্ষম হয়। এই ঘটনা ছিল বৃটিশদের জন্য অত্যন্ত গ্লানিকর। ব্রিটিশরা নতুন বাহিনী পাঠিয়েও সুবিধা করতে পারেনি। আবারো আকবর খানের সাথে চুড়ান্ত সমঝোতা হয়। চুক্তি মোতাবেক 1842 সালে দোস্ত মুহাম্মদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে পুনরায় ক্ষমতায় বসানো হয়। এরপর তিনি 1863 সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন।
ক্ষমতা সুদৃঢ়করণ
দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসে দোস্ত মুহাম্মদ সাবধানী পদক্ষেপ নেন। কান্দাহারে তার ভাই স্বাধীনভাবে চলছিল। এছাড়া হিরাত এবং কাবুলের পার্শ্ববর্তী রাজ্য গুলো স্বাধীনভাবে চলছিল। তিনি তার পুত্রদের মাধ্যমে আস্তে আস্তে শক্তি বৃদ্ধি করেন এবং রাজ্য গুলির উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে কেন্দ্রীয় সরকার শক্তিশালী করেন।
দ্বিতীয়বার ভারত অভিযান
তিনি শিখ অধিকৃত এলাকাগুলো পুনরুদ্ধার করতে চাইলেন। কিন্তু 1845 থেকে 46 সালে ব্রিটিশরা শিখদের এলাকাগুলো দখল করে নিলে শিখ নেতা দোস্ত মুহাম্মদের সাহায্য কামনা করেন। সাত্তার সিংয়ের সাথে চুক্তি হয়। যৌথবাহিনী 1848 সালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে কিন্তু দোস্ত মুহাম্মদ গুজরাটে পরাজিত হয়ে ফিরে যান। তিনি এ রাজ্যগুলোর আশা একেবারে ত্যাগ করেন। তবে উত্তর দিকে তুর্কিস্তান দখল করে তিনি আফগানিস্তান তুর্কিস্তান প্রদেশের সূচনা করেন। তবে তিনি হিরাত নিয়ন্ত্রণ করে পারেননি।
ব্রিটিশদের সাথে মৈত্রী স্থাপন:
শিখদের সাথে মৈত্রী জোট করে যুদ্ধে দোস্ত মোহাম্মদ ব্রিটিশদের সাথে হেরে গেলেও ব্রিটিশরা তাদের নিজেদের স্বার্থে দোস্ত মুহাম্মদের প্রতি তাদের নীতির পরিবর্তন করে। রাশিয়া এবং ইরানকে ঠেকাতে তার সাথে মিত্রতা স্থাপন করে। 1854 সালে জন লরেন্স আকবরের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এতে আফগানিস্তানকে স্বাধীন এবং মুহাম্মদকে মিত্র হিসেবে মেনে নেয়া হয়।
পেশোয়ার চুক্তি
1854 সালে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশ ভারতের নিরাপত্তার স্বার্থে আফগানিস্তানকে যুদ্ধ থেকে সরিয়ে রাখা এবং আফগানিস্তানের সম্ভাব্য হামলা প্রতিহত করার লক্ষ্যে লর্ড ডালহৌসি পুনরায় মৈত্রী চুক্তি করতে আগ্রহী হন।েআমির হিরাতকে আফগানিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে পারবেন না এ প্রস্তাব গ্রহণ করে 1855 সালের 30 মার্চ উভয়পক্ষের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে তিনটি মূল ধারা ছিল
.
কোম্পানি এবং দোস্ত মুহাম্মদ ও তাঁর উত্তরসূরিদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ শান্তি অবস্থা বিরাজ করবে;
তারা একে অপরের রাজ্যের ভৌগলিক ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখবে;
দোস্ত মুহাম্মদ প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে, তার ও তার উত্তরসূরিরা ব্রিটিশদের মিত্রদের মিত্র এবং শত্রুদের শত্রু হবে।
এটা ছিল একটি অসম চুক্তি। এর মাধ্যমে মূলত আফগানিস্তানকে ব্যবহার করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্রিটিশরা শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছিল। আমির যা পেলেন তার চেয়ে বেশি দিলেন, বিশেষ করে তার উত্তরসূরিদেরকে এর জন্য অনেক বেশি মূল্য দিতে হয়েছিল।
দোস্ত মোহাম্মদ এর পরবর্তী ঘটনাবলী:
1856 সালে ব্রিটিশদের সাথে দোস্ত মুহম্মদের আরেকটি মৈত্রী চুক্তি হয়। এদিকে রুশ প্ররোচনায় 1856 সালে পারস্য হিরাত আক্রমণ করলে বৃটিশ ভারত পারস্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। পরে Treaty of Persia এর মাধ্যমে1857 সালে এর সমাধান হয়। পারস্যের আফগানিস্তানকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করেন।
1862 সালে মোহাম্মদ হিরাত দখল করে তা রাজনৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় ও করেন। 1863 সালে মোহাম্মদ মারা যান।
সুতরাং বংশানুক্রমিক একটি নতুন রাজবংশ প্রতিষ্ঠায় দোস্ত মোহাম্মদ সফল হয়েছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকার গঠন, আফগান সামরিক শক্তি বৃদ্ধি, অস্ত্র নির্মাণ, পররাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে তিনি সফল হয়েছিলেন। তাকে সরাতে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র নীতি সফল হয়নি। তিনি ছিলেন দীর্ঘদেহী এবং রাজকীয় চেহারার অধিকারী। তিনি খুব নম্র স্বভাবের ছিলেন, তাঁর বলিষ্ঠ বাচনভঙ্গি এবং প্রখর দূরদৃষ্টি তার বিচক্ষণতা ইঙ্গিত করে। তার এসব যোগ্যতার কারণেই বিশৃঙ্খলা আফগানিস্থানে একটি স্থিতিশীল কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করে আধুনিক আফগানিস্তানের তিনি অন্যতম মহান শাসকে পরিণত হন।
Md. Billal Hossain
B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka
BCS (General Education)
Lecturer
Department of Islamic History Culture
No comments:
Post a Comment