জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর
এবং
ভারতে মুঘল বংশ প্রতিষ্ঠা (1526-1858)
(Zahir Uddin Mohammad Babar and Establishment of the Mughal Dynasty in India)
১৫২৬ সালে পানিপথের যুদ্ধে জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর আফগান শাসক ইব্রাহীম লোদিকে পরাজিত করেন। এরই মাধ্যমে গোড়াপত্তন হয় মুঘল শাসনের। বাবর মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হলেও এই সাম্রাজ্য উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে তৃতীয় মুঘল সম্রাট জালালউদ্দিন মুহাম্মদ আকবরের হাত ধরে। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রায় ৩০০ বছর স্থায়ী হয়েছিল এই মুঘল শাসন। ভারতবর্ষে মোঘল সাম্রাজ্যের সীমানা বর্তমান বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান-আফগানিস্থান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সমসাময়িক অন্যান্য সাম্রাজ্যের তুলনায় ভীষণ প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তার করা মোঘলদের শাসনক্ষেত্র ছিল ৪০ লাখ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের। সে সময় প্রায় ১৫০ মিলিয়ন মানুষ বসবাস করত এই সাম্রাজ্যের অধীনে।বাবর, হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান এবং আওরঙ্গজেব এই বংশের উল্লেখযোগ্য শাসক। এই সাম্রাজ্য ১৮ শতকে দুর্বল হয়ে পড়ে। ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ১৮৫৭ সালে সর্বশেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ কে ক্ষমতাচ্যুত ও নির্বাসিত করার মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্যের আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘটে।
মুঘলদের পরিচিতি
মোঙ্গ শব্দ থেকে মোঙ্গল এবং মোঙ্গল থেকে মুঘল শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে।মোঙ্গ এর অর্থ ‘নির্ভীক’/‘সাহসী’। মোঙ্গলরা অত্যন্ত দুর্ধর্ষ ও নির্ভীক প্রকৃতির লোক ছিলেন। ভারত ইতিহাসে এই ‘মোঙ্গল' কথাটি থেকেই মুঘল অথবা মোগল কথাটির উৎপত্তি। মোঙ্গলদের আদি নিবাস ছিল বর্তমান মোঙ্গলিয়া।ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর পিতার দিক থেকে চেঙ্গিস খান এবং মাতার দিক থেকে তৈমুর লং এর বংশধর ছিলেন। এর মধ্যে চেঙ্গিস খান ছিলেন মোঙ্গল বা তাতার। আর তৈমুর লং ছিলেন তুর্কি। ফারসি ভাষায় মোঙ্গল শব্দটি মুঘলে রূপান্তরিত হয়।মুঘলরা জন্মগতভাবে মধ্য এশিয়ার বাসিন্দা, ধর্মে আরবীয়, কৃষ্টিতে ইরানীয় এবং স্থায়ীভাবে ভারতের বাসিন্দা। প্রায় ৩০০ বছরের রাজত্বের ইতিহাস এই বংশ গৌরবের সাথে রাজত্ব করেছে প্রায় ১৫০ বছর।
আরও পড়ুন-
জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর
(Zahir Uddin Mohammad Babar)
১৫২৬ সালে পানিপথের যুদ্ধে জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর আফগান শাসক ইব্রাহীম লোদিকে পরাজিত করেন। এরই মাধ্যমে গোড়াপত্তন হয় মুঘল শাসনের। জহির উদ্দিন মুহম্মদ বাবর মধ্যএশিয়া থেকে এসে ভারতে রাজনৈতিক সফলতা লাভ করেন। ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ১১ বছর বয়সে পিতৃ সিংহাসনে আরোহণকারী বাবর কালের পরিক্রমায় পিতৃরাজ্য ফারগানা ও সমরকন্দ থেকে বিতাড়িত হয়ে ১৫০৪ খ্রিস্টাব্দে অভ্যন্তরীণ গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলার সুযোগে কাবুল দখল করেন। বাবর ভারতবর্ষে কয়েকটি পর্যবেক্ষণমূলক অভিযানে সফলতা লাভের পর ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে লোদী বংশের সর্বশেষ সুলতান ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত হত্যা করে দিল্লি সালতানাতের স্থলে মুঘল বংশের প্রতিষ্ঠা করেন।
জন্ম ও বংশ পরিচয়ঃ
নাম : জহির উদ্দিন মুহাম্মদ
উপনাম : বাবর,বাবর -তুর্কি শব্দ, এর অর্থ সিংহ/বাঘ
জন্ম : জহির উদ্দিন মোহাম্মদ জন্মেছিলেন ১৪৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি।
পিতা : ওমর শেখ মির্জা
মাতা : কুতলুঘ নিগার খানম
গৃহ শিক্ষক : আব্দুল মজিদ
বাবরের জন্ম মধ্য এশিয়ার ফারগানা প্রদেশের আনদিজান শহরে। ফারগানা বর্তমানে উজবেকিস্তান নামে পরিচিত। তিনি ফারগানা প্রদেশের শাসনকর্তা ওমর মির্জার বড় পুত্র ছিলেন। বাবরের মোঙ্গল জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত বারলাস গোত্রে বেড়ে উঠলেও তারমধ্যে পারস্য ও তুর্কি সংস্কৃতির সংমিশ্রণে লক্ষণীয়। বাবর আরবি, ফার্সি ও তুর্কি ভাষায় দক্ষ ছিলেন ।
জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর পিতার দিক থেকে চেঙ্গিস খান এবং মাতার দিক থেকে তৈমুর লং এর বংশধর ছিলেন।বাবরের বাবা ওমর শেখ মির্জা ফারগানার আমির ছিলেন, তিনি ১৪৯৪ সালে মারা যার, তখন বাবরের বয়স মাত্র ১১ বছর।
বাবরের ক্ষমতায় আরোহনঃ
১৪৯৪ সালে বাবর মাত্র এগার-বারো বছর বয়সে বাবার উত্তরাধিকারী হিসেবে বর্তমান উজবেকিস্তানের (তখন বলা হতো ফারগানা) সিংহাসনে বসেন। বাবরের প্রথম শাসনকাল শুরু হয় অনেকগুলো পরাজয় দিয়ে। সিংহাসনে আরোহনের সাথে সাথেই চরম বিরোধিতার মুখোমুখি হন বাবর। এখানে বলে রাখা ভালো, তখন মধ্য এশিয়ার আশেপাশের প্রায় সব এলাকার শাসকর্তারা ছিল তারই আত্মীয়-স্বজন (আহমদ মির্জা, মাহমুদ খান, সাইবানি খান)। এদের মধ্যে বিশেষ করে তার দুই চাচা বাবরকে সিংহাসন থেকে সরাবার চেষ্টা করতে থাকে। বাবর তার নানী আইসন দৌলত বেগমের সহায়তায় এবং কিছুটা ভাগ্যের জোরে তাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দেন।
আরও পড়ুন-
সম্রাট শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যকার উত্তরাধিকার যুদ্ধ
বাবরের উত্থান-পতন
১৪৯৭ সালে বাবর ফারগনার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ইরানের সমরকন্দ শহর জয় করে ফেলেন মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সেই। কিন্তু ১৪৯৮ তা হাতছাড়া হয়ে যায় এবং নিজ রাজ্য ফারগানা ও হাতছাড়া হয়ে যায়, তিনি রাজ্য হারা হন। ১৫০০ সালে তিনি ফারগানা পুনরুদ্ধার করেন এবং
১৫০২ সালে আবারো সমরকন্দ দখল করেন ১৫০৩ তিনি মোহাম্মাদ উজবেক নেতা শায়বানী খানের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে ফারগানা ও সমরকন্দ থেকে বিতাড়িত হন। আরম্ভ হয় বাবরের কঠিন সময়।
বাবর তার অল্প কিছু অনুসারী নিয়ে মধ্য এশিয়ার পর্বতমালা এবং তাশখন্দের আশেপাশের অঞ্চলে উদভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ান কয়েক বছর। ভাগ্যের পরিহাস, উজবেকিস্তানের শাসক হবার মাত্র দশ বছরের মাথায় বাবর হয়ে যান কপর্দকহীন রাজ্যবিহীন এক যাযাবর। এই সময়টায় তিনি বেঁচে ছিলেন স্থানীয় কৃষক আর তার কিছু বন্ধুদের সহায়তায়। আশেপাশের কোনো রাজ্যই তাকে আশ্রয় দিতে এগিয়ে আসেনি, যদিও এসব রাজ্যের বেশীরভাগ অধিপতিরা ছিল বাবরেরই ঘনিষ্ট আত্মীয়-স্বজন। যেমন, তাশখন্দের শাসক ছিলেন বাবরের আপন মামা, যিনি কিছুতেই বাবরকে তার রাজ্যে দেখতে চাননি। বাবর পরবর্তীতে নিজেই লিখেছেন, "তাশখন্দে অবস্থানকালে আমি অনেক দারিদ্র্যতা ও অপমান সহ্য করেছি। না ছিল আমার কোনো দেশ, না কোনো আশা!"
১৫০৪ সালে বাবর অত্যন্ত দুঃসাহসিক অভিযানে তুষারে আবৃত দুর্গম হিন্দুকুশ পর্বতমালা পেরিয়ে করে কাবুল দখল করেন। যা কিনা তখন অনেক শাসকের কাছে ছিল অকল্পনীয়। রণকৌশল হিসেবে এরপর তিনি ইরানের সাফাভিদদের সাথে মৈত্রী করে ১৫১১ সালে সমরকন্দসহ ফারগানা এবং তুর্কিস্তানের কিছু এলাকা দখল করেন । কিন্তু এই বিজয় বেশীদিন ভোগ করতে পারলেন না,
১৫১২ সালে আবার শায়বানী খানের কাছে পরাজিত হয়ে তিনি সমরকন্দসহ তুর্কিস্তানের বিজিত এলাকাগুলো হারিয়ে ফেললেন। এরপর তিনি কাবুল ফিরে যান। সমরকন্দ হারানোর ব্যথা তাকে বহুদিন তাড়া করে বেড়ায়। এমনকি বিশাল ভারতবর্ষের সম্রাট হবার পরও সমরকন্দে বারবার পরাজয়ের কথা তিনি কিছুতেই ভুলতে পারেন নি। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বাবর সমরকন্দ না পাবার আক্ষেপ করে গেছেন। তৃতীয়বারের মতো সমরকন্দ হাতছাড়া হবার পর বাবর মনোযোগ দিলেন ভারতের দিকে।
আরও পড়ুন-
হুমায়ুন-শেরশাহ (মুঘল-আফগান) সংঘর্ষ এবং শুর বংশ প্রতিষ্ঠা
জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবরের ভারত অভিযান:
তৎকালিন ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক অবস্থাঃ
বাবরের ভারত অভিযানের প্রাক্কালে তৎকালীন দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন লোদী বংশের সর্বশেষ শাসক ইব্রাহিম লোদী। দিল্লি সালতানাত তখন ধীরে ধীরে পতনের দিকে ধাবিত হচ্ছিল। দিল্লির কেন্দ্রীয় শক্তি অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এ সুযোগে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক ছোট ছোট স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। যেমন উত্তর ভারতে কাশ্মীর, জৌনপুর, দক্ষিণ ভারতে বিজয় নগর, পূর্বভারতে বাংলা,বিহার,উরিষ্যা, পশ্চিম ভারতের পাঞ্জাব, গুজরাট ইত্যাদি। প্রদেশগুলো স্বাধীনভাবে চলার চেষ্টা করেছে এবং কেন্দ্রের সাথে প্রদেশের যোগাযোগ শিথিল হয়ে পড়েছিল। ফলে ইব্রাহিম লোদীর ক্ষমতা দিল্লি এবং তার আশেপাশে সিমিত হয়ে পড়েছিল। এসব বিদ্রোহী শক্তিকে দমন করার মত যোগ্যতা ও শক্তি- সামর্থ্য ইব্রাহিম লোদীর ছিল না। প্রদেশপাল এবং ইব্রাহিম লোদীর আত্মীয়-স্বজনদের ষড়যন্ত্রের কারণে তার ক্ষমতা অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে লোদী বংশের বিভিন্ন অভিজাত ও আমির -উমরাদের মধ্যকার স্বার্থবাদী সংঘাত ছিল প্রকট, যা রাষ্ট্রের ঐক্য বিনষ্ট করেছিল। এমন একটি নৈরাজ্যকর রাজনৈতিক অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করে বাবর ভারত আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
বাবরের ভারত অভিযানের কারণসমূহ:
বাবরের উচ্চাভিলাসী মনোভাব:
পিতা-মাতা উভয় দিক থেকেই বাবর ছিলেন অভিজাত পরিবারের সন্তান সে কারণে স্বভাবতই বাবর ছিলেন উচ্চাভিলাষী মনোভাবের অধিকারী 13 বছর বয়সে যে বাবর সিংহাসনের অধিকারী হয়েছিলেন তিনি কখনোই সিংহাসন ছাড়া নিজেকে কল্পনা করতে পারেননি বাবরের এই উচ্চাভিলাষী মনোভাব তার ভারত অভিযানের অন্যতম কারণ।
ভারতের রাজনৈতিক দুর্বলতা
ভারতে তখন ছিল লোদী বংশের শাসন। দিল্লি সালতানাত তখন পতনোন্মুখ সময় অতিক্রম করছিল। তৎকালীন ভারতে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব শিথিল হয়ে পড়েছিল। প্রদেশগুলোর সাথে কেন্দ্রের সম্পর্ক ভালো ছিল না। প্রদেশগুলো স্বাধীনভাবে চলার চেষ্টা করেছিল। তাছাড়া কেন্দ্রীয় শাসক ইব্রাহিম লোদীর সাথেপ্রদেশ পালদের সম্পর্কের টানাপোড়েন ছিল প্রকট। ভারতের ভারতের এই রাজনৈতিক দুর্বলতা বাবরকে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
মধ্য এশিয়ায় বারবার ব্যর্থতা
বাবর মধ্যেএশিয়াতে তার পৈত্রিক রাজ্যে বারবার ব্যর্থ হয়েছিলেন। তিনি সেখানে স্থিরভাবে রাজ্য শাসন করতে পারেননি মধ্য এশিয়া তে তারেই উত্থান-পতন তার রাজনৈতিক গতিপথ পরিবর্তন করেছে যেহেতু তিনি অনেক চেষ্টার পরও মধ্য এশিয়ায় স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেননি সেজন্য তিনি বিকল্প হিসেবে ভারতের দিকে দৃষ্টিপাত করেছিলেন, আর সময়টি ছিল ভারত অভিযানের জন্য উপযুক্ত।
কাবুলের তীব্র অর্থ সংকট:
বাবর বাবর সর্বশেষ কাবুলে প্রতিষ্ঠা ছিলেন এখানে তিনি অর্থসংকটে ছিলেন। অন্যদিকে ভারত অর্থ-সম্পদে পরিপূর্ণ ছিল। সেজন্য ভারত থেকে অর্থ সম্পদ নিয়ে কাবুল গঠন করা আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল। তবে বাবর ভারতে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব লাভের পর তিনি আর কখনোই কাবুলে ফিরে যাননি।
প্রাথমিক অভিযানসমূহ:
দিল্লির শাসক ইব্রাহিম লোদীর বিরুদ্ধে পানিপথের যুদ্ধের পূর্বেও বাবর কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। এসব অভিযানকে প্রাথমিক অভিযান বলা হয়ে থাকে। ১৫১৯ থেকে ১৫২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাবর ভারতে তিনটি অভিযান পরিচালনা করেন। এসব অভিযানে তিনি সিন্ধুনদ অতিক্রম করে অতি সহজেই বজৌর দুর্গ, ভীরা, কুশব ও চেনাব নদীর অববাহিকা অঞ্চল দখল করেন।
১৫২৪ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবের শাসনকর্তা দৌলত খান লোদী ও কয়েকজন আফগান অমাত্য বিশেষ করে আলম খানের আমন্ত্রণ জানালে বাবর তাঁর সৈন্যবাহিনীসহ পাঞ্জাবে প্রবেশ করেন এবং লাহোর, দিপালপুর ও অন্যান্য স্থান অধিকার করেন।যখন দৌলতখান লোদী আলম খান ও অভিজাত বর্গ ভারতে বাবরের স্থায়ী প্রভুত্ব স্থাপনের মনোভাব বুঝতে পারেন তখন বাবরের লাহোর দখল তাদের মনোঃপুত হয়নি এবং স্বভাবতই তারা বাবরের বিরোধিতা শুরু করেন। তাদের বিরোধিতার বাধ্য হয়ে বাববর ভারত ত্যাগ করে কাবুলে প্রত্যাবর্তন করেন।
পানিপথের প্রথম যুদ্ধ, ১৫২৬:
বাবর ১৫২৫ খ্রিস্টাব্দে বাবর পূর্ণোদ্যমে সসৈন্যে কাবুল থেকে ভারত অভিমুখে যাত্রা করেনএবার তিনি সহজেই পাঞ্জাব অধিকার করেন এবং খান দৌলতখান বাবরের অধীনতা স্বীকার করেন । অতঃপর বাবর দিল্লির দিকে এগিয়ে যান। তিনি দিল্লির নিকটবর্তী পানিপথ প্রান্তরে দিল্লির লোদী বংশের শেষ সুলতান ইব্রাহিম লোদীর সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পরেন। তারিখটি ছিল ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে ১২ এপ্রিল। বাবরের আত্মজীবনী তুযুক-ই-বাবরী থেকে জানা যায়, এ সময়ে তাঁর সাথে বার হাজার সৈন্য ছিল। তাছাড়া পাঞ্জাব জয়ের পর কিছু সংখ্যক অতিরিক্ত সৈন্যও তাঁর সাথে যোগদান করে। তাঁর জ্যৈষ্ঠপুত্র হুমায়ুনও তাঁর সাথে যোগ দিয়েছিলেন। অপরদিকে ইব্রাহিম লোদীর সৈন্য সংখ্যা ছিল এক লক্ষ। পানিপথ প্রান্তরে বাবর ভিন্ন রকম যুদ্ধ কৌশল গ্রহণ করেছিলেন। প্রতিরক্ষা হিসেবে পরিখা খনন করেন। আর ভারতবর্ষে প্রথমবারের মতো কামান ও গোলন্দাজ বাহিনী ব্যবহার করেন। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদী পরাজিত ও নিহত হন।
এক নজরে পানিপথের ১ম যুদ্ধ:
পানিপথ একটি স্থনের নাম যা দিল্লি থেকে ৮০ কিলোমিটার উত্তরে হরিয়ানা রাজ্যে অবস্থিত।
যুদ্ধে বাবরের সাফল্যের কারণ
বাবরের সামরিক বাহিনী ইব্রাহিম লোদীর সামরিক বাহিনীর চেয়ে অধিক সুশৃঙ্খল ও সুশিক্ষিত ছিল।
ইব্রাহিম লোদীর অস্ত্রশস্ত্র অপেক্ষা বাবরের অস্ত্রশস্ত্র ছিল অধিক উন্নতমানের।
বাবর ছিলেন একজন দক্ষ সেনানায়ক। তিনি ইব্রাহিম লোদীর বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে দক্ষতার সাথে এবং উন্নত যুদ্ধ কৌশল গ্রহণ করে জয় লাভ করেন। তাছাড়া যুদ্ধ পরিচালনায় ইব্রাহিম লোদী অপেক্ষা বাবর অধিক অভিজ্ঞ ছিলেন।
আত্মীয় স্বজনের ষড়যন্ত্র ইব্রাহিম লোদীকে দুর্বল ও শক্তিহীন করে ফেলেছিল যা বাবরকে যুদ্ধে অনুপ্রাণিত করেছিল।
বাবর প্রথম ভারতবর্ষে যুদ্ধ ক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্র কামান ব্যবহার করেন। তাঁর গোলন্দাজ বাহিনী সুশৃঙ্খল ও দক্ষ ছিল।
বাবর উজবেগী ও তুর্কীদের নিকট থেকে নতুন রণকৌশল শিখেছিলেন। এ কৌশলকে বলা হত ‘তুলঘুমা’ যুদ্ধরীতি। এ রীতি মোতাবেক তিনি যুদ্ধে পরিখা খনন, সৈন্যদের মাঝে ব্যুহ রচনা, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার ও অশ্বারোহী দ্বারা আক্রমণ পরিচালনা করেন।
ভারতের রাজনৈতিক অনৈক্য বাবরের জয়ের অন্যতম কারণ।
ইব্রাহিম লোদীর সৈন্যসংখ্যা ইব্রাহিম লোদীর সৈন্য সংখ্যা বেশি হলেও তাদের মধ্যে ঐক্য ছিল না। পক্ষান্তরে বাবরের বাহিনী বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর দ্বারা গঠিত হলেও তা বাবর এর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ ছিল।
আরও পড়ুন-
শেরশাহের ভূমি রাজস্ব ও প্রশাসনিক সংস্কার
পরবর্তী যুদ্ধ বিগ্রহ:
ভারতের অন্যান্য শক্তির মধ্যে রাজপুত শক্তি ছিল অন্যতম। রাজপুতানার মেবারের অধিপতি ছিলেন রানা সংগ্রাম সিংহ। সংগ্রাম সিংহ আশা করেছিলেন যে বাবর তাঁর পূর্বপুরুষের ন্যায় দিল্লি লুট করে স্বদেশে ফিরে যাবেন। তখন তিনি ইব্রাহিম লোদীর রণক্লান্ত সেনাবাহিনীকে সহজেই পরাস্ত করে মুসলিম শাসনের ধ্বংসস্তূপের উপর এক স্বাধীন হিন্দুরাজ্য প্রতিষ্ঠা করবেন। কিন্তু পানিপথের যুদ্ধে জয় লাভের পর বাবরের ভারতবর্ষে স্থায়ীভাবে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সংকল্পের কথা জেনে সংগ্রাম সিংহ একটি শক্তিশালী রাজপুত সৈন্য বাহিনী গঠন করেন। বিভিন্ন রাজ্যের নেতৃবর্গ, আজমীর, মারওয়াড়, আম্বর ও চান্দেরীর রাজপুতগণ এবং মেওয়াটের হাসান খান তাঁর দলে যোগদান করেন।
প্রতিপক্ষের যুদ্ধ প্রস্তুতি দেখে বাবরের সৈন্যগণ আতংকিত হয়ে পড়ে এবং যুদ্ধ না করে কাবুলে ফিরে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠে। সেনাদলের মনোবল বৃদ্ধির জন্য বাবর দু’টি কাজ করেন। তিনি নিজের পানপাত্র ভেঙ্গে ফেলেন এবং তাঁর সোনার ও রূপার পানপাত্রগুলো বিতরণ করে দেন। বাবর সৈন্যদেরকে উদ্দীপ্ত করে মানসিক শক্তি বাড়িয়ে দেন। এভাবে তিনি রাজপুতদের মোকাবেলা করার জন্য আগ্রার পশ্চিমে খানুয়ার প্রান্তরে সৈন্য সমাবেশ করেন।
খানুয়ার যুদ্ধ, ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দ:
১৫২৭ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ খানুয়ার প্রান্তরে রানা সংগ্রাম সিংহ এবং বাবরের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। প্রায় ১০ ঘন্টার যুদ্ধে রাজপুত বাহিনী অসাধারণ বিক্রম দেখালেও বাবরের রণকৌশল শেষ পর্যন্ত রাজপুতদেরকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়।বাবর এ যুদ্ধেও তুলঘুমা যুদ্ধ রীতি এবং আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারের দ্বারা রাজপুত শক্তিকে ধ্বংস করেন। সংগ্রাম সিংহ আহত অবস্থায় যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করেন। কিছুদিনের মধ্যে তাঁর সহযোগীরা তাঁকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করে।
গোগরার যুদ্ধ, ১৫২৯:
ভারতবর্ষের দু’টি বৃহৎ শক্তি ইব্রাহিম লোদী ও রানা সংগ্রাম সিংহ বাবরের নিকট পরাজিত হলেও পূর্ব ভারতের আফগানগণ তাঁকে মনে প্রাণে গ্রহণ করতে পারেন নি। বাংলার সুলতান নুসরত শাহের আশ্রয়ে আফগান সর্দারগণ পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করতে থাকেন। বিহারের শের খান, জৌনপুরের মুহম্মদ লোদী এবং নুসরৎ শাহ একযোগে দিল্লি আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। বাবরের বাহিনী দ্রুত কনৌজ, বারাণসী, এলাহাবাদ দখল করে বিহার সীমান্তে গোগরা নদীর তীরে উপনীত হলে মুহম্মদ লোদী ও শের খান বাধা দেন। কিন্তু সুশিক্ষিত মোগল বাহিনীর নিকট আফগান বাহিনী পরাজিত হয়। ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দে মাহমুদ লোদী বাংলার সুলতান নাসিরুদ্দিন নুসরত শাহের শরণাপন্ন হন। কিন্তু বাবরের সঙ্গে নুসরত শাহের এক সন্ধি হয়। এর ফলে বাংলার সুলতান মোগল আফগান যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। বিনিময়ে বাবর নুসরত শাহের রাজ্য সীমা মেনে নেন এবং অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার অঙ্গীকার করেন। এ যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে ভারতবর্ষে বাবরের বিজয় অভিযান সমাপ্ত হয়। বাবর আমুদরিয়া থেকে গোগরা এবং হিমালয় থেকে গোয়ালিয়র পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূভাগের অধিপতি হন। এভাবে ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
বাবরের মৃত্যু:
বাবর ১৫৩০ সালের ২৬ ডিসেম্বর আগ্রায় মৃত্যুবরণ করেন। কথিত আছে যে, পুত্রের আরোগ্যের জন্য বাবর নিজেকে উৎসর্গ করেন। পুত্র হুমায়ুন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে পিতা বাবর তার নিজের জীবনের বিনিময়ে স্রষ্টার নিকট পুত্রের আরোগ্য কামনা করেন। ক্রমান্বয়ে হুমায়ুন আরোগ্য লাভ করতে থাকেন এবং বাবর পীড়িত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ইতিহাসবিদদের মতে, ইব্রাহিম লোদীর মা বাবরকে হত্যার জন্য বিষ প্রয়োগ করেছিলেন। সেই বিষের ক্রিয়া তার শরীরকে ধীরে ধীরে অসুস্থ করে দেয়। এছাড়া শারীরিকভাবে প্রবল শক্তিশালী বাবর ভারতের আবহাওয়ার সাথেও মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। হুমায়ুননামায় গুলবদন বেগম বলেছেন, বাবর অনেক আগে থেকেই পেটের পীড়ায় ভুগতেন। এছাড়া তাকে মানসিক ও শারীরিক অসুস্থতায়ও অনেক যুদ্ধে লড়তে হয়েছে। ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে জহির উদ্দিন বাবর আগ্রায় ইন্তেকাল করেন।
আরও পড়ুন-
ভারতীয় মুসলমানদের নবজাগরণে এবং আধুনিক শিক্ষার বিস্তারে সৈয়দ আমীর আলীর অবদান
বাবরের চরিত্র:
বিভিন্নমুখী প্রতিভার অধিকারী বাবর এশিয়ার ইতিহাসে এক আকর্ষণীয়, রোমাঞ্চকর ও কৌতূহলোদ্দীপক চরিত্র। বাবর ছিলেন সমসাময়িক এশিয়ার শাসকদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা দীপ্তিমান চরিত্রের অধিকারী। বাবরের চরিত্রে বীরসুলভ দু:সাহসিকতা,অদম্য অধ্যবসায়, রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি,, সামরিক প্রতিভা, দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়,অটুট মনোবল, অতুলনীয় রণনিপুণতা, দূরদর্শী রাজনৈতিক মেধা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, পিতৃবাৎসল্য, অসাম্প্রদায়িকতা, এবং গভীর মমত্ববোধ প্রভৃতি গুণাবলির এক অপূর্ব সমাবেশ ঘটেছিল।
তুর্কী ভাষায় ‘বাবর’ শব্দের অর্থ ‘সিংহ’। বাবরের চারিত্রিক গুণাবলি ও দৃঢ়তার জন্য তাঁর এ নামকরণ যথার্থ বলে অনেকে অভিমত প্রকাশ করেছেন। মধ্য এশিয়ার দুই প্রধান বিজেতা তৈমুর লং ও চেঙ্গিস খানের রক্ত তাঁর দেহে প্রবহমান ছিল।বাবরের চরিত্রে উভয় নেতার কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন দেখা যায়। তিনি ছিলেন মধ্য এশিয়ার একজন যাযাবর যোদ্ধা। যোদ্ধা জাতিসুলভ স্বভাব নিয়ে সমরখন্দ, আফগানিস্তান ও ভারতবর্ষে ভাগ্যান্বেষণ করেন। মধ্য এশিয়ার জন্য তাঁর ভালবাসা ছিল আন্তরিক। মধ্য এশিয়ার লোকদের স্বভাব অনুযায়ী বাবর যুদ্ধকে জীবনের এক স্বাভাবিক ধর্ম হিসেবে মনে করতেন।
জয় বা পরাজয়ে তিনি ছিলেন অবিচলিত। যুদ্ধের প্রয়োজনে চরম নিষ্ঠুরতা দেখালেও তিনি স্বভাব-নিষ্ঠুর ছিলেন না। যুদ্ধের মধ্যেও তিনি উদ্যান রচনা ও কবিতা রচনার কথা ভাবতেন। বস্তুত বাবরের হৃদয় ছিল কোমল। তিনি তাঁর পরিবারের লোকজনদেরকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। তিনি ছিলেন সাহসী, উচ্চাকাক্সক্ষী ও আত্মবিশ্বাসী, বিপদে তিনি ধৈর্য হারাতেন না।তীক্ষ্ণ বুদ্ধি দিয়ে তিনি শত্রুপক্ষের দুর্বল দিকগুলো খুঁজে বের করতেন। সঙ্গীত, কাব্য, সাহিত্যে তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল।
কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে বাবর ছিলেন ফরাসি বীর নেপোলিয়নের মতো আত্মনির্ভরশীল এবং ধৈর্যশীল। ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, “যোদ্ধা, শাসক ও পন্ডিত ব্যক্তি হিসেবে বাবর মধ্যযুগের একজন আকর্ষণীয় ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন নরপতি ছিলেন।” বাবর ছিলেন কষ্টসহিষ্ণু। রাজ্যহারা হয়ে তিনি বহু বিনিদ্র রজনী অতিবাহিত করেছেন। তবুও তিনি হতোদ্যম হন নি। সর্বোপরি তিনি ছিলেন স্নেহবৎসল পিতা।
ঐতিহাসিক রাশব্রুক উইলিয়ামের মতে, বাবর এর মধ্যে আটটি গুণের সমাবেশ ঘটেছিল; সেগুলো হলো নিখুঁত বিচারবুদ্ধি, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, যুদ্ধজয়ের নিপুন কৌশল, উন্নত প্রশাসনিক রীতি, উদারভাবে শাসন করার প্রতিভা, সেনাবাহিনীর হৃদয় জয় করার ক্ষমতা এবং ন্যায় বিচারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ
আরও পড়ুন-
মুহাম্মদ আলী পাশা এবং আধুনিক মিসর
বাবরের কৃতিত্ব:
মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা:
বাবরের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হচ্ছে তিনি ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ যা ভারতে প্রায় 300 বছর টিকে ছিল।রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে বাবর ভবঘুরে জীবন যাপন করেছেন মধ্য এশিয়ায় বাবরের ইতিহাস ছিল উত্থান-পতনের ইতিহাস। কিন্তু তিনি কখনো হতাশ হন নি। তাঁর অদম্য ইচ্ছা ও সাহসিকতার বলে তিনি সমস্ত বাধা বিপত্তি মোকাবেলা করে ভারতে একটি নতুন স্বাধীন রাজবংশের গোড়াপত্তন করতে সক্ষম হন।
সেনাপতি ও সামরিক সংগঠক
বাবরের মধ্যে তুর্কীদের সাহস ও কর্মদক্ষতার সাথে সাথে মোঙ্গলদের তেজস্বিতা ও সমর নিপুণতার এবং দুর্ধর্ষ যাযাবর তাতারদের বীরত্ব ও অস্থিরতার সঙ্গে পারসিক সংস্কৃতি ও সভ্যতার এক অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটেছিল। ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইব্রাহীম লোদীকে, ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে খানুয়ার যুদ্ধে মেবারের রাজপুত নেতা রানা সংগ্রাম সিংহকে, ১৫২৮ খ্রিস্টাব্দে চান্দেরী অভিযানের সময় মেদেনী রাওকে এবং সর্বশেষ ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দে গোগরার যুদ্ধে সম্মিলিত আফগান শক্তিকে পরাস্ত করার মধ্যে বাবরের উন্নত সামরিক কৌশল, রণনিপুণতা এবং একজন সফল সমর নায়কের কৃতিত্ব ফুটে উঠে।
প্রশাসক:
বাবরের সাম্রাজ্য কাবুল থেকে বিহার এবং হিমালয় থেকে দক্ষিনে চান্দেরি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সম্রাট হিসেবে রাজ্যকে সুশৃংখল ভিত্তির উপর দাঁড় করার মত সময় তিনি পাননি। মাত্র চার বছর পরে তিনি ইন্তেকাল করেন। 4 বছর সময়ের অধিকাংশ কেটেছে যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যম। ফলে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তিনি মৌলিক প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পারেননি। এক্ষেত্রে তিনি পূর্ববতী শাসনব্যবস্থাকে বহাল রেখেছিলেন। তবে তিনি খিলাফতের প্রতি আনুগত্য করে স্বাধীনভাবে নিজেকে “বাদশা” হিসেবে ঘোষণা করেন। বাদশাহের সাথে রাজ্যের প্রশাসনিক দপ্তর গুলোর যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিয়েছিলেন। তিনি জমিদারি প্রথা বহাল রাখেনি এবং তিনি প্রশাসনিক কার্যনির্বাহের জন্য প্রতি প্রদেশে সে একজন করে ওয়ালী, দিওয়ান, শিকদার এবং কোতোয়াল নিয়োগ দেন।
বিদ্যান ও সংস্কৃতিমনা:
জহির উদ্দিন মুহম্মদ বাবর ছিলেন শিল্প ও সাহিত্যানুরাগী এবং একজন রুচিশীল শাসক। তিনি দিল্লি ও আগ্রায় ২০টি উদ্যান, বহু পাকা নর্দমা, সেতু ও অট্টালিকা নির্মাণ করেছিলেন। বীরযোদ্ধাও সমরকুশলী বাবরের সাহিত্যানুরাগ ছিল প্রগাঢ়। তিনি তুর্কী ও ফার্সি ভাষায় যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। তিনি তুর্কি ও ফাসির্ ভাষায় অসংখ্য কবিতা রচনা করেন।তাঁর রচিত তুর্কি কবিতার সংকলন ‘দিওয়ান’ নামে পরিচিত। ফার্সি ভাষায় বাবর এক প্রকার নতুন ছন্দ আবিষ্কার করেন যা সাধারণত ‘মুবইয়ান’ নামে সুপরিচিত।
অসাম্প্রদায়িক:
ব্যক্তিগত জীবনে বাবর নিষ্ঠাবান একজন খাঁটি সুন্নি মুসলমান থাকলেও ধর্মের কারণে কারো প্রতি তিনি কোন অবিচার বা ঘৃণা পোষণ করেননি। নিজে ধার্মিক ছিলেন কিন্তু ধর্মীয় গোঁড়ামি সাম্প্রদায়িকতা এবং জাতপাতের ভিন্নতা থেকে তিনি যুক্ত ছিলেন। কালিদাস রায়ের বাবুরের মহত্ত্ব কবিতায় তার সেই পরিচয় বহন করে।
দুঃসাহসিক ও ক্যারিশমাটিক ব্যক্তিত্ব:
জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর সুস্থ ও সুঠাম দেহের অধিকারী এবং অত্যন্ত সাহসী ছিলেন। তিনি তার দুই বাহুতে দুইজনকে নিয়ে কোন প্রকার অসুবিধা ছাড়াই অনায়াসে দৌড়াতে পারতেন। তিনি নিয়মিত ব্যায়াম করতেন । তিনি খেলাধুলা এবং পশু শিকার পছন্দ করতেন। প্রায়ই তিনি অত্যন্ত ঠান্ডা আবহাওয়ায় শিকারে বের হতেন। তিনি সাঁতরিয়ে গঙ্গা নদী পাড়ি দিতেন। যুদ্ধের ময়দানে প্রতিকূল পরিবেশে সৈন্যদলকে উজ্জীবিত করা এবং প্রতিপক্ষের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করার মত অসাধারণ গুণাবলী ছিল তার। সেজন্যই অতি অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়েও তিনি পানিপথের প্রথম যুদ্ধ, খানুয়ার যুদ্ধ এবং গোগরার যুদ্ধে জয়লাভ করেছেন।
আত্মজীবনী লেখক (তুজুক ই বাবুরি/বাবর নামা):
জহির উদ্দিন মুহম্মদ বাবরের সাহিত্যানুরাগের শ্রেষ্ঠ নির্দশন তুর্কি ভাষায় রচিত আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘তুযুক-ই-বাবরী’ বা ‘বাবরনামা’ । ‘তুযুক-ই-বাবরী’ মুঘল ইতিহাসের এক অমূল্য দলিল। মুঘল শাসকদের মধ্যে বাবর ই সর্বপ্রথম তুজুক-ই-বাবুরী নামক আত্মজীবনী লিখেছেন যা তুর্কি ভাষায় রচিত হয়েছিল। এই গ্রন্থে বাবর তার উত্থান-পতনের নানা ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তিনি অকপটে তাঁর সততা, দুর্বলতা এবং দোষ-ত্রুটি উল্লেখ করেছেন। এই আত্মজীবনীর মাধ্যমে তার শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
আরও পড়ুন-
ইতিহাসে বাবরের স্থান:
জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাসের এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ঐতিহাসিক ঐতিহাসিক বলেন তাঁর সমসাময়িক যুবরাজদের মধ্যে উন্নত এবং ভারতের মধ্যে উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার যোগ্যতা সম্পন্ন ছিলেন ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন প্রকৃতপক্ষে প্রতিভা ও গুণাবলী দিক থেকে এশিয়ার ইতিহাসে খুব কম শাসকই বাবর অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ছিলেন।
ঐতিহাসিক S. Lane-Poole বলেন-
তিনি যে গৌরবময় সাম্রাজ্য সৌধের ভিত্তি স্থাপন করে যান তাকে তার পুত্র আকবর এক পরিপূর্ণ রূপ দান করেন তিনি আরও বলেন-শাসন এর মাধ্যমে ভারত শাসন এর মাধ্যমে তিনি রাজকীয় শাসকগোষ্ঠীর জন্য যে পথ উন্মুক্ত করেছিলেন তা-ই ইতিহাসে তাকে স্থায়ী আসন দান করেছে।
পরিশেষে একথা দৃঢ়চিত্তে বলা যায় যে, বাবরকে যথার্থই মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যদিও সাম্রাজ্যকে সুসংহত করার কাজটি তার নাতি আকবর করেছিলেন। তদুপরি বাবর মৌলিক নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন যা পরবর্তী দুই প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করেছিল। বাবর ছিলেন প্রতিভাধর একজন সামরিক নেতা এবং একজন সৌভাগ্যবান সাম্রাজ্য নির্মাতা ও আকর্ষক ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তিনি একজন প্রতিভাধর তুর্কি কবিও ছিলেন।তার আত্মজীবনী তাঁকে একজন শাসক হিসেবে অস্বাভাবিকভাবে উদার, সংস্কৃতিবান, বিদগ্ধ, দুঃসাহসিক মনোভাব এবং প্রাকৃতি প্রেমী হিসেবে চিত্রিত করেছে।
আরও পড়ুন-
বিদায় হজ্বের ভাষণ এবং হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কর্তৃক ঘোষিত সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংস্কারাবলী
Md. Billal Hossain
B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka
BCS (General Education)
Lecturer
Department of Islamic History
No comments:
Post a Comment