মুন্সি মুহাম্মদ মেহেরুল্লাহ:
তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের তুখোড় বিতার্কিক
[Munsi Muhammad Meherullah]
মুন্সি মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ (Munsi Muhammad Meherullah) বৃটিশ বাংলার অন্যতম বাগ্মী, ইসলাম প্রচারক, সমাজ সংস্কারক, বিতার্কিক ও মরদে মুজাহিদ ছিলেন। স্বল্প শিক্ষিত মেহেরুল্লাহ তাঁর তীক্ষèবুদ্ধি ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের সাহায্যে তৎকালিন উচ্চ শিক্ষিত এবং সরকারি মদদপুষ্ট খ্রিস্টান পাদ্রীদের ধর্ম প্রচারের গতিকে রোধ করেছিলেন এবং বিতর্কে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছিলেন। ইসলামের সেবায় তিনি বাংলা এবং আসাম চষে বেড়িয়েছেন। তিনি ইসলাম ধর্মসহ বিভিন্ন বিষয়ে গ্রন্থও রচনা করেছেন। আধুনিক বিবেচনায় তাকে তুলনামুলক ধর্মতত্ত্বের একজন প্রতিভাবান ছাত্র বলা যায়। তিনি জ্ঞানীমহল তেকে ‘বাগ্মীকুল তিলক’ উপাধি পেয়েছিলেন।
জন্ম ও পরিচয় :
মুন্সি মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ ১৮৬১ সালে বৃহত্তর যশোর জেলার (বর্তমান ঝিনাইদহ জেলা) কালিগঞ্জ উপজেলার ঘোপ গ্রামে মাতুলালয়ে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক নিবাস যশোর সদর উপজেলার ছাতিয়ানতলা গ্রামে। তাঁর পিতার নাম মুন্সি মোহাম্মদ ওয়ারেস উদ্দিন।
শিক্ষা জীবন :
মুন্সি মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ মৌলভি মোসহার উদ্দিনের নিকট ধর্ম শিক্ষা এবং মৌলভি মো: ইসমাইলের নিকট আরবি, ফার্সি ও উর্দু ভাষা শিক্ষা লাভ করেন। এ সময়ে তিনি কোরআন, হাদিস, ও ফার্সি সাহিত্যে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন। ফরিদ উদ্দিন আত্তারের পান্দেনামা এবং শেখ শাদির গুলিস্তা ও বুস্তা অধ্যয়ন সমাপ্ত করেন। উর্দু ভাষায় ও তাঁর ব্যাপক ব্যুৎপত্তি ছিল। বিভিন্ন উর্দু পুস্তক ও সাময়িক পত্র পত্রিকাদি তিনি নিয়মিত পড়াশোনা করতেন। দারিদ্রতা এবং শৈশবকালে পিতার মৃত্যুর কারণে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ সম্ভব হয়নি।
কর্ম জীবন :
অল্প বয়সেই মেহেরুল্লাহকে সংসারের হাল ধরতে হয়। ইংরেজ বাবুদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে তিনি যশোর জেলা বোর্ডে একটি ছোট খাট সরকারি চাকুরি নেন। কিন্তু স্বাধীনচেতা মেহেরুল্লাহ কিছুদিন পরেই চাকুরি ছেড়ে দেন এবং যশোরের দাড়টানা মোড়ে দর্জির দোকান দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। এই পেশায় তিনি ব্যাপক সুনাম অর্জন করেন। জেলা মেজিট্রেট থেকে শুরু করে অনেক মিশনারিরাও তার কাস্টমার ছিলেন। জেলা মেজিট্রেট খুশি হয়ে তাকে দার্জিলিং নিয়ে যান এবং সেখানে দোকান করে দেন।
মিশনারিদের সংস্পর্শ মেহেরুল্লাহ :
জ্ঞানার্জনের প্রতি মেহেরুল্লাহ এর ছিল দারুন আকর্ষণ। কাজের ফাকে তিনি বই পড়তেন। যশোরের দাড়টানা মোড়ে দোকনে বসে তিনি দেখতেন মিশনারিদেও তৎপড়তা। সেবার নামে তাার নিম্ন বর্ণের হিন্দু এবং গরিব মুসলমানদেরকে ধর্মান্তরিত করত। সরকারের পৃষ্ঠপোসকতায় তারা প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশে আল্লাহ,রাসুল ও কোরআন সম্পর্কে বিষোদগার করত। মিশনারিরা নানাবিধ প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে সাধারণ মুসলিমদের বিভ্রান্ত করত। তার দোকানে বসে মিশনারিরা প্রায়ই তাঁর সাথে আলাপ করতো এবং বই পড়ার জন্য উৎসাহিত করত।
সংশয়-প্রত্যয়ের দোলাচলে মেহেরুল্লাহ :
খ্রিস্টান প্রাদ্রীদের প্রভাবে এবং তাদের কিছু বই পড়ে মেহেরুল্লাহ এক সময় ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু এ সময় দুইজন মুসলিম লেখকের বই তার হাতে পড়ে এবং সেগুলো পড়ে তিনি নিজের ভুল বুঝতে পেরে তওবা করে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত থেকে সড়ে আসেন। অতঃপর খ্রিষ্টানদের অপপ্রচারের জবাব দেওয়ার জন্য তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন এবং ধর্মীয় বিষয়ে পড়াশুনা শুরু চালিয়ে চান।
তুলনামুলক ধর্মতত্ত্বের ছাত্র মেহেরুল্লাহ :
দার্জিলিং থাকাকালে মেহেরুল্লাহ বাইবেল, বেদ, গীতা, ত্রিপিটক এবং উপনিষদ ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন শুরু করেন। বিভিন্ন ধর্মের ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে তিনি জানতে পারেন। খ্রিস্টানদের অভিযোগগুলো কী এবং সেগুলো খন্ডনের দলিল কী এ বিষয়ে তিনি ব্যাপক পড়াশুনা করেন। এরপর তিনি ধীরে ধীরে মিশনারিদের বিরুদ্ধে নামতে শুরু করেন। তিনি দার্জিলিং থেকে যশোরে ফিরে আসেন। কিছুকালের মধ্যেই তিনি হয়ে উঠেন তুলনামুলক ধর্মতত্ত্বের তুখোড় বক্তা।
আরও পড়ুন-
ভারতীয় মুসলমানদের নবজাগরণে এবং আধুনিক শিক্ষার বিস্তারে সৈয়দ আমীর আলীর অবদান
ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমানে এবং খ্রিস্টানদের মোকাবেলায় মেহেরুল্লাহ :
মেহেরুল্লাহ সর্বপ্রথম ‘খ্রিস্ট্রীয় ধর্মের অসারতা’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। প্রতিদিন বিকালে যশোরের হাটে দাড়িয়ে নিজেই তা বিক্রি করতে শুরু করেন। বিক্রয়কালে বইটি সম্পর্কে পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি যে কথাগুলো বলতেন তা এতটাই বাগ্মীতাসুলভ ছিল যে, তা শোনার জন্য লোকজন ভীর করত এবং তা এক সময় জনসমাগমে পরিনত হতো।
এভাবে ইসলামের সার্বজনীনতা ও খ্রিস্টান ধর্মের অসারতা নিয়ে চমৎকার করে প্রতিদিন বিকালে তিনি সেখানে কথা বলতে থাকেন। তার বক্তৃতার সুনাম পুরো যশোরে ছড়িয়ে পড়ে। যেখানেই খ্রিস্টানদের উৎপাত বেড়ে যেত সেখানেই তিনি মানুষদের জড়ো করে তাদের যুক্তি খন্ডন করে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব সাবলিল ভাষায় বর্ণনা করতেন।
তিনি খ্রিস্টানদের অপপ্রচারের জবাব দিতে ছুটে চলেন বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা ও আসামের অলিতে গলিতে। এ সময় করকাতার নাখোদা মসজিদে আরো দুইজন আলেমের সাথে বৈঠক করে তিনি গঠন করেন ‘নিখিল ভারত ইসলাম প্রচার সমিতি’। সমিতির পক্ষ থেকে মেহেরুল্লাহকে বাংলা ও আসামে ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব দেয় হয়।
জন জমির উদ্দিন এবং মুন্সি মুহাম্মদ মেহেরুল্লাহ:
এরপর মেহেরুল্লাহ বাংলা ও আসামে বহু সভা সমাবেশ ও বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন। তিনি হতাশাগ্রস্থ ও দিধান্বিত মুসলিম সমাজকে জাগাবার চেস্টা করেন। তিনি খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত ও বিপথগামী অনেক যুবককে পুনরায় ইসলামে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। খ্রিস্টান অর্থে পড়াশুনা করে উচ্চ শিক্ষিত জমির উদ্দিন খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে হয়ে যান জন জমির উদ্দিন। তিনি ‘আসল কোরআন কোথায়’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেন। এর জবাবে মেহেরুল্লাহ পত্রিকায় ধারাবাহিক যে প্রবন্ধ লেখেন তা পাঠ করে এবং বিতর্কে হেরে গিয়ে তিনি আবার ইসলামে ধর্মে দীক্ষিত হন এবং বাকি জীবন ইসলামের সেবায় ব্যয় করেন।
‘বাগ্মীকুল তিলক’ মুন্সি মুহাম্মদ মেহেরুল্লাহ:
মেহেরুল্লাহ বহু বিতর্কে অংশ নিয়েছেন। যশোর এবং বরিশালে তিনদিন ব্যাপী বিতর্কে তিনি খ্রিস্টানদের পরাজিত করতে সক্ষম হন। তাঁর বিতর্ক ও বক্তৃতা শুনে জজ, মেজিট্রেট, মুন্সেফ, উকিল, মুক্তার সবাই মুক্ত কন্ঠে তাঁর প্রসংশা করেছে। এ ছাড়া তিনি কুষ্টিয়া, কুমারখালি, রাজবাড়ী, পাবনা, চাটমোহর, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর, নীলফামারি, দিনাজপুর, বগুড়া, করোটিয়া, গোয়ালন্দ, কুচবিহার, নদীয়া, খুলনা, হারবার, চব্বিশ পরগনা ইত্যাদি যেখানেই তিনি বিতর্কে অংশ নিয়েছেন সেখানেই প্রশংসিত হয়েছেন এবং তিনি ‘বাগ্মীকুল তিলক’ উপাধী প্রাপ্ত হন। তৎকালীন সময়ে তার সমকক্ষ কোন বক্তা বা বিতার্কিক বাংলায় ছিলেন না।
লেখক ও ইসলাম প্রচারে মুন্সি মেহেরুল্লাহ:
ইসলামি শিক্ষার বিস্তারের জন্য তিনি যশোরের মনোহরপুরে ‘মাদ্রাসায়ে কারামাতিয়া’ নামে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাকরেন। আর ধর্ম প্রচারের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ‘এসলাম ধর্মোত্তেজিকা সভা’। তিনি ‘সুধাকর’, ও ‘ইসলাম প্রচারক’, প্রভৃতি পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করতেন। তিনি কেরামত আলী জৈনপুরির আধ্যাত্মিক অনুসারি ছিলেন।
মুন্সি মেহেরুল্লাহ এর রচনাবলী:
শুধু বক্তৃতাই নয়, ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমানে তার ছিলো ক্ষুরধার লেখনি শক্তি। তিনি অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। কিছু গ্রন্থ সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিল। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হল-
খ্রিস্টিয় ধর্মের অসারতা (১৮৮৬)
মেহেরুল এসলাম (১৮৯৫)
রদ্দে খ্রিস্টান ও দলিলুল এসলাম (১৮৯৫)
জওয়াবে নাসারা (১৮৯৭)
বিধবা গঞ্জনা ও বিষাদ ভান্ডার (১৮৯৭)
পান্দেনামা
হিন্দুধর্ম রহস্য ও দেবলীলা (১৯০০)
শ্লোকমালা (১৯১০)
খ্রিস্টান মুসলমান তর্কযুদ্ধ
মানব জীবনের কর্তব্য (অপ্রকাশিত)
‘খিষ্টানি ধোঁকাভঞ্জন’ (গবেষনামুলক প্রবন্ধ)
‘আসল কুরআন সর্বত্র’ (গবেষনামুলক প্রবন্ধ)
প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব :
উপস্থিত বুদ্ধিতে তৎকালে মেহেরুল্লাহ এর সমকক্ষ কেহ ছিলনা। যেহেতু খ্রিস্টানদের কাছে কোরআন সুন্নাহর দলিলের কোন মূল্য ছিলনা সেহেতু তিনি অত্যন্ত যৌক্তিকতার সাথে যে কোন কঠিন প্রশ্নের তাৎক্ষনিক উত্তর দিতেন সহজভাবে। যেমন-
১. জান্নাত ও জাহান্নাম সংক্রান্ত প্রশ্ন:
একটি বাহাস অনুষ্ঠানে মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ কে লক্ষ্য করে খ্রিস্টান পাদ্রীরা জান্নাত এবং জাহান্নামের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন করে। তারা বলেন- ইসলামে সাতটি জাহান্নাম এবং আটটি জান্নাতের কথা বলা হয়েছে। আবার মুসলিমরা দাবি করে থাকেন যে শুধু মুসলিমরা ব্যতীত আর কেউ জান্নাতে যাবে না। মুসলমানদের মধ্যেও সবাই জান্নাতে যাবেনা শুধু ঈমানদার ব্যক্তিরাই যাবে। সেই হিসেবে জান্নাতে যাওয়ার লোক সংখ্যা খুবই কম। এই অল্প কিছু মানুষের জন্য আটটি জান্নাত রাখা হয়েছে আর বাকি সমস্ত মানুষের জন্য মাত্র সাতটি জাহান্নাম। এটা অত্যন্ত হাস্যকর বিষয়।
মুন্সী মেহেরুল্লাহ পাদ্রীদের কে প্রশ্ন করেন- আপনারা নিশ্চয়ই বাদুর দেখেছেন? তারা বলল হ্যাঁ দেখেছি। মুন্সী মেহেরুল্লাহ বললেন- রাতের বেলা শিকারীরা 30-40 টি বাদুড় শিকার করে সকাল বেলা সেগুলোকে বস্তায় চেপে চেপে ভর্তি করে নিয়ে যায়। পক্ষান্তরে ময়না শিকারি ময়না শিকার করার পর অতি আদর যত্ন করে ইয়া বড় একটি খাচায় করে সেটাকে পালন করতে নিয়ে যায়। দেখুন 30-40 টি বাদুরের জন্য একটি বস্তা আর একটি মাত্র ময়নার জন্য বিরাট একটি খাঁচা। যার যেমন মূল্য তার তেমন কদর। আপনারা খ্রিস্টানরা যারা জাহান্নামে যাওয়ার জন্য আগ্রহী হয়ে আছেন তাদের অবস্থা হচ্ছে এই বাদুড়ের মতো। আপনাদেরকে জাহান্নামে রাখা হবে ঠাসাঠাসি করে। পক্ষান্তরে আমরা যারা জান্নাতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি তাদেরকে এই ময়না পাখির মতই আদর যত্ন করে রাখা হবে। সেজন্য সংখ্যায় অল্প হলেও বরাদ্দটা বেশি।
মুন্সী মেহেরুল্লাহ এর এই জবাব শুনে উপস্থিত মুসলিম এবং অনেক অমুসলিমরাও তার প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব প্রশংসা করেছেন।
২. মুহাম্মদ (স) ও ঈসা আ: এর মর্যাদা সংক্রান্ত প্রশ্ন :
আরেকবার একজন পাদ্রী বললেন, ‘ইসলাম ধর্মে দাবী করা হয় মুহাম্মদই শ্রেষ্ঠ নবী। এবং তাঁর আগমনে নাকি পূর্বের সব নবী-রসূলের শরীয়ত রহিত হয়ে গেছে। এটা পুরোটাই তাদের বানোয়াট কথা ছাড়া আর কিছু নয়। দেখেন, মুসলমান ভায়েরা, আমাদের নবী ঈসাকে আল্লাহ কিন্তু আসমানের ওপর তুলে নিয়েছেন। আর আপনাদের নবী মাটির নীচে শুয়ে আছে। এবার আপনারাই বিচার করুন, কে শ্রেষ্ঠ?
মুন্সী মেহেরুল্লাহ তাদের বাড়াবাড়ি বুঝতে পারেন। তিনি অত্যন্ত শান্ত ভাবে বললেন, দেখুন সকল নবী রাসূল আমাদের কাছে সমান। ইসলামের নির্দেশ অনুযায়ী আমরা নবী-রাসূলের মধ্য কোন প্রকার প্রার্থনা করি না যেহেতু তারা সকলেই আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত হয়েছেন। তবে আপনাদের সাথে তর্কের খাতিরে যদি উঁচু-নিচু করার প্রশ্ন আসে তাহলে আমি বলতে পারি মুক্তা অতি মূল্যবান জিনিস কিন্তু সেটা সমুদ্রের তলদেশে থাকে আর উপরে থাকে জোয়ারের ফেনা।
মুন্সী মেহেরুল্লাহ এই প্রশ্নের আরেকটি জবাব দিয়েছেন। তিনি একটি দাঁড়িপাল্লা এনে একটি বড় বাটখারা এক পাল্লায় রাখেন এবং একটি ছোট বাটখারা অপর পাল্লায় রাখেন। অতঃপর দাঁড়িপাল্লা টি উপরে উঠালে স্বাভাবিকভাবেই ছোট বাটখারার পাল্লা উপরে উঠে যায় আর বড় বাটখারার পাল্লা নিচে নেমে যায়। এর দ্বারা তিনি হাতেনাতে তাদেরকে বুঝিয়ে দিলেন যে উপরে উঠলেই শুধু বড় হওয়া যায় না নিচে থেকেও বড় হওয়া সম্ভব। তার জবাব দেখে সবাই বিস্মিত হয় এবং খ্রিস্টানরা এ বিষয়ে প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে সর্তকতা অবলম্বন করে।
৩. মুসলিম ও খ্রিস্টানদের শরিরের বর্ণ ও আকৃতিগত প্রশ্ন;
মুন্সি মেহের উল্লাহকে ইংরেজরা এক সভায় ভারতবর্ষের মানুষকে নিয়ে বলতেছিলো তোমাদের দেশের মানুষ-বাটু, লম্বা, খাটো, বড়, কালো, ধলো কেন? আর আমাদের দেশে সব সাদা। ইংরেজদের কথার উত্তরে তাঁর বিখ্যাত উক্তি -
“শুয়রক্যা বাচ্ছা এক কিসিম হ্যায়- টাট্টুক্যা বাচ্ছা হ্যারেক কিসিম হ্যায়”
অর্থ্যাৎ- শূকরের বাচ্চা দেখতে এক রকম হয় আর ঘোড়ার বাচ্চা দেখতে বিভিন্ন রকমের হয়।
অনাড়ম্বর জীবন:
মেহেরুল্লাহ জীবনে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন কিন্তু তেমন কিছু রেখে যেতে পারেননি। তিনি অপব্যয় করেছেন এমনও নয় বরং ইসলামের উপকারার্থে ব্যয় করেছেন। তিনি সাধারণ জীবনযাপন করতেন, সাধারণ পোশাক পরিধান করতেন, খুবই সাধারণ খাদ্য গ্রহণ করতেন। কোথাও বিতর্কে গেলে তিনি আগেই বলে দিতেন “আলুভাতে ভাত চাই, মাংস আমরা খাইনা”।
চেয়ারম্যান মেহেরুল্লাহ :
১৯০৬ সালে মেহেরুল্লাহ জেলা মেজিট্রেট কর্তৃক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনোনীত হন।
আদর্শিক অনুসারী :
মুন্সী মেহেরুল্লাহ বক্তব্য লেখনীর মাধ্যমে অনেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সৈয়দ ইসমাইল হেসেন সিরাজি, শেখ হাবিবুর রহমান, শেখ ফজলুল করিম, গোলাম মোস্তফা, ফররুখ আহমদ, কাজী নজরুল ইলসাম। এদের পৃষ্ঠপোষক ও প্রেরণাদাতা ছিলেন মুন্সি মেহেরুল্লাহ।
পরলোক গমন:
অধিক পরিশ্রমে মেহেরুল্লাহর স্বাস্থ ভেঙ্গে পড়ে। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। বঙ্গের এই অদ্বিতীয় বাগ্মী, ইসলাম ধর্ম প্রচারক মুন্সি মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ ১৯০৭ সালের ৭ জুন শুক্রবার জুম্মার নামাজের সময় পরলোকগমন করেন। তাঁর স্মরণে সৈয়দ ইসমাইল হেসেন সিরাজি এক শোকগাঁথা রচনা করেন।
মুন্সি মুহাম্মদ মেহের উল্লাহর স্মরণে :
এই কর্মবীর মুন্সি মেহের উল্লাহর মুত্যুর পর তাঁর নিজ গ্রাম ছাতিয়ানতলায় তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি রেল স্টেশন প্রতিষ্ঠা করে তার নামকরণ করা হয় ‘মেহেরুল্লাহ নগর স্টেশন’। ১৯৯৫ সালের ৭ জুন ৮৭ তম মৃত্যু বার্ষিকীতে সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলাম তাঁর স্মৃতিকে আগামী প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় করে রাখার জন্যে মুন্সি মেহের উল্লাহ এর ছবিসহ ডাকটিকিট ও স্মারক খামের উদ্বোধন করেন।
১৯০১ সালে মুন্সি মেহের উল্লাহ কর্তৃক যশোরের মনোহরপুর গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় মাদ্রাসায়ে কেরামতিয়া। পরবর্তীতে তাঁর প্রচেষ্টায় মাদ্রাসাটি এম. ই স্কুলে রূপান্তরিত হয়ে আজকের পর্যায়ে উন্নীত হয়। এই কর্মবীরের স্মৃতির উদ্দেশ্যে বিদ্যালয়টির নামকরণ করা হয় ‘মুন্সি মেহের উল্লাহ একাডেমী’। পরে মুন্সি মেহের উল্লাহ সমাজকল্যাণ সংস্থা ও মুন্সি মেহের উল্লাহ ফাউন্ডেশন গড়ে উঠে।
আরও পড়ুন-
আরও পড়ুন-
শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী
আরও পড়ুন-
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বৃহৎ শক্তিবর্গের ভূমিকা
[ প্রিয় পাঠক,
যে কোন ভূল-ত্রুটির সংশোধনী বা পরামর্শ থাকলে ওয়েব সাইটে পোস্টের নিচে কমেন্ট বক্সে লিখুন। ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্য, স্বাধীন-বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস, ইসলামের বিধি-বিধান সংক্রান্ত কোন প্রবন্ধ বা সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে লেখা কোন প্রবন্ধ প্রকাশ করতে চাইলে আপনার লেখা এবং পরিচিতিসহ মেইল করুন। ]
Md. Billal Hossain
B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka
BCS General Education
Lecturer
Department of Islamic History & Culture
Chandpur Govt. College, Chandpur.
No comments:
Post a Comment