Breaking

Wednesday 19 October 2022

কারবালা ট্রাজেডি (680) : কারণ, ঘটনা ও ফলাফল (The Tragedy of Karbala)


কারবালার বিয়োগান্তক ট্রাজেডি: কারণ, ঘটনা ও ফলাফল

[The Tragedy of Karbala: Causes, Events, and Consequences]


মরুময় আরবের ফোরাত নদীর তীরে অবস্থিত কারবালা-প্রান্তরে 680 সালে সংঘটিত নির্মম হত্যাকাণ্ড ইসলামের ইতিহাসে এক বিষাদময় ট্রাজেডি। 


কবি নজরুল ইসলামের ভাষায়-

 “নীল সিয়া আসমান, লালে লাল দুনিয়া।

আম্মা ! লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া।

কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে,

সে কাঁদনে আঁসু আনে সীমারেরও ছোরাতে” [1] 


মুহাম্মদ (স.) এর দৌহিত্র ইমাম হুসাইন সত্য ও ন্যায়ের ঝান্ডা সমুন্নত করতে গিয়ে কারবালা-প্রান্তরে সপরিবারে শাহাদাত বরণ করেন। হযরত মুয়াবিয়া (রা.) এর পুত্র ইয়াজিদের মদদপুষ্ট উবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে এবং সীমারের দ্বারা গঠিত এই কলংকময় ট্রাজেডি সংঘটিত হয়। এই মর্মান্তিক ট্রাজেডির পেছনে অনেক প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ কারণ নিহিত রয়েছে। আর কারবালার হত্যাকাণ্ড ইসলামের ইতিহাসে এক সুদূর প্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছে ।









সংকটের যোগসুত্র: 

হযরত আলী (রা.) এর মৃত্যুর পর তার ও তার অধীনস্থ লোকদের সমর্থনে ইমাম হাসান খেলাফতের পদে আসীন হন। এ সময়ে হযরত মুয়াবিয়া (রা) ইরাক আক্রমণ করেন।  তাই বাধ্য হয়ে নতুন খলিফা হযরত হাসান (রা.) সিরিয়াবাসীদের বাধাদানের উদ্দেশ্যে যুদ্ধযাত্রা করেন। সেনাপতি কয়েসকে অগ্রে প্রেরণ করেন। কিন্তু পথিমধ্যে পরাজয়ের মিথ্যা সংবাদ প্রচারের ফলে নবীন খলিফার সৈন্যবাহিনীতে বিদ্রোহ দেখা দেয়। তারা জোরপূর্বক খলিফার শিবিরে প্রবেশ করে,দ্রব্যাদি লুন্ঠন করে এবং তাকে শত্রু হস্তে সমর্পণ করতে মনস্থ করে। এভাবে যুদ্ধ ছাড়াই হযরত হুসাইন মুয়াবিয়া(রা.) এর কাছে পরাস্ত হন। বাধ্য হয়ে তিনি ভগ্নহৃদয়ে খেলাফতের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। আর কর্ম ক্ষেত্রে অবিশ্বস্ততার পরিচয় দেওয়ায় তিনি ইরাকি সমর্থকদের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন।


অতঃপর ইমাম হুসাইন (রা.) খলিফার বিরোধিতা পরিত্যাগ করেন। পরস্পর আলোচনার মাধ্যমে একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।  661 সালে সম্পাদিত সেই চুক্তির শর্ত অনুসারে- 


  1. হযরত মুয়াবিয়া (রা) কে তাঁর জীবনের জন্য খেলাফত দেয়া হল

  2. শর্ত থাকে যে, হযরত মুয়াবিয়ার ইন্তেকালের পর আলীর দ্বিতীয় পুত্র হুসাইন খিলাফত প্রাপ্ত হবেন।

  3. ইমাম হাসান রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে মদিনায় জীবন যাপন করবেন।  খলিফার পক্ষ থেকে তিনি ভাতা প্রাপ্ত হবেন।

যদিও ইমাম ইমাম হাসানকে কিছুদিন পরেই এক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়।


আরও পড়ুন-

বিদায় হজ্বের ভাষণ এবং হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কর্তৃক ঘোষিত সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংস্কারাবলী 



কারবালার মর্মান্তিক ট্রাজেডির কারণসমূহ 


যে সকল পুঞ্জিভূত ঘটনার প্রেক্ষিতে কারবালার মর্মান্তিক ট্রাজিডি সংঘটিত হয়েছিল তা নিম্নরূপ-


  1. শান্তি চুক্তি ভঙ্গ:

661 সালে সম্পাদিত ইমাম হাসান-মুয়াবিয়া (রা.) চুক্তির ভিত্তিতে হযরত মুয়াবিয়া (রা) এর ইন্তেকালের পর হযরত ইমাম হুসাইন মুসলিম বিশ্বের খলিফা হওয়ার বৈধ দাবিদার ছিলেন। কিন্তু হযরত মুয়াবিয়া (রা.) শাসনকর্তা মুগীরা প্ররোচনায় ইয়াজিদকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। এটা ছিল পূর্বতন শান্তিচুক্তির বরখেলাপ। যেহেতু মক্কা-মদিনা তথা হেজাজে হাসানের সমর্থন ছিল তাই হাসান এটাকে অবৈধ বলে ঘোষণা করেন। এর মাধ্যমেই সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে। যার পরিসমাপ্তি ঘটে কারবালা মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে। 


  1. হাশেমী উমাইয়া বিরোধ:

মুহাম্মদ (স.) এর জন্মের পূর্ব থেকেই হাশমি এবং উমাইয়াদের মধ্যকার চরম বিরোধ চলে আসছিল। যারা যখনই সুযোগ পেয়েছে তখনই একে অন্যের উপর প্রতিশোধ স্পৃহা চরিতার্থ করেছে। মক্কা বিজয়ের পূর্ব মুহূর্তেও আবু সুফিয়ান  শুধু উমাইয়া হাশেমী দ্বন্দ্বের কারণেই ইসলাম গ্রহণ করছিলেন না। অবশ্য তখন ইসলাম গ্রহণ না করেও তার আর কোন উপায় ছিল না। মুহাম্মদ (স.) ব্যক্তিত্ব ও তার আদর্শে এই গোত্রীয় বিরোধ অনেকটা  মিটে গেলেও  তাঁর মৃত্যুর পর খলিফা নির্বাচনে এর  প্রভাব পড়ে।  খলিফা হযরত ওসমানের আমলে উমাইয়ারা নিজেদের অবস্থান  শক্তিশালী করে। হযরত মুয়াবিয়া (রা) খিলাফত লাভ ছিল তাদের প্রথম বিজয়। ইয়াজিদের ক্ষমতা গ্রহণের পর কারবালার হত্যাকান্ডের মাধ্যমে তারা হাশেমীয়দের উপর চূড়ান্ত প্রতিশোধ গ্রহণ করে। 



  1. উসমান হত্যার প্রতিশোধ:

কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার পেছনে খলিফা উসমান হত্যার প্রতিশোধ স্পৃহা সক্রিয় কাজ করেছে বলে ঐতিহাসিক গ্রহণ মনে করেন। উমাইয়ারা হযরত উসমান হত্যার জন্য হাশেমীয়দেরকেই দায়ী করে থাকে। আর হাশেমীয়দের উপর  প্রতিশোধ স্পৃহা চরিতার্থ করার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল কারবালা প্রান্তরে। 


  1. ধর্মীয় নেতাদের অবমাননা:

ইয়াজিদ ধর্মের বিধান তোয়াক্কা করতেন না। তিনি ধর্মীয় আলেম ও নেতাদেরকে চরমভাবে ঘৃণা ও অপমান করতেন। ঐতিহাসিক আমীর আলীর বর্ণনায় এসেছে-


”তিনি যেখানেই যাইতেন সেখানেই একটি বানর কে ধর্মযাজকের পোশাকে সজ্জিত করিয়া সুন্দর বেশভূষায় মন্ডিত একটি সিরিয় গর্দভের পৃষ্ঠে  আরোহন করাইয়া লইয়া যাইতেন “


এতে ধর্মীয় আলেমসমাজ তার বিরোধী হয়ে ওঠে। বিশেষ করে মক্কা-মদিনা তথা হেজাজ অঞ্চলের লোকজন বেশি অসন্তুষ্ট ছিল। তারা এরূপ শাসকের হাত থেকে মুক্তি পাবার আশা পোষণ করত। তাদের এই মনোভাব ইমাম হোসেনকে অনুপ্রাণিত করেছে। 


  1. ইয়াজিদের চরিত্রহীনতা:

মুসলিম মিল্লাতের নেতা ইমাম হুসাইন এবং ধর্মীয় নেতারা ইয়াজিদের চরিত্রহীনতার কারণেও তাঁর পতন কামনা করেছিলেন।  ইয়াজিদ পাপাসক্ত, অত্যাচারী, মদ্যপায়ী, হৃদয়হীন, বিশ্বাসঘাতক ও দুশ্চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। তিনি মানুষের কল্যাণ বাদ দিয়ে নিজের ইন্দ্রীয় তৃপ্তি সাধনে গা ভাসিয়ে দেন।




  1. কুফা বাসীদের বিশ্বাসঘাতকতা: 

কুফাবাসীরা ছিল দুর্বল চরিত্রের অধিকারী।তারা ছিল অস্থির প্রকৃতির। তাদের মন-মানসিকতা ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তিত হত। তারা ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের দুঃশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে হুসাইনকে আমন্ত্রণ করেছিল। কিন্তু সেখানে প্রয়োজন মুহূর্তে তারা উবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদের ভয়ে হোসাইন এর পক্ষ ত্যাগ করে ইমাম হোসাইন কে বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছিল।



আরও পড়ুন-

জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য,সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে মামলুকদের অবদান




  1. মারওয়ান এর ষড়যন্ত্র:

উমাইয়া সম্প্রদায় ছিল ষড়যন্ত্র আর কূটকৌশলে সিদ্ধহস্ত। এসব কুটকৌশলীদের মধ্যে মারওয়ান ছিলেন অন্যতম। মারওয়ান তাঁর এই  কূটকৌশলের মাধ্যমেই পরবর্তীতে উমাইয়া খিলাফতের মসনদে আসীন হয়েছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে উমাইয়া বংশধরগণ যে ষড়যন্ত্রমূলক কৌশলে সিদ্ধহস্ত ছিলেন ইমাম হোসাইন এ গুনটিই জানতেন না। মারওয়ান ইমাম হুসাইনের দৃঢ়তা এবং সততাকে দারুন ভয় করতেন। হোসাইন খলিফা হলে মারওয়ানের ক্ষমতা এবং স্বার্থের সামগ্রিক অসুবিধা হবে তাই সে ইয়াজিদের ডান হস্ত হিসেবে কাজ করে হোসাইন এর বিরুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্র শুরু করে। যারা ফলাফল ফলাফল কারবালার যুদ্ধ


  1. হুসাইন কর্তৃক প্রকাশ্য বিরোধিতা: 

ইয়াজিদ খলিফা ঘোষিত হওয়ার পরও হোসাইন কর্তৃক ইয়াজিদের প্রকাশ্য বিরোধিতা কারবালার যুদ্ধের অন্যতম কারণ। যদিও খলিফা হিসেবে ইয়াজিদের নিয়োগ ছিল অবৈধ এবং নীতি বিবর্জিত। হোসাইন খিলাফতের বৈধ দাবিদার ছিলেন। তাই তিনি ইয়াজিদের মত একজন অবৈধ দখলদার ব্যক্তির স্বীকৃতি ও  আনুগত্য মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। যা কারবালার মর্মান্তিক ঘটনারকে ত্বরান্বিত করেছে। 




  1. আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের এর প্ররোচনা: 

মক্কা ও মদিনা তথা হেজাজের জনগণের বৃহত্তর অংশ ইয়াজিদ বিরোধী ছিল এবং তারা হোসাইন এর পক্ষ অবলম্বন করে। তাদের অনেকেই হুসাইনকে যুদ্ধে যেতে আহবান করেছিল।  মক্কার অন্যতম ব্যক্তিত্ব আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর মনে-মনে খলিফা হওয়ার বাসনা পোষণ করতেন। তাই তিনি এক্ষেত্রে ইমাম হোসাইন কে তার পথের প্রতিবন্ধক মনে করেছিলেন। তিনি হোসাইনকে যুদ্ধে যাবার জন্য প্ররোচিত ও উৎসাহিত করেন। যদিও হুসাইনের অনেক বন্ধু-বান্ধব তাকে কুফা যেতে বারণ করেছিলেন কিন্তু তিনি কারো কথা না শুনে কুফার দিকে যাত্রা করেছিলেন।  যার পরিণতি কারবালার  যুদ্ধ। 


  1. মদিনার গুরুত্ব হ্রাস পাওয়া: 

মদীনাবাসীরাভেবেছিলেন হযরত মুয়াবিয়া (রা.) এর মৃত্যুর পর হুসাইন খলিফা হলে মদিনা আবারও গৌরব ও উন্নতিতে ভরে উঠবে। কিন্তু ইয়াজিদের ক্ষমতা লাভ করার ফলে রাজধানীসহ সবকিছু দামেস্কে হওয়ায় মদিনার গুরুত্ব বহুলাংশে হ্রাস পায়।  যা মদিনাবাসীরা মেনে নিতে পারেন নি। তাই তারা হুসাইনের পক্ষে ইয়াজিদের বিরুদ্ধাচারণ করেছিল যা কারবালার মর্মান্তিক ট্রাজেডির অন্যতম কারণ। 


  1. আবু মুসলিমের অনুকূল রিপোর্ট:

ইমাম হুসাইন কুফার সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার জন্য তার বিশ্বস্ত সহচর আবু মুসলিম কে প্রেরণ করেন। ওবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদ এ সময় কৌশলীভাবে আবু মুসলিমের সাথে ভালো আচরণ করেন। ফলে কিছুদিন পর আবু মুসলিম পরিবেশ পরিস্থিতি অনুকূলে আছে বলে ইমাম হোসাইন কে রিপোর্ট প্রদান করলে হুসাইন ফুফা রওয়ানা হন।  ওবায়দুল্লাহ যখন শুনতে পারেন হোসাইন কুফা যাত্রা করেছেন তখন সে আবু মুসলিমকে সপরিবারে বন্দি করে হত্যা করে। তার চাপাচাপি তে কুফার জনগণ হোসাইন বিরোধী হয়ে যায়। হোসাইন পথিমধ্যে আবু মুসলিম এর শাহাদাতের সংবাদ যা পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে।


  1. আবু মুসলিমের হত্যার প্রতিশোধ নেয়া:

পথিমধ্যে হুসাইন আবু মুসলিমের হত্যার খবর শুনলে তিনি কুফা যাবেন কিনা এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েছিলেন। তখনো তার ফিরে আসার সুযোগ ছিল।  কিন্তু এ সময়ে আবু মুসলিম এর পরিবার এবং তার ঘনিষ্ঠজনরা আবু মুসলিমের সপরিবারে হত্যা কান্ডের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য হোসাইনকে উৎসাহিত করতে থাকে এবং চাপ সৃষ্টি করে। এরপর হুসাইন থেমে না গিয়ে ফুফা যাত্রা শুরু করেন যা কারবালার প্রান্তরে এসে থেমে যায়। 



আরও পড়ুন-

মুহাম্মদ (স.) এর হিজরত: কারণ ও ফলাফল




কারবালার ঘটনা প্রবাহ

  1. ইমাম হুসাইনের কুফা যাত্রা:

কুফা বাসীদের আমন্ত্রণে এবং ইয়াজিদের বিরুদ্ধে তাদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পেয়ে ইমাম হুসাইন ৬৮০ সালে ৫৯ হিজরি ৩রা জিলহজ সপরিবারে কুফা যাত্রা করেন। কিন্তু তার আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধব অনেকেই তাকে কুফা যেতে বারণ করেন। হুসাইন তাদের কথায় কর্ণপাত না করে দৃঢ় মনোবল নিয়ে কুফার দিকে অগ্রসর হন। এ সময় তার সাথে  নারী ও পুরুষসহ প্রায় 200 অনুচর ছিল। এদের মধ্যে যুদ্ধ করতে পারে এমন সংখ্যা ছিল 72 জন। 


  1. আবু মুসলিম হত্যার সংবাদ:

কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর পথিমধ্যে বিপরীত দিক থেকে আসা কয়েকজন অশ্বারোহী তাকে সংবাদ দিলেন যে ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এবং আবু মুসলিম ও তার দুই পুত্রকে হত্যা করেছে। এ সময় ইমাম হোসাইন সামনে অগ্রসর হবেন কিনা ইতস্ত করছিলেন। তখন ও তাঁর ফিরে আসার সুযোগ ছিল। কিন্তু আবু মুসলিমের পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনরা ইমাম হোসেনকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য কুফা যাত্রা করতে চাপাচাপি করেছিলেন।  অতঃপর ইমাম হোসাইন সামনের দিকে অগ্রসর হন।


  1. ওবাইদুল্লাহ ইবনে জিয়াদের প্রতিরোধ:

ইমাম হোসাইন ফুফার উপকণ্ঠে উপস্থিত হলে প্রথমে তামিম গোত্রের লোকেরা তাকে বাধা দেয়। অতঃপর হুসাইন ফোরাত নদীর তীরবর্তী কারবালায় তাবু ফেলেন। অতঃপর ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের প্রেরিত ৪ হাজার সৈন্য তাদের অবরোধ করে এবং ফোরাত নদীর সীমানা দখল করে পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। দীর্ঘদিন পানি পানির অভাবে হুসাইনের শিবিরের হাহারের উঠে এবং ধীরে ধীরে অনেকেই মৃত্যুবরণ করতে থাকে।


  1. ইমাম হোসাইন এর শান্তি প্রস্তাব:

এই অবস্থায় রক্তপাত এড়াতে ইমাম হুসাইন তিনটি শান্তি প্রস্তাব পেশ করেন তা হল-


  1. তাকে নিরাপদে মদিনায় ফিরে যেতে দেয়া হোক;

  2. তুর্কি সীমান্তবর্তী কোন দুর্গে অবস্থান করতে দেয়া হোক; 

  3. তাকে সরাসরি ইয়াজিদের কাছে পৌঁছে দেয়া হোক যাতে তিনি তার সাথে আলোচনা করতে পারেন।

কিন্তু ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ এসব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং তাকে বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দেন। 


  1. কারবালার যুদ্ধ ও ইমাম হোসাইন এর শাহাদাত বরণ:

শান্তি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান হলে হুসাইন নিজেই সরাসরি তাদের কাছে কিছু আবেদন পেশ করেন কিন্তু কোন সাড়া মেলেনি। এদিকে পানির অভাবে হুসাইন শিবিরে কান্নার রোল পড়ে যায়। পুত্র আজগর কে কোলে নিয়ে পানির জন্য হোসাইন ফেরাতকুলে গেলেই একটি তীরে আজগরের বুকে বিদ্ধ হয়। শিশু আজগর হুসাইনের কোলেই শাহাদাৎ বরণ করেন। বাধ্য হয়ে হুসাইন 60 হিজরির 10 ই মহররম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। পুত্র কাশেমসহ একে একে মুসলিম বীর সন্তানেরা শহীদ হলে হোসাইন শিবিরে স্বজনদের আহাজারিতে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। অবশেষে হুসাইন সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন এবং এক পর্যায়ে ফোরাতকুল শত্রুমুক্ত করেন। পানি পান করার সুযোগ হলেও তিনি আর পানি পান করেন নি। ফোরাত থেকে তিনি উপরে উঠে আসেন। এ সময় হঠাৎ একটি তীর এসে তার চেহারা বিদীর্ণ করলে তিনি ভূপাতিত হন। অতঃপর সীমার  তাঁর শিরচ্ছেদ করলে তিনি শহীদ হন। হুসাইনের ছিন্ন মস্তক সীমার ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদের কাছে নিয়ে গেলে সে হুসাইনের চেহারা মুবারকে বেত্রাঘাত করে। অতঃপর ছিন্ন মস্তক তার  পরিবারবর্গসহ ইয়াজিদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ইয়াজিদ কর্তিত শির তার আত্মীয় স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করেন এবং তাদেরকে মদিনায় পাঠিয়ে দেন। অতঃপর ইমাম হোসেনকে মদিনায় সমাহিত করা হয়। 




আরও পড়ুন-

খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজ।। ইসলামের পঞ্চম খলিফা 



কারবালা ট্রাজেডির গুরুত্ব/ কারবালা ট্রাজেডির ফলাফল


  1. মুসলিম ঐক্য বিনষ্ট:

কারবালার মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড ইসলামের ঐক্যের প্রাচীরে বিরাট ফাটল সৃষ্টি করে, যা মুসলমানদের জাতীয় জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলে এবং পুনরায় গৃহযুদ্ধের দিকে আরব জাতিকে ঠেলে দেয়। খোলাফায়ে রাশেদীনের সময়ে বিশ্ব বিজয়ের যে ধারাবাহিকতা শুরু হয়েছিল তা অনেকাংশেই স্থবির হয়ে যায়। এক্ষনে আরবরা নিজেরাই নিজেদের শত্রু হয়ে দাঁড়ায়, যা ইসলামের অপূরণীয় ক্ষতি করে।  


  1. রাজনৈতিক বিপর্যয়:

কারবালার হত্যাকাণ্ডকে সুমাইয়া গ্রন্থের উপর হযরত ওসমানের হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে গণ্য করে। বলাবাহুল্য যে হত্যাকাণ্ড ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য এক রাজনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করে। ঐতিহাসিক মুইর বলেন- কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা কেবল খেলাফতের ভাগ্য ই নির্ধারণ করে নি বরং পরবর্তীকালে মুসলিম জাহানের ভাগ্য নির্ধারিত করে। কেননা এই হত্যাকাণ্ডের ফলে পরবর্তীতে বহু রাজনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। 


  1. খিলাফতের পট পরিবর্তন:

হযরত মুয়াবিয়া (রা. এর পর হযরত হোসাইন এর হাতে আরব খিলাফতের দায়িত্ব আসবে এটাই আরববাসী কামনা করেছিল। কিন্তু ইয়াজিদ খলিফা হলে খিলাফতের নীতি ও চরিত্রের পরিবর্তন ঘটে। আর এর বিরুদ্ধাচারণ করতে গিয়ে সংঘটিত হয় কারবালার যুদ্ধ। 


সেজন্য ঐতিহাসিক শিবলী নোমানী বলেন-

কারবালার ঘটনার ফলে খিলাফতের ধারা সম্পূর্ণ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়। ঐক্য, সংহতি ও ইসলামী বিধান সম্বলিত খেলাফত অযোগ্য, ফাসেক, জালিম স্বৈরাচারীদের মনগড়া আইনে চলতে থাকে।


  1. শিয়া সম্প্রদায়ের আত্মপ্রকাশ:

মুহাম্মদ সাঃ এর ইন্তেকালের পর একটি সম্প্রদায় হযরত আলীকে একমাত্র উত্তরাধিকারী মনে করত। তারা আবু বকর ওমর এবং ওসমানের ক্ষমতা গ্রহণকে সঠিক বলে মনে করত না। ফলে তারা অসন্তুষ্ট ছিল এবং গোপনে গোপনে তারা ক্ষুব্ধ ছিল। তাদের দীর্ঘদিনের গোপন ক্ষোভ প্রকাশিত হয় কারবালার হত্যাকাণ্ড হওয়ার কারণে। তারা তাদের নীতি আদর্শ নিয়ে জনসম্মুক্ষে চলে আসে এবং জন্ম হয় শিয়া সম্প্রদায়ের।  তখন থেকে মুসলিম মিল্লাত শিয়া এবং সুন্নি দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।  তারা হযরত আলী ব্যতীত অন্য তিন খলিফাদের ক্ষমতা লাভকে অবৈধ মনে করত। এই শিয়া সম্প্রদায় মুসলিম বিশ্বে বহু ঘাত-প্রতিঘাতের সৃষ্টি করেছে। তারা পৃথিবীতে আজও তাদের আদর্শ ও ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে টিকে আছে। বর্তমান ইরান তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। 


  1. উমাইয়াদের পতনের সূচনা:

কারবালার হত্যাকাণ্ড গোটা আরব সমাজের মানুষের অন্তরে আঘাত করেছিল। যদিও তাদের শক্তি ছিলনা তথাপিও তারা উমাইয়াদেরকে অন্তরে অভিশাপ দিচ্ছিল এবং তাদের শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার প্রার্থনা করছিল। উমাইয়া বিরোধী এই মন মানসিকতা ই আব্বাসীয় আন্দোলনের সূত্রপাত করে। উমাইয়া বিরোধীরা আব্বাসীয় দলে যোগ দেয় এবং এদের দ্বারাই উমাইয়াদের পতন ঘটে



  1. ইয়াজিদের শাসনকর্তা বিতাড়িত: 

কারবালার হত্যাকাণ্ড মদিনাতে ভয়ানক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তাদেরকে শান্ত করার জন্য ইয়াজিদ মদিনাতে একজন শাসনকর্তা প্রেরণ করেন। তার পরামর্শক্রমে মদিনার সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গ হুসাইনের পরিবারের প্রতিকার প্রার্থীরূপে দামেস্কে একদল প্রতিনিধি প্রেরণ করে। এই প্রতিনিধি দল ইয়াজিদের ব্যবহার এবং তাহার জঘন্য জীবনযাত্রা দেখে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ফিরে আসে। তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় মদীনাবাসীরা ইয়াজিদের পদচ্যুতি ঘোষণা করে এবং তার নিযুক্ত শাসনকর্তা কে বিতাড়িত করে। 


আরও পড়ুন-

খলিফা আব্দুল মালিক।। Abdul Malik the Umayyad Caliph.




  1. হাররার যুদ্ধ:

ইয়াজিদের শাসনকর্তাকে বিতাড়িত করার কারণে এবং মদিনায় বিদ্রোহের কারণে মদিনাবাসী কে শাস্তি দেওয়ার জন্য ইয়াজিদ তার বেতনভুক্ত সৈন্যবাহিনী এবং উমাইয়াদের অনুগত ব্যক্তিগণ দ্বারা গঠিত এক বিশাল সৈন্যবাহিনী মদিনায় প্রেরণ করে। আরব ইতিহাসে অভিশপ্ত ঘাতক হিসেবে পরিচিত মুসলিম ইবনে উকবা বাহিনীর প্রধান ছিলেন। শালা নামক স্থানে উভয়ে বাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং মদীনাবাসী কোন বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেও প্রতিপক্ষের সংখ্যাধিক্য হেতু পরাজয় বরণ করে এতে মদিনার বহুসংখ্যক সাহাবী সাদ বরণ করেন। 




  1. মদিনা লুণ্ঠন: 

মনিাবাসীদের পরাজয়ের পর ইয়াজিদের বাহিনী মদিনাতে ব্যাপক লুণ্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। তিন দিন ধরে মদিনায় তাদের অত্যাচার অব্যাহত ছিল মদিনার কবরগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছিল এবং অনেক প্রবীণ সাহাবীকে হত্যা ও নির্যাতন করা হয়েছিল এই সময়ে । যে মদিনাবাসী মুহাম্মদ(স.)  কে আশ্রয় দিয়েছিল আজ তাঁর অবর্তমানে এই ভাবে তারা তার প্রতিদান পেল। 



  1. মক্কা অবরোধ:

ইমাম হোসাইন এর শাহাদতের পর কার্যত মক্কা এবং মদিনায় দুটি পবিত্র স্থানে আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর এর নেতৃত্বে ছিল। তিনি মক্কায় নিজেকে খলিফা বলে ঘোষণা করেছিলেন। ইয়াজিদের সৈন্যবাহিনী মদিনা বিধ্বস্ত করার পর মক্কারঅবরোধ করে এবং অগ্নিসংযোগ করে,হাজরে আসওয়াদ তিন খন্ডে বিভক্ত হয়।  দীর্ঘ দিনের অবরোধের কারণে মক্কার অবর্ণনীয় ক্ষতি সাধিত হয়।  ঠিক এ সময়ে ইয়াজিদের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে সৈন্যবাহিনী মক্কা অবরোধ  প্রত্যাহার করে  চলে যায়। 




  1. হাশেমী উমাইয়া চরম বিরোধ::

এতোকাল যাবত হাশেমী-উমাইয়া বিরোধ যেটুকু ছিল কারবালা হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে তা আরো তীব্রতর হয়। একে অন্যের উপর প্রতিশোধ এর শপথ গ্রহণ করে। যার ফলশ্রুতিতে হাশেমীয় আন্দোলন এবং তারপরে আব্বাসীয় বিপ্লবের মাধ্যমে উমাইয়াদের পতন ঘটে। আব্বাসীয় বংশের আবুল আব্বাস আসসাফ্ফাহ সেই প্রতিশোধ স্পৃহা চরিতার্থ করেন।


  1. ত্যাগের মহান শিক্ষা:

কারবালার হত্যাকাণ্ড মুসলিম জাতির জন্য যে মহান শিক্ষা রেখে গেছে তা হলো ত্যাগের মহান শিক্ষা নেয়া। নীতি ও আদর্শকে পায়ে ঠেলে ইয়াজিদ যা করেছে তা মানতে পারেন নি। অন্যায় অসত্য সাথে আপোষ না করে তিনি সত্য এবং ন্যায়ের জন্য যে আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা ইতিহাসে বিরল এবং উজ্জ্বল ও অনুকরণীয় এক মহান শিক্ষা। মুসলিমদের কে অসত্যের বিপক্ষে লড়াই এবং প্রয়োজনে আত্মত্যাগের শিক্ষা দিয়েছেন তিনি।


কাজী নজরুল বলেছেন-

ফিরে এলো আজ সেই মহররম মাহিনা 

ত্যাগ চাই মর্সিয়া-ক্রন্দন চাহি না [11]


পরিশেষে কারবালার হত্যাকাণ্ড ইসলামের ইতিহাসে অবিস্মরনীয় এক ট্রাজেডি। এর পরবর্তী ফলাফল একসময় ইয়াজিদের সিংহাসন পর্যন্ত নড়বড়ে করেছিল। এখান থেকেই উমাইয়াদের পতনের বীজ রোপিত হয়। মূলত কারবালার হত্যাকাণ্ড ইসলামের অগ্রযাত্রাকে বেগবান করেছে।  ইসলাম শেষ হয়ে যায়নি বরং তাঁর নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়েছে। 


তাইতো খিলাফত আন্দোলনের বিখ্যাত নেতা মাওলানা মোহাম্মদ আলী বলেছিলেন-


“‘কাতলে হুসাইন আসল মে মারগে ইয়াজিদ হ্যায়, 

ইসলাম জিন্দা হোতা হায় হার কারবালা কে বাদ।”

(See-https://www.amadershomoy.com/bn/2020/08/30/1207438.html, 2022)


হুসাইনের নিহত হওয়ার ঘটনা আসলে ইয়াজিদেরই মৃত্যু, ইসলাম প্রতিটি কারবালার পর পুনরুজ্জীবিত হয়।


আরও পড়ুন-

মুহাম্মদ (স.) এর নবুওয়াত লাভ এবং ঘটনাবহুল মক্কী জীবন






[ প্রিয় পাঠক,

যে কোন ভূল-ত্রুটির সংশোধনী বা পরামর্শ থাকলে  ওয়েব সাইটে পোস্টের নিচে কমেন্ট বক্সে লিখুন। ইসলামের ইতিহাস, স্বাধীন-বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস,  ইসলামের বিধি-বিধান সংক্রান্ত কোন প্রবন্ধ বা সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে লেখা কোন প্রবন্ধ প্রকাশ করতে চাইলে আপনার লেখা এবং পরিচিতিসহ  মেইল করুন। ]


Md. Billal Hossain

B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka

BCS General Education

Lecturer

Department of Islamic History & Culture

Chandpur Govt. College, Chandpur.




No comments:

Post a Comment