সম্রাট শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যকার উত্তরাধিকার যুদ্ধ
(Succession war among the sons of Emperor Shah Jahan)
(1657-1659)
যার রাজত্বকালকে ঐতিহাসিকগণ মুঘলদের স্বর্ণযুগ বলে অভিহিত করেছেন, অদৃষ্টের নির্মম পরিহাসে তাঁর রাজত্ব কালের শেষের দিকে উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব মুঘল তথা সমগ্র মুসলিম ভারতের ইতিহাসে একটি কলংকময় ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। এ কারণে স¤্রাট শাহজাহানের শেষ জীবন হয়ে উঠেছিল হৃদয়বিদারক ও মর্মান্তিক। ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে শাহজাহান গুরুতর পীড়ায় অসুস্থ হলে এক পর্যায়ে গুজব রটে যে, তিনি জীবিত নেই। কিন্তু পরে তিনি জীবিত আছেন জানাগেলেও তাঁর ক্ষমতা লিপ্সু পুত্রগণের মধ্যে সিংহাসনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ শুরু হয় এবং রক্তপাতের মাধমে এর সমাপ্তি ঘটে।
চার পুত্রের অবস্থান:
চার পুত্রের মধ্যে শুধু দারাশিকো এ সময় পিতার কাছে তথা আগ্রাতে ছিলেন।
দ্বিতীয় জন শাহ সুজা ছিলেন বাংলার শাসনকর্তা।
আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যের এবং
মুরাদ ছিলেন গুজরাট ও মালওয়ারের শাসনকর্তা
শাহজাহানের দুই কন্যার মধ্যে জাহানারা বাবার পক্ষ তথা দারার পক্ষ ও রওশনারা আওরঙ্গজেবের পক্ষ সমর্থন করেন।
উত্তরাধিকার যুদ্ধের কারণ:
শাহজাহানের অসুস্থতা:
শাহজাহানের অসুস্থতাই এই যুদ্ধের সূচনা করেছে। ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে শাহজাহান গুরুতর পীড়ায় অসুস্থ হলে এক পর্যায়ে গুজব রটে যে, তিনি জীবিত নেই। দারাশিকো ব্যতিত আর কেহই পিতার সঠিক অবস্থা জানতেনা। শাহজাহানের প্রিয়পুত্র হিসেবে সম্রাটের ইচ্ছায় ক্ষমতা দারাশিকো কুক্ষিগত করতে পারেন এই আশংকায় বাকিরা সংকিত হয়ে উঠে।
সুষ্ঠু উত্তরাধিকার নীতির অভাব:
মুঘল সিংহাসন লাভের সুষ্ঠু উত্তরাধিকরী নীতির অভাবেই শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে সংঘটিত গৃহযুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল। বাবর, হুমায়ন, আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান সকলেই প্রতিদ্বনদ্বী আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সংঘটিত সংঘর্ষে জয়লাভ করে সিংহাসন লাভ করেছিলেন। কাজেই উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব শাহজাহানের পুত্রগণের মধ্যে সংঘটিত হওয়া ছিলো অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা মাত্র।
যোগ্যতা ও চারিত্রিক পার্থক্য:
দারার রুক্ষ মেজাজ, উগ্র স্বভাব ও রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার জন্য দরবারের অনেকেই তার প্রতি রুষ্ট ছিলেন। তিনি হিন্দুদের প্রতি মিত্র ভাবাপন্ন এবং শিয়াদের প্রতি উদার ছিলেন। দ্বিতীয় পুত্র সুজা তীক্ষè বুদ্ধিসম্পন্ন রাজনীতিবিদ ও যোদ্ধা হলেও বাংলার আবহাওয়া তাকে আয়েশী, দুর্বল ও স্থবির করেছিল। শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে তৃতীয় পুত্র আওরঙ্গজেব ছিলেন সর্বাপেক্ষা অধিক শক্তিশালী,যোগ্য ও প্রতিভা সম্পন্ন। চতুর্থ পুত্র মুরাদ অত্যধিক ভোগবিলাসী ও মদ্যপ হওয়ায় আওরঙ্গজেব তাকে হাতের পুতুলে পরিণত করেছিলেন।
দারাশিকোর প্রতি শাহজাহানের অন্ধ স্নেহ:
দারার প্রতি শাহজাহানের অন্ধ স্নেহ ও পক্ষপাতিত্ব এ দ্বন্দ্বের অন্যতম কারণ ছিল। যোগ্যতার বিচারে পিছিয়ে থাকা সত্ত্বেও শাহজাহান দারাকেই পরবর্তী স¤্রাট হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। সে জন্য তিনি সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করেও স্বহস্তে রাজ্যভার গ্রহণ না করে দারাকে দিয়ে সবকিছু করাতেন।
আওরঙ্গজেবের প্রতি দুর্ব্যবহার:
দারাশিকোর কারসাজিতে শাহজাহান আওরঙ্গজেবকে দাক্ষিণাত্যের সুবাদারের পদ থেকে বরখাস্ত করেন এবং বিজাপুর ও গোলকুন্ডা বিজয় করার সুযোগ থেকেই বঞ্চিত করেন। তাকে তিক্ত ভাষায় চিঠি পত্র লিখতেন। দারা আওরঙ্গজেবকে ফকির বলে সম্বোধন করত। এতে আওরঙ্গজেবের মনে ক্রোধের সঞ্চার হয়।
দারাশিকোর স্বৈরাচারী নীতি:
শাহজাহানের অসুস্থতার সুযোগে দারা সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করে ভ্রাতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তিনি আওরঙ্গজেবের অধীনস্থ সকল সুযোগ্য সেনাপতিকে রাজধানীতে ডেকে পাঠান। আওরঙ্গজেবের দূত ঈসা বেগ কে রাজধানীতে বন্দি করে রাখেন এবং তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন। রাজধানীর সাথে তিনি বাহিরের সকল যোগাযোগ বন্ধ করে দেন।
জনতার বিভক্তি:
ইসলামের ক্ষেত্রে দারার অতিমাত্রায় উদারতার কারনে তিনি সাধারণ মুসলিমদের বিরাগভাজন হন। অধিকাংশ অভিজাতবর্গ দারার প্রতি বিরক্ত ছিলেন। অন্যদিকে আওরঙ্গজেবের ন্যায় প্রতিভাবান ও যোগ্যতা সম্পন্ন আর কেউ ছিলেন না বলে সাধারণ জনগন তাকে সমর্থন করতেন। জনতার এই বিভক্তি যুদ্ধকে অনিবার্য করেছিলো।
আরও পড়ুন-
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বৃহৎ শক্তিবর্গের ভূমিকা
সংক্ষেপে যুদ্ধের ঘটনা প্রবাহ:
রাজধানীর সাথে যেগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে প্রথমে সুজা বাংলা থেকে নিজেকে মুঘল সম্রাট বলে ঘোষণা করেন। মুরাদ গুজরাট থেকে নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করেন এবং নিজ ভগ্নি জাহানারা বেগমকে দেওয়া সুরাট বন্দর ধ্বংস করে তার দেওয়ান মীর আলী নকীকে নিজ হাতে হত্যা করে রাজধানীর দিকে ধাবিত হন। তারা স্ব স্ব রাজ্যে নিজ নামে খুৎবা পাঠের রীতি চালু করেন এবং মুদ্রার প্রচলন করেন। আওরঙ্গজেব তাড়াহুড়া করলেন না। তিনি নর্মদা নদীর প্রতিটি ঘাটে পাহারা বসালেন এবং বোন রওশন আরা ও অন্যান্য দূত মারফত সকল খবর রাখতে থাকলেন।
বাহাদুরগড়ের যুদ্ধ:
১৬৫৮ সালে বাংলা থেকে সুজাই সর্ব প্রথম তার বাহিনী নিয়ে দিল্লি অভিমুখে যাত্রা করেন। এই সংবাদ বৃদ্ধ শাহজাহানের নিকট পৌঁছলে তিনি সুজাকে প্রতিহত করার জন্য দারাশিকোর পুত্র সুলায়মান শিকোকে সৈন্য দিয়ে প্রেরণ করেন। সুলায়মানের সঙ্গী হন আম্বরের রাজা জয় সিং। এই মিলিত বাহিনীর সাথে বাহাদুরগড়ের যুদ্ধে সুজা পরাজিত ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হন। জয় সিং তাকে বাংলার সীমানা পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে যান।
মুরাদ আওরঙ্গজেব চুক্তি:
এদিকে আওরঙ্গজেবও আগ্রা অভিমুখে যাত্রা করেন। দিপালপুরে মুরাদের বাহিনীর সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। স্বার্থসিদ্ধির জন্য আওরঙ্গজেব চুক্তি করেন মুরাদের সাথে। সিদ্ধান্ত হয় দু’জন এক জোট হয়ে দারা ও সুজার বিরুদ্ধে লড়বেন। জয়ী হলে সম্পদের ১/৩ অংশ আর পাঞ্জাব, সিন্ধু, আফগানিস্তান ও কাশ্মির পাবেন মুরাদ। এই চুক্তি ছিল আওরঙ্গজেবের কূটনীতির প্রথম সাফল্য। এর মাধ্যমে তিনি সাময়িকভাবে একজন বিরোধী কমিয়ে ফেলেন। দুই শাহজাদার মিলিত বাহিনী আগ্রার দিকে অগ্রসর হলো।
ধর্মাটের যুদ্ধ:
মুরাদ ও আওরঙ্গজেবের মিলিত বাহিনীকে প্রতিহত করতে দারা যোধপুরের অধিপতি যশবন্ত সিংকে এবং কাশিম খানকে পাঠান। এই দু’জনের নেতৃত্বে যথেষ্ট সমন্বয়হীনতা ছিল। অতঃপর ১৬৫৮ সালের ২৫ এপ্রিল ধর্মাট নামক স্থানে দুই দলে প্রচন্ড যুদ্ধ বাধে। দুই শাহজাদার সুসংগঠিত বাহিনীর সংখ্যাগরিষ্ঠতা, আর তার সাথে আওরঙ্গজেবের সুনিপুণ রণকৌশলের কাছে প্রাণপণ যুদ্ধ করেও যশবন্ত সিং এবং কাশিম খান হার মানতে বাধ্য হন। আহত হয়ে যশোবন্ত সিং পালিয়ে যোধপুর পৌঁছান।কাশিম খানের অধীনস্থ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাকেও আওরঙ্গজেব নিজের দলে টেনে নিয়েছিলেন। ফলে প্রতিপক্ষ আরও দুর্বল হয়ে হারতে বাধ্য হয়। ধর্মাটের এই যুদ্ধে বিজয় আওরঙ্গজেবের দাপট অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়।
সামুগড়ের যুদ্ধ :
ধর্মাটের যুদ্ধে জয়লাভ করে আওরঙ্গজেব যুদ্ধক্ষেত্রের কাছাকাছি ফতেহাবাদ নামে একটি শহরের গোড়াপত্তন করেন। তারপর শক্তিশালী এক বাহিনী নিয়ে তিনি চম্বল অতিক্রম করে সামুগড়ে পৌঁছান। আগ্রা থেকে এটি ছিল আট মাইল পূর্বে। এবার দারা পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী নিয়ে স্বয়ং সামুগড়ে পৌঁছান। ২৯ মে ১৬৫৮, সংঘটিত হয় সামুগড়ের যুদ্ধ। দারা হাতির পিঠে চেপে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। দারার পক্ষে ছিলেন সেনাপতি খলিলুল্লাাহ খান ও রুস্তম খান এবং রাজপুত নেতা রাম সিংহ। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগৃহীত তার সৈন্যদের মধ্যে ঐক্যের অভাব ছিল যথেষ্ট। আওরঙ্গজেবের ইউরোপিয়ান গোলন্দাজ বাহিনী লাগাতার গোলা ছুঁড়ে পরিস্থিতি বেসামাল করে দেয়। দারা এ সময় হাতির পিঠ থেকে নেমে ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ করতে থাকেন। কিন্তু তার সৈন্যরা হাতির পিঠে তাকে না দেখে তিনি নিহত হয়েছেন বা পলায়ন করেছেন ভেবে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। দারা যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। এই যুদ্ধে দারার প্রায় দশ হাজার সৈন্য নিহত হয়। দারা সহচর ও পরিবার পরিজন নিয়ে দিল্লী পালিয়ে যান।
আরও পড়ুন-
আওরঙ্গজেবের আগ্রায় প্রবেশ:
বিজয়ী আওরঙ্গজেব ও মুরাদ আগ্রায় উপস্থিত হন। স¤্রাট শাহজাহান আওরঙ্গজেবকে দেখা করার আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু সতর্ক আওরঙ্গজেব সাক্ষাৎ থেকে বিরত থাকেন। তিনি দুর্গের ভেতরে যমুনার পানি সরবরাহের পথ বন্ধ করে দেন। অতঃপর জাহানারার মধ্যস্থতায় শাহজাহান ও আওরঙ্গজেবের সাক্ষাৎ হয়। আওরঙ্গজেব শেষ পযর্ন্ত বৃদ্ধ সম্রাটকে গৃহবন্দী করেন। শেষ বয়সে দাপুটে স¤্রাট শাহজাহান পুত্রের কাছে নজরবন্দী হয়ে অন্তপুরে অবরুদ্ধ দিন কাটাতে থাকেন। কন্যা জাহানারাও তার সাথে স্বেচ্ছায় বন্দীত্ব বরণ করেন। আগ্রার দায়িত্ব পুত্র মোহাম্মদের হাতে দিয়ে আওরঙ্গজেব দিল্লীর দিকে রওনা দেন।
মুরাদের বন্দিত্ব ও মৃত্যুদন্ড:
এদিকে তলে তলে মুরাদ আরও সৈন্য সংগ্রহ করতে থাকেন। প্রয়োজন শেষে মুরাদকেও পথ থেকে সরানো দরকার ছিল। তাই দিল্লী যাত্রার পথে আওরঙ্গজেব মথুরায় যাত্রা বিরতিকালে মুরাদকে নৈশভোজের জন্য শিবিরে আমন্ত্রণ জানান। মুরাদ তার এক সহচরের পরামর্শে নৈশোভোজে যোগ দেন। উল্লেখ্য, এই সহচরকে আগেই অর্থ দিয়ে বশীভূত করে নিয়েছিলেন আওরঙ্গজেব। ভোজে মুরাদকে প্রচুর মদ খাওয়ানো হয় এবং তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়লে একজন পরিচারিকা দিয়ে তাকে তাঁবুতে পাঠানো হয়। ক্লান্ত, মাতাল মুরাদ শীঘ্রই ঘুমিয়ে পড়লে তার কোষ থেকে তরবারি বের করে নেয় সেই পরিচারিকা। এভাবে খুব সহজেই বন্দী হয়ে যান মুরাদ। তাকে প্রথমে দিল্লীর দুর্গে বন্দী রাখা হয়েছিল, পরে গোয়ালিয়রের দুর্গে পাঠানো হয়। সেখানে গুজরাটের দিউয়ান মীর আলী নকীকে হত্যার অপরাধে কাজীর বিচারে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। ১৬৬১ সালের ৪ ডিসেম্বর মুরাদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।
দারাশিকোর চুড়ান্ত পরাজয় ও পরিণতি:
মুরাদকে পথ থেকে সরানোর পর আওরঙ্গজেব যথেষ্ট নিশ্চিন্তে দিল্লীর দিকে যাত্রা করেন। এদিকে দারা দিল্লীতে যথেষ্ট সৈন্য সংগ্রহ করে নিজেকে শক্তিশালী করতে পারেননি। সংঘাত এড়াতে তিনি লাহোর পালিয়ে যান। আওরঙ্গজেব নির্বিঘ্নে দিল্লী দখল করে নিয়ে ১৬৫৮ সালের ২১ জুলাই নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেন এবং ‘আলমগীর’ নাম ধারণ করেন। এরপর আওরঙ্গজেব নিজেকে পুরোপুরি নিষ্কন্টক করতে চাইলেন। তিনি দু’দিকে দু’টি বাহিনী প্রেরণ করলেন। একটি বাহিনী দারার পেছনে লাহোরের দিকে গেল, আরেক বাহিনী গেল এলাহাবাদের দিকে দারার পুত্র সুলায়মান ও আরেক ভাই শাহ সুজাকে দমন করার জন্য।
দারা বিপদ বুঝে লাহোর ছেড়ে গুজরাটের দিকে পলায়ন করেন। আহমেদাবাদের শাসক তাকে সাদরে গ্রহণ করেন। তার কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পেয়ে দারা সৈন্য সংগ্রহ করে আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। মহারাজ যশবন্ত সিং এ সময় তাকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা রক্ষা করেননি। তিনি গোপনে বিজয়ী সম্রাট আওরঙ্গজেবের পক্ষে যোগ দিয়েছিলেন। আজমীরের নিকট দেওয়াইয়ের গিরিপথে আওরঙ্গজেবের সৈন্যের সাথে দারার তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দারা পুনরায় আহমেদাবাদে ফিরে আসেন। কিন্তু এবার সেখানকার শাসনকর্তা তাকে শহরে ঢুকতে বাধা দেন। বিজয়ের পতাকা কোনদিকে সমুচ্চ থাকবে তা তিনি নিশ্চিত বুঝে গিয়েছিলেন। ভাগ্য বিড়ম্বিত দারা এবার আফগানিস্তানের পথে অগ্রসর হন।
পথে দাদার নামক স্থানে মালিক জিওয়ান নামে এক বেলুচ সর্দারের কাছে তিনি আশ্রয় লাভ করেন। দারার স্ত্রী নাদিরা বেগমও তার সঙ্গী হয়ে এ পথে চলছিলেন। পথের ক্লান্তি, ধকল সহ্য করতে না পেরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন ও দাদারেই মৃত্যুবরণ করেন। এদিকে মালিক জিওয়ান দারার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করে সপরিবারে তাকে তুলে দেন আওরঙ্গজেবের সেনাদের হাতে।
দারাকে তার দ্বিতীয় পুত্র সিপহির শিকোহ ও দুই কন্যাসহ দিল্লীতে নিয়ে আসা হয়। আওরঙ্গজেব তাদের চরমভাবে অপমান করার সিদ্ধান্ত নেন। পিতা ও পুত্রকে জীর্ণ কাপর পরিয়ে একটি রুগ্ন হাতির পিঠে উল্টোমুখে বসিয়ে দিল্লীর রাস্তায় রাস্তায় ঘোরানো হয়। ফরাসি পর্যটক ফ্রান্সিস বার্ণিয়ার এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বর্ণনা দেন।
অবশেষে দারাকে বিচারের সম্মুখীন করা হয়। সভাসদগণ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন তার বিচার নিয়ে। দানিশমান্দ খান দারার প্রাণভিক্ষার আবেদন জানান। কিন্তু শায়েস্তা খান ও আপন বোন রওশন আরা দারাকে নাস্তিক সাব্যস্ত করে তার মৃত্যুদন্ড প্রার্থনা করেন। আলেম-উলামাগণও মৃত্যুদন্ডের পক্ষে রায় দেন। অবশেষে তার বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্মের বিরোধীতা করার অভিযোগ আনা হয় এবং ১৬৫৯ সালের ৩০ আগস্ট তাকে প্রাণদন্ড দেওয়া হয়।
সুজার পরিণতি:
উত্তরাধিকার সংগ্রামে শাহ সুজা ছিলেন আওরঙ্গজেবের শেষ প্রতিদ্বন্দ্বী। বাহাদুরগড়ের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সুজা বাংলায় পালিয়ে এসেছিলেন। আওরঙ্গজেব দিল্লীর সিংহাসনে বসার পর সুজাকে তার পদে অধিষ্ঠিত রাখার আশ্বাস দান করেন। কিন্তু সুজা তাকে বিশ্বাস করতে পারেননি। তিনি যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৬৫৯ সালে উত্তর প্রদেশের খাজুয়া নামক স্থানে তাদের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে অনিবার্যভাবে সুজার পরাজয় ঘটে। তিনি প্রথমে বাংলা ও পরে আরাকান পালিয়ে যান। আরাকানের মগ রাজা তাকে প্রথমে সাদরে গ্রহণ করলেও পরে তাদের মধ্যে তিক্ততার সৃষ্টি হয়। বনিক মারফত জানা যায় যে, ভাগ্য বিড়ম্বিত সুজা আরাকানের মগদের হাতে নিহত হন।
এভাবেই ছল, বল ও কৌশলের সুচারু প্রয়োগ ও সময়ের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে, নিজের বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা কাজে লাগিয়ে আওরঙ্গজেব ভারত বর্ষের একচ্ছত্র স¤্রাট হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এই সংগ্রাম নিঃসন্দেহে নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতামূলক, কিন্তু ক্ষমতার জন্য যে কোনো সীমা লঙ্ঘণ করা মুঘল বংশের রক্তে ছিল। উল্লেখ্য, সম্রাট শাহজাহানও তার যৌবনে পিতা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন, জাহাঙ্গীর করেছিলেন তার পিতা আকবরের বিরুদ্ধে। কিন্তু আওরঙ্গজেবের সময়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেশি ছিল এবং প্রত্যেক প্রতিদ্বন্দ্বি ছিলেন যথেষ্ট দক্ষ। আওরঙ্গজেব নিজেকে তুলনামূলক যোগ্যতর হিসেবে উপস্থাপন করেন এবং সম্রাট পদবীটি অর্জন করেন।
আরও পড়ুন-
বাঙ্গালি জাতির নৃতাত্ত্বিক পরিচিতি, Ethnographic identity of the Bengali nation
আওরঙ্গজেবের সফলতার কারণ:
আওরঙ্গজেবের যোগ্যতা:
শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে তৃতীয় পুত্র আওরঙ্গজেব ছিলেন সর্বাপেক্ষা অধিক শক্তিশালী,যোগ্য ও প্রতিভা সম্পন্ন। দারাশিকো ছিলেন রুক্ষ মেজাজ ও উগ্র স্বভাবের। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন হলেও সুজা ছিলেন আয়েশী, দুর্বল ও অলস। মুরাদ অত্যধিক ভোগবিলাসী ও মদ্যপ হওয়ায় আওরঙ্গজেব তাকে হাতের পুতুলে পরিণত করেছিলেন।
সামরিক বাহিনীর দক্ষতা
আল দীর্ঘকাল দাক্ষিণাত্যের অবস্থানের কারণে আওরঙ্গজেব ঠিক রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন।আরঙ্গজেব এর সুশৃংখল সামরিক বাহিনী,দক্ষ সেনাপতিত্ব ও উন্নত রণকৌশলের কাছে দারাশিকো সুজা এবং মুরাদ পরাস্ত হয়েছিলেন।
আওরঙ্গজেবের কূটনীতি:
সুচতুর ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন আরঙ্গজেব তার কূটনৈতিক চালে সহজেই অনভিজ্ঞ মুরাদকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
চারিত্রিক দৃঢ়তা:
শাহজাহানের বিবদমান এই চার পুত্রের মধ্যে চারিত্রিক দিক থেকে আওরঙ্গজেব ছিলেন সবচেয়ে বেশি এগিয়ে। দারাশিকো রুক্ষ মেজাজ ও উগ্র স্বভাবের, সুজা আয়েশী, দুর্বল ও অলস এবং মুরাদ মদকাসক্ত ছিলেন। পক্ষান্তরে আরঙ্গজেব এর সব দোষ ত্রুটি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন এবং উত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। জাতার গ্রহণযোগ্যতাকে বৃদ্ধি করেছে।
ধর্ম নিষ্ঠা:
আওরঙ্গজেব ধর্মনিষ্ঠ ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ইসলামী অনুশাসন মেনে চলতেন এবং অন্যান্যদের থেকে ধার্মিকতা ও ইসলামী জ্ঞানে এগিয়ে ছিলেন। ফলে মুঘল রাজদরবার এবং দাক্ষিণাত্য সহ সমগ্র দেশে তার একটা আলাদা ইমেজ ছিল যা তার বিজয়ের পথে সহায়তা করেছে।
জন সমর্থন:
আওরঙ্গজেবের সফলতার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে জনসমর্থন। সম্রাট শাহজাহান দারাশিকো কে পরবর্তী সম্রাট করতে চাইলেও কিন্তু দারাশিকোর জনগণের জনগণের তেমন সমর্থন ছিল না। অভিজাত বর্গ,সুন্নি আলেম ওলামা এবং জনসাধারণ ছিল আওরঙ্গজেবের পক্ষে। জনগণের এই সমর্থন আরঙ্গজেব এর বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল।
আরও পড়ুন-
মুহাম্মদ আলী পাশা এবং আধুনিক মিসর
Md. Billal Hossain
B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka
BCS General Education
Lecturer
Department of Islamic History & Culture
Chandpur Govt. College, Chandpur.
No comments:
Post a Comment