প্রথম বিশ্বযুদ্ধ
(1914-1918)
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণসমূহ
[Causes of the 1st World War]
ভূমিকা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ! কোটি কোটি মানুষের প্রাণহানি আর মহা ধ্বংসযজ্ঞের এক বীভৎস ইতিহাস। 1878 সালের বার্লিন কংগ্রেস এরপর ইউরোপ জুড়ে মোটামুটি শান্তি বিরাজ করেছিল তবে বাহ্য দৃষ্টিতে শান্তি বিরাজ করলেও হাজার 914 সাল পর্যন্ত এই সময়ের দিকে প্রকৃতপক্ষে ঐতিহাসিকগণ সশস্ত্র শান্তির যুগ বলে অভিহিত করেছেন কারণ এ সময়ে কোন যুদ্ধ না হলেও গোপনে গোপনে সবাই সামরিক ভান্ডার সমৃদ্ধ করে যুদ্ধ প্রস্তুতি নিতে থাকে। স্বার্থপরতা, উগ্র জাতীয়তাবাদ, পরস্পর ভীতি ও সন্দেহ তৎকালীন ইউরোপের প্রতিটি দেশের বসেছিল। উপর তৎকালীন ইউরোপের প্রতিটি দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল। অবশেষে বলকান সংকট এর মাধ্যমে বারুদে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের সূচনা হয়। অস্ট্রিয়া ও সার্বিয়ার মধ্যে শুরু হওয়া এই যুদ্ধে ইউরোপের দেশগুলো দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তা গোটা বিশ্বকে প্রভাবিত করে। আর বছরের এই যুদ্ধে সামরিক-বেসামরিক মিলিয়ে প্রায় 4 কোটি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নয়। দীর্ঘকালের বেশকিছু পরোক্ষ কারণ এবং কয়েকটি প্রত্যক্ষ কারণ এর মাধ্যমে এ যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণসমূহ [Causes of the 1st World War]
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরোক্ষ কারণ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধেরপ্রত্যক্ষ কারণ
পরোক্ষ কারণ সমূহ
জাতীয়তাবাদের অবমূল্যায়ন:
সাম্য মৈত্রী আর স্বাধীনতার স্লোগান নিয়ে সংঘটিত হওয়া ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে ইউরোপে জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে । 1815 সালের ভিয়েনা কংগ্রেসে জাতীয়তাবাদ কে উপেক্ষা করা হলেও পরবর্তীতে গ্রীস, ইতালি, জার্মানি, রুমানিয়া ও বুলগেরিয়া জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে স্বাধীনতা লাভ করে। 1856 সালের প্যারিস চুক্তি এবং 1877 সালের বার্লিন কংগ্রেসে মেসিডোনিয়া ও সার্বিয়ার জাতীয়তাবাদকে বাধাগ্রস্ত করা হয়। বার্লিন কংগ্রেসে মেসিডোনিয়া কে ভাগবাটোয়ারা করে নেয়া হয়েছিল অন্যদিকে সার্বীয় বিশাল সংখ্যক মানুষকে রাখা হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার অধীনে যা সার্ব জাতীয়তাবাদের মূলে কুঠারাঘাত করে। জাতীয়তাবাদের অপূর্ণতাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ।
স্বার্থপরতা:
আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি না রেখে বরং ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলি তখন নিজের স্বার্থের প্রতি সর্বাধিক সচেতন ছিল। স্বীয় স্বার্থ কতটুকু প্রতিষ্ঠা করা যায় সে বিষয়ে প্রত্যেকটি দেশ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিল। জাতীয়তাবাদ বিরোধী এই স্বার্থপরতা ইউরোপের প্রত্যেকটি দেশকে একে অপরের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল।
ফ্রান্স জার্মানি সংঘাত:
অটো ভন বিসমার্ক জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করতে গিয়ে 1878 সালে সেডানের যুদ্ধে ফ্রান্সকে পরাজিত করে ফ্রান্স এর নিকট থেকে লৌহ খনি সমৃদ্ধ আলসেস লরেন্স দখল করে নেন। এই অঞ্চলের লোকজন জাতিগতভাবে জার্মান হলেও দীর্ঘকাল যাবত ফরাসি শাসনে থাকায় তারা নিজেদেরকে ফরাসি জাতিভুক্ত বলে মনে করত। তদুপরি লৌহখনি সমৃদ্ধ এই অঞ্চলটি হাতছাড়া হওয়ার বেদনা ফ্রান্স মেনে নিতে পারছিল না। ফলে ফ্রান্স এই অঞ্চলটি ফিরে পাবার জন্য আগ্রহী ছিল এর পরিপ্রেক্ষিতেই ফ্রান্স এবং জার্মানির মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাত।
ইতালি অস্ট্রিয়া যুদ্ধ:
1870 সালে ইতালি ঐক্যবদ্ধ হলেও তখনও ট্রেনটিনো এবং ট্রিয়েট নামক দুটি অঞ্চল তখনো অস্ট্রিয়ার অধীনে ছিল। এই অঞ্চলের অধিকাংশ লোকজন ইতালির বংশোদ্ভূত থাকায় যে কোনো মূল্যে যুদ্ধ করে হলেও ইতালি এই দুটি অঞ্চল দখল করার জন্য বদ্ধপরিকর ছিল। অন্যদিকে অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের দখল নিয়ে অস্ট্রিয়া ও ইতালি এর মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করেছিল।
অস্ট্রিয়া-সার্বিয়া সংঘাত:
সাতাত্তর সালের হাজার 878 সালের বার্লিন কংগ্রেস সে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা নামক দুটি সার্ব অধ্যুষিত এলাকাকে অস্ট্রিয়ার অধীনে রাখা হয়। এর মাধ্যমে ইসলাম জাতীয়তাবাদ কে উপেক্ষা করা হয়। জাতিগতভাবে জাতিগতভাবে সার্বীয় হওয়ায় এই অঞ্চলের লোকেরা অস্ট্রিয়ার আধিপত্য খর্ব করে সার্বিয়ার সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য আন্দোলন শুরু করে। অন্যদিকে অস্ট্রিয়া ভয়ানক স্বৈরাচারী শাসনের মাধ্যমে সার্বিয় জাতীয়তাবাদকে দমনের চেষ্টা করলে সার্বিয়া এর প্রতিবাদ করে। ফলে অস্ট্রিয়া-সার্বিয়া সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে।
উগ্র জাতীয়তাবাদ:
কূটনীতির জাদুকর অটোভন বিসমার্ক এর নেতৃত্বে জার্মানি তখন ইউরোপের বড় পরাশক্তিতে পরিণত হয়। এরপর জার্মানিতে উগ্র জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে উগ্রজাতীয়তাবাদ জার্মানিতে প্রকট আকার ধারণ করে। জার্মান ঐতিহাসিক হেনরিক ফনট্রিটক্সি, হাউসটন স্টুয়ার্ট চেম্বারলেন এবং জেনারেল ফ্রেডারিক ফন বার্নহার্ড উগ্র জার্মান জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ছিলেন। জার্মান পিতৃভূমি এবং ইউরোপীয় সকল দেশের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ফলে তারা সমগ্র ইউরোপ শাসন করার অধিকার রাখে এরকম মতবাদ থেকেই এই জার্মান উগ্র জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে যা পরবর্তীতে সমরতন্ত্রে রূপ লাভ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করে।
ট্রিপল অ্যালায়েন্স:
স্বীয় নিরাপত্তা ও আধিপত্যবাদের বিস্তারের জন্য জার্মানি সর্বপ্রথম সামরিক মৈত্রী নীতি সূত্রপাত করে। এমন একটি ঐক্যবদ্ধ করার পর ফ্রান্সকে একঘরে করার জন্য 1873 সালে জার্মানি অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার সাথে ত্রি সম্রাটের চুক্তি স্বাক্ষর করেন। যদিও 1878 সালের বার্লিন কংগ্রেস এরপর তা স্থায়ী হয়নি। রাশিয়ার সাথে জার্মানির শত্রুতা শুরু হলে 1839 সালে অটো ভন বিসমার্ক অস্ট্রিয়ার সাথে দ্বিশক্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। অটোভন বিসমার্ক জার্মানির শক্তি ও নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য 1882 সালে ইতালিকে জার্মানি অস্ট্রো-জর্মান চুক্তির সাথে যুক্ত করলে দ্বিশক্তি চুক্তি ত্রিশক্তি বা ট্রিপল অ্যালায়েন্স এ রূপান্তরিত হয়। এই চুক্তিতে প্রতিটি দেশ পারস্পারিক সামরিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেয়। 1914 সাল পর্যন্ত ট্রিপল অ্যালায়েন্স বলাবত ছিল কিন্তু জার্মানির প্রতি ইতালির সন্দেহ হলে বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পরের বছর 1915 সালে ইতালি ট্রিপল অ্যালায়েন্স থেকে নিজেকে বের করে নেয়।
ট্রিপল আঁতাত গঠন:
আরমানির নেতৃত্বের মধ্যে ইউরোপে জার্মানির নেতৃত্বের মধ্যে ইউরোপে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জোট গড়ে উঠলে পশ্চিমের ফ্রান্স ও ব্রিটেন এবং পূর্বে রাশিয়া একাকীত্ব অনুভব করে এরই ধারাবাহিকতায় 1895 সালে রাশিয়া ও ফ্রান্স পরস্পর প্রতিরক্ষা চুক্তিতে আবদ্ধ হয় এই ঘটনার ফলে ইংল্যান্ড নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করে ওদিকে প্রথমদিকে ব্রিটেন জার্মানি সাথে সখ্যতা স্থাপনের চেষ্টা করে কিন্তু জার্মানির তৈরি মনোভাবের কারণে তার সম্ভব হয়নি অতঃপর ব্রিটেনের এশীয় দেশ জাপানের সাথে মিত্রতা স্থাপন করে। জার্মানির সম্প্রসারণবাদী নীতির কারণে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ইংল্যান্ড 1900 সালে ফ্রান্সের সাথে আঁতাত কার্ডিয়াল নামে একটি মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন করে। এদিকে 1905 সালে রুশ জাপান যুদ্ধে রাশিয়া হেরে গেলে সে জাপানের মিত্র ইংল্যান্ডের সাথে সমস্ত বিরোধ মিটিয়ে ফেলে বন্ধুত্ব স্থাপনের চেষ্টা করে। 1907 সালে অ্যাংলো-রুশ কনভেনশন এর মাধ্যমে ব্রিটেন এবং রাশিয়া নিজেদের সমস্ত বিরোধ মিটিয়ে ফেলে। এর ফলে ইউরোপের বৃহৎ তিনটি শক্তি তথা ফ্রান্স ব্রিটেন ও রাশিয়া জার্মানির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়। যার অবশ্যম্ভাবী ফলরূপে 1907 সালে ত্রিশক্তি আঁতাত গঠিত হয়। ট্রিপল আঁতাত এ স্বাক্ষরকারী এই তিনটি দেশ জার্মানির বিরুদ্ধে পারস্পারিক সামরিক সহযোগিতা প্রদানে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়। ফলে গোটা ইউরোপ ট্রিপল আঁতাত ও টিপল অ্যালায়েন্স নামে এই দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
বলকান সংকট:
মূলত বলকান সংকট থেকেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের উৎপত্তি হয়। তুর্কি অধীনতার বিরুদ্ধে বলকানে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটেছিল কিন্তু 1856 সালের প্যারিস চুক্তি ও 1877 সালের বার্লিন কংগ্রেসে এ অঞ্চলের জাতীয়তাবাদ কে উপেক্ষা করা হয়। মেসিডোনিয়া কে খণ্ড-বিখণ্ড করা এবং বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় সার্ব জাতীয়তাবাদকে প্লে উপেক্ষা করলে সার্বিয়া অস্ট্রিয়ার মধ্যে যে সংখ্যা তৈরী হয় তা-ই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দিকে ধাবিত হয়। বার্লিন কংগ্রেস এর সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে পূর্ব রুমেলিয়া এবং বুলগেরিয়া আবারো একত্রিত হয় সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ইতালি ক্রিয়েট এবং ট্রেন্টিনো উদ্ধারে তৎপর হয়। অন্যদিকে রাশিয়া বলকান অঞ্চলের স্লাভ জাতীয়তাবাদের পৃষ্ঠপোষক ছিল। আর্মেনীয় হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করে তুরস্কের বিরুদ্ধে বলকানীরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের শুরু করে । এই সময়ে বলকান অঞ্চলে এবং ইজিয়ান সাগরে জার্মানির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে।
সমরতন্ত্র:
1878 সালের বার্লিন কংগ্রেস থেকে 1914 সালের পূর্ব পর্যন্ত বলকান যুদ্ধ ব্যতিত গোটা ইউরোপে শান্তি বিরাজ করলেও গোপনে গোপনে প্রত্যেকটি দেশ সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সমরাস্ত্রের প্রতিযোগিতা শুরু হয় পর বিরোধী সার্থক সংবাদকে কেন্দ্র করে তারা গোপনে গোপনে সামরিক দিক থেকে এ সজ্জিত হতে থাকে এই জন্যই এই সময়টাকে বলা হয় সশস্ত্র শান্তির যুগ 1917 সালে জার্মানির সৈন্য সংখ্যা দাঁড়ায় ৮ লক্ষ ৭০ হাজার। অন্যদিকে ফ্রান্স তার দেশের সকল নাগরিকের জন্য তিন বছর চাকরি বাধ্যতামূলক করে। রাশিয়া সব নাগরিকের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করে ব্রিটেন কোন শক্তি বৃদ্ধি করে জার্মানি ডুবোজাহাজ তৈরিতে অপ্রতিরোধ এগোতে থাকে। জার্মান নৌ প্রতিদ্বন্দিতা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম অনুঘটক।
আরও পড়ুন-
সুয়েজ খালের ইতিহাস এবং মিসরের স্বাধীনতা ও জাতীয় জীবনে সুয়েজ খালের প্রভাব
গোপন কূটনীতি ও সন্দেহ:
প্রশান্তির যুগে সশস্ত্র শান্তির যুগ ইউরোপীয় দেশগুলোর উপর পারস্পারিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস জেঁকে বসে। এর মূল কারণ ছিল গোপন কূটনীতি। গোপনে কে কার সাথে চুক্তি করেছে এ বিষয়ে তারা ছিল সন্দিহান। এমনকি নিজ দেশের পার্লামেন্টের অনেক সদস্যই তার দেশের সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত জানতো না। বাহিনী আবার সামরিক বাহিনী তাদের কর্মপন্থা সম্পূর্ণরূপে পররাষ্ট্র দপ্তরকে সরবরাহ করত না। উদাহরণস্বরূপ 1906 সালে ইন ফ্রান্স সামরিক চুক্তি বৃটেনের কেবিনেট ও পার্লামেন্ট কে জানানো হয় নাই অন্যদিকে জার্মান জার্মান নেতা কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়ামকে যুদ্ধের পূর্বকার বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে জানানো হয় নাই। আর অবিশ্বাসের ধ্রুমজালে তখন ইউরোপ একটি বারুদের স্তূপে পরিনত হয়েছিল।
অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ:
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ঔপনিবেশিক ও বাণিজ্যিক আধিপত্যবাদকে কেন্দ্র করে দারুণ প্রতিযোগিতা শুরু হয়। জাতীয়তার জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা দেশগুলো সর্বদাই শক্তি বৃদ্ধিতে সচেষ্ট ছিল। ফলে তারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রের উপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। তাদের এই আধিপত্যবাদ ইউওরোপের সীমানা ছাড়িয়ে এশিয়া এবং আফ্রিকাতেও বিস্তার লাভ করে। পাশাপাশি শক্তিশালী দেশগুলোর ব্যাংকব্যবস্থা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশে অর্থ বিনিয়োগের চেষ্টা করে। ইউরোপের বাইরে তাদের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠা পারস্পারিক রেষারেষি সৃষ্টি করে।
আন্তর্জাতিক সংকট:
1907 সালের পর থেকে ট্রিপল অ্যালায়েন্স ও ত্রিশক্তি আঁতাত এর মধ্যে সংকট আরো ঘনীভূত হতে শুরু করে। জার্মানি অস্ট্রিয়া ও ইতালি মিলে ত্রিশক্তি অ্যালায়েন্স গঠন করলেও ইতালি জার্মানির প্রতি সন্তুষ্ট ছিল না। ইতালি 1902 সালে ফ্রান্সের সাথে এবং 1909 সালে রাশিয়ার সাথে পৃথক মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করে।কো সঙ্কটকে কেন্দ্র করে মরক্কো সংকট কে কেন্দ্র করে 1906 সালে আলজিয়ার্স কনভেনশনে ইতালি জার্মানির বিপক্ষে ভোট দেয়। 1909 সালে আগাদির সংকট কে কেন্দ্র করে জার্মানি ও মিত্র শক্তির সাথে যে কুটনৈতিক লড়াই হয় তাতে জার্মানির পরাজয় ঘটে। এর ফলে মিত্রবাহিনী আরও শক্তিশালী হয়। ইতালি ট্রিপল এলাইন্স থেকে আস্তে আস্তে দূরে সরে গিয়ে মিত্র বাহিনীর সাথে একতাবদ্ধ হয়।
অস্ত্রের বাজার তৈরি:
ইউরোপীয় প্রতিটিতে শান্তির অন্তরালে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে এবং সমরাস্ত্র উৎপাদন বৃদ্ধি করতে থাকে। সমরাস্ত্রবিজ্ঞানী ও সমরাস্ত্র তৈরি করে এমন শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো যেকোনো মূল্যে একটি যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়ে অস্ত্রের বাজার তৈরি করার জন্য উদগ্রীব ছিল। কেননা ইউরোপীয় সময় সমালোচকরা প্রতিষ্ঠানগুলো যে পরিমাণ অস্ত্র উৎপাদন করেছিল একমাত্র যুদ্ধ ভ্রতিত সেগুলো বিক্রি করার কোন পথ ছিল না।
সংবাদপত্রের ভূমিকা:
অসাধু প্রচারযন্ত্রের দায়িত্বজ্ঞানহীন বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম অনুঘটক। প্রতিটি দেশের সংবাদপত্র স্বীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে উন্মাদনা সৃষ্টি করে অন্যান্য দেশগুলোকে শত্রুভাবাপন্ন বলে তাদের সম্পর্কে নানা প্রকার অসত্য আজগুবি সংবাদ প্রকাশ করে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করেছিল। সংবাদপত্রের জন্য সংবাদ প্রকাশ করে সংবাদপত্রগুলো পরিস্থিতিকে জটিল এবং যুদ্ধের জন্য উন্মাদনার সৃষ্টি করে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নামে প্রতিবেশী প্রতিপক্ষ দেশের বিরুদ্ধে বিষোদগার সচেষ্ট ছিল। জার্মানি এবং ইংল্যান্ডের এরকম প্রচারযন্ত্রের ভূমিকা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য দায়ী।
আরও পড়ুন-
গ্রিসের স্বাধীনতা যুদ্ধ।। Greek War of Independence
প্রত্যক্ষ কারণ সমূহ:
অস্ট্রো-হাঙ্গেরি ও সার্বিয়া বিরোধ:
1878 সালের বার্লিন কংগ্রেসে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা স্লাভ অধ্যুষিত হওয়া সত্ত্বেও অস্ট্রিয়ার অধীনে রাখা হয়েছিল। এই দুইটি অঞ্চলে সাপ জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে অস্ট্রিয়া আত্তন্ত স্বৈরাচারী কায়দায় তা দমন করতে থাকে। ফ্লাপ জাতীয়তাবাদের প্রতি অস্ট্রিয়ার এই নিপীড়নের ইরানের বিরুদ্ধে সার্বিয়া বাধা দান করে। এই দুটি অঞ্চল সার্বিয়ার সহায়তায় স্বাধীন অথবা সার্বিয়ার সাথে উত্তপ্ত হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করছিল। অস্ত্র হাংগিরি সরকারকে ভিডিও বেকায়দায় ফেলার জন্য এই অঞ্চলে বেশকিছু সন্ত্রাসবাদী সমিতি গড়ে ওঠে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘ব্লাক হেন্ড’ বা গ্রুপ অব ডেথ। এই Black-Hand নামক সমিতির কর্মকাণ্ডই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের গোড়াপত্তন করে।
সারায়েভো হত্যাকান্ড:
অস্ট্রিয়ার ভবিষ্যৎ যুবরাজ আর্চ ডিউক ফ্রান্সিস ফার্ডিনান্ড এবং তার স্ত্রী সোফি 1914 সালে 28 জুন বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভোতে ভ্রমণে আসেন কিন্তু ব্ল্যাক হ্যান্ড বা ইউনিয়ন অব ডেথ নামক একটি সার্বিয় সন্ত্রাসবাদি দল তাদের লক্ষ্য করে বোমাবর্ষণ করে। এই যাত্রায় তারা রক্ষা পেলেও অনুষ্ঠান শেষে ফেরার পথে সন্ত্রাসবাদি দলের একজন ছাত্র তাদের উভয়কে আকস্মিকভাবে গুলি করে হত্যা করে। কান্ড এই হত্যাকাণ্ড ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রধান প্রত্যক্ষ কারণ।
অস্ট্রিয়ার চরমপত্র:
সারায়েভো হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বারুদে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় অস্ট্রিয়া সার্বিয়া কে দায়ী করে এবং সার্বিয়াকে অস্ট্রিয়ার সরকার ‘আততায়ীর জাতি’ বলে অভিহিত করে। ঘটনাটি অস্ট্রিয়ার অস্ট্রিয়ার অধীনস্থ বসনিয়ার রাজধানীর সারায়েভোতে ঘটলেও অস্ট্রিয়া এর জন্য সার্বিয়াকে দায়ী করে এবং জার্মানির সহায়তার গোপন প্রতিশ্রুতিতে অস্ট্রিয়া ২৩ জুলাই সার্বিয়াকে একটি চরমপত্র প্রদান করে। চরমপত্রে-
শুরুতেই অস্ট্রিয়া এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানায়।
পাশাপাশি সার্বিয়াকে এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করার আদেশ দেয়া হয়।
অস্ট্রিয়া বিরোধীদের চাকরীচ্যুত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
দুইজন পদস্থ সার্বিয়ান কে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দেয়া হয়।
হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রক্রিয়ায় অস্ট্রিয়ার সহায়তা নিতে বলা হয়।
অস্ট্রিয়া বিরোধী প্রচারকার্য বন্ধ করতে বলা হয়।
48 ঘণ্টার মধ্যে চরমপত্রের জবাব দিতে বলা হয়।
অস্ট্রিয়ার যুদ্ধ ঘোষণা
25 শে জুলাই সার্বিয়া চরমপত্রের জবাব দেয়। জবাবে সন্তুষ্ট না হয়ে অস্ট্রিয়া 28 জুলাই 1914 সালে সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
আরও পড়ুন-
বলকান যুদ্ধ (1912-13): প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ড্রেস রিহার্সেল
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তি:
ব্রিটেন
ফ্রান্স
রাশিয়া
সার্বিয়া
জাপান
ইতালি
বেলজিয়াম
ইউএসএ
পর্তুগাল
চীন
গ্রিস
থাইল্যান্ড
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অক্ষশক্তি:
জার্মানি
অস্ট্রিয়া
অটোমান তুরস্ক এবং
বুলগেরিয়া
রুমানিয়া
বেলগ্রেড আক্রমণ ও যুদ্ধ শুরু:
29 জুলাই 1914 অস্ট্রিয়া সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেড আক্রমণ করে। এর মাধ্যমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়।
পারস্পারিক অ্যাকশন ও রিঅ্যাকশন:
এই সময় ব্রিটিশ পররাষ্ট্রসচিব স্যার এডোয়ার্ড গ্রে এই জটিল পরিস্থিতির সমাধান এর জন্য কূটনৈতিক চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। বেলগ্রেড আক্রমণের মাধ্যমে যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটলে ইউরোপ জুড়ে দারুন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। প্রত্যেকটি দেশ তার স্বার্থ বিবেচনায় প্রতিক্রিয়া জানায়। বলকানে অস্ট্রিয়ার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে রাশিয়ার নেতৃত্বে স্লাভ ঐক্য বিনষ্ট হবে। তাই রাশিয়া অস্ট্রিয়াকে জানিয়ে দেয় যে, সার্বিয়া আক্রান্ত হলে রাশিয়া নিরপেক্ষ থাকবে না। 29 জুলাই রাশিয়া অস্ট্রিয়া ও জার্মান সীমান্তে শুনে সমাবেশ করে। অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে রাশিয়ার অবস্থান কে জার্মানি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা শামিল বলে মনে করে। জার্মানি পহেলা আগস্ট রাশিয়ার বিরুদ্ধে এবং তেসরা আগস্ট ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ওদিকে জার্মানি বেলজিয়ামের নিরপেক্ষতা নষ্ট করলে বেলজিয়াম ইংল্যান্ডের দ্বারস্থ হয়। থে বেলজিয়ামের অনুরোধে ব্রিটেন 4 আগস্ট জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। আবার জার্মানি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে ফ্রান্স তার নিজস্বার্থ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয় অর্থাৎ চুক্তি অনুযায়ী সে রাশিয়ার পক্ষে থাকে। এদিকে ইতালি যুদ্ধ শুরুর কিছুকাল পরেই নিরপেক্ষ নীতি ঘোষণা করলেও বাস্তবে ইটালি ট্রিপল আঁতাত এর বলয়ে চলে যায়। ইতালির দৃষ্টিতে ট্রিপল অ্যালায়েন্স ছিল আত্মরক্ষামূলক চুক্তি। কিন্তু জার্মানি ও অষ্ট্রিয়া আক্রমণাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে এই যুক্তিতে ইতালি 1915 ত্রিশক্তি অ্যালায়েন্স থেকে বেরিয়ে যায়।
যুদ্ধের প্রকৃতি:
এটি ছিল একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ। এ যুদ্ধে বৈজ্ঞানিক মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হয় যেমন ডুবোজাহাজ ট্যাংক কামান, মাস্টার্ড গ্যাস, তরল গ্যাস, বিষাক্ত গ্যাস, জীবাণু অস্ত্র, স্থল জল ও আকাশপথে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এটি ছিল ইউরোপীয় শক্তিসাম্য পুনঃস্থাপনের যুদ্ধ।
সংক্ষেপে যুদ্ধের ঘটনা প্রবাহ:
1914 সালে জার্মান বাহিনী অগ্রগতি লাভ করে এবং তারা বেলজিয়াম দখল করে নেয়। 1915 সালে ইতালির অবস্থান পরিবর্তন করে মিত্র বাহিনীর সাথে যোগ দেয়। তুরস্কের জার্মানির সাথে যোগদান করে এবং সর্বক্ষেত্রে মিত্রপক্ষের পরাজয় ঘটে। স্থল স্থল জল ও নৌপথে বিভিন্ন প্রান্তে ভয়ানক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। 1917 সালে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লব ঘটে। বিপ্লবের পর রাশিয়া জার্মানির সাথে যুদ্ধ পরিহার করে। এর ফলে জার্মানি বহু সংখ্যক সৈন্য পূর্ব থেকে পশ্চিম ইউরোপে নিযুক্ত করতে সক্ষম হয়। এতে জার্মানির অবস্থান শক্তিশালী হয়। এসময় জার্মানি সাবমেরিনের মাধ্যমে নির্বিচারে প্রতিপক্ষের জাহাজ ধ্বংস করতে শুরু করে। জার্মানির সাবমেরিনের আঘাতে আমেরিকার বাণিজ্যিক জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হলে জার্মানি কে শায়েস্তা এবং মিত্র বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য1917 সালে আমেরিকা যুদ্ধে যোগদান করে। 1918 সালের দিকে জার্মানির পরাজয় শুরু হয় এবং রুমানিয়া পরাজিত হয়। এসময় জার্মানিতে বিপ্লবের আশঙ্কা দেখা দেয়। 11 নভেম্বর 1918 তৎকালীন জার্মান শাসক কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম পলায়ন করেন এবং জার্মানি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে ঘোষিত হয়।
যুদ্ধ বিরতি:
মিত্রবাহিনীর জেনারেল ফার্স্ট এর সুযোগ্য সমর পরিচালনায় এবং আমেরিকার প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে জার্মানির পরাজয় ঘটে। এদিকে তুরস্ক অস্ট্রিয়া, রোমানিয়া বিভিন্ন ফ্রন্টে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। জার্মানির অভ্যন্তরে বিপদের আশঙ্কা, নৌবাহিনী বিদ্রোহী হওয়া ইত্যাদি সংকটাপন্ন অবস্থায় জার্মানি যুদ্ধের অবসান করার চিন্তা করে এবং 1918 সালের 11 ই নভেম্বর মিত্রপক্ষের সাথে জার্মানির যুদ্ধ বিরতি হয়। 1919 সালের প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে।
আরও পড়ুন-
ক্রিমিয়ার যুদ্ধ : ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলোর স্বার্থের সংঘাত
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণসমূহ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণসমূহ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণসমূহ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণসমূহ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণসমূহ
Causes of the 1st World War
Causes of the 1st World War
Causes of the 1st World War,
[ প্রিয় পাঠক,
যে কোন ভূল-ত্রুটির সংশোধনী বা পরামর্শ থাকলে ওয়েব সাইটে পোস্টের নিচে কমেন্ট বক্সে লিখুন। ইসলামের ইতিহাস, স্বাধীন-বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস, ইসলামের বিধি-বিধান সংক্রান্ত কোন প্রবন্ধ বা সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে লেখা কোন প্রবন্ধ প্রকাশ করতে চাইলে আপনার লেখা এবং পরিচিতিসহ মেইল করুন। ]
Md. Billal Hossain
B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka
BCS General Education
Lecturer
Department of Islamic History & Culture
Chandpur Govt. College, Chandpur.
No comments:
Post a Comment