Breaking

Wednesday, 4 January 2023

বার্লিন কংগ্রেস: ইউরোপীয় আধিপত্যবাদের ভাগ-বাঁটোয়ারা

 বার্লিন কংগ্রেস (1878):  

ইউরোপীয় আধিপত্যবাদের ভাগ-বাঁটোয়ারা


কংগ্রেস ছিল ইউরোপীয় আধিপত্যবাদের ভাগবাটোয়ারা করার একটি প্রক্রিয়া। ক্রিমিয়ার যুদ্ধ পরবর্তী প্যারিস চুক্তিতে বলকান সমস্যার ন্যায় সঙ্গত, স্থায়ী ও শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়নি। ফলে প্রাচ্য সমস্যা থেকে থেকে চলতে থাকে। ক্রিমিয়ার যুদ্ধে হেরে যাওয়া এবং গ্লানিকর প্যারিস চুক্তি সম্পাদনের পর রাশিয়া তার প্রতিশোধ চরিতার্থ করার সুযোগ খুজতেছিল। 1877 সালে রুশ-তুর্কি যুদ্ধে রাশিয়া সে সুযোগটি পেয়ে যায়। রাশিয়া এককভাবে প্যারিস চুক্তি বাতিল করে দিয়ে তুরস্কের সাথে সান স্টিফানো চুক্তি স্বাক্ষর করে বলকান অঞ্চল একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করলে ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলো ক্ষিপ্ত হয়। অতঃপর শক্তিসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য  এবং আধিপত্যবাদের ভাগবাটোয়ারা করার জন্য ইউরোপীয় শক্তিগুলো রাশিয়াকে স্যান স্টিফানো চুক্তি আন্তর্জাতিক বৈঠকে উত্থাপন করতে বাধ্য করে। 1878 সালে বার্লিনে অটোভন বিসমার্ক এর সভাপতিত্বে বার্লিন কংগ্রেস সম্পন্ন হয়। 







বার্লিন কংগ্রেস এর প্রেক্ষাপট:


  1. প্রাচ্য সমস্যার স্থায়ী সমাধান না হওয়া:

ক্রিমিয়ার যুদ্ধে পূর্ব ইউরোপে রুশ আধিপত্যবাদের বিস্তার রোধ করলেও তার সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়নি। অন্যদিকে বলকান অঞ্চলের স্লাভ গ্রিক প্রভৃতি জাতিগুলোর আশা-আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ হয়নি। ক্রিমিয়ার যুদ্ধ পরবর্তী প্যারিস শান্তি চুক্তির মাধ্যমে প্রাচ্য সমস্যা একরকম জোর পূর্বক ধামাচাপা দেয়া হয়েছিল মাত্র। যা সুযোগ পেলেই মাথাচাড়া দিয়েে উঠেছে।


  1. বৃহৎ শক্তিবর্গের স্বার্থ দ্বন্দ্ব:

ক্রিমিয়ার যুদ্ধ পরবর্তী প্যারিস শান্তি চুক্তিতে বৃহৎ শক্তিবর্গের পারস্পরিক স্বার্থদ্বন্দ্বের সমাধান হয়নি। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে প্রতিটি দেশ তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কাজ করতে থাকে। 1869 সুয়েজ খাল চালু হলে বৃটেন তার স্বার্থ রক্ষার জন্য তুরস্ক সাম্রাজ্যের অখণ্ডতায় সচেষ্ট ছিল। ফ্রান্স কর্তৃক তুরস্কে বিনিয়োগকৃত অর্থের নিরাপত্তা বিধান করার জন্যও তুরস্ক সাম্রাজ্যের অখন্ডতা রক্ষা করা  ছিল ফ্রান্সের স্বার্থ। রাশিয়া তার হারানো আধিপত্য ফিরে পাওয়ার পথ খুঁজতে থাকে। অন্যদিকে অস্ট্রিয়া বলকান অঞ্চলে রুশ আধিপত্য মোকাবেলায় সচেষ্ট হয়। এরকম স্বার্থ দ্বন্দ্বের কারণে প্রাচ্য সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়নি। 


  1. তুরস্কে উদারনৈতিক সংস্কার গ্রহণ না করা:

প্যারিস প্যারিস শান্তি চুক্তিতে তুর্কি সরকারকে উদারনৈতিক সংস্কার সাধন করে নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত প্রজাবর্গের সন্তুষ্টি ও আনুগত্য অর্জন করে প্রাচ্য সমস্যার স্থায়ী সমাধান করার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তুরস্ক সরকার কোন উদারনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সচেষ্ট হননি। তুরস্ক সরকারের এরকম নিষ্ক্রিয়তা অন্যদিকে বলকান অঞ্চলের স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক চেতনা প্রাচ্য সমস্যা কে বাড়িয়ে দিয়েছিল। 

 

  1. বলকান রাজ্যগুলোর স্বাধীনতায় স্পৃহা:

বলকান অঞ্চলগুলোর স্বাধীনতা স্পৃহা থেকেই প্রাচ্য সমস্যার পুর্ণউদ্ভব ঘটে। বলকান অঞ্চলের স্লাভ জাতিগোষ্ঠী তুরস্ক সুলতান এর নাগপাশ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য উদগ্রীব ছিল।অন্যদিকে গ্রিস স্বাধীনতা লাভ করলেও তাদের  প্রাপ্ত সীমানায় তারা সন্তুষ্ট ছিল না। তখনো তুরস্ক সাম্রাজ্যে রয়ে যাওয়া রাজ্যগুলো  দখলে তারা সচেষ্ট ছিল।  


  1. মোলদাভিয়া ও ওয়ালাসিয়ার  ঐক্য:

1856 সালের প্যারিস শান্তি চুক্তিতে মোলদাভিয়া এবং ওয়ালাচিয়াকে বেশ কিছু সুবিধা দিয়ে তা তুরস্ক সুলতানের অধীনে রাখা হয়েছিল। কিন্তু মোলদাভিয়া এবং ওয়ালাচিয়ার জনগণ এটা মেনে নিতে পারেনি। মোলদাভিয়া এবং ওয়ালাচিয়ার অধিবাসীরা জাতিগত ভাষা ও সংস্কৃতিগত ভাবে একই জাতির লোক ছিল বলে তারা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আশা পোষণ করতা এবং তারা নিজেদেরকে রুমানিয়ান বলে পরিচয় দিত।  1859 সালের তারা ঐক্যবদ্ধভাবে আলেকজান্ডার কৌজাকে শাসনকর্তা নির্বাচিত করে এবং 1868 সালে তারা রুমানিয়া নাম ধারণ করে একই পার্লামেন্টের অধীনে আসে। এভাবে 1856 সালের চুক্তির বিরুদ্ধে গিয়ে রুমানিয়া ঐক্যবদ্ধ হয় যা তুরস্ক সুলতানের স্বার্থের পরিপন্থী ছিল।  



  1. তুরস্ক সরকারের অত্যাচার নীতি:

মোল্দাভিয়া এবং ওয়ালাসিয়ার ঐক্য ইউরোপে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা না দিলেও তুরস্ক সরকার এসব অঞ্চলে দমন-পীড়ন শুরু করে। তুরস্কে সরকারের দমন-পীড়ন ও অত্যাচার নীতি বলকান অঞ্চলগুলিতে দারুন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। বলকান অঞ্চলের খ্রিস্টান অধ্যুষিত দেশগুলো তুরস্ক সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে পারস্পরিক সহযোগিতা শুরু করে। অন্যদিকে স্লাভ অধ্যুষিত বলকান অঞ্চলের প্রতি রাশিয়ার অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল। এরকম পরিস্থিতিতে বলকান অঞ্চলগুলোর স্বাধীনতা অর্জনের জন্য এসব অঞ্চলে বহু গুপ্ত সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। 


  1. বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা স্বাধীনতা আন্দোলন: 

বসনিয়া এবং হার্জেগোভিনার জনগণ তুরস্ক সরকারের রাজকর্মচারী এবং জমিদারদের তারা নিপীড়িত নিষ্পেষিত হচ্ছিল। অন্যান্য অঞ্চলের মতো এখানেও স্বাধীনতা স্পৃহার জন্ম হয়েছিল। জাতীয়তাবোধ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে এসব অঞ্চলে তুরস্ক বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন দেখা দেয়। তুরস্ক সরকার জোরপূর্বক আন্দোলন দমন করতে চাইলে বলকান অঞ্চলের অন্যান্য শক্তিগুলো সহায়তায় তুরস্ক পরাজিত হয়।



  1. সার্বিয়া মন্টিনিগ্রোর ও বুলগেরিয়ার যুদ্ধ ঘোষণা:

বসনিয়া-হার্জেগোভিনার কাছে তুরস্ক সরকারের পরাজয় এর অব্যবহিত পরেই সার্বিয়া ও মন্টিনিগ্রো তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং বুলগেরিয়া তাদের সাথে যোগদান করে। অতঃপর সমগ্র বলকান অঞ্চলের তুরস্ক সাম্রাজ্য বিরোধী আন্দোলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। 


  1. ইউরোপীয় শক্তিবর্গের নিষ্ক্রিয়তা:

বিদ্রোহ বিশৃঙ্খলা ব্যাপক আকার ধারণ করলে তুর্কি বাহিনী বুলগেরিয়ায় প্রবেশ করে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষিতে ইউরোপের খ্রিস্টান অঞ্চলে ব্যাপক অসন্তোষ তৈরি হয়। কিন্তু রাশিয়া ব্যতীত ইউরোপীয় অন্য দেশগুলো এসময় নিষ্ক্রিয় থাকে। উত্তর আফ্রিকা এবং ভারতে ব্রিটিশ ভারতের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ডিজরেলী তুরস্কের বিপক্ষে যেতে চাইলেন না। তুরস্কের দুর্বলতা প্রকাশ করে রাশিয়াকে প্রবেশের সুযোগ দিয়ে তিনি তার ভারতীয় উপনিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত করতে চাইলেন না। 


  1. রাশিয়ার যুদ্ধ ঘোষণা:

বুলগেরিয়ায় তুর্কি আগ্রাসন এবং হত্যাকান্ডের ব্যাপারে একমাত্র রাশিয়া নিরপেক্ষ থাকলো না । ইউরোপের অন্যান্য বৃহৎ শক্তি দেরকে উপেক্ষা করে রাশিয়া 1877 সালের 24 এপ্রিল তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। যুদ্ধ ঘোষণার পূর্বেই রাশিয়া অস্ট্রিয়ার সাথে এক মৈত্রী চুক্তি স্থাপন করে অস্ট্রিয়াকে নিরপেক্ষ থাকতে রাজি করে এবং রাশিয়া এই যুদ্ধে রুমানিয়ার সাহায্য লাভ করে। 



আরও পড়ুন-

সুয়েজ খালের ইতিহাস এবং মিসরের স্বাধীনতা ও জাতীয় জীবনে সুয়েজ খালের প্রভাব




স্যান স্টিফানোর চুক্তি:

1877 সালের রুশ-তুর্কি যুদ্ধে রাশিয়া ভালো অবস্থান গ্রহণ করে। ককেশাস অঞ্চল ও দানিয়ুব অঞ্চলের সংঘটিত যুদ্ধে তুর্কি বাহিনী রুশ বাহিনীর কাছে পরাস্ত হয় এবং এক বছরের মধ্যেই তুরস্ক রাশিয়ার সাথে অত্যন্ত গ্লানিকর স্যান স্টেফানো চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়। চুক্তির শর্তসমূহ ছিল নিম্নরূপ- 


  1. প্যারিস শান্তি চুক্তি বাতিল করা হয়;

  2. সার্বিয়া মন্টিনিগ্রো ও রুমানিয়ার স্বাধীনতা করে;

  3. বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা রুশ অষ্ট্রিয়ার আধিপত্য হয়;

  4. দানিয়ুব নদী তে তুর্কি প্রাধান্য বিলুপ্ত হয়;

  5. আর্মেনিয়ায় শাসনতান্ত্রিক সংস্কার সাধন করতে তুর্কী সুলতান প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন;

  6. বাটুল কারাস সার্বিয়া এবং দবরুজা রাশিয়াকে ছেড়ে ধেয়া হয়;

  7. দানিয়ুব নদী থাকে ইজিয়ান সাগর, কৃষ্ণসাগর ও ম্যাসিডোনিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ড নিয়ে বৃহৎ বুলগেরিয়া নামে এক নতুন দেশ গঠন করা হয়। 



ইউরোপীয় বৃহৎ শক্তিবর্গের প্রতিক্রিয়া


ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পরাজয়ের পর প্যারিস শান্তি চুক্তির মাধ্যমে বলকান অঞ্চলে রুশ আধিপত্যবাদের বিস্তার নীতি প্রতিহত করা হয়েছিল।  কিন্তু সান স্টিফানো চুক্তি করতে তুরস্ককে বাধ্য করে রাশিয়া 1856 সালের প্যারিস শান্তি চুক্তির প্রতিশোধ গ্রহণ করেছিল। রাশিয়া কর্তৃক এককভাবে প্যারিস শান্তি চুক্তি নাকচ করায় অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোতে বিশেষ করে ইংল্যান্ডে প্রতিবাদ দেখা দিল।রাশিয়া এবং বুলগেরিয়া ব্যতীত বলকান অঞ্চলের অন্য কোন দেশও এই চুক্তিতে সন্তুষ্ট ছিল না। 


বলকান অঞ্চলে রাশিয়ার একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ায়ে এবং মেসিডোনিয়া পর্যন্ত কর্তত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় গ্রিস অসন্তুষ্ট হলো। রাশিয়া কর্তৃক বেসারবিয়া অধিকৃত হওয়ার কারণে রুমানিয়া ক্ষুব্ধ হয়। প্যারিস শান্তি চুক্তির এরকম পরিবর্তনে জার্মানি অস্ট্রিয়াও শঙ্কিত হয়ে পড়ে। ভূমধ্যসাগরের দিকে রাশিয়ার অগ্রযাত্রায় ইংল্যান্ড শঙ্কিত হয়ে উঠে। কেননা ভূমধ্যসাগরে আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলে বৃটেনের স্বার্থ নষ্ট হবে। 


বার্লিন কংগ্রেস 1878:

ইউরোপীয় শক্তিগুলোর এরকম  অসন্তুষ্টি স্যান স্টিফানোর চুক্তিকে পুনর্বিবেচনা করতে আন্তর্জাতিক বৈঠকে উপস্থাপন করার জন্য রাশিয়ার প্রতি চাপ প্রয়োগ করতে থাকে।  ইংল্যান্ড এ বিষয়ে সর্বাধিক ভূমিকা পালন করে। রাশিয়া প্রথমত ইউরোপীয় শক্তিবর্গের এরকম চাপ উপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু  ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ডিজরেলি এই বিষয়ে রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতে পারেন এরকম আশঙ্কায় রাশিয়া শেষ পর্যন্ত স্যান স্টিফানো চুক্তি আন্তর্জাতিক বৈঠকে পুনর্বিবেচনার জন্য উত্থাপন করতে সম্মত হয়। অতঃপর 1877 সালের জুন মাসে বার্লিনে জার্মান নেতা অটোভন বিসমার্ক এর সভাপতিত্বে আন্তর্জাতিক বৈঠকে সান স্টিফানো চুক্তির শর্তসমূহ পরিবর্তন করে বার্লিন চুক্তি নামে এক নতুন চুক্তি সম্পাদিত হয়। ইতিহাসে ইহাই বার্লিন কংগ্রেস নামে পরিচিত। 


 

বার্লিন কংগ্রেস 1878 এর শর্তাবলী

  1. সার্বিয়া কারস, বাটুম এবং আর্মেনিয়ার একাংশ রাশিয়া পাবে;

  2. সার্বিয়া, মন্টিনিগ্রো ও রুমানিয়ার স্বাধীনতা তুর্কি সুলতান মেনে নেন;

  3. বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা শাসনভার অস্ট্রিয়ার উপর থাকবে। অস্ট্রিয়া এই দুই দেশের মধ্যবর্তী স্থানে সৈন্য সমাবেশ করতে পারবে;

  4. বৃহৎ বুলগেরিয়া রাজ্য বিভক্ত করে পূর্ব রুমেলিয়া ও বুলগেরিয়া নাম নামে দুটি রাজ্য গঠিত হয় বুলগেরিয়া তুরস্কের অধীনে নামমাত্র থাকবে তারা নিজেরা শাসনকর্তা নির্বাচন করবে এবং স্বায়ত্তশাসনের অধিকার লাভ করবে 

  5. পূর্ব রুমেলিয়া তুরস্কের অধীনে থাকলেও তুর্কি সুলতান খ্রিস্টান ব্যতীত কাউকে রুমালিয়ার শাসনকর্তা নিয়োগ দিতে পারবেন না 

  6. এই বৈঠকে অপর একটি চুক্তির মাধ্যমে ইংল্যান্ড তুরস্কো সাম্রাজ্যের বাকি অংশ রক্ষায় সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সাইপ্রাস অধিকার করে নেয়।






বার্লিন কংগ্রেস এর ফলাফল 

  1. রাশিয়ার কূটনৈতিক পরাজয়: 

বার্লিন কংগ্রেস রাশিয়ার কূটনৈতিক পরাজয় ঘটেছে। এই চুক্তির মাধ্যমে রাশিয়ার দখলকৃত অধিকাংশ অঞ্চলেই তাকে ছাড়তে হয়। 


  1. তুরস্কের দুর্বলতা: 

তুরস্ক সরকার এবং তার সামরিক শক্তির দুর্বলতা প্রকাশ পায়। যদিও এই চুক্তিতে তুরস্ক প্রায় 30 হাজার বর্গমাইল এলাকা ফিরে পেয়েছিল। তুরস্ক কিছুকালের জন্য আবারো প্রাণ ফিরে পেল। স্যান স্টিফানো চুক্তির গ্লানি বার্লিন কংগ্রেস এর মাধ্যমে কিছুটা লাঘব করা সম্ভব হয়। নিজ সাম্রাজ্য রক্ষার ক্ষমতা তুরস্ক সরকারের নেই সেটা প্রমাণিত হয়।  


  1. বৃটেনের আত্মতুষ্টি: 

বার্লিন কংগ্রেস সম্পন্ন করে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন ডিজরেলি বেশ আত্মতুষ্টিতে ছিলেন। তিনি মন্তব্য করেছিলেন যে আমরা সসম্মানে শান্তি রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছি। তুরস্কের অখণ্ডতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইংল্যান্ড এই চুক্তিতে সাইপ্রাস দখল করে নিয়েছিল। 



  1. বৃহৎ বুলগেরিয়ার স্বাধীনতা  লোপ:

স্যান স্টেফানো চুক্তির ভিত্তিতে যে বৃহৎ বুলগেরিয়া গঠিত করেছিল বার্লিন কংগ্রেসে সেই বৃহৎ বুলগেরিয়াকে ভেঙে পূর্ব রুমেলিয়া এবং বুলগেরিয়া নামে দুটি রাষ্ট্র গঠন করা হয়। রাষ্ট্র দুটি বেশ কিছু ক্ষমতা ভোগ করলেও তুরস্ক সরকারের করদ রাজ্য হিসেবে থাকে।


  1. অস্ট্রিয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি:

বার্লিন কংগ্রেসে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে অস্ট্রিয়া। বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা উপর অস্ট্রিয়ার পূর্ণ কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেয়া হয়। এর মাধ্যমে স্লাভ জাতির স্বাধীনতা স্পৃহাকে দমন করা হয়। যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করে। 


  1. মেসিডোনিয়ার প্রতি অবিচার: 

মেসিডোনিয়া কে বুলগেরিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে আবারো তুরস্ক সুলতানের অধীনে রাখা হয়। একে বুলগেরিয়ার সাথে না রেখে অথবা স্বাধীনতা না দিয়ে চরম  অবিচার করা হয়েছিল। যেকারনে আরো দীর্ঘ কাল যাবৎ মেসিডোনিয়া তুর্কি বাহিনীর নিপীড়ন নির্যাতনের শিকার হয়। 


  1. জার্মানির গুরুত্ব বৃদ্ধি: 

বলকান অঞ্চলের জার্মানির সরাসরি কোন স্বার্থ ছিল না। জার্মান তখন অটো ভন বিসমার্ক এর নেতৃত্বে ইউরোপের উদীয়মান শক্তি। বার্লিন কংগ্রেসের মাধ্যমে ইউরোপের রাজনীতিতে জার্মানীর গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। 


  1. সাধু দালাল এর ভূমিকায় বিসমার্ক:

বার্লিন কংগ্রেস এর প্রাণপুরুষ ছিলেন অটো ভন বিসমার্ক। অটোভন বিসমার্ক এই বৈঠকে অত্যন্ত কৌশলী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। বিসমার্ক ইউরোপীয় কোন শক্তির সরাসরি পক্ষাবলম্বন করেননি। জার্মানি কোন পক্ষ অবলম্বন করলেই অপরপক্ষ যে ফ্রান্সের সাথে মিলিত হয়ে জোটবন্ধ হবে তা তিনি মাথায় রেখেই ফ্রান্সকে কোন শক্তির সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ দেননি। অটো ভন বিসমার্ক মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ইংল্যান্ডকে চাইলেও আশানুরূপ সাড়া না পেয়ে তিনি নিজেই এই মধ্যস্থতাকারীর দায়িত্ব পালন করেন। মধ্যস্থতা করতে গিয়ে অত্যন্ত কৌশলের সাথে তিনি কোন পক্ষ অবলম্বন করেন নি। এজন্য তাকে বলা হয় সাধু দালাল। বিসমার্কের কূটনৈতিক যোগ্যতার কারণে জার্মানি তখন আন্তর্জাতিক কর্মকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। 



আরও পড়ুন-

বলকান যুদ্ধ (1912-13): প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ড্রেস রিহার্সেল





বার্লিন কংগ্রেস এর সমালোচনা:

এতে কার্যত রাশিয়ার পরাজয় ঘটলেও বার্লিন কংগ্রেস ব্রিটেন ও ফ্রান্স অস্ট্রিয়া কারো জন্যই সাফল্যের পরিচয় বহন করে না। এই বৈঠকের মাধ্যমে প্রাচ্য সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়নি। বার্লিন কংগ্রেস বৃহৎ বুলগেরিয়া, বসনিয়া হার্জেগোভিনা এবং মেসিডোনিয়ার প্রতি যে অবিচার করা হয়েছিল তা পরবর্তীতে প্রথম বলকান যুদ্ধের সূত্রপাত করে। 



পরিশেষে বার্লিন কংগ্রেস ছিল ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলোর আধিপত্যবাদের ভাগবাটোয়ারা করার একটি বৈঠক। সান স্টিফানো চুক্তিতে রাশিয়া এককভাবে যে সুবিধা আদায় করেছিল তাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বলকান অঞ্চলে রুশ একক আধিপত্য বরাবরই ফ্রান্স, ব্রিটেন, গ্রিস, অস্ট্রিয়া, প্রভৃতি দেশের স্বার্থ বিরোধী ছিল। ফলশ্রুতিতে ইউরোপীয় শক্তিবর্গ রাশিয়াকে বাধ্য করে স্যান স্টিফানো চুক্তি পুনর্মূল্যায়নের জন্য। কাঙ্ক্ষিত সেই বৈঠকটি হয় উদীয়মান শক্তি জার্মানির রাজধানী বার্লিনে আর মধ্যস্থতা করেন উদীয়মান জার্মান নেতা অটোভন বিসমার্ক। তাঁর সভাপতিত্বে ইউরোপীয় আধিপত্যবাদের ভাগবাটোয়ারা সম্পন্ন হয়। রাশিয়াকে প্রতিহত করতে পারলেও বলকান অঞ্চলে নতুন করে অস্ট্রিয়া এবং তুরস্কের আধিপত্য স্বীকার করে নেয়া হয়েছিল। যা ছিল বসনিয়া-হার্জেগোভিনা বুলগেরিয়া রুমানিয়া এর প্রতি অবিচার। 




আরও পড়ুন-







No comments:

Post a Comment