Breaking

Tuesday, 27 December 2022

সম্রাট আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি: কারণ ফলাফল ও সমালোচনা

 

সম্রাট আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি এবং সাম্রাজ্য বিস্তার

(Aurangzeb's Deccan Policy and State Expansion) 


সম্রাট আওরঙ্গজেব! মুঘল আমলের সর্বশেষ শক্তিশালী এবং যোগ্য শাসক। সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়ে মুঘল সাম্রাজ্য সর্বাধিক বিস্তৃতি লাভ করেছিল। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত নীতি উত্তর-পূর্ব সীমান্ত নীতি এবং দাক্ষিণাত্য নীতির মাধ্যমে সম্রাট আওরঙ্গজেব মুঘল সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ ঘটান। সম্রাট আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি  সবচেয়ে বেশি আলোচিত এবং সমালোচিত একটি অধ্যায়। ঐতিহাসিকগণ আরঙ্গজেব এর দাক্ষিণাত্য নীতির বেশ সমালোচনা করেছেন। দাক্ষিণাত্য নীতির মাধ্যমে আরঙ্গজেব সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটালেও বিপরীতে এর অনেক নেতিবাচক প্রভাব ছিল। তবে আরঙ্গজেব এর দাক্ষিণাত্য নীতির বেশকিছু কারণও রয়েছে। 








আওরঙ্গজেবের রাজ্য বিস্তার নীতি

আওরঙ্গজেবের রাজ্য বিস্তার নীতিকে আমরা কয়েকটি ভাগে ভাগ করতে পারি। যেমন-

  1. উত্তর-পূর্ব সীমান্ত নীতি

  2. উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত নীতি

  3. দাক্ষিণাত্য নীতি   



  1. উত্তর-পূর্ব সীমান্ত নীতি


  1. কুচবিহার অধিকার: 

আওরঙ্গজেব এর শাসন আমলে মুঘল সাম্রাজ্যের সর্বাধিক বিস্তৃতি ঘটে । আওরঙ্গজেব সর্ব প্রথম ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে দুটি হিন্দু রাজ্য আসামও কুচবিহার রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরন করেন । ১৬৬১ খ্রি সম্রাট মীর জুমলাকে বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন এবং তাকে কুচবিহার ও আসামের নৃপতিদেরকে দমন করার জন্য প্রেরণ করেন করেন । আসাম ও কুচবিহারের হিন্দুরাজারা প্রায়ই মুঘল সীমান্তে হামলা চালিয়ে লুটপাট করত। সম্রাটের নির্দেশে মীরজুমলা কুচবিহার আক্রমণ করেন এবং সহজে কুচবিহার দখল করেন । কুচবিহারের রাজা যুদ্ধ না করে না করেই পালয়ন করেন । 


  1. আসাম অধিকার :

এরপের মীর জুমলা আসামের দিকে অগ্রসর হন। এই সময় আসামের শাসক ছিলেন আহোমরাজ জয়ধ্বজ। মীর জুমলা  ১২০০০ অশ্বরোহী, গোলন্দাজ বাহিনী  ও নৌবহর নিয়ে  আক্রমণ  চালালে আহোমরাজ প্রতিরোধে অসমর্থ হয়ে রাজধানী পরিত্যাগ করে সপরিবারে পার্বত্য অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। মুঘল বাহিনী আসামের রাজধানী গড়গাও দখল করে এবং ধনরত্ন ও হাতি লুট করে । এরপর বর্ষাকাল এসে পড়ায় মুঘল সৈন্যরা আসামের জলবায়ু ও নানাপ্রকার রোগে আক্রান্ত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৷  এই সুযোগে আহোমরা মুঘল বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায় এবং সব কিছু পুনরুদ্ধার করে । বর্ষা শেষে মুঘলরা আবার শক্তিশালী হয়ে উঠলে  আহোমরাজ মীরজুমলার সাথে এক সদ্ধি স্থপন করেন । পরবর্তীতে মীরজুমলা আসাম অবস্থান কালে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ঢাকা ফেরার পথে ১৬৬৩ খ্রি. তার মৃত্যু হয়। মীরজুমলার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আহোমরা তাদের হস্থচ্যুত স্থানগুলো আবার দখল করে নেয় ।


  1. চট্টগ্রাম অধিকার :

মীর জুমলা মৃত্যুর পর আওরঙ্গজেব শায়েস্তা খানকে  দাক্ষিনাত্য থেকে প্রত্যাহার করে বাংলার শাসনর্কা নিযুক্ত করেন । শায়েস্তা খান ৩০ বছর এই পদে অদিষ্ঠিত ছিলেন । তিনি বাংলা এসে লক্ষ্যে করেন যে, আরাকানরা পর্তুগীজদের সহায়তায় পূর্ব ও দক্ষিন বঙ্গের জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছে। শায়েস্তা খান পর্তুগীজ এবং আরাকান রাজাকে পরাস্থ করার জন্য নৌশক্তি বৃদ্ধি করেন। তিনি ১৬৬৬ খ্রি আরাকান রাজাকে পরাস্থ করে চট্টগ্রাম দখল করেন। ফলে রাংলার জনগন আরাকানদের হাত থেকে মুক্তি পায়। তিনি চট্টগ্রামের নাম রাখেন ইসলামাবাদ ।



B. উত্তর পশ্চিম সীমান্ত নীতি :

উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে আওরঙ্গজেব অগ্রসরবাদ নীতি অনুসরণ করেন । এই নীতির পেছনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারন আছে । সীমান্তে মুসলিম গোত্রগুলো মুগল সাম্রাজ্যের জন্য বিপদের কারণ ছিল। তাদের পাঞ্জাবের সম্পদের প্রতি আর্কষন ছিল  এবং ভারত সীমানায় আক্রমণ চালাত। আওরঙ্গজেব সীমান্তের জতিগুলোকে বশে আনার জন্য প্রথমে অর্থ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন কিন্তু এর ফল তেমন লাভ হয় না। 


  1. ইউসুফজাই উপজাতির বিদ্রোহ (১৬৬৭) :

১৬৬৭ খ্রি. ইউসুফজাই নামক এক উপজাতি ভাগু মোল্লা চালাক নামক এক নেতার নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ভাগু অন্য উপজাতিগুলোকে সংবদ্ধ করে রাজনৈতিক চেতনায় জাগিয়ে তোলেন । উপজাতি দলগুলো সিন্ধুনদ অতিক্রম করে মুঘল সাম্রাজ্য আক্রমণ করে লুটতরাজ ও অত্যাচার শুরু করে। আওরঙ্গজেব এই সংবাদ জানতে পেরে  উপজাতিদের বিরুদ্ধে মুঘল সেনাপতি কামিল খান ও আমীন খানকে প্রেরন করেন । অবশেষে তারা উপজাতিদের দমন করতে সমর্থ হন ।


  1. আফ্রিদি ও খটক উপজাতিদের  বিদ্রোহ (১৬৭২) :

১৬৭২ খ্রি. আফ্রিদিরা আকমল খানের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে । আকমল খান তার অনুসারীদের মুঘলদের বিরুদ্ধে জেহাদ করতে নির্দেশ দেন। আলী মসজিদ নামক স্থানে আফ্রিদিরা মুঘলদের পরাজিত করে। এতে মুঘলদের প্রচুর ক্ষয় ক্ষতি হয় । আর আকমল খানের মর্যাদা বৃদ্ধি পায় । পরবর্তীতে খটকেরাও আফ্রিদিদের সঙ্গে যোগ দেয় । খটকদের নেতা ছিলেন খুশহাল খান । তিনি এক ধারে সৈনিক ও কবি ছিলেন । ১৬৭৪ খ্রি. আফগান বিদ্রোহীরা মুঘল বাহিনীকে আক্রমণ করে । মুগল সেনাপতি সুজাত খান নিহত হন । আওরঙ্গজেব নিজে এই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন । তিনি কূটনীতিক চালে এবং অর্থের প্রলোভনে প্রতিপক্ষের  একটি অংশকে নিজ পক্ষভুক্ত করেন। অতঃপর সামরিক শক্তির দ্বারা বিদ্রোহী আফগানদেরকে দমন করতে সক্ষম হন । কাবুলে মুঘল শাসন কর্তা আমীর খান আফগানদের দমন করেন । পরবর্তীতে খুশহাল খান কে মুঘল বাহিনী পরাজিত করে ।


  1. উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত নীতির ফলাফল :

  1. এই যুদ্ধের ফলে মুঘল রাজকোষ প্রায় শূন্য হয়ে পড়ে।

  2. এই অভিযানে বহু সংখ্যক সৈনিক প্রাণ হারায়।

  3. উত্তর পশ্চিম সীমান্তের উপজাতিদের মধ্যে জাতীয় জাগরণ দেখা দেওয়ায় ঐ অঞ্চল থেকে মুঘল বাহিনীতে সৈন্য সংগ্রহ অসম্ভব হয়ে পড়ে।

  4. এই নীতিতে আওরঙ্গজেব উপজাতিদের দমন করার জন্য দক্ষ সেনাদের প্রেরন করেন । এই সুযোগে মারাঠা নেতা শিবাজী দাক্ষিণাত্যে নিজ শক্তি অপ্রতিহত করতে সক্ষম হন । 



  C. আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি : 

আওরঙ্গজেবের  ১৬৮১-১৭০৭ খ্রি. পর্যন্ত  দাক্ষিনাত্যে অবস্থান করেন । সম্রাট উত্তর ভারতে সমস্যার অনেক খানি সমাধান করে তিনি দক্ষিণে যেতে উৎসাহীত হন। তাঁর দাক্ষিনাত্য নীতি বেশ আলোচিত সমালোচিত বিষয়।   



দাক্ষিণাত্যে অভিযানের কারণ : 


  1. পূর্ব পুরুষদের ধারাবাহিকতা:

প্রায় সকল সম্রাট দাক্ষিণাত্য নীতি অনুসরণ করেছেন সুতরাং সম্রাট আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্য নীতি অনুসরণ করাই ছিল স্বাভাবিক ।


  1. মারাঠাদের দমন:

শিবাজির নেতৃত্বে মারাঠারা বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল, যা দক্ষিণ ভারতে মুঘলদের জন্য ছিল চরম হুমকি৷ মারাঠাদের এই উত্থান রোধ কারার জন্য তিনি দাক্ষিনাত্য নীতি গ্রহণ করেন।


  1. যুবরাজ আকবরকে দমন:

যুবরাজ আকবর বিদ্রোহী হয়ে  সম্ভুজীর কাছে আশ্রয় নিয়ে মারাঠা নেতাদের সাথে মৈত্রী স্থাপন করেছিল । এটা সম্রাটের জন্য বিব্রতকর ছিল ৷তাকে সায়েস্তা করা ছিল দাক্ষিনাত্য নীতির আরেকটি কারণ । 


  1. বিজাপুর ও গোলকুন্ডা দখল:

দক্ষিণ ভারতের বিজাপুর ও গোলকুন্ডা রাজ্য দুটি মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত করা ছিল দাক্ষিণাত্য নীতির অন্যতম উদ্দেশ্য । এছাড়া গোলকুন্ডা ও বিজাপুরের বিরুদ্ধে সম্রাটের অভিযোগ ছিল নিম্নরূপ : 


  1. শিয়া শক্তির উত্থান রোধ:

গোলকুন্ডা ও বিজাপুরউভয় ছিল শিয়া রাষ্ট্র যা সুন্নী মুঘল সাম্রাজ্যের চরম শত্রু। তারা কার্যত দিল্লীর সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের চেয়ে পারস্য সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনে বেশি উৎসাহী ছিল ৷


  1. কর প্রদান বন্ধকরণ:

গোলকুন্ডা ও বিজাপুরের রাজ্যদূটি নিয়মিত মুঘল সম্রাটকে কর প্রদান বন্ধ করে দিয়েছিল। 


  1. মুঘল বিরোধী আতাঁত:

এই রাজ্য দুটি মারাঠাদের সাথে আতাঁত করেছিল এবং উভয় রাষ্ট্র যুদ্ধোপকরণ দিয়ে মারাঠাদের সাহায্য করতো। গোলকুন্ডা শম্ভুজিকে সাহায্য দান করেছিল অন্যদিকে তাহা  মুঘলদের বিরুদ্ধে বিজাপুরকে সাহায্য করেছিল ৷


  1. রাজনৈতিক হুমকি:

গোলকুন্ডা এবং বিজাপুর রাজ্য দুটির উত্তর উত্তর শক্তি বৃদ্ধি এবং স্বাধীন মনোভাব এবং তাদের শক্তি ও সামর্থ মুঘল সাম্রাজ্যের জন্য ছিল রাজনৈতিক হুমকি ৷


  1. সুন্নীদের উপর অত্যাচার:

গোলকুন্ডার হিন্দু মন্ত্রীগণ সুন্নী মুসলমানদের উপর অত্যাচার করত । 



দাক্ষিণাত্য নীতির তিনটি পর্যায় :

১ম পর্যায় : (১৬৫৮-১৬৮০) 

মারাঠা নেতা শিবাজীর বিরদ্ধে অভিযানঃ

১৬৫৮-১৬৮০ পর্যন্ত সম্রাট বিভিন্ন সেনাপতির মাধ্যমে শিবাজীর বিরদ্ধে অভিযান প্রেরণ করেন। মহারাষ্টের অধিবাসীরা মারাঠা নামে পরিচিত। ভারতের ইতিহাসে দক্ষিনে মারাঠাদের উখান একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা । দাক্ষিণাত্যের সুলতানদের অধীনে মারাঠারা চাকরি করে সামরিক দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। মারাঠাদের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা ছিলেন শিবাজী। তার পিতার নাম শাহজি ভোসলে । শিবাজী ১৬৪৬ সালে বিজাপুরের তোর্ণা দুর্গ, অতপর রায়গড়, চাকান, বারমতী, ইন্দ্রপুর, পুরন্দর ও কোন্দার দুর্গ দখল করে তার শক্তি বৃদ্ধি করেন। আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে থাকাকালীন শিবাজীকে দমন করার জন্য চেষ্টা করেছেন। আওরঙ্গজেব সম্রাট হওয়ার পর তিনি তার প্রধানমন্ত্রী আফজাল খানকে শিবাজীর বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। কিন্তু ১৬৫৯ সালে শিবাজী কৌশলে আফজাল খানকে হত্যা করেন।


অতপর সম্রাট তার মাতুল শায়েস্তা খানকে দাক্ষিণত্যের সুবাদার নিযুক্ত করে শিবাজীর শক্তিকে দমন করার নির্দেশ দেন । শায়েস্তা খান শিবাজীর কয়েকটি দুর্গ দখল করে সেখানে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৬৬৩ খ্রি. এক রাতে শিবাজী শায়েস্তা খানের শিবির আক্রমন করে তার পুত্রকে হত্যা করেন  আর  শায়েস্তা খান হাতের একটি আঙ্গুল হারিয়ে কোন রকম পালিয়ে যেতে সমর্থন হয় । 


১৬৬৪ খ্রি. শিবাজী সুরাট দুর্গ লুন্ঠন করেন৷ ঠিক এই সময় আওরঙ্গজেব শিবাজীর  বিরুদ্ধে যুবরাজ মুয়াজ্জম ও রাজা জয়সিংহকে প্রেরণ করেন । মুঘল বাহিনী শিবাজীর পুরন্দর দূর্গ অবরোধ করেন। শেষে শিবাজী কোন উপায় না পেয়ে মুঘলদের  সঙ্গে পুরন্দরের সদ্ধির প্রস্তাব করেন এবং ১৬৬৫ খ্রি সন্ধি স্বাক্ষরিত হয় । অতঃপর জয়সিংহের অনুরোধে শিবাজী মুঘল দরবারে আগমন করেন আর সম্রাট শিবাজীকে নজরবন্দী করেন যাতে শিবাজী বিজাপুর ও গোলকুন্ডার সাথে ঐক্য করতে না পারেন। কিন্তু ১৬৬৬ সালে কৌশলে তিনি  পলায়ন করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে সক্ষম হন ।

১৬৭০ সালে শিবাজী পুনরায় মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। ইতোমধ্যে আওরঙ্গজেব ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে বিদ্রোহ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন । সে সুযোগে শিবাজী নিজ রাজ্যে মুঘল  অধিকৃত অঞ্চলগুলো প্রায় সবই  পুনরুদ্ধার নিজেকে শাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৬৭৪ সালে রায়গড় দুর্গে তার অভিষেক হয় । তিনি ‘ছত্রপতি’  উপাধি গ্রহণ করেন। কিন্তু শিবাজীর সকল উদ্দেশ্য সার্থক হয়ে উঠবার পূর্বেই ১৬৮০ সালে শিবাজীর মৃত্যু হয়। শিবাজীর মৃত্যুর পর তার পুত্র শম্ভজী মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিযে যান 


দ্বিতীয় পর্যায়; (১৬৮০-৮৭) 

বিজাপুর ও গোলকুন্ডা অধিকার :

মারাঠাদের শক্তি দুর্বল হয়নি বরং বাড়তে থাকে । এদিকে শাহজাদা আকবর বিদ্রোহ করে মারাঠা নেতা শম্ভুজীর সাথে যোগদিলে মারাঠা শক্তি বৃদ্ধি পায়। আবার গোলকুন্ডা ও বিজাপুর দখলের চিন্তা। সবদিক বিবেচনায় ১৬৮২  সালে সম্রাট রাজধানী ছেড়ে দাক্ষিণাত্যে চলে আসেন এবং আহমদ নগরে স্থাযীভাবে অবস্থান করে তার দাক্ষিণাত্য নীতি বাস্তবায়নে আত্মনিয়োগ করেন।


বিজাপুর অধিকার :

দাক্ষিণাত্যের বিজাপুরের বিরুদ্ধেও আওরঙ্গজেব সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন । এই দুটির রাজ্যর বিরুদ্ধে অভিযানের কারন শাহজাহানের আমলে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী সম্রাটকে বার্ষিক কর  নিয়মিত প্রদান করেনি। তাছাড়া এ দুটি রাজ্য কেবলমাত্র মুঘলদের আজন্ম শত্র মারাঠাদের সঙ্গেই নয়, পারস্যের শিয়া সুলতানদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল । ১৬৬৫, ১৬৮০ এবং ১৬৮২ সালে তাদের বিরুদ্ধে প্রেরিত তিনটি অভিযানই ব্যর্থ হয়। সম্রাট আওরঙ্গজেব ১৬৮৫ খ্রি. শাহজাদা আজমকে বিজাপুরের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন । আজম ১৫ মাসেও বিজাপুর অধিকারে ব্যর্থ হন। পরবর্তীতে সম্রাট নিজে এসে বিজাপুর অবরোধ করেন । বিজাপুর অবরোধ অবস্থায় খাদ্যাদিক থেকে দুর্বল হয়ে পরে । অবশেষে বিজাপুরের সুলতান সিকান্দার আদিল শাহ মুঘল বাহিনীর কছে আত্মসমর্পন করেন । প্রায় দুই শতাব্দীর অস্তিত্বের পর বিজাপুর রাজ্য মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। 


গোলকুন্ডা অধিকার :

বিজাপুরের পর আওরঙ্গজেব গোলকুন্ডার দিকে দৃষ্টি দেন। গোলকুন্ডা গোপনে বিজাপুর এবং মারাঠাদের সাহায্য করেছিল। এই অপরাধে সম্রাট স্বয়ং গোলকুন্ডা অবরোধ করেন।  আট মাস অবরোধের পর ১৬৮৭ খ্রি. কুতুবশাহী বংশের শেষ সুলতান আবুল হাসান আত্মসমর্পন করেন। গোলকুন্ডা মুঘল সম্রাজ্যভুক্ত হয়। এভাবে বিজাপুর ও গোলকুন্ডা রাজ্য মুঘলদের অধীনে হওয়ায় দাক্ষিণাত্যে মুঘলদের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।


তৃতীয় পর্যায়;

মারাঠাদের বিরুদ্ধে পুনরায় অভিযান :

দাক্ষিণাত্যের শক্তিশালী শিয়া রাজ্য দু'টি পদানত করার পর সম্রাট মারাঠাদের বিরুদ্ধে জোর তৎপরতা চালান। শিবাজীর মৃত্যুর পর তার পুত্র শম্ভুজী মারাঠাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ইতোমধ্যে সম্রাট তনয় আকবরও শম্ভুজীর সাথে যোগ দেয়। তাই আওরঙ্গজেব বিদ্রোহ নির্মূল করার লক্ষ্যে ১৬৮১ খৃস্টাব্দে আহমদনগরে এসে উপস্থিত হন। পিতার উপস্থিতিতে আকবর পারস্যে পলায়ন করেন এবং মারাঠাদের কিছু দূর্গ আওরঙ্গজেব দখল করে শম্ভজীর শক্তি হ্রাস করেন।  নবনিযুক্ত মুঘল সেনাপতি মুকাররম খান দামেশ্বরের এক যুদ্ধে শম্ভুজীকে বন্দি করে হত্যা করেন। রায়গড় মুঘলদের দখলে আসে এবং শম্ভুজীর সমগ্র পরিবার কারারুদ্ধ হয়। এভাবে ১৬৮৯ খৃস্টাব্দের মধ্যে দাক্ষিনাত্যে আওরঙ্গজেবের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এর পরেও পর্যায়ক্রমে রাজারাম, তৃতীয় শিবাজী এবং তার মাতা তারাবাঈযের নেতৃত্বে মারাঠাগণ আওরঙ্গজেবের মৃত্যু পর্যন্ত তাদের সংগ্রাম অব্যাহত রাখে। শেষ পযর্ন্ত মারাঠা শক্তি নির্মূল হয়নি।


দক্ষিণাত্য নীতির ফলাফল :

  1. আওরঙ্গজেব তার দাক্ষিণত্য নীতি প্রবর্তন করতে গিয়ে অর্থের অপচয় করেন।

  2. এই নীতির ফলে রাজকোষের শূন্যতা দেখা দেবার কারনে সরকার দেউলিয়া হয়ে যায়। এ সময় সৈন্যদের বেতন অনেক বাকি পর। এজন্য সৈন্যরা বিদ্রোহ ঘোষনা করেন।

  3. ঔরঙ্গজেব দাক্ষিণ্য নীতির কারনে জায়গিরদারি সংকট দেখা দেয় । এতে মনসবদারগন সম্রাটের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে।

  4. সম্রাট দক্ষিণ ভারত নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে উত্তর ভারতে শাসন তার হাত থেকে দূরে সরে যায়।

  5. সম্রাট  ঔরঙ্গজেবের শাসন ক্ষেত্রে কিছু ভুল সিদ্ধান্ত নেবার ফলসরুপ তার দাক্ষিনাত্য নীতি বিফল হয়। এ বিফলতার জন্য তার অদূরদর্শিকতাই দায়ী।  



দাক্ষিনাত্য নীতির সমালোচনা :

বিভিন্ন ঐতিহাসিকরা এই বিষয়ে সমালোচনা করেছেন। 

  1. বিজাপুর ও গোলকুন্ডার ন্যায় দুইটি স্বাধীন রাষ্টের বিলুপ্তির ফলে মারাঠা শক্তিকে প্রতিহত করার মত দাক্ষিণাত্যে আর কোন অবশিষ্ট শক্তি রইল না।

  2. ঐ দুটি বিজিত রাজ্যের কর্মচ্যুত সেনাবাহিনী মারাঠাদের সহিত যোগাযোগ করে ফলে মারাঠাদের শক্তি বহুগুনে বৃদ্ধি পায় । তারা দাক্ষিনাত্যের শিয়া রাজ্যগুলির সহিত মৈত্রী স্থাপন করে । 

  3. মারাঠা শক্তিকে বিধ্বস্ত করার ব্যবস্থা না করে আরঙ্গজেব মারাত্ম ভুল করেন। কাজেই শিয়া রাজ্যদ্বয়ের ধ্বংস সাধন করে সম্রাট অদুদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন




আরও পড়ুন-

আরও পড়ুন-

আরও পড়ুন-

আরও পড়ুন-


আরও পড়ুন-
আরও পড়ুন-
সম্রাট আকবরের রাজপুত নীতি 



সম্রাট আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি
সম্রাট আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি
সম্রাট আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি
সম্রাট আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি
সম্রাট আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি






Md. Billal Hossain

B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka

BCS General Education

Lecturer

Department of Islamic History & Culture

Chandpur Govt. College, Chandpur.












No comments:

Post a Comment