Breaking

Sunday, 4 September 2022

দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় গণধর্মান্তর বা দ্রুত ইসলাম বিস্তারের কারণসমূহ


দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় গণধর্মান্তর  বা দ্রুত ইসলাম বিস্তারের কারণসমূহ

(Causes of mass conversion of Islam in South East Asia)


সপ্তম শতাব্দীতে আরব উপদ্বীপে ইসলামের আবির্ভাব হলেও তা কয়েক শতাব্দী মধ্যে বিভিন্ন বিজয় অভিযানের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিস্তার লাভ করে। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইসলামের বিস্তার কোন সামরিক অভিযানের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়নি, বরং এখানে ইসলামের বিস্তার ঘটেছে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায়। বণিক এবং সুফি সাধকদের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইসলামের বিস্তার ঘটেছে বলে ঐতিহাসিকগণ তথ্য প্রমাণ দিয়েছেন। আরব্য বনিকগনের ব্যক্তিগত এবং যৌথ প্রচেষ্টা এবং ইসলামের অনুকরণীয় আদর্শের কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইসলাম দ্রুত প্রসার লাভ করে। পরবর্তীতে মালাক্কা সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হলে তা ইসলাম প্রচারের প্রাণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। আধুনিক মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাই তারই উৎকৃষ্ট প্রমাণ। 




আরও পড়ুন-

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার  বৈচিত্রে ঐক্য।। Unity In Diversity of South-East Asia।।


দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইসলামের প্রথম আগমন:

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সপ্তম শতাব্দীতে ইসলামের আগমন ঘটেছে আরব বণিকরা ভারতের গুজরাট, বোম্বে, সিলন বন্দর হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় গমন করেছে।মুসলিম বণিকরা মালাবার দ্বীপ অতিক্রম করে চীনের ক্যান্টন বন্দর পর্যন্ত পৌঁছে। চীনের দক্ষিণাংশে মুসলিম বণিকরা জলপথে বাণিজ্য করতো। আর এ জলপথ বাণিজ্যের পথ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য চীন সরকারের সাথে বিরোধ হওয়ায় মুসলিমরা ক্যান্টন ত্যাগ করে সিল্করুট ধরে ফিরে আসে। 878 সালে চীনের কৃষক বিদ্রোহের সময় সেখানে অবস্থানরত মুসলিম বণিকরা বিতাড়িত হয়ে মালয় জগতের কেদাহ এবং  সুমাত্রার পালেম্বাং এ আশ্রয় নেয়। পরবর্তীতে মুসলিম বণিকরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে তাদের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে মসলা ক্রয় করে সেটা আরব, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে রপ্তানি করা এবং অন্যান্য অঞ্চল থেকে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে তারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে যেত। আরব বণিকদের পাশাপাশি ভারতের গুজরাটি বণিকরা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।


দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইসলামের অস্তিত্বের প্রমাণ


  1. মুসলিম সমাধি ও শিলালিপি:

  1. 1039 সালে চম্পা তে পাথরের খোদাইকৃত আরবি শিলালিপি ও একজন মুসলমানের কবর পাওয়া যায়। 

  2. 1082 সালে জাভা দ্বীপের সুরাবায়া নামক অঞ্চলে মুসলিম সমাধি/মাজার এবং পাথরের খোদাইকৃত শিলালিপি পাওয়া গেছে তবে সেগুলো ছিল গুজরাটি বণিকদের।

  3. 1112 সালে আরব ধর্মপ্রচারক আব্দুল্লাহ আরিফ এবং বোরহানউদ্দীন সুমাত্রায় ইসলাম প্রচার করেন।

  4. উল্লেখ্য যে এর প্রায় 200 বছর পর তথা 1200 সালের পর থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইসলামের দ্রুত প্রসার হতে থাকে যা কেবল বাণিজ্যিক যোগাযোগ এর সূত্র ধরে এবং সুফি সাধকদের প্রচেষ্টায় সম্ভব হয়।


  1. ছোট ছোট মুসলিম রাজ্যের উপস্থিতি

আরব ও গুজরাটি বণিকদের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বহু পূর্ব থেকেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুসলিম রাজ্যের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়-

  1. সুমাত্রা দ্বীপের পসেই রাজ্যে 1282-1287 সালের দিকে প্রায় সকল লোক মুসলিম ছিল বলে জানা যায়।

  2. 1292 সালের দিকে Perleck রাজ্যের অধিকাংশ লোক মুসলিম ছিল বলে জানা যায়। Perleck রাজ্যের তত্ত্বাবধানে আচেহ কেদাহসহ বিভিন্ন রাজ্য ইসলাম অধ্যুষিত হয়ে যায়। 

  3. পসেই রাজ্য থেকে সুলাইমান ও হোসাইন নামক দুজন রাজপ্রতিনিধি কে চীনে প্রেরণ করা হয়েছিল। ইতালির পর্যটক মার্কোপোলো তার বর্ণনায় একথা লিপিবদ্ধ করেছেন। কেননা তিনি সমসাময়িক সময়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ভ্রমণ করেছিলেন।

আর এ থেকে বুঝা যায় বহু পূর্ব থেকে এখানে মুসলিম রাজ্য ছিল যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়  দ্রুত ইসলাম বিস্তারে অবদান রাখে।


আরও পড়ুন-

মুহাম্মদ আলী পাশা এবং  আধুনিক মিসর    


দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় গণ ধর্মান্তর বা দ্রুত ইসলাম প্রচারের কারণসমূহ

Causes of mass conversion of Islam in South East Asia


দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইসলাম বা মুসলমানদের উপস্থিতি পূর্ব থেকে থাকলেও সেগুলো ছিল বন্দর কেন্দ্রিক তথা সমুদ্র উপকূলে। মূল ভূখণ্ডে ইসলাম প্রবেশ করেছে আরও অনেক পরেG DGE Hall  এর মতে 1303 -1375 সালের মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মূল ভূখণ্ডে ইসলাম প্রবেশ করে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইসলাম দ্রুত প্রসার এর পিছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে-


  1. মালাক্কার প্রতিষ্ঠাতা পরমেশ্বর এর ইসলাম গ্রহণ: 

  2. বনিক সমাজের প্রচেষ্টা ও বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা 

  3. সুফিদের নিরলস প্রচেষ্টা: 

  4. ইসলাম গ্রহণের সহজ পদ্ধতি: 

  5. মুসলিম উম্মাহর ঐক্যবদ্ধতা 

  6. পর্তুগীজদের আগমন ভীতি: 

  7. ইসলামী সভ্যতার সম্প্রসারণ: 

  8. শাহ বন্দর নিয়োগ: 

  9. বাণিজ্যের সুযোগ সুবিধা লাভের আকাঙ্খা: 

  10. বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের ব্যর্থতা: 

  11. বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন:  

  12. ইসলামের শান্তিপূর্ণ  আগমন প্রক্রিয়া: 

  13. রাজনৈতিক কারণ:  

  14. আদাত আইনের সাংঘর্ষিক না হওয়া:


(Causes of mass conversion of Islam in South East Asia)

  1. মালাক্কার প্রতিষ্ঠাতা পরমেশ্বর এর ইসলাম গ্রহণ: 

শৈলেন্দ্র বংশের যুবরাজ পরমেশ্বর 1402 সালে মালাক্কা রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন। মালাক্কা ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইসলামের দ্রুত প্রসারের প্রাণকেন্দ্র। 1414 সালে পরমেশ্বর পসেই রাজ্যের শাসক ও মুসলিম বনিকদের অনুরোধে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেণ।তিনি মেগাওয়াত ইস্কান্দার শাহ নাম ধারণ করেন এবং সুমাত্রার রাজকন্যাকে বিয়ে করে সম্পর্ক শক্তিশালী করেন।  এর ফলে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মালাক্কায় ইসলাম প্রবেশ করে এবং শাসক এর অনুকরণে দলে দলে লোক ইসলাম গ্রহন করতে থাকে। মালাক্কা কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রাজ্যে ইসলাম প্রচার চলতে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৪৫৬ সালে প্রধানমন্ত্রী তুনপেরাকের সহায়তায় মুজাফফর শাহ সুলতান উপাধি লাভ করলে মালাক্কা ‘রাজ্য’ থেকে সালতানাতে পরিণত হয় এবং ইসলাম এখানে রাষ্ট্রীয় ধর্মের মর্যাদা লাভ করে। পঞ্চদশ শতকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মালাক্কা সালতানাত ইসলাম প্রচারের প্রাণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। 



  1. বনিক সমাজের প্রচেষ্টা ও বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা: 

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দ্রুত ইসলাম বিস্তারের জন্য যেসকল বণিক গোষ্ঠী বেশি অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে গুজরাটি বণিকরা অন্যতম। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় গুজরাটি মুসলিম বণিকরা বেশ ভালো অবস্থানে ছিল। তারা কখনো নিজ অবস্থান থেকে অথবা কখনো ফেরিওয়ালা সেজে বিভিন্নস্থানে প্রবেশ করে অন্যান্য বণিক গোষ্ঠীর মধ্যে প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে এই বণিকরা ওই অঞ্চলের বিভিন্ন রাজন্যবর্গের সাথে দর কষাকষি করে পারলেক ও টেংগানুতে বাণিজ্যিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। এ সকল মুসলিম বণিকদের বিভিন্ন শর্তে অমুসলিম বণিকগণ দ্রুত ইসলাম গ্রহণ করে নিজ দেশে তা প্রচার করতে থাকে। বণিকগণ নিজের চেষ্টায় উচ্চপদের কর্মচারী নিয়ে বণিক সমিতি গঠন করে নব মুসলিমদের পুনর্বাসন এবং বাণিজ্যিক সুবিধা প্রদান করে। আর এ সকল কাজ যারা করতেন তাদের বলা হতো সুলতান, শেখ, শাহ, মাখদুম ইত্যাদি। ফলশ্রুতিতে নিম্ন শ্রেনীর অমুসলিমগণ সাহায্য পাওয়ার আশায় দ্রুত ইসলাম গ্রহণ করলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইসলামের গণ ধর্মান্তর ঘটে।


অন্যদিকে মুসলিম-মুসলিম ব্যক্তি পর্যায়ে এবং রাজ্য পর্যায়ে ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠলে মুসলিম বণিকদের যেমন উন্নতি ঘটে তেমনি রাজ্যগুলোর দ্রুত উত্থান ঘটে। বিপরীতে অমুসলিম বনিক ও রাজ্যগুলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য থেকে ক্রমেই পিছিয়ে যেতে থাকে। ফলে অমুসলিম বণিকরা পার্শ্ববর্তী মুসলিম রাজ্যগুলোর সাথে বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে একই শ্রেণীভূক্ত হয়ে যায়। এরকম বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতায় মুসলিম বণিকরা মালাক্কা ও ক্যাম্পে বন্দরে ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। D.G.E. Hal  বলেন- মালাক্কা ক্যাম্বে ছাড়া বা ক্যাম্বে মালাক্কা ছাড়া বাঁচতে পারে না


আরও পড়ুন-

প্রাক-মুসলিম মালয় জগতের উপর ভারতীয় ও চৈনিক প্রভাব: স্বরূপ ও তাৎপর্য


  1. সুফিদের নিরলস প্রচেষ্টা:

বণিকদের পাশাপাশি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইসলাম প্রচারে সুফী দরবেশদের উপস্থিতি লক্ষণীয়। তারা রাজদরবারের বিভিন্ন পদে চাকরি নিয়ে রাজদরবারে মুসলিম প্রভাব বৃদ্ধির পাশাপাশি অন্যান্য অঞ্চলে ইসলাম প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। শুরু থেকেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শাফী মাযহাবের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, সুফীদের প্রচেষ্টায় এখানে বিভিন্ন অঞ্চলে মসজিদ খানকাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে । 

অন্যদিকে এ অঞ্চলের মানুষ কিছুটা রহস্য বাদে বিশ্বাসী ছিল, সুফিবাদের মধ্যেও কিছুটা রহস্য থাকায় তারা সুফিদেরকোথায় প্রভাবিত হয় এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যেসকল সূফী ধর্ম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন- 

  1. মাওলানা মালিক ইব্রাহিম 

  2. মাওলানা জুনায়েদ আল কবরা 

  3. মাওলানা ইসহাক

  4. মাওলানা হাসান আল দীন 

  5. সাইখুল ইসলাম  শামস উদ্দিন প্রমুখ 


  1. ইসলাম গ্রহণের সহজ পদ্ধতি:

ইসলাম গ্রহণের সহজ পদ্ধতি এখানের অনেক মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। অন্যান্য ধর্ম গ্রহণ ও কার্যকলাপ যেমন পন্ডিত বা পুরোহিত ভিত্তিক ছিল, ইসলাম গ্রহণে তেমন কোন পন্ডিত বা পুরোহিতের দরকার হয়না। ইসলাম গ্রহণ করতে চাইলে অন্তত সহজ পদ্ধতি তথা কালিমা বললেই হয়ে যায়। তাছাড়া এখানে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে কখনোই জোরজবরদস্তি বা বল প্রয়োগ করা হয়নি। এই অঞ্চলে ইসলামের শান্তিপূর্ণ আগমন এবং ইসলামী সংস্কৃতি স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে অধিকাংশ মিল থাকায় তারা সহজেই ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়। 



আরও পড়ুন-

সুয়েজ খাল (Suez Canal) ।। সুয়েজ খালের ইতিহাস ।। মিসরের স্বাধীনতা ও জাতীয় জীবনে সুয়েজ খালের প্রভাব



  1. মুসলিম উম্মাহর ঐক্যবদ্ধতা:

এখানে মুসলিম শাসক থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণ পর্যন্ত যে যে জাতি গোষ্ঠীরই হোক না কেন সকলের মধ্যে সহমর্মিতা সহানুভূতি এবং ঐক্য ছিল লক্ষণীয় যা এ অঞ্চলের মানুষকে মুগ্ধ করেছে এবং ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছে।


  1. পর্তুগীজদের আগমন ভীতি:

পর্তুগীজদের আগমন দুটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জনগণকে ইসলামের দিকে ধাবিত করেছিল স্পেন থেকে মুসলমানদের বিতরণসহ যে  ধ্বংসযজ্ঞ ইউরোপিয়ানরা করেছে তা সুফিদের মাধ্যমে রাজদরবারে প্রকাশ পায় এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বাসী জানতে পারে তাছাড়া পর্তুগিজরা বিভিন্ন মানুষকে বন্দি করে দাস হিসেবে ইউরোপে  বিক্রি করে দিতো। ফলে 1497 সালে ইউরোপীয় তথা পর্তুগীজদের আগমনকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বাসীর ভীতির চোখে দেখছিল।  যদিও পনেরশো এগারো সালে পর্তুগিজরা মালাক্কা দখল করে নেয় মালাক্কার পতনের পর মুসলমানরা আচেহ বন্দরকে কেন্দ্র করে ইসলাম প্রচার শুরু করে পর্তুগীজদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মুসলিমরা পর্তুগিজ বিরোধী আন্দোলন করে তোলে এতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বাসীর মুসলিমদের পক্ষাবলম্বন করে।



  1. ইসলামী সভ্যতার সম্প্রসারণ: 

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তৎকালীন দুটি বিখ্যাত সভ্যতা তথা ভারতীয় ও চৈনিক সভ্যতার মাঝামাঝি ছিল। ফলে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ছিল লক্ষণীয় এই দুটি ধর্ম কুসংস্কারাচ্ছন্ন হওয়ায় তা মানুষের দাবি পূরণে ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে ইসলামের আদর্শ সাম্যবাদ ও মাধুর্যতা তথা ইসলামী সভ্যতার প্রভাব বনিক ও সুফিদের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। হিন্দু ধর্মের বর্ণবাদ মানুষকে বিষিয়ে তুলে অন্যদিকে ইসলাম ও মুসলমানদের মধ্যে বর্ণবাদ বিরোধী মনোভাবে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দরিদ্র অমুসলিমদের আকৃষ্ট করে। ফলে তারা দ্রুত ইসলাম গ্রহণ করে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় গণধর্মান্তর চলতে থাকে। এটি ছিল ইসলামের সভ্যতার প্রভাবের ফসল।


  1. শাহ বন্দর নিয়োগ:

বণিক তান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে যখন মালাকার উত্থান ঘটে তখন মালাক্কার সুলতান কর্তৃক নিয়োগকৃত শাহবন্দর বা বন্দর প্রধানগণ মালাক্কা প্রণালী এবং স্থানীয় বণিকদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন। এবং যাবতীয় দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে সময় দিতেন এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন- 

  1. সৈয়দ আব্দুল আজিজ  

  2. মাওলানা আবু বকর 

  3. কাজী মনোয়ার ও 

  4. সদর জাহান


আরও পড়ুন-

গ্রিসের স্বাধীনতা যুদ্ধ।। Greek War of Independence


  1. বাণিজ্যের সুযোগ সুবিধা লাভের আকাঙ্খা

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সুমাত্রা জাভা এবং মালাক্কায় মুসলিম বণিকদের প্রভাব ছিল বেশি। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে তাদের কর্তৃত্ব ছিল। ফলে স্থানীয় বনিকরা মনে করেছিল যে ইসলাম গ্রহণ করলে আরব বণিক ও ইন্ডিয়ান মুসলমানদের আনুকূল্য ও সাহায্য পাওয়া যাবে এবং তারা বাণিজ্যে উন্নতি লাভ করতে পারবে। এরকম বাণিজ্যিক সুযোগ সুবিধা লাভের আশায় অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।


  1. বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের ব্যর্থতা:

ইসলাম প্রবেশের পূর্বে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীন থেকে আসা বৌদ্ধ ধর্ম এবং ভারত থেকে আসা হিন্দু ধর্মের প্রভাব ছিল। তবে এসব ধর্ম কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিল এবং  মানব সমাজের চাহিদা পূরণে পুরোপুরি সফল হয়নি। অপরদিকে ইসলাম ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ, সার্বজনীন ও কুসংস্কার মুক্ত ধর্ম ও জীবন ব্যবস্থা। ধর্ম হিসেবে বৌদ্ধ এবং হিন্দু ধর্মের চেয়ে ইসলাম ধর্ম সাধারণ মানুষের কাছে অধিকতর উন্নত, রুচিশীল এবং শ্রেষ্ঠ মনে হয়েছে। ফলে তাঁরা সহজেই ইসলামের দিকে আকৃষ্ট হয়েছে।


  1. বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন: 

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইসলামের বিস্তারের ক্ষেত্রে বৈবাহিক সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্য সাধারণত নির্ভর করত মৌসুমী বায়ুর উপর। ভারত তথা আরব ভূখন্ড থেকে এক বার পণ্য সামগ্রী নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এসে যাবতীয় পন্য বিক্রি করে আবার নতুন পণ্য ক্রয় করে তাকে ফিরে যেতে মৌসুমী বায়ুর জন্য অপেক্ষা করতে হতো। এ দীর্ঘ সময় অবস্থান করার কারণে অনেকে স্থানীয় রমনীদের বিবাহ করে সেখানে পরিবার গড়ে তুলেছিলেন। বনিকরা মুসলমান হওয়ায় তাদের স্ত্রী ও সন্তানরাও মুসলমান হয়ে যেত। ফলে সম্পূর্ণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইসলামের প্রচার ও প্রসারে এই প্রক্রিয়াটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। 


  1. ইসলামের শান্তিপূর্ণ  আগমন প্রক্রিয়া:

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে ইসলামের আগমন প্রক্রিয়া ছিল অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ এবং ইসলামের নিয়ম কানুন স্থানীয় সংস্কৃতি এবং আদর্শের সাথে অনেকটাই সাদৃশ্য ছিল। এখানকার লোকেরা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া কোন কিছুকে পছন্দ করত না। অন্যদিকে এখানে আগত ধর্মসমূহের মধ্যে ইসলামই একমাত্র ধর্ম যা কোনো বিষয় বা যুদ্ধাভিযান ছাড়াই এসেছে। ইসলাম এখানে শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়া এসেছে এবং স্থানীয় লোকজনও শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় ইসলাম গ্রহণ করেছে। কোন প্রকার জোর জবরদস্তি এখানে করা হয়েছে এমন কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। 




আরও পড়ুন-

রেজা শাহ পাহলভী  এবং ইরানের  আধুনিকায়নে তাঁর অবদান


  1. রাজনৈতিক কারণ: 

কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কারণে ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইসলাম বিস্তার ঘটেছে। পসেই রাজ্য মুসলিম অধ্যুষিত ছিল, অন্যদিকে মাজাপাহিত ছিল হিন্দু অধ্যুষিত এবং একটি শক্তিশালী রাজ্য। পরমেশ্বর মাজাপাহিত রাজ্যের রাজকন্যাকে বিয়ে করেছিলেন এবং তিনি একবার মাজাপাহিত রাজ্যের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন যার ফলে তাকে পালিয়ে আসতে হয়েছিল। তিনি মালাক্কায় মাজাপাহিত রাজ্যের আক্রমণের আশঙ্কা করেছিলেন। সে জন্য তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে পসেই রাজ্যের সাথে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়ে তার রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করেছিলেন। 


  1. আদাত আইনের সাংঘর্ষিক না হওয়া:

আদালত আইন ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমাজে প্রচলিত রীতি নীতির নাম যায এখানকার মানুষ পূর্ব থেকেই চর্চা করে আসছিল। ইসলাম আসার পর যে কোন কোন মানুষকে আদত আইন বা শরিয়া আইন এর যে কোনো একটিকে মেনে নিতে হতো।  কিন্তু ইসলামিক শরিয়ার অনেক কিছুই এখানকার আদত আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। এখানকার মানুষেরা প্রচলিত আইনের সাথে ইসলামের খুব বেশি বৈপরীত্য বা সংঘর্ষ দেখেনি।  ফলে তাঁরা স্বাচ্ছন্দে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে।


দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইসলামের দ্রুত সম্প্রসারণ বা গণ ধর্মান্তর শুধু মুসলিম ইতিহাসে নয় বরং বিশ্ব ইতিহাসের একটি কৌতুহলী অধ্যায়। বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের প্রাধান্য থাকার পরেও ইসলাম অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে এখানে প্রবেশ করে তার আদর্শ, সাম্যবাদ, ঐক্যের বাণী প্রচার করেছে। করে বিশেষ করে বণিক এবং সুফী দরবেশদের অভিনব কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় গণ ধর্মান্তর ঘটেছে। 1936 সালে আচেহ এবং পারলেকে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের সারকথায় বলা হয়; দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ইসলামের প্রাথমিক ভিত্তি গুজরাটের বণিকরা শুরু করলেও এর প্রচার ও প্রসার করেছিল মূলত আরব বণিকরা। 


আরও পড়ুন-

তানজিমাত কী? তানজিমাত যুগে  অটোমান  তুরস্কে গৃহীত সংষ্কারাবলী কী ছিল 



[প্রিয় পাঠক,

যে কোন ভূল-ত্রুটির সংশোধনী বা পরামর্শ থাকলে  ওয়েব সাইটে পোস্টের নিচে কমেন্ট বক্সে লিখুন। ইসলামের ইতিহাস, স্বাধীন-বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস,  ইসলামের বিধি-বিধান সংক্রান্ত কোন প্রবন্ধ বা সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে লেখা কোন প্রবন্ধ প্রকাশ করতে চাইলে আপনার লেখা এবং পরিচিতিসহ  মেইল করুন। ]


Md. Billal Hossain

B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka

BCS General Education

Lecturer

Department of Islamic History & Culture

Chandpur Govt. College, Chandpur.








3 comments:

  1. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
    Replies
    1. মালাক্কা সlলতানাথের সরকার ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার উপর আলোকপাত কর | এ প্রশ্নের উত্তরটি দিলে ভালো হতো অনেক,

      Delete
  2. আসিয়ান গঠনের উদ্দেশ্য কি এর সাফল্যসমূহ পর্যালোচনা করে |এ প্রশ্নের উত্তরটি দিলে ভালো হতো অনেক

    ReplyDelete