বক্সারের যুদ্ধ:
কারণ ঘটনা ও ফলাফল
(The Causes and Result of the Battle of Boxar)
ইরাকের নাজাফের অভিজাত বংশীয় মীর রাযী খানের পুত্র মীর কাশীম। পুরো নাম মীর মুহাম্মদ কাশীম আলি খান। মীর জাফরের কন্যা ফাতিমা বেগমকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন তিনি। নবাব হিসেবে তার যোগ্যতার কোনো অভাব ছিলো না। তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা ও দেশপ্রেমিক। শ্বশুরের মতো কাপুরুষ ও মেরুদন্ডহীন ছিলেন না। দেশপ্রেমের ক্ষেত্রে তার কোনো দৈন্য তো ছিলোই না, বরং এই গুণটির যথেষ্ট আধিক্য ছিলো।পলাশীর যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তিনিই একমাত্র শাসক যিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধাচারণ করার সাহস দেখিয়েছিলেন। বিলাসিতার পথে না গিয়ে নিজের সবটুকু দেশের স্বাধীনতার জন্য বাজি রেখে স্বাধীনতাকামীদের জন্য স্মরণীয় অনুপ্রেরণা হয়ে আছেন তিনি।সিরাজউদ্দৌলার গ্রেফতারের ব্যাপারে তিনি যে পাপ করেছিলেন তার জন্য তিনি আজীবন অনুতাপ করে গেছেন।
মীর কাশিমের ক্ষমতায় আরোহন:
১৭৫৭ সালে পলাশীর ঐতিহাসিক যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে পরাজিত ও হত্যা করার পর বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর বাংলার নবাবীর মসনদে বসেন। মীরজাফরের সাথে সম্পাদিত গোপন চুক্তির আলোকে বাংলার রাজকোষ থেকে কোটি কোটি টাকা এবং বিভিন্ন জেলার রাজস্ব আদায় করে নেয়।মীরজাফর বুঝতে পারেন কোম্পানি একটি তলাবিহীন ঝুড়ি। এবার কোম্পানির নজর পড়ে তার ধনাঢ্য জামাতা মীর কাশিমের উপর।অতপর কোম্পানি ১৭৬০ সালে মীর জাফরকে অপসারণ করে তার স্থানে তার জামাতা মীর কাসিমকে ক্ষমতায় বসায়।মীর কাশিমের সাথেও কোম্পানির একটি গোপন চুক্তি হয়।
প্রাথমিক কার্যাবলীঃ
সাথে কোম্পানির সাথে সম্পাদিত গোপন চুক্তি মোতাবেক তিনি তিনটি জেলার (বর্ধমান মেদিনীপুর চট্টগ্রাম) রাজস্ব কোম্পানিকে ছেড়ে দেন।
কোম্পানির কাছে মীর জাফরের বকেয়া দেনা পরিশোধের দায়ও তার উপরে বর্তায়।তিনি কোম্পানির সকলর্ ঋণ পরিশোধ করেন।
জমি জরিপ ব্যবস্থার সংস্কার সাধন, নতুন ভূমি কর প্রবর্তন এবং তা কঠোরভাবে আদায়ের ব্যবস্থা করেন। এতে তার সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পায়।
অবাধ্য জমিদারদের দমন।জমিদারদের ওপর কয়েকটি বাড়তি কর চাপান ও ভূমিরাজস্বের হার দেড় আনা বাড়ান।
ইংরেজদের প্রতি অনুগত রয়েছেন এমন কর্মচারী ও জমিদারদেরকে তিনি কঠোর হাতে দমন করেন। ইংরেজ মদদপুষ্ট বিহারের নায়েব দেওয়ান নবাবের প্রাপ্য অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে এবেং হিসাবপত্র দাখিলের আদেশ অগ্রাহ্য করলে তিনি রামনারায়ণকে হত্যা করেন।
সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের মধ্যে রাজস্ব আত্মত্যাগকারীদের চিহ্নিত করে তিনি তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন এবং তাদের শাস্তি প্রদান করেন।
আলিবর্দি ও মিরজাফরের পরিবারবর্গের কাছ থেকে অসাধু উপায়ে অর্জিত ও সঞ্চিত অর্থ জোর করে আদায় করেন।
পলাশীর যুদ্ধের পর ষড়যন্ত্রকারীরা মেতে উঠে স্বার্থের দ্বন্দ্বে। এদের মূল হোতা ছিলেন জগৎ শেঠ। মীর কাসিমের নির্দেশে বিহারের মুঙ্গের দুর্গ থেকে বস্তা বন্দী করে তাকে নদীতে ফেলে হত্যা করা হয়।
রাজকোষের আয় বাড়ানোর জন্য ব্যয়ভার সঙ্কোচন করেন।
ধনবান নগরবাসীর অতিরিক্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত এবং জমিদারদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করেন। সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারীদের বেতন প্রদান করা সম্ভব হয়।
শাসনকার্যে শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট হন।
তিনি মুঘল সম্রাট শাহ আলমের আস্থা ও স্বীকৃতি অর্জন করেন
বক্সারের যুদ্ধের কারণসমূহ:
মীর কাশীমের স্বাধীনচেতা মনোভাব:
মিরকাশিম আলি খান পূর্ব ভারতে এক স্বাধীন রাজ্য গড়ে তোলার জন্য বদ্ধপরিকর। যেহেতু তিনি কোম্পানির সকল দায়-দেনা মিটিয়ে দিয়েছিলেন, সেহেতু তিনি স্বাধীন ভাবে বাংলাকে শাসন কারার চেস্টা করেন্। ফলে শুরু থেকেই কোম্পানির সাথে তার বিরোধ ও সংশয় দানা বেধে উঠে।তার স্বাধীনচেতা মনোভাব কোম্পানি মেনে নিতে পারেনি।
সামরিক শক্তি বৃদ্ধিঃ
ক্ষমতালাভের পর তিনি স্বাধীনভাবে শাসন কাজ পরিচালনায় সচেষ্ট হন। মীর কাসিম একটি চৌকস সতন্ত্র সামরিক বাহিনী গঠন করেন।আর্মেনীয় সামর বিশারদ নিয়োগ করে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবন্থা করেন।
রাজধানী স্থানান্তরঃ
ক্ষমতায় বসার অনতিকাল পরেই নবাব মীর কাসিম রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে বিহারের মুঙ্গেরে স্থানান্তরিত করেছিলেন। সেখানে তিনি নিজের একটি স্বতন্ত্র সেনাবাহিনীও গড়ে তোলেন। ইংরেজদের প্রভাবমুক্ত হবার বাসনা তার গোড়া থেকেই ছিলো। ইংরেজদের সাথে শুল্ক নিয়ে বিরোধের জের ধরে মীর কাসিমের জন্য একাধিক সশস্ত্র সংগ্রাম অবধারিত হয়ে পড়ে। বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরও ইংরেজদের পক্ষ নিয়ে নিজ জামাতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যোগ দেন।
বানিজ্য শুল্ক দ্বন্দ্বঃ
নবাব মীর কাসিম সিংহাসনে বসে দেশের অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত করতে গিয়ে দেখেন, ইংরেজরা সরকারকে ফাঁকি দিয়ে বিনা শুল্কে অথবা অতি সামান্য শুল্ক প্রদানের মাধ্যমে এদেশে বাণিজ্য করে যাচ্ছে। ব্যাপারটার শুধু সেখানেই শেষ নয়। নবাব লক্ষ্য করেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তো শুল্কের সব ফায়দা লুটছেই, সেই সাথে ইংল্যান্ড থেকে আসা সাধারণ ব্যবসায়ীরাও শুধু ইংরেজ বলে কোম্পানীর ভোগকৃত সুবিধাসমূহ ভোগ করে যাচ্ছে।নবাব মীর কাসিম এই দস্তক প্রথার পূর্ণ বিরোধিতা করেন। এ ব্যাপারে কোম্পানীর সাথে আলোচনায় বসে বলেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ব্যবসার সাথে যেসব সুবিধা ভোগ করছে, তা তিনি মেনে নেবেন। কিন্তু কোম্পানীর সদস্য ব্যাতিরেকে ইংল্যান্ডের অন্য ব্যবসায়ীদের নিয়মমতো শুল্ক দিয়েই ব্যবসা করতে হবে। কিন্তু ইংরেজদের দাবি ছিলো, সকল ইংরেজ বণিককে একই রকম সুবিধা দিতে হবে। বানিজ্য শুল্ক বিরোধের জের ধরে ইংরেজদের সাথে মীর কাসিমের সশস্ত্র সংগ্রাম অবধারিত হয়ে পড়ে।
বানিজ্যশুল্ক প্রত্যাহারঃ
সঙ্গত কারনেই নবাব তাতে সম্মত হতে পারলেন না। ব্যবসায় একচেটিয়া অধিকার লাভের আশাতেই ইংরেজরা পুরো একটা সাম্রাজ্যের মূলোৎপাটন করে বসেছিলো। এমন স্বাধীনচেতা মনোভাব তারা কখনোই আশা করেনি। তারা সকল ইংরেজ বণিকের জন্যই শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের ধারা বজায় রাখতে চায়। ইংরেজদের সাথে মীমাংসায় ব্যর্থ হয়ে মীর কাসিম রেগে গিয়ে দেশে সকল প্রকার বণিকের শুল্ক প্রদানের ব্যবস্থা রহিত করেন। শুধু নিরীহ বণিকেরাই শুল্ক দেবে, আর ইংরেজরা সব বিনা শুল্কে এদেশে বাণিজ্য করবে, এমনটা তিনি মেনে নিতে চাননি। এতে ইংরেজদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে ও তারা মিরকাশিমকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য তৈরি হয়। ফলে ইংরেজ ও কোম্পানি, উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়ে।
পাটনার কুঠিয়াল এলিসের হত্যাঃ
নবাব সরকারের সাথে কোম্পানির সংঘর্ষ পাটনা থেকেই শুরু হয়। বাণিজ্য শুল্ক সংক্রান্ত বিষয়ে কোম্পানির কর্মচারীদের সাথে সবচেয়ে বেশি আগ্রাসী ছিলেন পার্টনার কুঠিয়াল এলিস। পার্টনার কুঠিয়াল এলিস সর্বপ্রথম মীর কাশেমের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। উত্তেজিত জনতার রোষানলে পার্টনার কুঠিয়াল এলিস নিহত হলে কোম্পানি আনুষ্ঠানিকভাবে মীর কাশেমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
বক্সারের যুদ্ধঃ 1764
(Battle of Boxar)
বক্সারের যুদ্ধ (১৭৬৪ খ্রি. ২২ অক্টোবর)। মিরকাশিমের সেনাপতি মার্কার ও ইংরেজ সেনাপতি মেজর হেক্টর মনরো।
পাবনার কুঠিয়াল এলিস যুদ্ধের সূত্রপাত করলেও কোম্পানি মনে করে মীর কাসিম যুদ্ধ শুরু করেছেন। ফলে কোম্পানি অফিশিয়াল মিটিং এর মাধ্যমে কাসেমের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা করে। প্রায় ৭টি যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ যুদ্ধ হয়। অতঃপর 1764 সালে 22 অক্টোবর চূড়ান্ত যুদ্ধ তথা বক্সারের যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
সংক্ষেপে যুদ্ধের ঘটনা প্রবাহঃ
(The Events of the Battle of Boxar)
যুদ্ধক্ষেত্রঃ
পাটনা,
কাটোয়া,
মুর্শিদাবাদ,
সূতি,
গিরিয়া,
উদয়নালা,
মুঙ্গের,
বক্সার।
যুদ্ধটা শুরু করে প্রথমে ইংরেজরাই। যুদ্ধ শুরু হয় আজিমাবাদ-পাটনায়। ইংরেজরা অতর্কিত আক্রমণ করে পাটনা দখল করে নেয়। এরপরের যুদ্ধ হয় কাটোয়ায়। নবাব মীর কাসিম প্রতিটি যুদ্ধেই তার বিভিন্ন সেনাপতির অধীনে সৈন্য প্রেরণ করতেন। সেনাপতিদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে এবং ব্যক্তিগত অহংকার ও হিংসার কারণে যে যুদ্ধে মীর কাসিমের জয় নিশ্চিত ছিলো, তাতে তিনি পরাজয় বরণ করেন। সেই যুদ্ধেই তার সর্বনাশের সুচনা হয়।
এরপরের যুদ্ধ হয় সুতি নামক স্থানে। এই যুদ্ধেও মীর কাসিম নিজে না গিয়ে সেনাপতিদের পাঠান এবং সেনাপতিদের মতানৈক্যের কারণে নবাবের বিশাল বাহিনী ইংরেজদের ক্ষুদ্র সেনাদলের কাছে পরাজিত হয়। সুতির যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মীর কাসিম তার পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদ নিরাপত্তার জন্য দুর্ভেদ্য রোটাস দুর্গে পাঠান। তিনি রাজমহলের কাছে উদয়নালা নামক একটি অতি সুরক্ষিত স্থানে তার বিরাট সৈন্যদল নিয়ে ঘাঁটি স্থাপন করেন। স্থানটি খুবই দুর্ভেদ্য বলে বিবেচিত হওয়ায় তার সৈন্যরা ঘাঁটি প্রহরার কোনো ব্যবস্থাই করলো না।
এই ঘাঁটি সংলগ্ন এক বিশাল জলাভূমির অপর তীরেই মীর জাফরকে সাথে নিয়ে ইংরেজরা শিবির স্থাপন করেছিলো। জলাভূমি অতিক্রম করার একটি গোপন পথের সন্ধান পেয়ে ইংরেজদল একরাতে আক্রমণ করে মির কাসিমের অপ্রস্তুত বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। অধিকাংশ সৈন্য বিনা যুদ্ধে নিহত হয় এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ইংরেজদের হস্তগত হয়। মীর কাসিম কী করে রক্ষা পেয়েছিলেন, তার সঠিক বর্ণনা পাওয়া যায় না, তবে তিনি পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছিলেন।
একের পর এক যুদ্ধে হেরে যাওয়ায় মীর কাসিম বেশ নিরাশ হয়ে পড়েন। উদয়নালার যুদ্ধে পরাজয়ের পর মীর কাসিম পাটনার দিকে অগ্রসর হন। পথে খবর পান ইংরেজরা তার মুঙ্গের দুর্গ দখল করে নিয়েছে। পরিস্থিতি সহ্যসীমার বাইরে গেলে মীর কাসিম তার কাছে বন্দী থাকা সব ইংরেজকে হত্যা করেন। একমাত্র ইংরেজ ডাক্তার ফুলারটন পালিয়ে ইংরেজ শিবিরে আশ্রয় নেন।
মৈত্রীজোট গঠনঃ
এরপর নবাব অযোধ্যার নবাব সুজা-উদ-দৌলার কাছে সাহায্য চান। সুজা-উদ-দৌলা আর মুঘল সম্রাট ২য় শাহ আলম এর মিলিত বাহিনী নিয়ে মীর কাসিম ইংরেজদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। প্রথমে পাটনায়, পরবর্তীতে ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে তিনি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। শাহ আলম ও সুজা-উদ-দৌলার মধ্যে অন্তর্দ্বন্দের কারণে এই জোট ভেঙে পড়ে। শাহ আলম যুদ্ধের এক পর্যায়ে ইংরেজদের সাথে যোগ দেন। তিনজন মরিয়া হয়ে ওঠা মিত্রের মধ্যে মৌলিক সমন্বয়ের অভাবেই এই জোট ব্যর্থ হয়। বিভিন্ন সূত্রমতে, ঐতিহাসিক বক্সারের যুদ্ধে এই তিন শাসকের মিলিত বাহিনীর ৪০,০০০ সেনা ইংরেজদের মাত্র ১০,০০০ সেনার কাছে পরাজিত হয়।
মীর কাসিমকে কোণঠাসা করে ইংরেজরা পুনরায় মীর জাফরকে ক্ষমতায় বসায়। পরাজিত মীর কাসিমের ধন-সম্পদ সব সুজা-উদ-দৌলা লুটে নেন এবং তাকে একটি খোঁড়া হাতির পিঠে চাপিয়ে নির্বাসিত করেন। দুর্দশাগ্রস্ত নবাব প্রথমে রোহিলাখন্ড, তারপর এলাহাবাদ, গোহাদ, যোধপুর হয়ে দিল্লীর নিকটে আবাস গাড়েন। একেবারে অজ্ঞাতসারে এবং অতি দারিদ্রের মধ্যে তার মৃত্যু হয়। তার ছেড়ে যাওয়া সম্পত্তির মধ্যে ছিলো শুধু দুটো শাল, যেগুলো বিক্রি করে তার সৎকারের খরচ যোগাড় করা হয়। এই দেশপ্রেমিকের জীবনপ্রদীপ নেভার সাথে সাথে উপমহাদেশ থেকে ইংরেজবিরোধী শেষ শিখাটিও নিভে যায়।
বক্সারের যুদ্ধের ফলাফল ও গুরুত্ব
(The Results and importance of the Battle of Boxar)
ভাগ্য নির্ণায়ক যুদ্ধ:
বক্সারের যুদ্ধ পলাশীর যুদ্ধ অপেক্ষা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই যুদ্ধটি ভাগ্য নির্ধারণ কারী যুদ্ধ । এই যুদ্ধে পরে আর কখনোই বাঙালিরা কোম্পানির বিরুদ্ধে জয়ী হতে পারেনি। এই যুদ্ধে যদি কোম্পানি হেরে যেত তাহলে হয়তো বা ভারতের ইতিহাস অন্যভাবে লিখা হতো।
ঔপনিবেশিক শাসনের ভীত:
পলাশীর যুদ্ধে কোম্পানি রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের সূচনা করেছিল আর বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে তারা প্রকৃত ক্ষমতা গ্রহণ করে ঔপনিবেশিক শাসনের সূত্রপাত করেছিলেন। সুতরাং বক্সারের যুদ্ধই ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনের ভিত্তি রচনা করে।
বাংলার চুড়ান্ত পতন:
বক্সারের যুদ্ধে মীর কাশিমের পরাজয়ের পর শক্তিকে বাধা দেওয়ার মত আর কোন শক্তি অবশিষ্ট থাকেনি। এর মাধ্যমে বাংলায় কোম্পানির প্রকৃত আধিপত্য বিস্তারের পথ কণ্টকমুক্ত হয়।
উত্তর ভারতে আধিপত্যের সূচনা:
বক্সারের যুদ্ধে জিতে কোম্পানি বাংলার আধিপত্যকে দৃঢ় করে উত্তর ভারতের দিকে নজর দেয়। অযোধ্যায় নবাব সুজা-উদদৌলা কোম্পানির অনুগত হন এবং নামসর্বস্ব মুঘল সম্রাট কোম্পানির দয়ার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। বাংলা রাজনৈতিক কর্তৃত্ব যখন এর মাধ্যমে সমগ্র উত্তর ভারতে কোম্পানির আধিপত্য সূচনা হয়।
আর্থিক লুণ্ঠনঃ
বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের পর বাংলার বাণিজ্য ও অর্থনীতির ওপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলায় কোম্পানির অবাধ অর্থনৈতিক লুণ্ঠন শুরু হয়। কোম্পানির উচ্চপদস্থ আমলারা নতুন নবাব নজম-উদদৌলার কাছ থেকে পনের লক্ষ টাকা উপঢৌকন হিসেবে আদায় করে। এর পাশাপাশি যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ অযোধ্যার নবাব সুজা-উদদৌলার কাছ থেকে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা আদায় করা হয়।
দেওয়ানি লাভঃ
বক্সারের যুদ্ধে চরম প্রাপ্তি হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার ও ওড়িশায় দেওয়ানি লাভ করেছিল। দেওয়ানি লাভের ফলে একদিকে বাংলার রাজনীতিতে কোম্পানির কর্তৃত্ব দৃঢ় হয়েছিল অপরদিকে কোম্পানির আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য বহুগুণ বেড়েছিল।
এলাহাবাদ চুক্তিঃ ১২ আগস্ট,১৭৬৫,
এলাহাবাদ এলাহাবাদ চুক্তির মাধ্যমে কোম্পানির দেওয়ানি লাভ করে এখানে দুটি চুক্তি হয়েছিল।
দুটি চুক্তি
মোঘল সম্রাট – কোম্পানি
(সম্রাটকে ২৬ লক্ষ টাকা এবং এলাহাবাদ ও কারা জেলার রাজস্ব স্থায়ী ভাবে ছেড়ে দেয়া হয়)
২. বাংলার নবাব – কোম্পানি
(বাংলার নবাবকে প্রশাসন পরিচালনা বাবদ ৫৩,৮৬,১৩১ টাকা, ৯ আনা দেয়া হবে)
মীর কাশীমের শেষ পরিণতি
স্বাধীনচেতা মীর কাশীম বাংলার স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করতে পারেননি। বরং নিজেই ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। অযোধ্যার নবাব 50 লক্ষ টাকার বিনিময়ে তাঁর রাজ্য ফিরে পেয়েছেন। মুঘল সম্রাটকে উপহার-উপঢৌকন দিয়ে কোম্পানি তার সাথে বন্ধুত্ব করেছে। কিন্তু মীর কাশিমের খবর কেউ রাখেনি। অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা মীর কাশীমের সমস্ত সম্পত্তি গ্রাস করেছিলেন। বক্সারের যুদ্ধের পরাজয়ের পর মীর কাসিম ভগ্ন হৃদয়ের পশ্চিমে পালিয়ে যান। বেশ কয়েক বছর যাবৎ তিনি অজ্ঞাত অবস্থায় ঘুরে বেড়ান।অর্থ সংকটে তিনি দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াতেন। তাঁর নাবালক দুই পুত্র দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে তাঁর জন্য খাবার সংগ্রহ করত। নাবালক দুই ছেলেকেও ইংরেজ বাহিনী হত্যা করে। 1777 সালে দিল্লী জামে মসজিদের নিকটে অত্যন্ত নিস্বঃ ও জরাজীর্ণ অবস্থায় মীর কাসিম ইন্তেকাল করেন। তার সাথে থাকা পরনের দুটি শাল বিক্রি করে তার দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা হয়। এভাবে বাংলার স্বাধীনচেতা নবাব মীর কাশিমের নবাব থেকে ভিখারী হওয়া করুন জীবনের অবসান ঘটে।
মীর কাশিমের পরাজয়ের কারণ
অর্থনৈতিক দুর্বলতা:
মীর কাসিম কোম্পানির সাথে আঁতাত করে ক্ষমতায় এসেছিলেন। সেজন্য কোম্পানির দায়-দেনা পরিশোধ করতে গিয়ে তাঁর রাজকোষ প্রায় শূন্য হয়ে গিয়েছিল। কোম্পানির পাওনা পরিশোধ করার পর প্রশাসন পরিচালনা, সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ, নতুন সেনা নিয়োগ এবং আধুনিক অস্ত্র ক্রয় করার জন্য এবং সামরিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য যেরকম অর্থের প্রয়োজন ছিল সেই পরিমাণ অর্থ তার ছিল না। তাই তার সে পরিমাণ অর্থ ছিল না।
জমিদার ও কর্মচারীদের অবিস্ততা:
নবাবের বেশকিছু হিন্দু কর্মচারী এবং জমিদার নবাবের অবাধ্য ছিল। তারা ইংরেজদের সাথে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। কোম্পানি কৌশল হিসেবে মীরজাফরকে নবাব পদে বসালে এ সমস্ত জমিদাররা খাৎনা দেয়া বন্ধ রাখেন। তারা একান্ত বিপদে না পড়লে প্রায়ই খাজনা দিতেন না।
মিত্রদের বিশ্বাসঘাতকতা
সুজাউদ্দৌলার উজির-বেনী বাহাদূর এবং সম্রাটের দিওয়ান-সেতাব রায় এরাম যুদ্ধক্ষেত্রে বিশ্বস্ততার পরিচয় দেননি। বাহাদুর বিশ্বাসঘাতকতা করে ইংরেজি বাহিনীকে সহযোগিতা করেন অন্যদিকে সাদা ঘোড়ায় কূটনীতির মাধ্যমে কোম্পানির বিজয়কে ত্বরান্বিত করেন।
আর্মেনীয় সেনাবাহিনীর বিশ্বাসঘাতকতা:
মীর কাসেমের গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান মার্কা ও আরোটান আর্মেনিয়ান খ্রিস্টান ছিলেন। ইউরোপীয় ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে তারা বিশ্বস্ততার পরিচয় দেননি।
যুদ্ধাস্ত্র যুদ্ধকৌশল:
বক্সারের যুদ্ধে কোম্পানি ইউরোপীয় সর্বাধুনিক অস্ত্রের ব্যবহার এবং সর্বোচ্চ কৌশল ব্যবহার করেছিল মীর কাসেমের যুদ্ধাস্ত্র এবং কৌশল এর তুলনায় রণকৌশল অস্ত্রশস্ত্রে ইংরেজরাই শ্রেষ্ঠ ছিল। নবাবের অনিয়ন্ত্রিত অবিশ্বস্ত সম্মেলন এর তুলনায় ইংরেজ বাহিনী ছিল অধিক সুশৃংখল। বক্সারের যুদ্ধে মীর কাসেমের পরাজয় মূলত আধুনিক সামরিক সরঞ্জাম এর কাছে একটি পুরাতন ও অনুন্নত সামরিক বাহিনীর পরাজয়।
মীর কাশিমের অনুপস্থিতি:
ধারাবাহিকভাবে বেশ কয়টি যুদ্ধ সংঘটিত হলেও মীর কাসিম এ সমস্ত যুদ্ধে নিজে উপস্থিত না হয়ে সেনাপতি পালন করেছিলেন। সেনাপতিদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ব্যক্তিগত হিংসা-বিদ্বেষ এর কারণে যেসব যুদ্ধে মীর কাসিম জয়লাভ করতেন সেসব যুদ্ধেও তিনি হেরে যান। প্রথম থেকেই মীর কাসেমের অনুপস্থিতিতেই তার পরাজয়কে ত্বরান্বিত করেছে।
আরও পড়ুন-
আরও পড়ুন-
Md. Billal Hossain
B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka
BCS General Education
Lecturer
Department of Islamic History & Culture
Chandpur Govt. College, Chandpur.
No comments:
Post a Comment