বলকান যুদ্ধ (1912-13): কারণ, ঘটনা ও ফলাফল
(The Balkan Wars)
1856 সালে ক্রিমিয়ার যুদ্ধের অবসান ঘটলেও প্রাচ্য সমস্যার সমাধান হয়নি। তুরস্কে আভ্যন্তরীণ সংস্কারের কথা থাকলেও তেমন উন্নত সংস্কার সাধিত হয়নি। ফলে 1877 সালে রুশ-তুর্কি যুদ্ধে তুরস্ক হেরে গিয়ে গ্লানিকর স্যানস্টিফানো চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু প্রাচ্য সমস্যার আবর্তে বৃটেন ও ফ্রান্সের চাপে রাশিয়া এক বছর পরেই বার্লিন কংগ্রেস স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়। এভাবে তুরস্ক রাশিয়ার আগ্রাসন থেকে রক্ষা পেলেও সামরিক দিক থেকে তুরস্ক তেমন অগ্রগতি সাধন করতে পারেনি। আভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক দুই দিক থেকেই তুরস্কের দুর্বলতা দেখা দেয়। বার্লিন কংগ্রেস পরবর্তী সময়ে বলকান অঞ্চলগুলোতে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটতে থাকে। তুরস্কের দুর্বলতা হেতু তুর্কি সাম্রাজ্যভুক্ত বলকান উপদ্বীপের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো স্বাধিকার ও স্বাধীনতা লাভের প্রয়াসে তুর্কি বিরোধী আন্দোলন ও সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। সফল আন্দোলন পরিচালনা করার জন্য গ্রিসের নেতৃত্বে বলকান রাষ্ট্রগুলি বলকান লীগ গঠন করে। বলকান লীগ এবং তুরস্কের মধ্যে প্রথম বলকান যুদ্ধ সংঘটিত হলেও দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধ সংঘটিত হয় বলকান রাষ্ট্রগুলির আন্তদ্বন্দ্বের কারণে। প্রথম এবং দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধের মাধ্যমে ইউরোপে তুরস্ক সাম্রাজ্য শুধুমাত্র ইস্তাম্বুল এবং এড্রিয়ানোপলের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধ ইউরোপে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বীজ বপন করে।
প্রথম বলকান যুদ্ধ 1912
পূর্ব ইউরোপ থেকে তুর্কিদের বিতাড়ণ করে স্বাধীনতা অর্জন করার জন্য ঐক্যবদ্ধ ভাবে বলকান রাষ্ট্রগুলো 1912 সালে তুরস্কের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ পরিচালনা করে তাই প্রথম বলকান যুদ্ধ।প্রথম বলকান যুদ্ধে বলকান লীগের নেতৃত্ব দেয় গ্রিস। প্রথম বলকান যুদ্ধ তুরস্ক ভয়ানকভাবে বিধ্বস্ত হয়। এই যুদ্ধের পেছনে বেশ কিছু কারণ নিহিত রয়েছে।
প্রথম বলকান যুদ্ধের কারণসমূহ
তুরস্কের অধঃপতন
তুরস্কের শক্তি-সামর্থের অধঃপতন বলকান যুদ্ধের একটি অন্যতম কারণ। তুর্কি সাম্রাজ্য প্রথমত এশিয়া মাইনর এর আনাতোলিয়া কেন্দ্রিক ছিল। সময়ের আবর্তে একসময় তুর্কি তুর্কিরা ইউরোপের বলকান অঞ্চলের আধিপত্য কায়েম করে। তুর্কি সুলতানগণ বসনিয়া আলবেনিয়া রোমানিয়া গ্রিস, সার্বিয়া, মন্টিনিগ্রো, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, হার্জেগোভিনা প্রভৃতি বলকান অঞ্চল অধিকার করে এক বিশাল ভূমধ্যসাগরীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। বিপরীতে এই মুসলিম তুর্কি আধিপত্য ধ্বংস করার জন্য ইউরোপীয় খ্রিস্টান রাষ্ট্র সমূহ সঙ্ঘবদ্ধ প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। তারই ফলশ্রুতিতে গ্রিস স্বাধীনতা, যুদ্ধ ক্রিমিয়ার যুদ্ধ এবং রুশ-তুর্কি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এসব যুদ্ধের পরিণাম ছিল তুরস্কের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। রেনেসাঁর বদৌলতে ইতিমধ্যেই ইউরোপে সামরিক অস্ত্র ও বিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতি ঘটলেও তুরস্কে সেই তুলনায় তেমন কোনো উন্নতি সাধিত হয়নি। ফলে রাশিয়া একসময় তুরস্ককে ইউরোপের রুগ্ন ব্যক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করে। শুধু এখানেই শেষ নয় পরবর্তীতে ইউরোপীয় সঙ্ঘবদ্ধ শক্তি ইউরোপ থেকে বিতাড়িত করার চূড়ান্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
ইউরোপীয় শক্তির ষড়যন্ত্র
তুর্কি সাম্রাজ্যের দুর্বলতা হেতু স্বার্থন্বেষী ইউরোপীয় শক্তিবর্গ নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য তুর্কি সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। বিশেষ করে রাশিয়ার সম্প্রসারণ নীতি ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের জন্য বড় হুমকি। প্রাচ্য সমস্যার পেক্ষাপটে বলকান অঞ্চলের রুশ আধিপত্য বৃদ্ধি পেতে থাকলে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়া রাশিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য। ইউরোপীয় এই পরাশক্তিগুলোর স্বার্থান্বেষী চিন্তাভাবনার কারণেই বলকান অঞ্চল হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক বিদ্বেষ, প্রতিদ্বন্দ্বীতা এবং যুদ্ধবিগ্রহে পরিপূর্ণ এক ডেঞ্জার জোন, যা বলকান যুদ্ধ কে ত্বরান্বিত করে।
বলকানে নবজাগরণ:
1877 সালে রুশ-তুর্কি যুদ্ধে তুরুস্ক রাশিয়ার কাছে ভয়ানকভাবে হেরে গেলে তুরস্ক স্যান স্টিফানো নামে একটি গ্লানিকর চুক্তি স্বাক্ষর করে। কিন্তু ইউরোপীয় পরাশক্তি ফ্রান্স ও বৃটেনের চাপে পরবর্তী বছর 1878 সালে বার্লিন কংগ্রেস স্বাক্ষরিত হয়। বার্লিন কংগ্রেসের মাধ্যমে তুরস্ক সাম্রাজ্যকে চূড়ান্ত ধ্বংস করতে না পারলেও এ চুক্তির মাধ্যমে ইউরোপের বলকান অঞ্চলের জনসাধারণের মধ্যে জাতীয়তাবাদী নবজাগরণের সূচনা হয়। এই নবজাগরণের মাধ্যমে প্যান-স্লাভিজম আন্দোলনের সূচনা হয়। রাশিয়ার পরোচনায় পরিচালিত জাতীয় ও ধর্ম ভিত্তিক এই আন্দোলন সমগ্র বলকান উপদ্বীপে ছড়িয়ে পড়ে। আর এই গণজোয়ার বলকান অঞ্চলে তুর্কি আধিপত্য খর্ব করে।
উগ্র তুর্কি জাতীয়তাবাদ
তুর্কি ইতিহাস ঐতিহ্যকে ধারণ ও রক্ষা করার স্লোগান দিয়ে 1908 সালে নব্য তুর্কিদের উত্থান ঘটে এদের উদ্দেশ্য ছিল তুর্কিদের ইতিহাস, ভাষা, সাহিত্য, নৃতত্ত্ব, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার মূল্যায়ন করে তুর্কি জাতীয়তাবাদকে পুনর্জীবিত করা, যাতে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা অঞ্চলে তুর্কি সাম্রাজ্য সুসংহত থাকে। কিন্তু ইউরোপীয় আদলে তুরস্কে তেমন সংস্কার সাধিত হয়নি। তাই ঐতিহাসিক মহাজন' বলেন- 1912 খ্রিস্টাব্দের বলকান যুদ্ধ 1908 খ্রিস্টাব্দে নব্য তুর্কি বিপ্লবের ফলশ্রুতি। যেহেতু নব্য তুর্কিরা তুরস্কের অধীনে বসবাসকারী খ্রিস্টানদের তুর্কিকরণ অথবা গনহত্যার আশ্রয় গ্রহণ করে সেহেতু বলকান উপদ্বীপের দ্বিধা বিভক্ত পরস্পর স্বার্থবিরোধী রাষ্ট্রসমূহ তুরস্কের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হয়। যার ফলে বলকান যুদ্ধ ত্বরান্বিত হয়।
বলকান লীগ গঠন
বলকান অঞ্চলের তুর্কিকরণ নীতি বলকান অঞ্চলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খ্রিস্টান রাজ্যগুলোকে একত্রিত হতে সহায়তা করে। ঐতিহাসিক ও জাতিগত এবং সাংস্কৃতিক বৈপরীত্য থাকা সত্ত্বেও বলকান রাষ্ট্র গুলি তুর্কি সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে 1912 সালে একটি লীগ গঠন করে যা ‘বলকান লীগ’ নামে পরিচিত। গ্রিসের নেতৃত্বে বুলগেরিয়া সার্বিয়া ও মন্টিনিগ্রো মিলে বলকান লীগ গঠিত হয়। এই লীগ গঠনের উদ্দেশ্য ছিল বলকান অঞ্চলের তুর্কি সরকারের অত্যাচার-নিপীড়ন রোধ করা এবং বলকান অঞ্চল তুর্কি প্রভাব মুক্ত করা। তুরস্কের আভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা এবং ইটালির সাথে যুদ্ধ লিপ্ত থাকার সুযোগে অস্ট্রিয়া বার্লিন চুক্তি ভঙ্গ করে তুরস্কের কর্তৃত্বে থাকা বসনিয়া-হার্জেগোভিনা দখল করে নেয়। যা বলকান লীগ কে তুরস্ক বিরোধী যুদ্ধে অনুপ্রাণিত করে।
আরও পড়ুন-
তানজিমাত কী ? তানজিমাত যুগে অটোমান তুরস্কে গৃহীত সংষ্কারাবলী কী ছিল?
প্রথম বলকান যুদ্ধের ঘটনা প্রবাহ
যুদ্ধ ঘোষণা:
1912 সালে 8 ই অক্টোবর তুরস্কের বিরুদ্ধে মন্টিনিগ্রোর যুদ্ধ ঘোষণার মাধ্যমে প্রথম বলকান যুদ্ধের সূচনা হয়। প্রাথমিক সাফল্যে তারা বেশ উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। বলকান লীগ তুর্কি সুলতান এর নিকট স্বায়ত্ত্বশাসন ও শাসনতান্ত্রিক সংস্কাকারের চাপ সৃষ্টি করে। তুর্কি সুলতান তাদের দাবি-দাওয়া মানতে অস্বীকার করলে বলকান লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
বলকান লীগের অগ্রযাত্রা:
বুলগেরীয়দের সর্বাধিক আক্রমণে বলকান লীগ দ্রুত অগ্রসর হয় ব্যাপক সফলতা লাভ করে। এত দ্রুত তুর্কি বাহিনীর পতন ঘটবে তা তারা কল্পনাও করতে পারেনি। বলকান লীগ কনস্টান্টিনোপলের মাত্র 25 মাইল এর মধ্যে চলে আসে। বুলগারদের পাশাপাশি গ্রিকরাও এই যুদ্ধে ব্যাপক রণনৈপুণ্য এমনকি ব্যক্তিগত সাহসেও তুর্কিদের উপর শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দেয়।
তুরস্কের ধারাবাহিক পরাজয়:
বলকান লীগের যুদ্ধ প্রস্তুতি জানতে পেরে তুর্কি সুলতান আগেই সৈন্যসমাবেশ করেছিলেন। কিন্তু বলকান লীগের উপুর্যপুরী, পরিকল্পিত ও সুশৃংখল আক্রমণে প্রতিটি ক্ষেত্রেই তুর্কি বাহিনী ধারাবাহিক পরাজয় বরণ করে। শুধু কনস্টান্টিনোপল ব্যতীত ইউরোপীয় সাম্রাজ্যের অবশিষ্ট সব অংশই বলকান বাহিনী দখল করে নেয়। অবশেষে ইউরোপীয় শক্তিবর্গের মধ্যস্থতায় 1913 সালে লন্ডন চুক্তির মাধ্যমে প্রথম বলকান যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
লন্ডন চুক্তি -1913
তুরস্ক এড্রিয়ানোপল ছেড়ে দিবে ,তবে ইস্তাম্বুল তুরস্ক সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে থাকবে।
ইজিয়ান সাগর এর ইন্স থেকে কৃষ্ণসাগরের মেডিয়া পর্যন্ত কাল্পনিক রেখা টেনে এর বাহিরের সকল এলাকা তুরস্ক বলকান লীগের কাছে ছেড়ে দেয়।
আলবেনিয়া স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
গ্রীস ক্রীট, সালোনিকা ও দক্ষিণ মেসিডোনিয়া লাভ করে
বুলগেরিয়া থ্রেস ও ইজিয়ান উপকূলের কিছু অংশ লাভ করে
প্রথম বলকান যুদ্ধের ফলাফল:
1913 সালের লন্ডন চুক্তির মাধ্যমে প্রথম বলকান যুদ্ধের অবসান ঘটে। কিন্তু এই যুদ্ধে তুরস্কের ধারাবাহিক পরাজয়ের ফলে শুধু ইস্তাম্বুল ব্যতীত পূর্ব ইউরোপীয় অঞ্চলের তুরস্ক অধ্যুষিত তুর্কি সাম্রাজ্যের সকল এলাকা তুরষ্কের হাতছাড়া হয়ে যায়। তুরস্ক সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তির দুর্বলতা ভয়ানকভাবে প্রকাশিত হয়।
আরও পড়ুন-
সুয়েজ খালের ইতিহাস এবং মিসরের স্বাধীনতা ও জাতীয় জীবনে সুয়েজ খালের প্রভাব
দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধ -1913
তুরস্ককে বিদায় করার জন্য বলকান দেশগুলো নিজেদের মধ্যে এই নানাবিধ বিরোধ থাকা সত্বেও ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলকান লীগ গঠন করেছিল। প্রথম বলকান যুদ্ধে তুরস্ককে পরাস্ত করার পর তুরস্ক থেকে প্রাপ্ত রাজ্যগুলোর ভাগবাটোয়ারা নিয়ে বলকান লীগের মধ্যে চরম প্রতিদ্বন্দিতা ও বিরোধ দেখা দেয়। তুরস্ক যে সমস্ত স্থান বলকান লীগের হাতে ছেড়ে দিয়েছিল সেগুলো নিয়ে সার্বিয়ার ও বুলগেরিয়ার মধ্যে চরম লড়াই শুরু হয়। যার ফলশ্রুতি হচ্ছে দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধ।
দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধের কারণসমূহ
বলকান রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থের লড়াই:
দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধের মূল কারণ হচ্ছে বলকান রাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক স্বার্থ দ্বন্দ্ব। এর মধ্যে প্রধান কারণ ছিল সার্বিয়া একটি সমুদ্র সংযোগহীন রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া। এই কারণে সার্বিয়া আলবেনিয়া দখল করতে চেষ্টা করে। গ্রিস প্রাচীন সভ্যতার দোহাই দিয়ে মেসিডোনিয়া অধিকার করতে চায়। অন্যদিকে মেসিডোনিয়ায় স্লাভ জাতির বসবাস রয়েছে এবং সার্বিয়াকে আলবেনিয়া দখলে বাধা দেয়া হচ্ছে এই যুক্তিতে সার্বিয়া তার ক্ষতিপূরণ স্বরূপ মেসিডোনিয়া দাবি করে। আবার মেসিডোনিয়ার অধিকাংশ লোক বুলগেরীয় জাতিগোষ্ঠীর বসবাস, সেজন্য বুলগেরিয়া মেসিডোনিয়া দখল করতে চায়। রোমানিয়া বুলগেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একখণ্ড অঞ্চল দাবি করে বসে।
আলবেনিয়ার স্বাধীনতা:
অস্ট্রিয়া ও ইতালির চাপে আলবেনিয়া লন্ডন চুক্তির মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করে। আলবেনিয়ার স্বাধীনতা সার্বিয়ার জন্য সবচেয়ে ক্ষতির কারণ ছিল। কারণ আলবেনিয়া স্বাধীন হওয়ার প্রেক্ষিতে সার্বিয়া ভূমিবেষ্টিত রাষ্ট্রে পরিণত হয় এবং অ্যাড্রিয়াটিক সাগরে প্রবেশের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। এর ফলে সার্বিয়া আলবেনিয়ার কিছু অংশ দখল করার চেষ্টা করে। পাশাপাশি সার্বিয়া মন্টিনিগ্রোর সঙ্গে মিলে আলবেনিয়া ভাগবাটোয়ারা করে নেওয়ার চেষ্টা করে। কারণ আলবেনিয়ার একাংশ দখল করতে পারলে তার অ্যাড্রিয়াটিক সাগরে প্রবেশের পথ খোলা থাকবে। আলবেনিয়া একাংশ দখলের চেষ্টা ই দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধের মূল কারণ।
পরাশক্তিগুলোর কুটনীতি::
দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধের পেছনে কলকাঠী নেড়েছে জার্মানি, রাশিয়া, এবং অস্ট্রো-হাঙ্গেরি। অস্ট্রিয়া আলবেনিয়াতে সার্বিয়ার সম্প্রসারণ নীতির ঘোর বিরোধী ছিল। এই প্রেক্ষিতে জার্মানি অস্ট্রিয়াকে সমর্থন দেয়। অন্যদিকে রাশিয়া, ব্রিটেন ও ফ্রান্স সার্বিয়ার দাবি সমর্থন করে। জার্মানি মনে করে যে সার্বিয়াকে আলবেনিয়ার কিছু অংশ দখল করতে না দিলে অথবা এড্রিয়াট্রিক সাগরে তার যাবার পথ উন্মুক্ত না হলে বাধ্য হয়ে সার্বিয়া আলবেনিয়া আক্রমণ করবে। আর সার্বিয়াকে ঠেকাতে গ্রিস ও বুলগেরিয়া সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবে। এর ফলে বলকান রাষ্ট্র গুলোর মধ্যে ঐক্য বিনষ্ট হবে এবং সেই সুযোগে জার্মানি এ অঞ্চলে তার কূটনৈতিক প্রাধান্য বিস্তার করতে সক্ষম হবে। এই উদ্দেশ্যে জার্মানি অস্ট্রিয়াকে সর্বাত্বক সমর্থন ও উৎসাহ দিতে থাকে।
সার্বিয়া কর্তৃক আলবেনিয়ার বন্দর দখলের চেষ্টা:
সার্বিয়া কর্তৃক অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের প্রবেশের জন্য আলবেনিয়ার একটি বন্দর জোরপূর্বক দখল করতে গেলে দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি এবং ইতালি সার্বিয়াকে বাধা দেয়। এই রকম পরিস্থিতিতে এবং ইউরোপীয় শক্তিবর্গের এই কূটচালে বলকান সমস্যা আরো জটিল আকার ধারণ করে।
আরও পড়ুন-
রেজা শাহ পাহলভী এবং ইরানের আধুনিকায়নে তাঁর অবদান
দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধের ঘটনা প্রবাহ
সার্বিয়ার আধিপত্যবাদ ধ্বংস করার জন্য 1913 সালের জুন মাসে বুলগেরিয়া সার্বিয়া ও গ্রিসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং সার্বিয়া ও গ্রিস আক্রমণ করে। এর মাধ্যমেই দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়। এরপর দাবীকৃত অংশ না পেয়ে রুমানিয়া বুলগেরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এদিকে তুরস্ক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বুলগেরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে প্রথম বলকান যুদ্ধে হারানো রাজ্য উদ্ধারে তৎপর হয়ে ওঠে এবং এড্রিয়ানোপল দখল করে নেয়। দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধ মাত্র কয়েক দিন স্থায়ী হয়েছিল। এই যুদ্ধের একক শক্তি বুলগেরিয়া অন্যান্য সম্মিলিত শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরাজিত হয় এবং অস্টিয়ার চেষ্টায় বুখারেস্ট চুক্তির মাধ্যমে আগস্ট মাসে দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধের পক্ষসমূহ
বুখারেস্ট চুক্তির -1913
বুলগেরিয়া উত্তরদিকের সিলিস্টিয়া এবং দবরুজার বড় অংশ রুমানিয়াকে ছেড়ে দেয়।
মেসিডোনিয়াকে তিনভাবে বিভক্ত করা হয়।
গ্রীস দক্ষিণ মেসিডোনিয়া, কাভানা ও সেলোনিকা লাভ করে।
উত্তর-পশ্চিম মেসিডোনিয়া লাভ করে সার্বিয়া।
বুলগেরিয়া মেসিডোনিয়ার সবচেয়ে ছোট অংশ এবং থ্রেসের একাংশ ও ডিডিআগাজ বন্দরসহ ইজিয়ান সাগর তীরবর্তী অঞ্চল লাভ করে।
তুরস্ক থ্রেসের কিছু অংশ এবং দখলকৃত এড্রিয়ানোপল এর উপর কর্তৃত্ব লাভ করে।
আলবেনিয়ার স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা বহাল থাকে।
দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধের ফলাফল
তুর্কি সাম্রাজ্যের সংকোচন
দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধের পর তুরস্ক সাম্রাজ্য, ইস্তাম্বুল এবং এড্রিয়ানোপলের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এত দিন Turkey in Europe নামে যে অঞ্চল ছিল তা এখন মাত্র 811 বর্গমাইলের মধ্যে সংকুচিত হয়ে পড়ে। এভাবেই ইউরোপে প্রতাপশালী অটোমান সাম্রাজ্যের পরিসমাপ্তি ঘটে।
সম্মিলিত বলকান শক্তির লাভ:
দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধের সম্মিলিত বাহিনী তথা গ্রীস, মন্টিনিগ্রো, সার্বিয়া ও রুমানিয়া বেশ লাভবান হয়। মেসিডোনিয়া কে ভাগ বাটোয়ারা করার ফলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয় গ্রিস। গ্রিস 68%, মন্টিনিগ্রো 62%, রুমানিয়া 5% এবং সার্বিয়া প্রায় 82% ভূখন্ড বৃদ্ধি করে।
ক্ষতিগ্রস্থ বুলগেরিয়া:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বুলগেরিয়া। কেননা বুখারেস্ট চুক্তির শর্তাবলী ছিল বুলগেরিয়ার স্বার্থবিরোধী। যদিও বুলগেরিয়া মেসিডোনিয়ার খুব ছোট অংশ লাভ করেছিল। এতে বুলগেরিয়ার ভূখণ্ড 16% বৃদ্ধি পায়। এই যুদ্ধে পরাজয়ের যে গ্লানি বুলগেরিয়া ভোগ করেছিল তার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বলকান অঞ্চলের পারস্পারিক শত্রুতা বৃদ্ধি:
তুরস্ক থেকে মুক্তি লাভের জন্য বলকান অঞ্চলগুলো প্রথম বলকান যুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। বলকান রাষ্ট্রগুলি স্বাধীন হলেও দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধের পর তাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। বুলগেরিয়াকে সমর্থন করার কারণে সার্বিয়া ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে শত্রুতা চরম আকার ধারণ করে। রুশ সমর্থনে প্যান-স্লাভ আন্দোলন সার্বিয়া, মন্টিনিগ্রো এবং বুলগেরিয়ার সার্ফ অধ্যুষিত অঞ্চলে বিস্তার লাভ করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব মহড়া:
সর্বোপরি দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধ ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব মহড়া।বলকান যুদ্ধের ভিত্তিতে ইউরোপীয় শক্তি দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে এবং ট্রিপল অ্যালায়েন্স ও ট্রিপল আতাঁত গঠিত হয়। অস্ট্রিয়ার সাথে সার্বিয়ার যে বিরোধ তৈরি হয় সেই প্রেক্ষিতেই অস্ট্রীয় সিংহাসনের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী আর্স ডিউক ফ্রান্সিস ফার্ডিনান্ড তার স্ত্রীসহ সার্বিয়া ভ্রমণের আসলে আততায়ীর গুলিতে সারায়েভোতে নিহত হয় যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত করে।
সর্বোপরি প্রথম ও দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধ ইউরোপের তুরস্ক সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটে। শুধুমাত্র ইস্তাম্বুল তুর্কিদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। কিন্তু যুদ্ধ এখানেই শেষ হয়ে যায়নি । দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধ ছিল ইউরোপের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর।দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধ বলকান অঞ্চলের শান্তি বিনষ্ট করে এবং পরাশক্তিগুলোর পক্ষপাতিত্বের যে পরিনতি তা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত করে।
আরও পড়ুন-
গ্রিসের স্বাধীনতা যুদ্ধ (Greek War of Independence)
প্রিয় পাঠক,
যে কোন ভূল-ত্রুটির সংশোধনী বা পরামর্শ থাকলে ওয়েব সাইটে পোস্টের নিচে কমেন্ট বক্সে লিখুন। ইসলামের ইতিহাস, স্বাধীন-বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস, ইসলামের বিধি-বিধান সংক্রান্ত কোন প্রবন্ধ বা সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে লেখা কোন প্রবন্ধ প্রকাশ করতে চাইলে আপনার লেখা এবং পরিচিতিসহ মেইল করুন।
Md. Billal Hossain
B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka
BCS General Education
Lecturer
Department of Islamic History & Culture
Chandpur Govt. College, Chandpur.
No comments:
Post a Comment