Breaking

Sunday 2 October 2022

বাদশাহ আমানুল্লাহ ! আধুনিক আফগানিস্তানের পথিকৃৎ


বাদশাহ আমানুল্লাহ (1919-29)

(Badshah Amanullah)


বাদশাহ আমানুল্লাহ-এর সংস্করাবলী কী ছিল ? তিনি কেন ব্যর্থ হয়েছিলেন ?


বাদশাহ আমানুল্লাহ খান আধুনিক আফগানিস্তানের জনক। আফগানিস্তানের স্বাধীনতার জনক। ক্ষমতায় আসার পরপরই তিনি ব্রিটিশ ভারতের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে আফগানিস্তানকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি অতি অল্প সময়ে প্রাশ্চাত্য ভাবধারায় আফগানিস্তানকে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়ে ছিলেন। তিনি আমিরের পরিবর্তে নিজেকে ‘বাদশাহ’ হিসেবে ঘোষণা দেন এবং তিনি আফগানিস্থানে প্রথম সংবিধান প্রণয়ন করেন। দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য তার আন্তরিক কোন অভাব ছিল না, কিন্তু সামাজিক বাস্তবতা তার সংস্কারের মর্ম উপলব্ধি করতে পারেনি। আফগানিস্তানের জনগণ খুব সহজেই পরিবর্তন মানতে প্রস্তুত ছিল না। ফলে বাদশা আমানুল্লাহর দ্রুত সংস্কার প্রক্রিয়া পরিপূর্ণ সফল হয়নি। তবে তিনি যা শুরু করতে পেরেছিলেন তা ছিল আফগানিস্তানের জন্য বড় পাওনা।










ক্ষমতায় আরোহন:

আমির হাবিবুল্লাহ খান মারা গেলে তার ভাই নসরুল্লাহ নিজেকে আমির বলে ঘোষণা দিলে কাবুলে অবস্থানরত আমানুল্লাহ খান নিজেকে আমির বলে ঘোষণা দেন।  কাবুলে এসে তার ভাই এনায়েতুল্লাহ ও নিজেকে আমির বলে দাবি করেন। আমানুল্লাহ কাবুলের দায়িত্বে থাকার কারণে দেশ পরিচালনা ও প্রশাসনের বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। তাছাড়া অন্য দু'জন এর চেয়ে তিনি বেশি যোগ্য ছিলেন। এর বাইরে তরুণ ও প্রগতিশীলরা তার পক্ষে ছিল, অর্থ ও সেনাবাহিনী তার হাতে ছিল। এসব কাজে লাগিয়ে তিনি ৭ দিনের মধ্যে তাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন। সেনাবাহিনীকে তার অনুকূলে নিয়ে এসে তিনি সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করে 1919 সালের 27 জানুয়ারি অভিষেক অনুষ্ঠান করে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আরোহন করেন। ৩ ফেব্রুয়ারি বক্তৃতায় তিনি তার কয়েকটি লক্ষ্যের ঘোষণা দেন।


  1. আফগানিস্তানের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন 

  2. পিতার হত্যাকারীদের শাস্তি ও 

  3. বেকার সমস্যা দূরীভূত করা 


তিনি সেনাবাহিনীর বেতন বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়ে কৌশলে তাদের সমর্থন আদায় করে নেন। কারো বিরুদ্ধে সামরিক নীতি গ্রহণ, কাউকে কৌশলে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। ভাইকে ক্ষমা ও চাচাকে বন্দী করেন।


আরও পড়ুন-

আমির দোস্ত মুহাম্মদ খান ।। Amir Dost Mohammad Khan



তৃতীয় ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধ (1919)

যেহেতু আমির আব্দুর রহমান এর পর থেকেই আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ব্রিটিশ প্রভাবাধীন ছিল, তাই বাদশাহ আমানুল্লাহ সেই থেকে মুক্ত হতে চাইলেন। ক্ষমতা সুসংহত করার পর থেকে হঠাৎ করেই আমানুল্লাহ ব্রিটিশ ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এতে থার্ড এংলো আফগান যুদ্ধের সূচনা হয়। এটাকে বলা হয় আফগানিস্তানের স্বাধীনতা যুদ্ধ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে ব্রিটেনে ছিল বিপর্যস্থ, এ সময় তারা আরেকটি যুদ্ধে জড়াতে চায়নি। দুই পক্ষই যুদ্ধের অবসান চায়। তাই  1919 সালের মে মাসে শুরু হওয়া যুদ্ধ আগস্ট মাসে রাওয়ালপিন্ডি চুক্তির মাধ্যমে সমাপ্ত হয়। ব্রিটেন আফগানিস্তানের পূর্ণ স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয় এবং তাদের যে কোনো হস্তক্ষেপের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করে।



বাদশাহ আমানুল্লাহ এর সংস্থারাবলী:


বাদশা আমানুল্লাহর সংস্কারের উদ্দেশ্য:

বাদশাহ আমানুল্লাহ তিনটি উদ্দেশ্যে সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেন 

  1. আফগানিস্তানবাসীকে পাশ্চাত্য ভাবধারায় অনুপ্রাণিত করে প্রগতিশীল জাতিতে পরিণত করা;

  2. আফগানিস্তানকে সত্যিকার অর্থে একটি স্বাধীন সার্বভৌম ও বৈদেশিক প্রভাবমুক্ত রাষ্ট্রে পরিণত করা এবং 

  3. মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক মজবুত করা ।


এসব উদ্দেশ্যে গৃহীত তার সংস্কারগুলি নিম্নে আলোচিত হল- 


  1. পাশ্চাত্য ভাবধারার প্রচলন:

বাদশাহ আমানুল্লাহ খানের সংস্কারের মূল লক্ষ্য ছিল দেশে প্রাশ্চাত্য ভাবধারার প্রচলন করা। এক্ষেত্রে তিনি  তিনজন ব্যক্তি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন-

  1. তুরস্কের মুস্তফা কামাল পাশা 

  2. ইরানের রেজা শাহ পাহলভী এবং 

  3. তার স্ত্রী রানী সুরাইয়া


সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত ছিলেন রানী সুরাইয়ার দ্বারা।  তাছাড়া দীর্ঘদিনের ইউরোপ সফর থেকে তিনি বেশ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। এগুলোর প্রতি অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি দেশে প্রাশ্চাত্য ভাবধারার বিকাশ ঘটাতে পেয়েছিলেন। 


  1. প্রশাসনিক সংস্কার:

আফগানিস্তানের তখন বিধিবদ্ধ কোনো প্রশাসনিক আইন-কানুন ছিলনা। শাসক তার বুদ্ধি-বিবেচনা ও ইচ্ছামতো আইন জারি করতেন। আমানুল্লাহ ই প্রথম, যিনি 1923 সালের 9 মার্চ আফগানিস্তান 73 ধারা বিশিষ্ট একটি সংবিধান প্রণয়ন করেন। এতে প্রশাসন, আইন ও বিচার আলাদা করা হয়। লয়াজিরগার অনুমোদনক্রমে একটি আইন পরিষদ এবং উচ্চকক্ষ হিসেবে  ‘দরবারে আলা’ জন্য গঠন করেন। সংবিধান অনুযায়ী নিজে ‘বাদশা’, স্ত্রীর সুরাইয়াকে ‘রানী’ এবং 10 বছরের শিশু পুত্রকে উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেন। শ্বশুর আহমদ তারাজিকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়। একটি প্রশাসনিক গাইড লাইন চালু করা হয়। সংবিধানে সমঅধিকার, মানবাধিকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতা সংরক্ষন করা হয়। 


  1. অর্থনৈতিক সংস্কার। 

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অল্পই ছিল। ইউরোপীয় ধ্যান-ধারণা তাকে আকৃষ্ট করেছিল। তিনি 1922 সালে আফগানিস্তানে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয় বাজেট প্রণয়ন করেন। তিনি রাজস্ব ব্যবস্থার বিন্যাস করেন। নগদ অর্থে ভূমি কর নির্ধারণ করেন পশম রপ্তানিতে কর ধার্য করা হয়। 1924 সালে ভূমি আইন করলে ভূমিতে ব্যক্তিমালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। ন্যাশনাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলে মহাজনদের বাধার কারণে সেটা সম্ভব হয়নি।


  1. বাণিজ্য সংস্কার:

বৈদেশিক বাণিজ্য ব্রিটিশদের হাত থেকে আফগানদের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন। বাণিজ্যিক উন্নতির জন্য বহু দেশের সাথে তিনি ভাল সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এশিয়া ও ইউরোপের অনেক দেশের সাথে বাণিজ্য বৃদ্ধি করেন। 


  1. শিক্ষা সংস্কার:

তিনি বুঝতে পেরেছিলেন অশিক্ষাই আফগানদের পশ্চাৎপদতার কারণ। তখনও প্রায় 90% লোক ছিল অশিক্ষিত। এ অবস্থায় তিনি পাশ্চাত্য ধারায় ধর্মনিরপেক্ষ কারিকুলামে সার্বজনীন বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা চালু করেন। প্রায় 4000 স্কুল তিনি প্রতিষ্ঠা করেন। এগুলো পরিচালনার জন্য 1924 সালে জার্মানির সহায়তায় কাবুলে একটি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। পাশ্চাত্য দেশ থেকে শিক্ষাবিদদের নিয়ে আসা হয়। ইউরোপ সফর করে এসে দেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেন। তিনি কাবুলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।  বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার জন্য বহু ছাত্রকে বিদেশে প্রাঠানা হয়। রাষ্ট্রীয় খরচে কাবুলে ইস্তিকলাল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। 



রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুপারিশ ক্রমে এবং বাদশাহ আমানুল্লাহর আমন্ত্রণে বাংলাদেশ থেকে সৈয়দ মুজতবা আলী কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতে গিয়েছিলেন।  



আরও পড়ুন-

আমির হাবিব উল্লাহ খান ।। Amir Habib Ullah Khan



  1. নারী শিক্ষা: 

বাদশাহ আমানুল্লাহ নারীদের জন্য শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেন। মেয়েদের জন্য আলাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। তার স্ত্রী রানী সুরাইয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনসহ নারী শিক্ষার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। 




  1. শিল্পায়ন: 

বাদশাহ আমানুল্লাহ রাষ্ট্রীয় উন্নতির অন্যতম দিক শিল্প-কারখানার উন্নতি ঘটান। জার্মান প্রযুক্তির সহায়তায় বস্ত্র, রেশম, সিমেন্ট, কাগজ, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি ইত্যাদির কারখানা স্থাপন করেন। বিদেশী বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ দেন। তবে দেশীয় কারিগর এবং খুচরা যন্ত্রাংশ না থাকার কারণে এগুলো নষ্ট হলে আর মেরামত করা যেত না।



  1. বিচার ব্যবস্থার সংস্কার:

আমানুল্লাহ শরিয়াভিত্তিক বিচার ব্যবস্থা বাতিল করে ফরাসি ‘কোড অব ল’ এর অনুকরণে ধর্ম নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা চালু করেন। শিক্ষা ও বিচার ব্যবস্থায় আলেমদের প্রভাব  দূর করেন।



  1. সামরিক সংস্কার:

সংস্কারের প্রতি মনোযোগ দিতে গিয়ে তিনি সেনাবাহিনীর প্রতি কিছুটা উদাসীন হয়ে গিয়েছিলেন। তবে তিনি ইউরোপীয় মডেলে সেনাবাহিনী গড়ে তোলার পক্ষে ছিলেন। সকল পুরুষের জন্য তিনি তিন বছর সামরিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করেন। কাবুলে মিলিটারি একাডেমিতে জার্মান শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়া হয়। তুর্কি ও রুশদের সহায়তায় তিনি কাবুলে একটি অস্ত্র কারখানা স্থাপন করেন। সামরিক ব্যয় মেটাতে তিনি সকল জনগণের উপর অতিরিক্ত তিন আফগানি করেন এবং সেনা সদস্যদের এক মাসের বেতন কেটে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। তবে জন্য সেনাবাহিনী ক্ষুব্ধ ছিল। 


আরও পড়ুন-

দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় গণধর্মান্তর বা দ্রুত ইসলাম বিস্তারের কারণসমূহ



  1. যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন 

বাদশা আমানুল্লাহ খান যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করেন। তিনি হিন্দুকুশ থেকে ভারতবর্ষ পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ করেন। রেললাইন সম্প্রসারণ করেন। টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ও রেডিও স্টেশন চালু করেন। বিমান সংস্থা গঠন করেন। কাবুল-জার্মান বিমান যোগাযোগ চালু করেন। এগুলো ছিল বৈপ্লবিক উন্নতি।


  1. সংবাদপত্র ও গণযোগাযোগ:

পিতা হাবিবুল্লাহ এর আমলে সংবাদপত্রের বিকাশ ঘটেছিল। আমানুল্লাহ তার সংস্কার মানুষের মাঝে তুলে ধরার জন্য সংবাদপত্রের বিকাশে ভূমিকা রাখেন। তখন নয়টি পত্রিকা প্রকাশিত হতো। সরকারি কর্মকর্তা ও উচ্চবর্গের লোকদের জন্য দুটি পত্রিকা রাখা বাধ্যতামূলক করেছিলেন।


  1. জনস্বাস্থ ও গণপূর্ত কর্মকাণ্ড:

আধুনিক চিকিৎসা সেবা চালুর লক্ষ্যে বাদশা আমানুল্লাহ পিতা প্রতিষ্ঠিত কাবুল হাসপাতালের উন্নতিবিধান করেন। তুর্কি ও জার্মান ডাক্তার নিয়োগ দেন। জনসাস্থ সংরক্ষণে মা ও শিশুর মৃত্যু রোধ কল্পে দেশের সর্বত্র শিশু ও নারী কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। আমির হাবিবুল্লাহ এর রাজপ্রাসাদের একাংশ হাসপাতালে পরিণত কার হয়। এখানে ব্যবস্থাপত্রেএবং ঔষধের ব্যবস্থা করা হয়। 


  1. সামাজিক সংস্কার: 

আমানুল্লাহ খান সমাজে বাল্যবিবাহ ও চারটির বেশি বিবাহ নিষিদ্ধ করেন। নারী পুরুষের বিবাহের বয়স যথাক্রমে 18 এবং 22 নির্ধারণ করেন। পর্দা প্রথা বাতিল করেন এবং ঐতিহ্যবাহী পোশাক নিষিদ্ধ করে আইন করেন। পাশ্চাত্য পোশাক পরার নির্দেশ দেন। শার্ট-প্যান্ট ও কোর্ট পরিধান করার আদেশ দেন। 1928 সালে তিনি Dress Regulating Act জারি করেন। শুক্রবার এর পরিবর্তে রবিবারকে সাপ্তাহিক ছুটি ঘোষণা করা হয়। তবে এগুলোর পরিণতি তার পতন ডেকে এনেছিল। 


  1. বিনোদন:

জনস্বাস্থ্য ও বিনোদনের জন্য তিনি সিনেমাহল, থিয়েটার হাউস, পার্ক স্থাপন করেন। স্টেডিয়াম স্থাপন করে খেলাধুলার প্রচলন করেন। জার্মান প্রযুক্তিতে তিনি পাগমানে আরেকটি আধুনিক দ্বিতীয় নগরী গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। 



আরও পড়ুন-

রেজা শাহ পাহলভী এবং ইরানের আধুনিকায়নে তাঁর অবদান



সমালোচনা এবং আমানুল্লাহ এর পতনের কারণ:

পন্ডিত মহল মনে করেন বাদশাহ আমানুল্লাহ সংস্কারের প্রতি আন্তরিক দেশ প্রেমিক এবং গণতন্ত্রমনা ছিলেন কিন্তু তিনি দূরদর্শী ছিলেন না। জনগণের মন-মানসিকতা এবং সামাজিক বাস্তবতা, তারা সংস্কার কতটুক গ্রহণ করতে পারবে সে ব্যাপারে তিনি সতর্ক ছিলেন না। বৈপ্লবিক পরিবর্তন গ্রহণ করার মত সচেতনতা আফগান জনগণের ছিল না। তাই তার সমস্ত সংস্কার কার্যাবলী অনেকাংশে ব্যর্থ হয়েছিল। 


  1. প্রথমে দরকার ছিল  শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক ভীত তৈরি করা,কিন্তু সেটা তিনি করতে পারেননি।

  2. শত শত বছরের প্রচলিত ব্যবস্থা বাতিল করে নতুন নতুন সংস্কার স্বাধীনচেতা আফগানরা মানতে পারেনি। 

  3. পর্দা প্রথা নিষিদ্ধ করা, পাশ্চাত্য পোশাক চালু করা এবং মেয়েদের বাধ্যতামূলক শিক্ষা তারা মানতে পারেনি।

  4. পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করলে ছেলেমেয়েরা বিধর্মী হয়ে যাবে বলে আফগান জনগণ মনে করত। 

  5. সংস্কারের উদ্দেশ্যে বিদেশিদের অবাধে বিচরণ আফগানরা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না।

  6. খুচরা যন্ত্রাংশ না থাকায় তাঁর নবপ্রতিষ্ঠিত শিল্পকারখানাগুলো অকেজো হয়ে পড়েছিল।

  7. সংস্কারের বাড়তি খরচ যোগাতে জনগণের ওপর বাড়তি করারোপ এবং সেনাবাহিনীর বেতন কেটে নেয়া ইত্যাদি কারণে জনগণ বিদ্রোহ করলে সেনাবাহিনী ও তাদের সমর্থন দেয়, আমানুল্লাহ একা হয়ে পড়েন। 

  8. ধর্ম নিরপেক্ষ বিচার ও পাশ্চাত্য পোশাক চালুর কারণে মোল্লা শ্রেনী ক্ষিপ্ত ছিল। তাদের ক্ষমতা কমে গিয়েছিল তাই তারা আন্দোলন শুরু করে।

  9. তার সংস্কারগুলো ছিল পুরাতনদের বিরুদ্ধে নতুনদের লড়াই। এতে পুরাতনরা জয়ী  হলে তার পতন ঘটে ।

  10. বাদশা আমানুল্লাহ রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারেননি এটা তার বড় একটি ব্যর্থতা। কামাল পাশাকে অনুকরণ করলেও তিনি তার মত রদশী দূরদর্শী ছিলেন না এবং সে রকম পরিবেশ তিনি পাননি। 

  11. শিক্ষার বিষয়ে মানুষের মাঝে তিনি বেশি আগ্রহ তৈরি করতে পারেন নি ।

  12. তার দীর্ঘ ইউরোপ সফর দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিয়েছিল যা থেকে তিনি উদ্ধার পাননি। 


সংস্কারের প্রতিক্রিয়া:

আফগানিস্তানের স্থবির সমাজ দ্রুত আধুনিকায়ন এবং পশ্চিমাকরণ মানতে প্রস্তুত ছিল না। বাদশা আমানুল্লাহর সামাজিক সংস্কার সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। নারী শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা, পর্দা প্রথা বাতিল করা, পাশ্চাত্য পোশাক বা  ড্রেসকোড চালু করা, শুক্রবার এর পরিবর্তে রবিবারকে সাপ্তাহিক ছুটি ঘোষণা করা এসমস্ত সিদ্ধান্তের ফলে আলেম শ্রেণি এবং আফগান সমাজ থেকে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বাদশা আমানুল্লাহর সংস্কার কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম 1923 সালে  আফগানিস্তানের খোস্ত অঞ্চলে বিদ্রোহ দেখা দেয়। যা 1925 সালে অনেক প্রাণহানির মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয়। 1928 সালের দিকে আফগানিস্থানে ব্যাপক গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। বাদশা আমানুল্লাহ এর বিরুদ্ধে চতুর্দিকেই বিদ্রোহ বিশৃঙ্খলা দানা বেঁধে উঠে। বাদশা আমানুল্লাহ কে ‘কাফির’ ফতোয়া দেওয়া হয়। উচ্চশিক্ষার জন্য নারীদেরকে তুরস্কে পাঠালে অপপ্রচার চালানো হয়েছে বাদশা আমানুল্লাহ আফগান নারীদের কে কামাল পাশার হেরেমে পাঠিয়েছেন। এ সমস্ত অপপ্রচারের মাধ্যমে আফগানিস্থানে আমানুল্লাহ বিরোধী বিদ্রোহ জোরালো হয়। 


আরও পড়ুন-

গ্রিসের স্বাধীনতা যুদ্ধ।। Greek War of Independence



বিদ্রোহ-বিশৃঙ্খলা এবং বাচ্চা-ই-সাক্কার উত্থান:


এই রকম পরিস্থিতিতে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয়। অতি দ্রুত পশ্চিমাকরণ এবং সেনাবাহিনীর বেতন কর্তনসহ বহুবিধ কারণে সামন্ত প্রভু, কৃষক শ্রেণী, সরকারি কর্মচারী,  মোল্লা শ্রেনী এবং সেনাবাহিনী তার বিরুদ্ধে চলে গেলে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। যেহেতু তাকে ‘কাফের’ ফতোয়া দেওয়া হয়েছিল সেজন্য তার সেনাবাহিনী তার পক্ষ হয়ে বাচ্চা ই সাক্কার বিরুদ্ধে লড়াই করতে অস্বীকৃতি জানায়। তিনি তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন।  


এই সুযোগে দস্যুদল সরকার বাচ্চা-ই-সাক্কা (হাবিবুল্লাাহ কালাকানি) এর উত্থান ঘটে। বাচ্চা ই সাক্কা একজন দস্যু দলের নেতা ছিলেন। তার বাবা ছিলেন একজন ভিস্তিওয়ালা তথা পানি বিক্রয়কারী। ‘বাচ্চা ই সাক্কা’ এর অর্থ হচ্ছে ভিস্তিওয়ালার ছেলে বা পানি বিক্রেতার ছেলে। তার প্রকৃত নাম হাবিবুল্লাহ কালাকানি। বাচ্চা-ই-সাক্কা প্রথমে সেনাবাহিনীতে চাকরি করেছিলেন। পরে তিনি একটি দস্যুদল গড়ে তোলেন। বিভিন্ন বিদ্রোহ বিশৃঙ্খলার সুযোগে তিনি অনেক লুটপাট করে অর্থ ও ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন। বাদশা আমানুল্লাহ বাচ্চা-ই-সাক্কার মাথার মূল্য 500 আফগানি ঘোষণা করলে বিপরীতে বাচ্চা-ই-সাক্কা  বাদশা আমানুল্লাহর মাথা কর্তনের মূল্য 1000 আফগানী ঘোষণা করেছিলেন।  সৈয়দ মুজতবা আলী এই সময়কার গৃহযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। তার ‘দেশে-বিদেশে’ নামক ভ্রমণ কাহিনীতে এ বিষয়ে বর্ণনা রয়েছে। 


বাদশা আমানুল্লাহ এর পতন: 

বাচ্চা-ই-সাক্কার প্রচন্ড আক্রমণে বাদশা আমানুল্লাহ কাবুলের ক্ষমতা তার ভাই এনায়েত উল্লাহ এর কাছে হস্তান্তর করে কান্দাহারের দিকে পালিয়ে যান। কান্দাহার থেকে তিনি ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করলেও তার সম্ভব হয়নি। কান্দাহার থেকে তিনি ভারতে আসেন। ভারত থেকে বাদশা আমানুল্লাহ ইটালিতে চলে যান। 1941 সালে দিকে কিছু পশ্চিমা গণমাধ্যম রিপোর্ট প্রকাশ করে যে, আমানুল্লাহ জার্মানির নাৎসিদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন। অনেকে মনে করেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন বাদশাহ আমানুল্লাহ জার্মানির পক্ষে কাজ করেছেন এই ভেবে যে, জার্মানী জয়ী হলে তিনি পুনরায় আফগানিস্তানের ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করবেন। কিন্তু জার্মানীর পতনের ফলে তার সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়।  বাদশাহ আমানুল্লাহ 30 বছর নির্বাসনে থেকে 1960 সালে ইটালিতে অথবা সুইজারল্যান্ডের জুরিখে ইন্তেকাল করেন। তার মৃতদেহ আফগানিস্থানে নিয়ে আসা হয় এবং তার পিতা আমির  হাবিবুল্লার কবরের পাশে সমাহিত করা হয়। 


পরিশেষে, তার সদিচ্ছা থাকলে ও জনগণের অসহযোগিতা তার পতনের জন্য দায়ী। তাছাড়া সামাজিক সংস্কার ছিল তার পতনের জন্য বিশেষভাবে দায়ী। কেননা আফগানিস্তানের স্থবির সমাজ দ্রুত গতিতে পরিবর্তনশীল হওয়ার মতো  অবস্থায় ‍ছিলনা। সেখানে প্রথমে সংস্কারের জন্য পরিবেশ তৈরি করার প্রয়োজন ছিল। তিনি তা না করে খুব দ্রুত ইউরোপীয় কালচার, ধ্যান-ধারণা, শিক্ষাব্যবস্থা, ধর্মনিরপেক্ষতা, পোশাক-আশাক ইত্যাদি ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলাম যা আফগানরা গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে সামগ্রিক আফগান গোষ্ঠী তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায় এবং বিদ্রোহ বিশৃঙ্খলায় তিনি ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যান।  




আরও পড়ুন-

মুহাম্মদ আলী পাশা এবং আধুনিক মিসর





প্রিয় পাঠক,

যে কোন ভূল-ত্রুটির সংশোধনী বা পরামর্শ থাকলে ওয়েব সাইটে পোস্টের নিচে কমেন্ট বক্সে লিখুন। ইসলামের ইতিহাস, স্বাধীন-বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস, ইসলামের বিধি-বিধান সংক্রান্ত কোন প্রবন্ধ বা সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে লেখা কোন প্রবন্ধ প্রকাশ করতে চাইলে আপনার লেখা এবং পরিচিতিসহ মেইল করুন। 

 

Md. Billal Hossain

B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka

BCS General Education

Lecturer

Department of Islamic History & Culture

Chandpur Govt. College, Chandpur.




No comments:

Post a Comment