খোলাফায়ে রাশেদীন কারা ?
তারা কিভাবে ক্ষমতাসীন হয়েছিল ? একে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলা যায় কি ?
খিলাফত ইসলামী শাসন ব্যবস্থার একটি মর্যাদাপূর্ণ ব্যবস্থা। এটি একই সাথে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রধান পদবী যিনি এই পদে অধিষ্ঠিত হন তাকে বলা হয় খলিফা। রাসূলুল্লাহ (স.) এর ইন্তেকালের পর এ খিলাফতের যাত্রা শুরু হয়। ইসলামের ইতিহাসে এই খিলাফত বলতে খলিফাতুর রাসুল বা রাসুলের প্রতিনিধি কে বুঝানো হয়। রাসূলুল্লাহ (স.) তাঁর নবয়তের 23 বছরে আরবদের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছিলেন। তিনি গড়ে তুলেছেন একটি নতুন জাতি এবং একটি নতুন সমাজ ও জীবন ব্যবস্থা। কিন্তু তাঁর ইন্তেকালের কারণে মুসলিম জাতি সাময়িক সংকটে পতিত হয়। যেহেতু তিনি তার কোন উত্তরসূরী নির্বাচন করে যাননি তাই তার পরবর্তী উত্তরসূরির নির্বাচনে মুসলিমদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়।
উত্তরাধিকারী নির্বাচনের সরাসরি রাসূলুল্লাহু (স.) এর নির্দেশনা থাকলেও তাঁর জীবদ্দশায় কিছু ইঙ্গিতবহ কর্মকাণ্ড এই সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে। হযরত ওমরের বিচক্ষণতায় আবুবকর খলিফা নির্বাচিত হন। সেই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে হযরত ওমর, ওসমান, আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুম খলিফা নির্বাচিত হন। ইসলামের ইতিহাস রাসূলুল্লাহ (স.) এর এ ৪ জন সাহাবী খোলাফায়ে রাশেদীন হিসেবে পরিচিত।
খোলাফায়ে রাশেদীনের পরিচিতি:
খোলাফায়ে রাশেদীন বলতে তাদেরকে বোঝানো হয় যারা মুহাম্মদ (স.) এর নীতি ও আদর্শ অনুসারে মুসলিম সাম্রাজ্যের সর্বাধিনায়ক করেছেন। খোলাফায়ে রাশেদীন শব্দের অর্থ হচ্ছে হেদায়েত প্রাপ্ত প্রতিনিধিবর্গ। একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাম বলেছিলেন তোমাদের কর্তব্য হচ্ছে আমার রীতিনীতি এবং এবং আমার হেদায়েত প্রাপ্ত খলিফাদের রীতিনীতির অনুসরণ করা। মুসলিম ধর্মতত্ত্ববিদগণ এ বিষয়ে একমত যে, এখানে হেদায়েত প্রাপ্ত খলিফা বলতে চার খলিফা কে বোঝানো হয়েছে। সুতরাং খলিফা বলতে খলিফাতুর রাসুল বা রাসুলের প্রতিনিধি বুঝানো হয়। কেননা তারা রাসূলুল্লাহ (স.) এর মিশনের পরবর্তী পরিচালক ছিলেন।
ইবনে খালদুনের মতে ইসলামী আদর্শের সংরক্ষণ তদনুযায়ী সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন এবং পরিচালনা হল খিলাফত অর্থাৎ খিলাফত এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা মহানবী (স.) এবং ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করে।
ইবনে তাইমিয়ার মতে খিলাফত এমন একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যেখান থেকে রাষ্ট্রীয় আইন প্রয়োগ করা হয়।
আল গাজ্জালীর মতে খিলাফত এমন একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যা যুক্তিতর্কের দিক দিয়ে নয় বরং স্বর্গীয় আইনের অনুশাসনের জন্য প্রয়োজন।
সুতরাং খিলাফত হচ্ছে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক যুগপৎ এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব এবং তাঁর রাসূলের নীতি আদর্শের ভিত্তিতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতিনিধি হিসেবে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করে থাকে।যিনি খেলাফতর আসনে সমাসীন হন তিনি হলেন খলিফা। তিনি একই সাথে রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় প্রধান।
খোলাফায়ে রাশেদীন ছিলেন চার জন।
হযরত আবু বকর (রা ) 632-634
হযরত ওমর (রা) 634-644
হযরত উসমান (রা) 644-656
হযরত আলী (রা) 656-661
খোলাফায়ে রাশেদীনের সময়কাল:
খোলাফায়ে রাশেদীনের সময়কাকে ইসলামের সোনালী যুগ ধরা হয়। চারজন খলিফার শাসনকাল ছিল 29 বছর 6 মাস। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু (স.) এর একটি হাদীসে খোলাফায়ে রাশেদীনের সময়কাল 30 বছর বলে উল্লেখ করেছিলেন। সেই হিসেবে মুসলিম মনীষীগণ হযরত আলীর পরে তার ছেলে হযরত হাসান এর ছয় মাসের খেলাফত কালকে গণ্য করে মোট ত্রিশ বছর স্থির করেন।
খোলাফায়ে রাশেদীনের নির্বাচন প্রক্রিয়া
আবু বকর (রা.) এর নির্বাচন
আনসাদের সমাবেশ:
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম ইন্তেকালের পূর্বে যেহেতু উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান নিএমনকি তার কোনো পুত্র সন্তান ও জীবিত ছিল না যাকে পরবর্তী উত্তরাধিকারী ঘোষণা করা যেতে পারে সেহেতু উত্তরাধিকার নির্বাচনে বিরোধের সৃষ্টি হয় সর্বপ্রথম আনসাররা তাদের দাবি প্রতিষ্ঠায় আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে তারা তাদের মধ্য থেকে একজন খলিফা নির্বাচনের জন্য সাকিব ফাহমিদা নামের আরেকটি সভাকক্ষে সমবেত হয় আলোচনার ভিত্তিতে তারা সাদ বিন আবু ওবায়দা খেয়ে মুসলিম জাহানের খলিফা হিসেবে ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেয়আনসারদের এই সমাবেশের কথা শুনতে পেরে মসজিদে নববী থেকে আবু বকর ওমর আবু ওবায়দা প্রমুখ তাৎক্ষণাৎ সেখানে ছুটে যান হযরত আবু বকর ইসলামের জন্য আনসারদের খেদমতের কথা উল্লেখ করেন এবং তাদেরকে বুঝলেন যে এই পরিস্থিতিতে কুরাইশ বংশ থেকে খলিফা নির্বাচিত নির্বাচিত হলে তা বিশ্বময় গ্রহণযোগ্য হবে।
চারটি দলের উদ্ভব ও বিতর্ক:
হযরত আবু বকরের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের নির্বাচন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায় অতঃপর সেখানে চার ধরনের দাবি উত্থাপিত হয়-
মুহাজিরগণ দাবি করেন যে তারা প্রথমে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন এবং ধর্মের জন্য সর্বপ্রকার ত্যাগ ও অত্যাচার ভোগ করেছেন। এমনকি নিজের আবাসভূমি পর্যন্ত ছেড়ে এসেছেন সুতরাং তাদের মধ্য থেকেই খলিফা নিযুক্ত হোক।
আনসারদের পক্ষ থেকে দাবি উত্থাপন করা হয় যে, ইসলামের দুর্দিনে তারা মুহাম্মদ (স.) এবং মুহাজিরদেরকে আশ্রয়দান করে ইসলামকে নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। সুতরাং তাদের মধ্য থেকেই খলিফা নির্বাচিত হওয়া যৌক্তিক।
এদিকে মদিনার প্রবীন ব্যক্তিবর্গ দাবি করলেন যে, আরবদের অভিজাত বংশ হচ্ছে কুরাইশ বংশ। রাসূলুল্লাহ (স.) কুরাইশ বংশের লোক ছিলেন। এই বংশের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। সেজন্য খিলাফতের দায়িত্ব অবশ্যই কুরাইশ বংশের লোকদেরকে দিতে হবে। তা নাহলে আরব বিশ্ব তা মানবে না।
মোহাম্মদ সালাহ সালামের কোন সন্তান না থাকলেও তার অতি আদরের কন্যা ফাতিমার জামাতা হযরত আলীর পক্ষে একটি দল আত্মপ্রকাশ করে। তাদের দৃষ্টিতে হযরত আলী মোহাম্মদ (স.) এর পিতৃব্য পুত্র এবং একমাত্র জীবিত কন্যা বিবি ফাতেমার স্বামী এবং তিনি মহানবী (স.) কর্তৃক লালিত-পালিত হয়েছিলেন। কাজেই হযরত আলী খেলাফত পাওয়ার ন্যায্য দাবিদার।
আবু বকরের খেলাফত লাভ:
হযরত আবু বকরের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে এবার আনসাররা মুহাজির এবং অ্যানসার দুই দলের পক্ষ থেকে দুইজন খলিফা নির্বাচনের প্রস্তাব করে। কিন্তু এক খাপে দুই তরবারি থাকতে পারে না মন্তব্য করে হযরত ওমর এর তীব্র বিরোধিতা করেন। অতঃপর হযরত আবু বকর হযরত উপস্থিত জনতাকে হযরত ওমর অথবা হযরত আবু উবায়দা এই দুইজনের যে কোনো একজনকে মুসলিম জাহানের খলিফা হিসেবে মেনে নেওয়ার জন্য প্রস্তাব করেন। এ সময় হযরত আবু উবায়দা হযরত আবু বকর কে সমর্থন দিয়ে নিজের নাম প্রত্যাহার করেন। একই সময়ে হযরত ওমর নিজের নাম প্রত্যাহার করার পাশাপাশি হযরত আবু বকরের বয়স, পদমর্যাদা এবং তার প্রতি রাসুলুল্লাহ (স.) এর যে সমর্থন এবং রাসুলের প্রতি তাঁর যে অকৃত্রিম আনুগত্য এবং ভালবাসা সেগুলো স্মরণ করে তিনি হযরত আবু বকরকে মুসলিম বিশ্বের প্রথম খলিফা হিসেবে ঘোষণা করে নিজে সর্বপ্রথম বায়াত গ্রহণ করেন।
হযরত ওমরের আনুগত্যের শপথ গ্রহণের সাথে সাথে উপস্থিত সকল আনসার ও মুহাজির স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই প্রস্তাব মেনে নেন। অতঃপর আবু ওবায়দা, উসমান, আব্দুর রহমানসহ শীর্ষ সকল সাহাবী হযরত আবু বকরের প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেন। এভাবে হযরত আবু বকর মুসলিম জাহানের খলিফা নির্বাচিত হন এবং খলিফা নির্বাচনসংক্রান্ত জটিল সমস্যার সমাধান হয়।
হযরত আবু বকরের বিশেষ যোগ্যতা:
হযরত আবু বক্কর এর বিশেষ কিছু যোগ্যতা থাকে খেলাফতের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে যেমন হযরত আবু বকর সার্বক্ষণিক রাসূলুল্লাহ সাল্লাম এর সহচর ছিলেন পবিত্র কুরআনে ও তার সম্পর্কে ইঙ্গিত রয়েছে 629 সালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাম হযরত আবু বক্কর কে মক্কার হাজীদের নেতা হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাম এর অসুস্থতার সময় সময় হযরত আবু বকর নামাজে ইমামতি করেছিলেন হযরত আবু বক্কর ছিলেন সাহাবীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মর্যাদাবান ও বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি রাসুল সালাম বলেছেন নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও আনুগত্যের আমি আবু বকরকে শ্রেষ্ঠ মনে কার রাসূলুল্লাহ সাল্লাম মসজিদে নববীতে একদিন বলেছিলেন আজ থেকে এই মসজিদের সব দরজা বন্ধ হয়ে যাক শুধু আপলোড করে দরজা খোলা থাক।
এসব এটাই ইঙ্গিত করে যে রাসুলের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার একমাত্র যোগ্য ছিলেন হযরত আবু বকর (রা) হযরত আবু বকর খলিফা নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (স.) এর ইচ্ছা বাস্তবায়িত হয়েছে অন্যদিকে মুসলিমরা গণতান্ত্রিক ধারাকে সমুন্নত করেছে।
আরও পড়ুন-
মুহাম্মদ (স.) এর নবুওয়াত লাভ এবং ঘটনাবহুল মক্কী জীবন
হযরত ওমর (রা.) এর নির্বাচন প্রক্রিয়া
খিলাফত নিয়ে যাতে পুনরায় কোন সমস্যা সৃষ্টি না হয় সেজন্য হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু তার মৃত্যুর পূর্বেই কয়েক জন সাহাবীর পরামর্শ গ্রহণ করেন এদের মধ্যে ছিলেন আব্দুর রহমান বিন আউফ হযরত ওসমান আলী তালহা জুবায়ের প্রমুখ তাদের সাথে পরামর্শ করে তিনি হযরত ওমরকে পরবর্তী খলিফা মনোনীত করেন কিন্তু তালহা এবং আব্দুর রহমান বিন আউফ ওমরের কঠোর মনোভাবের কারণে খলিফার প্রস্তাবে রাজি ছিলেন না তখন হযরত আবু বকর তাদেরকে বুঝালেন যে রাষ্ট্রের গুরুদায়িত্ব আর তার উপর অর্পিত হলেই তিনি কোমল হবেন তখন আবুবকর একটি আনুষ্ঠানিক সভা ডেকে ওমরকে পরবর্তী খলিফা হিসেবে ঘোষণা করেন জনসাধারণ তার মেনে নেন এবং আনুগত্যের শপথ নেন এভাবে ৬৩৪ সালে হযরত ওমর খলিফা নির্বাচিত হন।
হযরত ওসমান (রা.) এর নির্বাচন
10 বছর খিলাফত পরিচালনার পর 644 সালে ফজর নামাজ রত অবস্থায় মসজিদে মসজিদে ফজরের নামাজ রত অবস্থায় হযরত ওমর দ্বারা ছুরিকাঘাতে আহত হন আহত অবস্থায় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ হযরত ওমর এর কাছে এসে বললেন যে আপনি একজন উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করে যান তখন তিনি উত্তরে বললেন উত্তরাধিকারী মনোনীত করলে আবু বকরের অনুসরণ করা হবে আর না করলে রাসূলের অনুসরণ করা হবে এই বলে তিনি তাৎক্ষণিক কোনো উত্তরাধিকারী মনোনীত না করে বরং মৃত্যুর পূর্বে সদস্যবিশিষ্ট একটি নির্বাচনী পরিষদ গঠন করে যান তাদের উপর নির্বাচনের দায়ভার প্রদান করেন এই ছয় জন সদস্য হলেন হযরত ওসমান হযরত আলী হযরত তালহা হযরত জুবায়ের হযরত আব্দুর রহমান বিন আউফ এবং সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস
আব্দুর রহমান বিন আউফ কে এই নির্বাচনী পরিষদের প্রধান করা হয় যদি তিনজন একদিকে এবং বাকি তিনজন অন্যদিকে মদ দেন তাহলে আব্দুর রহমান বিন আউফ খলিফা নির্বাচনের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন এই ছয়জনের দক্ষতা এবং মর্যাদা প্রায় সমান হয় নির্বাচনে জটিলতা দেখা দেয় পরিস্থিতি জটিল হলে আব্দুর রহমান বিন আউফ নিজের দাবী প্রত্যাহার করে সমস্যা নিরসনে কাজ করেন জুবায়ের ওসমান আলী সমর্থন দেন সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস ওসমানকে আবার হযরত ওসমান আলী কে সমর্থন দেন আলী ওসমান কে সমর্থন দেন উভয়ের পক্ষে সমসংখ্যক সমর্থন পড়ায় আব্দুর রহমান বিন আউফ মদিনার অলিতে-গলিতে জনসমর্থন যাচাই করেন অতঃপর তিনি ঘোষণা দেন যে জনসমর্থনে হযরত ওসমান এগিয়ে এবং হযরত উসমানকে পরবর্তী খলিফা হিসাবে ঘোষণা করা হয় হযরত আলী এই প্রস্তাব মেনে নেন এভাবে হযরত ওসমান তৃতীয় খলিফা নির্বাচিত হন
হযরত আলী (রা.) এর নির্বাচন:
মিশরীয় বিদ্রোহীদের হহাতে হযরত ওসমানের শাহাদাতের পর পরবর্তী খলিফা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তিনটি বিদ্রোহী দলের উদ্ভব হয় কুফাবাসীর জবাইর (রা.) কে বসরাবাসীরা তালহাকে এবং দুষ্কৃতিকারী ইবনে সাবা এর নেতৃত্বে মিশরবাসীর হযরত আলী (রাঃ) কে সমর্থন দেয়। খলিফা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এ সাম্রাজ্যে বিশৃঙ্খলা অবস্থা তৈরি হয়। অবশ্য কালীন সময়েআব্দুল্লাহ সালালা সালামের সাহাবীদের মধ্যে হযরত আলী ছিলেন সবচেয়ে বেশি দক্ষ যোগ্য ও সম্মানিত ব্যক্তি। খলিফা হিসেবে তাকে প্রস্তাব করা হলে তিনি তালহা অথবা জুবাইর এর এর প্রতি আনুগত্যের শপথ নিতে প্রস্তাব দেন। অবশেষে হযরত উসমান হত্যার পঞ্চম দিনে মদিনার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অনুরোধে হযরত আলী খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মুসলিম বিশ্বের খলিফা হিসাবে মদিনার মসজিদে হযরত আলীর নাম ঘোষণা করলে সর্বসম্মতিক্রমে 656 খ্রিস্টাব্দের 24 শে জুন হযরত আলী খলিফা হিসেবে নির্বাচিত হন। হযরত তালহা এবং জুবায়ের হযরত আলীর এই নিয়োগ মেনে নিয়ে তার বায়াত গ্রহণ করেছিলেন।
খোলাফায়ে রাশেদিনের নির্বাচন গণতান্ত্রিক ছিল কিনা?
খোলাফায়ে রাশেদিনের নির্বাচন প্রক্রিয়াকে আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে তুলনা করাটা যৌক্তিক নয় বলে আমি মনে করি। আধুনিক গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটেছে মাত্র 2-3 শত বছর আগে। সেজন্য আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে দেড় হাজার বছরের খেলাফতের পুরোপুরি তুলনা করে মূল্যায়ন করা অযৌক্তিক।
তবে খোলাফায়ে রাশিদিন তৎকালীন বিশ্বের সর্বোত্তম প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হয়েছিলেন একথা অনস্বীকার্য। খোলাফায়ে রাশেদীন যেভাবে ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন এবং যেভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিলেন তৎকালীন বিশ্বের অন্য কোথাও কোন শাসক বা রাজা এই রকম পদ্ধতিতে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন বা রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিলেন ইতিহাসের এরুপ কোন প্রমাণ নেই। তৎকালীন সময়ে আরবের গোত্রপতি তথা শেখ নির্বাচনের ক্ষেত্রে বুদ্ধিমান বয়স্ক বিজ্ঞ ও সর্বদিক দিয়ে মর্যাদাবান ব্যক্তিকেই গোত্র-প্রতি নির্বাচন করা হতো। সে দৃষ্টিকোণ থেকে হযরত আবু বকর এর নির্বাচন ছিল তৎকালীন প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত গণতান্ত্রিক এবং গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি।
মুহাম্মদ (স.) এর হিজরত: কারণ ও ফলাফল
গণতন্ত্রের সংজ্ঞা
গণতন্ত্র শব্দটি দ্বারা প্রায়শই এমন একটি সরকারকে বোঝায় যেখানে জনগন ভোট দিয়ে নেতা নির্বাচন করে থাকে।
একটি গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা হল এমন এক ধরনের সরকার ব্যবস্থা যেখানে সর্বোচ্চ ক্ষমতা জনগণের উপর ন্যস্ত করা হয় এবং তাদের দ্বারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয় যা সাধারণত পর্যায়ক্রমিক অবাধ নির্বাচনের সাথে জড়িত থাকে।
আব্রাহাম লিংকনের মতে গণতন্ত্র হচ্ছে একটি জনগণের সরকার যা জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্যই গঠিত।
বিশ্লেষেণ:
এসব আধুনিক গণতন্ত্রের সংজ্ঞার মূল কথা হচ্ছে গণতন্ত্র হলো জনগণের জন্য জনগণের দ্বারা নির্বাচিত একটি সরকার ব্যবস্থা খোলাফায়ে রাশেদীনের উল্লেখিত নির্বাচন পদ্ধতি আলোচনা করলে আমরা বলতে পারি যে তারা জনগণের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন কিন্তু তাদের নির্বাচন প্রক্রিয়াটি আধুনিক গণতন্ত্রের সাথে সম্পূর্ণ সংগতিপূর্ণ নয়।
আব্রাহাম লিংকনের সংজ্ঞা অনুযায়ী গণতন্ত্রের তিনটি বৈশিষ্ট্য, সেগুলো মধ্যে দ্বিতীয় দুইটি খোলাফায়ে রাশেদীনের মধ্যে অবশ্যই ছিল শুধুমাত্র প্রথম শর্তটি আংশিকভাবে ছিল। খোলাফায়ে রাশেদীন সকল জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হননি অল্প কিছু নির্বাচকমণ্ডলী দ্বারা নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু তারা জনগণের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং তাদের কার্যক্রম জনগণের মতামতের ভিত্তিতেই পালিত হয়েছিল।
এখানে বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে যে উদ্দেশ্যে একজন গণতান্ত্রিক শাসক নির্বাচন করা হয় খলিফাগন সেই উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ রূপে বাস্তবায়ন করেছেন অর্থাৎ জনকল্যাণ, জবাবদিহিতা, সততা, যোগ্যতা, ন্যায়পরায়ণতাসহ আধুনিক গণতান্ত্রিক একজন শাসকের যে সমস্ত গুণাবলী থাকা দরকার সব কিছুই খলিফাদের মধ্যে ছিল।সুতরাং আধুনিক ভোট এবং ব্যালট ব্যবস্থার উদ্ভব সে যুগে না ঘটলেও আধুনিক গণতন্ত্রের যে চাহিদা, আধুনিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত একজন শাসকের যে দায়িত্ব-কর্তব্য সবকিছুই খলিফা গনের মধ্যে পাওয়া যায়।
চারজন খলিফার নির্বাচন চার রকমের ছিল। হযরত আবু বকরকে যাদের উপস্থিতিতে খলিফা ঘোষণা করা হয়েছিল তাদের কে যদি আমরা একটি নির্বাচকমন্ডলী হিসেবে বিবেচনা করি এবং জনগণের মতামত দেওয়াকে আধুনিক ভোট সাথে তুলনা করি তাহলে অবশ্যই সেটি একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ছিল।
হযরত ওমরের খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ সম্পূর্ণরূপে আবু বকর কর্তৃক মনোনয়নের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে। এর সাথে নির্বাচন প্রক্রিয়ার কোন সম্পর্ক নেই। যেখানে উল্লেখ করা উচিত যে গণতন্ত্র শুধু নির্বাচন প্রক্রিয়া নয় নির্বাচন এবং নির্বাচন পরবর্তী তার দায় দায়িত্ব জনগণের প্রতি জবাবদিহিতা সব কিছুই গণতন্ত্রের অংশ। তো হযরত ওমরের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র নির্বাচন প্রক্রিয়াটা অবলম্বন করা হয়নি কিন্তু তিনি তার ক্ষমতাসীন জীবনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সব কিছুই পরিচালিত করেছেন। মজলিসে শূরা, উচ্চ কক্ষ নিম্ন কক্ষ তথা মজলিসে আম এবং মজলিসে খাস ইত্যাদিসহ তাঁর সমস্ত কর্মকাণ্ড গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়েছে।
হযরত ওসমানের নির্বাচন প্রক্রিয়া আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে অনেকটাই সংগতিপূর্ণ। এখানে ছয় সদস্য বিশিষ্ট নির্বাচক মন্ডলীর পাশাপাশি জনমতের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল । ফলে হযরত ওসমান নির্বাচন প্রক্রিয়াটি আধুনিক গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে আমি মনে করি।
হযরত আলী এ নির্বাচন প্রক্রিয়া টি হযরত আবু বকর নির্বাচন প্রক্রিয়ার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। জটিল ও অস্থির রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে হযরত আলী খলিফার আসনে অধিষ্ঠিত হন। রাসূলুল্লাহ (স.) চারজন বিখ্যাত অনুচরের মধ্যে অবধারিতভাবে হযরত ওসমানের পরে হযরত আলীর অবস্থান ও মর্যাদা ছিল। হযরত ওসমানের পরে আলী খলীফা হবেন এটা ছিল একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এবং সবার মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা। এজন্য মদিনার প্রবীণ ব্যক্তিবর্গ হযরত আলীকে খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ করেন। মদিনার এসব প্রবীণ সাহাবীদেরকে যদি আমরা নির্বাচকমণ্ডলী হিসেবে গ্রহণ করি তাহলে হযরত আলীর নির্বাচনটি হযরত আবু বকর নির্বাচনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এবং এটি একটি সীমিত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া।
অতএব খোলাফায়ে রাশেদীনের কেউই জোরপূর্বক ক্ষমতা গ্রহণ করেননি। তারা সবাই কোনো না কোনোভাবে জনসমর্থনের ভিত্তিতেই খলিফা নির্বাচিত হয়েছিলেন। আধুনিক গণতান্ত্রিক বিচারে খোলাফায়ে রাশেদীনের নির্বাচন প্রক্রিয়াকে সীমিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলা যেতে পারে। আর তৎকালীন ব্যবস্থার ও বাস্তবতার প্রেক্ষিতে বিচার করলে খোলাফায়ে রাশেদীনের নির্বাচন প্রক্রিয়া ছিল সে যুগে সারা বিশ্বে সর্বোত্তম পদ্ধতি।
আরও পড়ুন-
হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর জীবন ও কর্ম: নবুয়ত লাভের পূর্ব পর্যন্ত
খলিফা আব্দুল মালিক।। Abdul Malik the Umayyad Caliph.
খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজ।। ইসলামের পঞ্চম খলিফা
[ প্রিয় পাঠক,
যে কোন ভূল-ত্রুটির সংশোধনী বা পরামর্শ থাকলে ওয়েব সাইটে পোস্টের নিচে কমেন্ট বক্সে লিখুন। ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্য, স্বাধীন-বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস, ইসলামের বিধি-বিধান সংক্রান্ত কোন প্রবন্ধ বা সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে লেখা কোন প্রবন্ধ প্রকাশ করতে চাইলে আপনার লেখা এবং পরিচিতিসহ মেইল করুন। ]
Md. Billal Hossain
B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka
BCS General Education
Lecturer
Department of Islamic History & Culture
Chandpur Govt. College, Chandpur.
No comments:
Post a Comment