Breaking

Friday 28 October 2022

হুদায়বিয়ার সন্ধি: ইসলামের প্রকাশ্য বিজয়

      হুদায়বিয়ার সন্ধি: ইসলামের প্রকাশ্য বিজয়

প্রেক্ষাপট, ঘটনা ও গুরুত্ব


       [ The Treaty of Hudaybiyah: A Clear Victory of Islam ] 

          

628 সালে মোহাম্মদ (স.) এবং মক্কার কুরাইশদের মধ্যে সম্পাদিত হুদায়বিয়ার সন্ধি ইসলামের অগ্রযাত্রার এক মাইলফলক। ইসলামী শক্তিকে বেগবান করার ক্ষেত্রে এ সন্ধি এক নবযুগের সূচনা করেছে। বস্তুত মক্কা বিজয়ের সহ পরবর্তী বিভিন্ন অভিযানের সাফল বীজ হুদায়বিয়ার সন্ধিতে নিহীত  ছিল। হুদায়বিয়ার সন্ধি মক্কা বিজয়কে তরান্বিত করেছিল। হুদায়বিয়ার সন্ধির শর্তাবলী বাহ্যিক দৃষ্টিতে মুসলমানদের প্রতিকূল মনে হলেও এর সুদূরপ্রসারী ফল ছিল সম্পূর্ণরূপে মুসলমানদের অনুকূলে। এই সফলতার প্রতি দৃষ্টিপাত করে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা হুদায়বিয়ার সন্ধি কে ফাতহুম মুবিন বা প্রকাশ্য বিষয় হিসেবে ঘোষণা করেছেন। 







 হুদায়বিয়ার সন্ধির পটভূমি: 


  1. রাসুলুল্লাহ (স.) এর স্বপ্ন:

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মদিনায় হিজরত এর পর দীর্ঘ ৬ বছর যাবৎ পবিত্র মক্কা নগরী দর্শন করতে পারেননি। একরাত্রি তিনি স্বপ্নে দেখেন যে সাহাবীগণ সহ তিনি বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করছেন এবং ইহরামের কাজ সমাপ্ত করে কেউ কেউ মাথা মুন্ডন করছেন । তিনি বাইতুল্লাহ শরীফে প্রবেশ করছেন এবং চাবিও তার হস্তগত হয়েছে। আর নবীদের স্বপ্ন সত্য হয়ে থাকে। তিনি  সাহাবীদেরকে সবকিছু জানালেন এবং ওমরা পালনের জন্য প্রস্তুতির নির্দেশ দিলেন। সবাই আনন্দ সহকারে ওমরা পালনের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে । আর নবীজি তাদেরকে কোরবানির পশু সাথে নিতে বললেন  [2] 


  1. মুসলিম কাফেলার হজ্ব যাত্রা: 

628 সাল, ৬ষ্ঠ হিজরীর জিলকদ মাসে রাসূলুল্লাহ (স,) প্রায় 1400 সাহাবী নিয়ে ওমরা পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা যাত্রা করেন। তিনি প্রচলিত পথ ছেড়ে অন্য পথে অগ্রসর হন এবং মক্কার অদূরে হুদাইবিয়া নামক একটি কুপের নিকট যাত্রাবিরতি করেন। তাঁর আগমনের সংবাদ শুনে মুসলিমদের গতি রোধ করার জন্য খালিদ ও ইকরামার নেতৃত্বে কুরাইশরা সৈন্য প্রেরণ করে। মুহাম্মদ (স.) বুনু খোঁজা গোত্রের বুদাইলের মাধ্যমে সমস্ত খোঁজখবর জানতে পারেন। বুদাইলের মাধ্যমে তিনি কুরাইশদেরকে জানিয়ে দিলেন যে শান্তিপূর্ণভাবে শুধু  ওমরাহ পালন করার উদ্দেশ্যেই তাঁরা এসেছেন অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই। কিন্তু কুরাইশরা মুসলিমদেরকে কোনভাবেই মক্কায় প্রবেশ করতে দিবে না বলে জানিয়ে দেয়।  


  1. দুত বিনিময় ও মধ্যস্থতার চেষ্টা:

বুদাইলের মধ্যস্থতা ব্যর্থ হয়। অতঃপর মুকরিজ ইবনে হাফস মুসলিমদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে বিস্তারিত কুরাইশদেরকে অবহিত করেন। তৃতীয়বারে কেননা গোত্রের হালিস ইবনে আলকামা মুসলিম শিবির পর্যবেক্ষণ করে তাদের সাথে কোরবানির পশু দেখে কুরাইশদেরকে বলেন যে, এই কাফেলাকে মক্কা থেকে ফিরিয়ে দেওয়া সমীচীন হবে না। কিন্তু কোরাইশরা তার কথায় কর্ণপাত করেনি। অতঃপর উরওয়া ইবনে মাসউদ শাকাফি মুহাম্মদ (স.) এর কাছে আলোচনার জন্য আসেন। সে মুহাম্মদ এবং তাঁর সাহাবীদের সাথে অশালীন ও বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ করে। অতঃপর মোহাম্মদ (স.) এর প্রতি সাহাবীদের অগাধ ভক্তি দেখে সে মক্কায় ফিরে গিয়ে কুরাইশদেরকে মুহাম্মদ (স.) এর প্রস্তাব মেনে নেওয়ার পরামর্শ দেয়। 


এসময় মক্কার প্রবীণ ব্যক্তিরা সন্ধির পক্ষে ছিলেন। কেননা সন্ধি না হলে মদিনার পথে সিরিয়া বাণিজ্য নষ্ট হবে। প্রবীনদের এই সন্ধি মনোভাব বুঝতে পেরে সন্ধি প্রক্রিয়া বানচাল করার জন্য রাতের আধারে মক্কা 70-80 জন যুবক মুসলিম শিবির আক্রমণ করতে এসে উল্টো উল্টো নিজেরাই মুসলিমদের হাতে বন্দী হয়ে যায়। সন্ধির খাতিরে মুহাম্মদ (স.) তাদের ক্ষমা করে মুক্ত করে দেন। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (স.) হযরত উসমান (রা.) কে শান্তি প্রস্তাব এর বিস্তারিত বুঝিয়ে বলার জন্য মক্কায় প্রেরণ করেন। 



আরও পড়ুন-

বিদায় হজ্বের ভাষণ এবং হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কর্তৃক ঘোষিত সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংস্কারাবলী 



  1. হযরত উসমান হত্যার গুজব:

হযরত উসমানকে কুরাইশরা গ্রহণ করে এবং দীর্ঘক্ষন তাদের কাছেই রেখে দেয়। সম্ভবত কুরাইশদের মনোভাব ছিল উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর ওসমানকে জানিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু দীর্ঘ সময় হযরত ওসমানের ফিরে না আসার কারণে মুসলিম শিবিরে এই গুজব রটে যায় যে হযরত উসমানকে কে হত্যা করা হয়েছে। 


  1. বাইয়াতে রিদওয়ান: 

হযরত ওসমানের হত্যাকাণ্ডের সংবাদ শুনে রাসূলুল্লাহ সাহাবীদেরকে বললেন, হযরত উসমান হত্যার প্রতিশোধ তথা কুরাইশদের সাথে যুদ্ধ না করে আমরা এখান থেকে যাব না। অতঃপর তিনি সাহাবীদেরকে তার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করার আহ্বান জানান। সাহাবীরা একটি গাছের নিচে মুহাম্মদ (স.) এর হাতে হাত রেখে শপথ গ্রহণ করলেন যে, উসমান হত্যার প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত কেউ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করবে না। ইসলামের ইতিহাসে এই বাইয়াতকে ’বাইয়াতে রিদওয়ান’। তবে বা‘য়াত গ্রহণ শেষেই হযরত ওসমান এসে হাজির হন। 


  1. হুদায়বিয়ার সন্ধি প্রস্তাব:

মুসলিমরা যখন যুদ্ধ করার জন্য শপথ গ্রহণ করে তখন কুরাইশদের মনে ভীতির সঞ্চার হয়। পরিস্থিতির নাজুকতা উপলদ্ধি করে কুরাইশরা সুহাইল ইবনে আমর কে চুক্তি সম্পাদনের উদ্দেশ্যে আলোচনার জন্য পাঠায়। সোহাইল ইবনে আমর রাসূলুল্লাহ (স.) এর কাছে এসে কিছুক্ষণ আলাপ করেন। অতঃপর সন্ধির শর্তসমূহ স্থির হয়। ইতিহাসে এই সন্ধিই হুদায়বিয়ার সন্ধি নামে পরিচিত। 




হুদায়বিয়ার সন্ধির শর্তাবলী


  1. 10 বছর মক্কার কুরাইশ ও মুসলিমদের মাঝে  যে কোনো ধরনের যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ থাকবে।

  2. মুসলিমরা এ বছর ওমরা পালন না করেই ফিরে যাবে। তারা চাইলে আগামী বছর হজের জন্য আসবে, তবে তিন দিনের বেশি মক্কায় অবস্থান করতে পারবে না। মক্কায় তাদের অবস্থানের সময় মক্কাবাসীরা অন্যত্র আশ্রয় নেবে। 

  3. মুসলিমের আত্মরক্ষার জন্য শুধুমাত্র কোশবদ্ধ তরবারি আনতে পারবে। এছাড়া অন্য কোন অস্ত্র বহন করতে পারবে না। 

  4. এ সন্ধি সূত্রের ভিত্তিতে আরবের যে কোন গোত্র হযরত মোহাম্মদ (স.) বা কুরাইশদের সাথে সন্ধি সূত্রে আবদ্ধ হতে পারবে। এতে কেউ বাধা দিতে পারবে না। 

  5. সন্ধির মেয়াদকালে জনগণের পূর্ণ নিরাপত্তা রক্ষা করতে হবে।কেউ কারো ক্ষতি সাধন করবে না, আক্রমণ বা লুণ্ঠন করবে না। 

  6. কোনো মক্কাবাসী মদিনায় আশ্রয় গ্রহণ করলে মুসলিমগণ তাকে আশ্রয় দিতে পারবে না। পক্ষান্তরে কোনো মুসলিম মদিনা থেকে মক্কায় আগমন করলে মক্কাবাসী তাকে প্রত্যাপর্ণ করতে বাধ্য থাকবে না। 

  7. হজ্বের সময় কুরাইশরা মুসলমানদের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করবে। বিনিময়ে মক্কার বণিকরা নিরাপদে মদিনার পথে সিরিয়া, মিশর প্রভৃতি দেশে বাণিজ্য করতে পারবে।

  8. অভিভাবকের অনুমতি ব্যতিরেকে কোন নাবালক মুসলিমদের দলে যোগ দিতে পারবে না। 

  9. এ সন্ধি চুক্তি ১০ বছরের জন্য বলবৎ থাকবে।

  10. সন্ধির শর্তাবলি উভয়পক্ষকেই পরিপূর্ণভাবে পালন করতে হবে।



আরও পড়ুন-

খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজ।। ইসলামের পঞ্চম খলিফা




হুদায়বিয়ার সন্ধির গুরুত্ব ও তাৎপর্য


হুদায়বিয়ার সন্ধির তাৎপর্য আলোচনা করলে প্রতীয়মান হবে, এতে বিধর্মী ও মুসলিমদের মধ্যে অন্ততপক্ষে দশ বছরের জন্য নিরবচ্ছিন্ন শান্তি রক্ষার প্রচেষ্টা করা হয়। যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাবে কুরাইশ ও হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর সদিচ্ছা প্রকাশ পায়। কারণ কুরাইশরাও যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। এ সন্ধির ফলে তারা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। বাণিজ্যে অবাধ চলাচলের নিশ্চয়তা লাভ করে। অন্যদিকে মুসলিমরাও অবাধে ইসলাম প্রচারের সুযোগ পায়। কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামে-এর মহানুভবতা ও দূরদর্শিতার প্রতি আকৃষ্ট হয়। এতে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব বহুগুণে বৃদ্ধি পেতে থাকে।  হুদায়বিয়ার সন্ধির গুরুত্ব/ফলাফল নিম্নরূপ-


  1. প্রকাশ্য বিজয়: 

আপতদৃষ্টিতে হুদায়বিয়ার সন্ধি মুসলিমদের জন্য অপমানজনক মনে হতে পারে, সাহাবায়ে কেরামও তাই মনে করেছিলেন। কারণ এতে মুসলিমদের স্বার্থ পুরোপুরি রক্ষিত হয়নি। উমর (রা.) এর মধ্যে এ বিষয়ে চরম প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গিয়েছিল, কিন্তু দূরদৃষ্টিতে রাসুলুল্লাহ (সা.) এ সন্ধিচুক্তি মুসলিমদের অনুকূলে অনুভব করতে পেরেছিলেন। এ সন্ধির পরবর্তী সুফল লক্ষ্য করলেই এর সার্থকতা স্পষ্টরূপে ফুটে উঠে।এই সুদুরপ্রসারি ফলাফল লক্ষ্য করে আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কুরআনে  হুদায়বিয়ার সন্ধিকে  ফাতহুম মুবিন বা প্রকাশ্য বিজয় বলে ঘোষণা করেন। 


আল্লাহ বলেন-


انا فتحنا لك فتحا مبينا 

(নিশ্চয়ই আমি আপনাকে প্রকাশ্য বিজয় দান করেছি) [4]


  1. সম্পর্কের উন্নতি:

হুদাইবিয়ার সন্ধির ফলে  আরবের সকল সম্প্রদায়ের সাথে  মুসলমানদের সম্পর্কের উন্নতির দারুণ সুযোগ আসে। এতদিন পর্যন্ত  কুরাইশ ও মুসলমানদের মধ্যে পারস্পারিক মেলামেশা ছিলনা। সন্ধির ফলে তাদের উভয়ের মধ্যে ভালো সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। মুসলমানদের সাথে উঠাবসার কারণে তাদের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কিত আলোচনা চলতে থাকে। এবং কুরাইশদের অন্তঃকরণ আপনা আপনি ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ইতিহাসবেত্তাদের মতে হুদায়বিয়ার সন্ধির পর হতে মক্কা বিজয় পর্যন্ত যত লোক ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল তেমনটি আর কখনো ঘটেনি। 


  1. যুদ্ধবিরতি

হিজরতের  পর পরই  রাসূল (স.) এর সাথে কুরাইশদের যুদ্ধের সম্ভাবনা ছিল যে কোন সময়ে।  সন্ধির মাধ্যমে 10 বছর যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ হলে নবীজি যুদ্ধের চিন্তা মুক্ত হন। অন্যদিকে মক্কার  কুরাইশরাও যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, তারও কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। আর রাসূলুল্লাহ (স:) এর নেতৃত্বে মুসলিমরা শক্তি সঞ্চয় করার সুযোগ পায়, অধিক পরিমাণে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ইসলাম বিস্তারে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ তৈরি হয়। 





  1. ইসলামের প্রসার:

হুদায়বিয়ার  সন্ধির ফলে ইসলাম  চারিদিকে  প্রসারিত হতে থাকে। যেহেতু এখন কোরাইশদের থেকে কোন আক্রমনের আশঙ্কা ছিল না তাই মুসলমানদের আদর্শ এবং নীতি সাধারণ মানুষের মন জয় করে নেয়। দলে দলে মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছিলেন হুদায়বিয়ার সন্ধির ফলে আমরা যে রূপ বিজয়ী হয়েছিলাম সে রূপ আর কখনো হয়নি।




  1. বীর পুরুষদের ইসলাম গ্রহণ: 

হুদায়বিয়ার সন্ধির ফলে আরবের পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে আসে। সাধারণ মানুষের সাথে কুরাইশদের বীর সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ ও আমর বিল আল আস  ইসলামের আদর্শে মুগ্ধ হন । তারা মদিনাতে আগমন করেন এবং রাসূলের হাতে বায়াত গ্রহণ করে ইসলামে দীক্ষিত হন। তাদের কারণে ইসলামের শক্তি বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। 


আরও পড়ুন-

মুহাম্মদ (স.) এর হিজরত: কারণ ও ফলাফল



  1. কাফিরদের স্বীকৃতি

এতকাল মক্কার কুরাইশরা মুহাম্মদ স: বরাবর অস্বীকার করে আসছিল। নবী হিসেবে তাকে তারা মূল্যায়ন করত না। কিন্তু হুদায়বিয়ার সন্ধি সম্পাদনের ফলে তারা নবীজিকে তাদের একজন সমান প্রতিপক্ষ হিসেবে স্বীকৃতি দিল। মুহাম্মদ (স) এবং ইসলাম যে বিশ্বের এক মহাশক্তি তারা তা কাগজে-পত্রে মেনে নিল। গোলাম মোস্তফা বলেন; হুদায়বিয়ার সন্ধিতে কুরাইশদের স্বাক্ষর প্রকৃতপক্ষে তাদের আত্মসমর্পণের স্বাক্ষর (বিশ্বনবী 276)


  1. আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইসলাম

হুদায়বিয়ার সন্ধি কারণে ইসলাম আরবের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। নবীজির দুতগণ ইসলামের বার্তা নিয়ে সিরিয়া, আবিসিনিয়া এবং পারস্যের রাজ দরবারে গমন করেন। নবীজির লিখিত পত্র নিয়ে তারা রোম সম্রাটের নিকটও গমন করেছিলেন এবং ইসলামের বাণী পৌঁছে দিয়ে ইসলামের ছায়াতলে আসার আহ্বান জানান। 


  1. মিত্রতা স্থাপন:

সন্ধির একটি ধারা অনুযায়ী আরবদের যে কোনো গোত্রের লোক হযরত মুহাম্মদ (সা.) অথবা কাফিরদের সঙ্গে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হওয়ার সুযোগ ছিল। এ ধারা মোতাবেক মক্কার বনু খোজা গোত্র নবীজির সাথে এবং বনু বকর গোত্র কোরাইশদের সাথে মিত্রতা সূত্রে আবদ্ধ হয়। এতে করে  বনু খোজা গোত্রের সাথে মুসলমানদের বন্ধুত্ব এবং ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত তাদের অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে যায়। 


  1.  নিরাপদে হজ্ব পালন: 

এতকাল যাবত মুসলিমরা ইচ্ছা করলেই হজ পালন করতে পারতো না। হুদাইবিয়ার সন্ধির ফলে পরের বছরই রাসুল (স:) নিরাপদে সাহাবীদের নিয়ে উমরাতুল কাযা পালন করেন। এরপর হতেই মুসলমানরা প্রতি বছর নিরাপদে হজ পালন করত এবং জন্মভূমি মক্কাকে  দেখতে তাঁদের কোনোও অসুবিধা হতো না। 


  1. খাইবার অভিযান  সপ্তম হিজরী:

মদিনা থেকে নির্বাসিত হয়ে ইহুদিদের একটি বিরাট অংশ খাইবারে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। তারা সেখানকার দুটি গোত্রের সাথে আঁতাত করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে এবং বিরাট সৈন্যবাহিনী গঠন করে। নবীজি হুদায়বিয়ার সন্ধির মাধ্যমে বেশ কিছুদিন সময় পেয়েছিলেন তিনি ৭ম হিজরীতে খাইবারের ইহুদীদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করে তাদেরকে পরাস্ত করেন এবং করবানে বাধ্য করেন। 


  1. অর্থনৈতিক উন্নতি:

হুদায়বিয়ার সন্ধির ফলে মদিনার সাথে মক্কা ও তায়েফের বাণিজ্য সম্পর্কের উন্নতি লাভ করে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও মদিনার ব্যবসায়ীরা নিরাপদে ব্যবসা-বাণিজ্য করার সুযোগ পায়। এতে করে একদিকে তারা ইসলামের বাণী ছড়িয়ে দিতে থাকে অন্যদিকে বাণিজ্যের মাধ্যমে নিজেদের আর্থিক স্বচ্ছলতা আনয়ন করে। এ সময় কুরাইশদের পক্ষ থেকে কোনপ্রকার ক্ষতির সম্ভাবনা ছিল না। 


  1.  মদিনা রাষ্ট্র সুসংহতকরণ

হুদায়বিয়ার সন্ধির পূর্বে মদিনা রাষ্ট্র একটি ভীতির মধ্যে ছিল।  যে কোন সময় কোরাইশরা মদিনা আক্রমণ করতে পারত এরকম আশঙ্কা ছিল। কিন্তু সন্ধির ফলে মদিনা নিরাপত্তা লাভ করে এবং এ সুবর্ণ সুযোগে মুসলিমরা রাসুলের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে মদিনাকে একটি শক্তিশালী ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে সুসংগঠিত করার সুযোগ পায়।  সর্বোপরি একটি উদীয়মান শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। 


  1. মক্কা বিজয়ের সূচনা:

হুদায়বিয়ার সন্ধির ফলে মুসলিমরা যে বিরাট কল্যাণ লাভ করেছিল তা হল মক্কা বিজয়। এর সূচনা হয়  হুদাইবিয়ার সন্ধির মাধ্যমে। মাত্র দুই বছরে মুসলিমরা মক্কা বিজয় সম্পন্ন করে কুরাইশদের ক্ষমতাকে ধ্বংস করে দেয়। প্রকৃতপক্ষে হুদায়বিয়ার সন্ধির ফলে আরববাসী ইসলামকে খুব কাছ থেকে জানতে পেরেছে, ফলে ইসলামের শক্তি এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে দুই বছর পরে মক্কা বিজয় করতে তাদের তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। 


  1. মুহাম্মদ (স:) এর শ্রেষ্ঠত্ব বহিঃপ্রকাশ:

হুদায়বিয়ার সন্ধির ফলে মুহাম্মদ (স:) এর শ্রেষ্ঠত্বের  বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এতকাল যে কুরাইশরা তাকে মানতে পারেনি সেই কোরাইশরাই তার সাথে একই চুক্তিপত্রের আবদ্ধ হয়। আর মুহাম্মদ (স) গোটা বিশ্ব দরবারে একজন দূরদর্শী রাজনীতিবিদ নিজের অবস্থান তৈরি করেন।  মনে হয় যেন কোরাইশরা এই সন্ধির মাধ্যমে রাসুলের বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছে। 


  1. মুসলিম নারীদের ফিরিয়ে না দেয়া:

সন্ধি সম্পাদিত হওয়ার কিছু কাল পরে উম্মে কুলসুম নামের এক মুসলিম রমণী মক্কা থেকে মদিনায় আসেন। কিন্তু তার দুই ভাই মদিনায় এসে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী তাকে ফেরত দিতে আহ্বান জানায় । তখন রাসূলুল্লাহ (স.) বললেন যে, এই ধারাটি শুধুমাত্র পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নারীদের ক্ষেত্রে নয়। কেননা পবিত্র কুরআনে মুসলিম নারীদেরকে পুরুষদের কাছে ফিরিয়ে না দেয়ার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। 


পবিত্র কুরআনে এসেছে-

হে ঈমানদারেরা, যখন তোমাদের কাছে কোন ঈমানদার নারী হিজরত করে আসে, তাদেরকে পরীক্ষা করে নাও। আল্লাহ তাদের ঈমান সম্পর্কে অবগত রয়েছেন। যদি তোমরা বুঝতে পারো যে তারা ঈমানদার তাহলে তাদেরকে আর কাফেরদের কাছে ফিরিয়ে দিও না। কেননা কাফিরদের জন্য এরা হালাল নয় কাফিররা এদের জন্য বৈধ হয় [ সূরা মুমতাহিনা]


আরও পড়ুন-



হুদায়বিয়ার সন্ধিকে ফাতহুম মুবিন বা প্রকাশ্য বিজয় বলার কারণ


এ সন্ধিপত্রের লেখক ছিলেন হযরত আলী। সন্ধি পত্রের শুরুতে বিসমিল্লা লিখতে চাইলে সোহাইল ইবনে আমর এর আপত্তির কারণে  ‘বি-ইসমিকা আল্লাহুম্মা’ লেখা হয়।  সন্ধিতে রাসুরুল্লাহ (আল্লাহর রাসূল) মুহাম্মদ (স.) লিখা হলে তাতেও সুহাইল ইবনে আমর আপত্তি করেন। সে বলল যদি আমরা আপনাকে আল্লাহর রাসূল মানতাম তাহলে তো আপনাকে কাবা ঘর তাওয়াফের বাধা দিতাম না এবং আপনার সাথে যুদ্ধও হতো না বরং মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ লিখুন।  অতঃপর নবীজী হযরত আলীকে রাসুলুল্লাহ শব্দটি  মুছে দিয়ে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ লিখতে বলেন। হযরত আলী শব্দটির মুছতে অপারগতা প্রকাশ করলে মোহাম্মদ (স.)  লেখা টি কোথায় রয়েছে সেটি জেনে নিজ হাতেই সেটি মুছে দেন। অতঃপর তিনি বললেন , তোমরা মানো আর না মানো আমি আল্লাহর রাসূল। 



যখন হুদায়বিয়ার সন্ধি লেখা হচ্ছিল তখন সোহাইলের পুত্র আবু জান্দাল  শিকল পরিহিত অবস্থায় মক্কা থেকে পালিয়ে মুসলিম শিবিরে হাজির হন। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন আর সেই অপরাধে তাকে  নির্যাতন করা হয় এবং শিকল দিয়ে বন্দি করে রাখা হয়। সে রাসুলুল্লাহ (স.) এর কাছে তাকে তাঁর সাথে  মদিনায় নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করতে থাকে। এসময় সুহাইল ইবনে আমর বলতে থাকেন সন্ধির শর্ত অনুযায়ী আপনি তাকে নিতে পারবেন না। কিন্তু রাসুলুল্লাহ (স.)  বললেন যে, সন্ধির শর্তাবলী লেখার কাজটি এখনো শেষ হয়নি। তখন সুহাইল ইবনে আমর বলেন  আবু জান্দাল কে ফিরিয়ে না দিলে আমি আপনাদের সাথে সন্ধি করবো না। শান্তির খাতিরে মুহাম্মদ (স.) আবু জান্দালকে মক্কায় ফিরে যেতে বলেন। আবু জান্দাল অসহায়ের মতো কান্নাকাটি করে বলল হে মুসলিমরা! তোমরা কি আমাকে আবারও সে কাফেরদের মধ্যে রেখে যাবে? তখন রাসুলুল্লাাহ (স.) বললেন যেহেতু সন্ধিচুক্তি হয়ে গেছে সেহেতু আমি তাদের সাথে বিশ্বাস ভঙ্গ করতে পারিনা।  তিনি তাকে ইসলামের উপর অবিচল থেকে ধৈর্য ধারণ করার পরামর্শ দেন। শৃঙ্খলিত অবস্থায় আবু জান্দাল মক্কায় ফিরে যান। 


এসব কারণে  মুসলিমদের কাছে হুদায়বিয়ার সন্ধির শর্তগুলো অপমানজনক এবং প্রতিকূলে মনে হয়। এ সময় হযরত ওমর অত্যন্ত মনঃক্ষুণ্ণ হন। তিনি বলেন ইসলাম কি সত্যধর্ম নয় ? আপনি কি সত্য নবী নন ? তাহলে আমরা কেন এত অপমান সহ্য করব?  অথচ আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে এটাকে ফাতহুম মুবিন বা প্রকাশ্য বিজয় বলে উল্লেখ করেছেন। 




সন্ধির একটি ধারাতে উল্লেখ করা হয়েছে কোন মদিনাবাসী মক্কায় গেলে মক্কাবাসীরা তাকে ফেরত দিতে বাধ্য থাকবে না, কিন্তু কোনো মক্কাবাসী মদিনায় গেলে অবশ্যই মদীনাবাসী তাকে ফেরত দিতে বাধ্য থাকবে। এ শর্তের কারণে মক্কায় অবস্থানরত মুসলিমরা ইসলাম গ্রহণ করেও মদিনায় যেতে পারছিলেন না। এদের মধ্যে পূর্ব উল্লেখিত আবু জান্দাল এবং আবু বাশির উল্লেখযোগ্য। আবু বাশির মক্কা থেকে পালিয়ে মদিনায় আশ্রয় নিলে চুক্তির শর্ত মোতাবেক তাকে মক্কায় ফেরত পাঠানো হয়। কিন্তু আবু বাশির মক্কায় ফিরে যাওয়ার পথে কৌশলে তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাঠানো ব্যক্তিকে হত্যা করে মক্কায় না গিয়ে মদিনায় ফিরে আসেন। মুহাম্মদ (স.) তাকে আবারও মক্কায় পাঠাতে পারেন এই আশঙ্কায় তিনি মদীনা ছেড়ে লোহিত সাগরের তীরে একটি স্থানে আশ্রয় নেন। এই খবর মক্কায় প্রচারিত হওয়ার পর আবু জান্দালসহ অন্যান্য যারা মক্কায় নির্যাতিত হচ্ছিলেন তারাও মদিনায় না গিয়ে আবু বাশিরের দলে যোগ দেন। সে সেখানে একটি ছোটখাট দল গড়ে তোলেন এবং এই দল সিরিয়াগামী কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলা আক্রমন, মারধর ও  লুটপাট করতে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় কুরাইশরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকলে একসময় তারা মুহাম্মদ রাসুলুল্লাাহ (স.) এর কাছে সন্ধির এই ধারাটি বাতিলের আবেদন করে। অতঃপর সাগরের তীরে সেই দলটিও মদিনায় ফিরে আসে। 


মজার বিষয় হলো এই চুক্তির ফলে কোন মদিনাবাসী কিন্তু মক্কা ফিরে যায়নি। কারণ মোহাম্মদ (স.) এটা জানতেন যে যারা প্রকৃত ঈমানদার তারা কখনোই মক্কায় ফিরে যাবে না। যে ধারাটি মুসলিমদের বিপক্ষে মনে হয়েছিল সেই ধারাটির কার্যত মুসলিমদের পক্ষে গিয়েছে। 


অন্যদিকে এ চুক্তির ফলে মুসলিম ও করিাইশদের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ হয়ে গেলে শান্তিপূর্ণভাবে মুসলিমরা ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার সুযোগ পায়। ফলশ্রুতিতে ইসলাম দুরন্ত গতিতে এগিয়ে যায়। আরববাসীরা ইসলাম এবং মুসলমানদের সম্পর্কে জানার সুযোগ পায়। আর সন্ধির মাত্র দুই বছরের মাথায় বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে মুসলিমরা মক্কা বিজয় সম্পন্ন করে। এসব কারণেই হুদায়বিয়ার সন্ধি কে ফাতহুম মুবিন বা প্রকাশ্য বিজয় বলা হয়েছে। 


পরিশেষে আমরা বলতে পারি হুদাইবিয়ার সন্ধি ছিল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে মক্কার কুরাইশদের আত্মসমর্পণ আর মুসলমান ও ইসলামের বিজয়ের একটি লিখিত চুক্তি। এর মাধ্যমে কুরাইশদের অদূরদর্শিতা এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ইসলামের কূটনৈতিক প্রজ্ঞার জ্বলন্ত প্রমাণ পাওয়া যায়। হুদাইবিয়ার সন্ধির মাধ্যমে মুসলমানরা সহজেই মক্কা বিজয় সম্পন্ন করেছে। হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় যেখানে সাহাবীদের সংখ্যা ছিল চৌদ্দশ, অথচ মাত্র ২ বছর পরই মক্কা বিজয়ের সময় সেখানে সাহাবীদের সংখ্যা ছিল দশ হাজার। সাহাবীদের সংখ্যার পরিমাণটি দেখল আমরা বুঝতে পারি মাত্র দুই বছরে ইসলাম কতটা বিস্তৃতি লাভ করেছে। 




আরও পড়ুন-

খলিফা আব্দুল মালিক।। Abdul Malik the Umayyad Caliph.


খলিফা আব্দুল মালিকের আরবীয়করণ নীতি


জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য,সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে মামলুকদের অবদান



[ প্রিয় পাঠক,

যে কোন ভূল-ত্রুটির সংশোধনী বা পরামর্শ থাকলে  ওয়েব সাইটে পোস্টের নিচে কমেন্ট বক্সে লিখুন। ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্য, স্বাধীন-বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস,  ইসলামের বিধি-বিধান সংক্রান্ত কোন প্রবন্ধ বা সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে লেখা কোন প্রবন্ধ প্রকাশ করতে চাইলে আপনার লেখা এবং পরিচিতিসহ  মেইল করুন। ]


Md. Billal Hossain

B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka

BCS General Education

Lecturer

Department of Islamic History & Culture

Chandpur Govt. College, Chandpur.



No comments:

Post a Comment