দ্বৈত শাসনের যুগ এবং ছিয়াত্তরের মন্বন্তর
(The Era of Diarchy and the famine of 1176)
1765 সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক বাংলার দেওয়ানি লাভ বাংলার মানুষের জন্য ছিল এক অপ্রত্যাশিত এবং হতাশাব্যঞ্জক ঘটনা দেওয়ানি লাভের মাধ্যমে মূলত অবৈধ দখলদার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার বৈধ শাসন কে পরিণত হয় এবং বিদেশী একটি বেনিয়া গোষ্ঠী এই দেশের রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়ায় প্রাণ কোম্পানির আমলে এদেশীয় জমিmদারগণ ছিলেন মোগল সরকারের রাজস্ব সংগ্রহ কারী এজেন্ট বা প্রতিনিধি বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয় যে তখন জমিতে জমিদারদের কোন মালিকানা ছিল না বরং সরকারকে নিয়মিত খাজনা দেওয়ার শর্তে কৃষকরা জমির মালিকানা ভোগ করতেন এবং হস্তান্তর ও ক্রয় বিক্রয় করতে পারতেন। 1765 সালে কোম্পানি দেওয়ানি লাভের পর ভূমি ও রাজস্ব ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। 1765 থেকে 70 পর্যন্ত দ্বৈত শাসনের যুগ এদেশের মানুষের জন্য ছিল অত্যন্ত ভয়ানক একটি সময়।এই সময়ের চূড়ান্ত পরিণতি ছিল বাংলা 1176 এবং ইংরেজী 1770 সালের দুর্ভিক্ষ। যা ইতিহাসে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত। 1765-93 পর্যন্ত দফায় দফায় ভূমি নীতির পরিবর্তন ঘটে কিন্তু কোন পদ্ধতিতে এদেশের মানুষের তথা কৃষকের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি বরং এই ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রকৃত বড় বড় জমিদার পতন ঘটে উদীয়মান পুঁজিপতি ফটকাবাজদের উত্থান ঘটে এবং খোদকাস্তা রায়ত পাইকাস্তা রায়তে পরিণত হয়।
দ্বৈত শাসনের যুগ (1765-1772)
দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা
1765 সালে এলাহাবাদ চুক্তির মাধ্যমে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম এর নিকট থেকে লড ক্লাইভ গোত্র দেওয়ানি লাভের পর বাংলায় যে শাসন ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে তা ইতিহাসে দ্বৈত দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা হিসেবে পরিচিত। এলাহাবাদ চুক্তির ভিত্তিতে মুঘল সম্রাটকে বছরে 26 লক্ষ টাকা এবং বাংলার নবাব কে নিজামত তথা প্রশাসন পরিচালনা বাবদ বার্ষিক 53,86,131 টাকা 9 আনা প্রদানের শর্তে লর্ড ক্লাইভের নেতৃত্বে কোম্পানি বাংলা বিহার উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করে।
দেওয়ানি লাভের পর কোম্পানি বাংলা রাজস্ব নির্ধারণ ও আদায়ের ক্ষমতা লাভ করে এদিকে মীর জাফরের পুত্র নাজিম-উদ-দৌলা কে নবাব বানানো হয়। তার সাথেও কোম্পানিকে অবাধ বাণিজ্য করার সুযোগ দেওয়ার শর্ত থাকে।একদিকে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দখল অন্যদিকে একচেটিয়া বাণিজ্য কোন করে কোম্পানির প্রচুর অর্থ বৈভবের মালিক হয়। এদিকে নবাব নিজামত তথা শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ও ফৌজদারি ক্ষমতা লাভ করে। বাংলার শাসনে প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী হয় উঠে কোম্পানি নবাব হন নামমাত্র শাসক। একই সাথে দুই ধরনের শাসন কাঠামোকে দ্বৈত শাসন বা ডুয়েল সিস্টেম অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বলা হয়।
কোম্পানি দেওয়ানি লাভ করলেও দিওয়ানী পরিচালনার কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা তাঁদের ছিল না। সেজন্য তারা মুঘল প্রশাসক রেজা খান কে বাংলার এবং সেতাব রায়কে বিহারের নায়েবে দিওয়ান নিযুক্ত করে। এ সময় একজন কোম্পানীর প্রতিনিধি মুর্শিদাবাদে অবস্থান করে তাদের কাছ থেকে হিসাব বুঝে নিতেন। যেহেতু এলাহাবাদ চুক্তির মাধ্যমে বাংলার নবাব কে প্রদেয় টাকার পরিমাণ নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল সেহেতু বাংলার নবাবের 5386131 টাকা প্রদান করে বাকি সমস্ত টাকা কোম্পানির নিয়ে যেত বাংলার নবাব সিতাপুরা কে জনগণের মুখোমুখি করে বিড়ি কোম্পানির অর্থ হাতিয়ে নিতো। কোন প্রকার দায়িত্ব পালন করা করা ছাড়াই কোম্পানি অর্থ লাভ করতে থাকে। এটা ছিল ধরি মাছ না ছুঁই পানি মত অর্থাৎ কোম্পানি কোন কাজ না করে তার স্বার্থ হাসিল করে নেয়। এই দ্বৈত শাসনের যুগে কোম্পানি পেয়েছে দায়িত্বহীন ক্ষমতা আর বাংলার নবাব পেয়েছেন ক্ষমতাহীন দায়িত্ব।
দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা লর্ড ক্লাইভ, ভেরেলস্ট এবং কার্টিয়ারের আমলে 1764 -1772 পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। কোম্পানি দেওয়ানি লাভ করে প্রতি বছরই বাংলা রাজস্বের পরিমাণ বাড়াতে থাকে এতে দেশের কৃষকদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে। রেজা খান মুঘল পদ্ধতিতে রাজস্ব উত্তোলন করতে চাইলে কোম্পানি তা করতে দেয়নি। লর্ড ক্লাইভ কোম্পানির বাণিজ্য রাজস্ব বাড়াতে বেশ কিছু নীতি গ্রহণ করেন কিন্তু এদেশের কৃষকদের উপর করার মাত্রা বেড়েই চলে। সমগ্র বাংলাদেশ মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়।
দ্বৈত শাসন প্রবর্তনের কারণ:
দেওয়ানি লাভের পর কোম্পানি চেয়েছিল ধীরে ধীরে বাংলার শাসন ক্ষমতা দখল করতে।
রবার্ট ক্লাইভ মনে করতেন কোম্পানি সরাসরি শাসন ক্ষমতায় এলে অন্যান্য ইউরোপীয় বাণিজ্য গোষ্ঠীর মধ্যে এক তীব্র প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
কোম্পানির বাংলার রাজস্ব উত্তোলন বা প্রশাসন পরিচালনা সংক্রান্ত পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিলনা।
নিজামত এবং দিওয়ান পরিচালনার জন্য এবং রাজস্ব উত্তোলন করার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক ব্রিটিশ কর্মচারী তাদের ছিল না।
কোম্পানি যদি সরাসরি প্রশাসনের দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করে তাহলে প্রশাসনিক সমস্ত ব্যয়ভার কোম্পানিকে বহন করতে হবে যা 53,86,131 টাকার মধ্যে সম্ভব না।
ঐতিহাসিক র্যামসে মুরের মতে- কোম্পানি নিজে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান খোলস ছেড়ে সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হতে চায়নি।
দ্বৈত শাসনের প্রভাব/ফলাফল:
কৃষকদের চরম দুর্দশা:
কোম্পানি দেওয়ানি লাভ করলেও নিজেরা রাজস্ব আদায় না করে দেশীয় গোমস্তা ও আমিল নিয়োগ করা হয়। যারা অতিরিক্ত রাজস্ব দিতে সক্ষম হতো আমরা তাদেরকেই দায়িত্ব প্রদান করত। ফলে জমিদারেরা কার্যত ইজারাদারের পরিণত হয়। অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের লোভে ইজারাদাররা কৃষকদের উপর অত্যন্ত চড়া হারে কর নির্ধারণ করে। কোম্পানি দেওয়ানি লাভের পর প্রতি বছর করের মাত্রা বাড়তে থাকে। প্রতিবছর ক্রমবর্ধমান রাজস্ব দিতে গিয়ে এদেশের কৃষক সমাজ নিঃস্ব হয়ে যায়। পরবর্তীতে তাদেরকে জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়।
ব্যবসা-বাণিজ্যের ধ্বংস সাধন:
দ্বৈত শাসনের ফলাফল কোম্পানি একচেটিয়া ভাবে বিনাশুল্কে বাণিজ্য করায় দেশীয় বণিকরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আদালত তাদের প্রয়োজনীয় বাণিজ্য পণ্যগুলো কৃষকদের থেকে জোরপূর্বক কম দামে পণ্য ক্রয় করতো। আবার বিলেতি পণ্যের বাজার তৈরি করার জন্য দেশীয় পণ্য উৎপাদনের বাধা দেয়া হতো। এভাবে দেশীয় শিল্প বাণিজ্য ধ্বংস করা হয়। ভারতে কোম্পানির বাণিজ্য করার জন্য ইংল্যান্ড থেকে অর্থ বিনিয়োগ বন্ধ করা হয়। বাংলা থেকে রাজস্ব আদায় করে পণ্য ক্রয় করে কোম্পানি এই পণ্য বিক্রয়ের মাধ্যমে মুনাফা করে ইংল্যান্ডে পাঠাতে থাকে।
সামাজিক দুরবস্থা
রাজস্ব থেকে বাঁচার জন্য অনেক রায়ত বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়। কৃষকের পালানো ঠেকাতে কোম্পানি প্রতিবেশীর উপর ফেরারি টেক্স তথা না যাই পলাতক কর আরোপ করে। পেশা পরিবর্তন করে অনেকে ভিক্ষাবৃত্তি চুরি-ডাকাতি শুরু করে কিংবা ফকির-সন্ন্যাসীদের দলে যোগ দেয়। সে সময়কার বাংলা দুরবস্থা প্রসঙ্গে রবার্ট ক্লাইভ তার লেখায় বলেছিলেন- আমি শুধু এটুকু বলেছি যে পৃথিবীর আর কোন দেশে এত অরাজগতা, বিভ্রান্তি ঘুষ দুর্নীতি এবং উৎপীড়ন ও শোষণের ঘটনা কেউ শুনেনি বা দেখেনি যতটুকু হয়েছিল এই বাংলাদেশ
ছিয়াত্তরের মন্বন্তর:
সালে 1770 সালে অনাবৃষ্টি এবং খরার কারণে বাংলায় ফসলের হানি ঘটে। একদিকে ফসলের হানি অন্যদিকে দ্বৈত শাসনের করের বোঝা এই দুই কারণে বাংলায় এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। উল্লেখ্য যে এই দুর্ভিক্ষ বাংলার ইতিহাসে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (বাংলা 1176) নামে পরিচিত। । এই দুর্ভিক্ষে বাংলার প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ কোন মতে প্রায় অর্ধেক মানুষ না খেয়ে মারা যায়। 1766 সালে টাকায় তিন মণ চাল পাওয়া যেত। কিন্তু 69 সালে সেটা টাকায় 5 কেজিতে নেমে আসে। 1770 সালের দিকে বাজারে চাল পাওয়া যায়নি। জীবন বাঁচাতে মানুষ ছেলে মেয়ে বিক্রি করে দেয়। মানুষ গাছের পাতা এবং ঘাস খেয়ে জীবন ধারণের চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত মানুষ মানুষের মাংস ভক্ষণ করে।
দুর্নীতি ও লুটপাট
কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা নামে-বেনামে রাস্তা বাঁধ সেতু ইত্যাদি নির্মাণের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকা মুনাফা বাগিয়ে নেয় । কোম্পানির কর্মচারীরা ব্যাপকহারে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এ যুগে কোম্পানির কর্মচারীরা বাংলাকে লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করে।
কোম্পানির উদাসীনতা:
বাংলা এবং বাংলার জনগণের সম্পদ জোঁকের মতন শুষে খেলেও জনগণের জীবন রক্ষায় কোম্পানির কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের মত এত বড় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের পরেও কোম্পানি দেশের মানুষের উপর থেকে রাজস্ব মওকুফ করেনি বরং উত্তোলিত রাজস্ব পূর্বের বছরের চেয়ে বেশি ছিল।
আরও পড়ুন-
মূল্যায়ন:
এ ধরনের দ্বৈত শাসনব্যবস্থায় বাংলার সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি ও স্বাভাবিক জনজীবন ভেঙে পড়ে। এ প্রসঙ্গে রিচার্ড বাউচার একটি চিঠিতে লিখেছেন— "অত্যন্ত স্বেচ্ছাচারী শাসনের যুগেও যে বাংলা সমৃদ্ধ ছিল, আজ তা ধ্বংসের দারপ্রান্তে এসে পৌছেছে।" ইতিহাসবিদ জন কের মতে, "দ্বৈত শাসনব্যবস্থা বিশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থাকে আরও বিশৃঙ্খল এবং দুর্নীতিকে আরও দুর্নীতিগ্রস্ত করে তােলে।" ওয়ারেন হেস্টিংস সিলেট কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে 1772 সালে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটান।
আরও পড়ুন-
বক্সারের যুদ্ধ এবং নবাব থেকে ফকির হওয়া মীর মুহাম্মদ কাশীম আলী খান
আরও পড়ুন-
আকবরের ধর্মনীতিঃ দীন-ই-ইলাহী।। প্রেক্ষাপট, মূলনীতি এবং সমালোচনা
No comments:
Post a Comment