Breaking

Saturday 21 January 2023

ইরানের সাংবিধানিক আন্দোলন


 ইরানের সাংবিধানিক আন্দোলন-1906

[Constitutional Movement of Iran]


সংবিধান আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কিন্তু বিশ্বের সাংবিধানিক বিকাশ ধারার ইতিহাস অনেক পুরনো ও সংঘাতময়। স্বৈরাচারী শাসকদের ক্ষমতার লাগাম টেনে ধরতে এবং তাদেরকে কতগুলো নিয়ম নীতির মধ্যে বেঁধে ফেলার জন্য যুগ-যুগান্তরে জনগণ যে আন্দোলন করে আসছে তারই ফলশ্রুতিতে বিশ্বের সংবিধানের সূত্রপাত ঘটে মুসলিম বিশ্বে পুরস্কার পর দ্বিতীয় দেশ হিসেবে একটি আধুনিক সংবিধান লাভ করে পারস্য।ক্রমবর্ধমান বিদেশি প্রভাব এবং প্রশাসনযন্ত্রের অযোগ্যতা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে মূলত সাংবিধানিক আন্দোলনের সূচনা হয় জামাল উদ্দিন আফগানি ওখানে ম্যালকম খানের  আন্দোলনের পটভূমি সৃষ্টিতে দারুন ভাবে সাহায্য করে উলেমা ও ব্যবসায়ী শ্রেণি এবং আধুনিক ভাবধারা পুষ্ট ইরানি ছাত্রসমাজ এই আন্দোলনকে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে ধাবিত করে।






কিন্তু পারস্যসীর এই  সফলতা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো মেনে নিতে পারেনি । এ সংবিধান তাদের স্বার্থে আঘাত করেছিল বলেই তারা এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে এবং তাদের নির্লজ্জ হস্তক্ষেপের ফলে এবং শাহ এর স্বৈরাচারী মনোভাবের ফলে পারসিকরা কিছুকাল পরেই সাংবিধানিক শাসন থেকে বঞ্চিত হয়। 




আরও পড়ুন-

মুহাম্মদ আলী পাশা এবং আধুনিক মিসর





ইরানে সাংবিধানিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপট:

শতাব্দী ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ইরানে সাংবিধানিক আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে ।বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এর সূচনা হয় এবং আন্দোলনের সফলতা লাভ করে। শাহী আমলে আমলের অর্থনৈতিক দুর্বলতা, দুর্নীতি এবং বিদেশীদের কাছে পারস্যের স্বার্থ সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেয়ার  যে প্রবণতা তারই প্রতিবাদ হিসেবে এই সাংবিধানিক আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। 


সাংবিধানিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপট কে আমরা দুটি ভাগে ভাগ করতে পারি-

  1. Intellectual Development বা বুদ্ধিবৃত্তি অগ্রগতি

  2. বাস্তব সমস্যা 

  3. প্রত্যক্ষ কারণ


A.Intellectual Development /বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতি:

  1. নিজস্ব চিন্তা চেতনা:

বিশ্লেষকরা মনে করেন পারস্যের জনগণ ইসলাম ধর্মের অনুসারী। তারা ন্যায়বিচার ও রাষ্ট্রীয় ন্যায়-নীতির সাথে পরিচিত ছিল। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীতে পারস্যের যে শাসনব্যবস্থা ও শাসক শ্রেণী ছিল তার সাথে ইসলামের কোন বিধান বা মূল্যবোধের মিল ছিল না। তাই জনগণ এটা মানতে পারেনি। এ অবস্থায় আলেম সমাজ জনমত তৈরি করতে এগিয়ে আসে। সমাজের একটা প্রভাব ছিল।তারা জনসম্মুখে প্রচার করলো যে; ক্ষমতাসীনরা ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাস করে না এবং এই শাসনব্যবস্থা ইসলাম সমর্থিত নয়। তাছাড়া এরা পরাশক্তিদের দ্বারা পরিচালিত মুসলিমদের শত্রু। তাদের ক্ষমতায় থাকার অধিকার নাই, এদের সরিয়ে দিতে হবে অথবা এদেরকে কতগুলো নিয়ম নীতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রন করতে হবে।এরকম নিজস্ব চিন্তা নিরিখে তারা মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। 


  1. আধুনিকতার প্রভাব:

নাসির উদ্দিন সাহেব সময়ে ইরানের উপরে বৃহৎ শক্তিবর্গের অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় এসময় টেলিফোন লাইন স্থাপন, রেলপথ নির্মাণ,ব্যাংক স্তাপন, খনিজ সম্পদ উত্তোলন, সামরিক বাহিনীর সংস্কার, তামাক কনসেশন ইত্যাদির মাধ্যমে সরকার যখন দেশের সম্পদ বিদেশীদের হাতে তুলে দিচ্ছে তখন ইরানে ব্যাপকহারে ইউরোপীয়দের আগমন ঘটে। ইউরোপীয়দের সাথে যখন ইরানীদের পরিচয় ঘটে তখন তারা বিদেশি রাজনীতি ও সভ্যতার ধারনা লাভ করে। নাসিরুদ্দিন শাহ পাশ্চাত্য শিক্ষার আদলে ‘দারুল ফুনুন’ নামক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। এর ফলে ইরানে পাশ্চাত্য ভাবধারার প্রসার ঘটে।ইরানি শিক্ষার্থীরা জ্ঞান অর্জনের জন্য যে ইউরোপে গমন করে। এ সকল আধুনিক শিক্ষিত ছেলেরা নিজ দেশএবং ইউরোপীয় সরকারব্যবস্থা সাথে তুলনা করে বুঝতে পারে যে নিজ বাসভূমে ইউরোপের মত কোন সংবিধান/শাসনতন্ত্র নাই। জনগণের কাছে জবাবদিহিতা কোন বিধান এখানে নেই। তারা মনে করে ইউরোপের উন্নতির মূলে রয়েছে সংবিধান এবং আইনের শাসন। পারস্যে এগুলোর উপস্থিতিই স্বৈরতন্ত্র আর পশ্চাৎপদতার মূল কারণ। 


  1. জামাল উদ্দিন আফগানি ও ম্যালকম খানের প্রভাব

ইরানের সংবিধান প্রণয়নে জামাল উদ্দিন আফগানি এবং ম্যালকম খানের দারুণ প্রভাব রয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জামাল উদ্দিন আফগানি এবং ম্যালকম খান লেখনীর মাধ্যমে তরুণ সমাজকে সতর্ক ও সংগঠিত করতে থাকেন। তারা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লেখা প্রচার করেন। শাহ এর স্বৈরশাসনের নাগপাশ থেকে জাতিকে মুক্ত করার দিকনির্দেশনামূলক ‘আল-কানুন’ নামক একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। ইরানের এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা। ছিল কিন্তু শাহ এই পত্রিকাটি নিষিদ্ধ করেন। এসময় কিছু সাহিত্য ও রচনা করা হয়। এগুলো শাসন ব্যবস্থার সচ্ছ চিন্তা ধারার জন্ম দেয়। নতুন প্রজন্ম এগুলো থেকে শাসনতন্ত্রের অনুপ্রেরণা পায়। 


  1. 1905 সালের রুশ জাপান যুদ্ধ

1905 সালে রুশ জাপান যুদ্ধে রাশিয়া জাপানের কাছে হেরে যায়। এই ঘটনা থেকে এই ঘটনা থেকে ইরানিরা শিক্ষা লাভ করে যে; জাপান একটি ছোট রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রশক্তি ও শৃঙ্খলা কারণেই রাশিয়ার বিপক্ষে তারা জিতেছে। পক্ষান্তরে পারস্যের শাসকদের দুর্বলতার কারণেই  রাশিয়ার কাছে তারা বার বার পরাজিত হচ্ছে। 


  1. গণআন্দোলনে রাশিয়ায় সংবিধান প্রণয়ন:

1905 সালে জাপানের কাছ থেকে রাশিয়ার হেরে যাওয়ার প্রেক্ষিতে রাশিয়ার জনগনের বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। রাষ্ট্রশক্তির দুর্বলতাকে তারা এর জন্য দায়ী করে। জনগণের বিপ্লবের মুখে জার সরকার নতি স্বীকার করে এবং 1905 সালে সংবিধান প্রণয়নে বাধ্য হয়। এই ঘটনা ইরানী জনগণের মনে রেখাপাত করে। তারা মনে করে যে; আন্দোলনের মাধ্যমে আমরাও শাহকে সংবিধান প্রণয়নের বাধ্য করতে পারি। 





  1. তামাক কন্সেশনের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন:

1890 সালের দিকে ইরান সরকার বৃটেনের Talbot কে 50 বছরের জন্য টোবাকো কন্সেশন দেয়। এর মাধ্যমে তামাক উৎপাদন, বিপণন ও বাজারজাতকরণের একচেটিয়া অধিকার লাভ করে। এর ফলে তামাক উৎপাদনকারী, ব্যবসায়ী এবং সেবনকারী সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ঘটনা তাৎক্ষণিকভাবে সকল মানুষকে উত্তেজিত করে তোলে। 1890 সালে জনগন ব্যবসায়ী এবং আলেম সমাজ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনের মুখে সরকার চুক্তিটি বাতিল করতে বাধ্য হয়।প্রথমবারের মতো ইরানি জনগণ উপলদ্ধি করে যে; আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারী শাহ নতী স্বীকারে বাধ্য হবেন। 

This concession affected the position of the tobacco growers, sellers, and smokers alike, and in Parsi, both men and women smoke regularly.  

A history of Persia, V-2, London, P-400




আরও পড়ুন-

প্রাক-মুসলিম মালয় জগতের উপর ভারতীয় ও চৈনিক প্রভাব: স্বরূপ ও তাৎপর্য






B.বাস্তব সমস্যা:

  1. অর্থনৈতিক মন্দা; 

  2. অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয়; 

  3. ঘনঘন ইউরোপ সফর অর্থের বিরাট অপচয়; 

  4. অভ্যন্তরীণ সম্পদ বৃদ্ধির কোনো পরিকল্পনা না করা;

  5. শাসকদের সীমাহীন দুর্নীতি;

  6. বিদেশিদের অবাধ সুবিধা প্রদান;

  7. বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ নেয়া; P. Sykes বলেন-

There  was a yearly deficite and the debt of the country was growing daily. A history of Persia, V-2, London, P-400

  1. প্রতিবছর করের মাত্রা বৃদ্ধি করা;

  2. প্রাদেশিক রাজস্ব ও গভর্নরের পদ নিলামে বিক্রি। সরকার রাশিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করতে না পারার কারণে উপকূলীয় অঞ্চল ব্যতিত সমগ্র অঞ্চলের রাজস্ব রাশিয়ারকে জামানত হিসেবে দেয়া হয়। এসব এলাকার প্রাদেশিক গভর্নর পদ অনেকসময় নিলামে বিক্রি করা হতো। যে বেশি রাজস্ব দেওয়া অঙ্গীকার করতো তাকেই প্রাদেশিক গর্ভনর নিয়োগ করা হতো। আর এই গভর্নররা তাদের নিজেদের টাকা উত্তোলনের জন্য নির্বিচারে কর বৃদ্ধি করত। সর্বোপরি নাসিরুদ্দিন শাহ এবং  মোজাফফর উদ্দিন শাহের সময়ে রাজকোষ প্রায় শূন্য হয়ে পড়েছিল। 

George Lenezwisky বলেন-

“At the time of Nasser-ed-din`s violent death in 1896, Parsia had an uncertain future and empty treasury.” Middle East in the world affairs, third edition California, 1962, P-33.


C. প্রত্যক্ষ কারণ: 

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জনগণ শাহী শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়। অতিরিক্ত ঋনের বোঝ জনগন ক্ষুধ্ব, দেশের সম্পদ বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়া এবং বিদেশীদেরকে বহুবিধ সুবিধা দেওয়া বিষয়টি ব্যবসায়ীরা মানতে পারেনি,আধুনিক ভাবধারাপুষ্ট ইরানি ছাত্র সমাজ স্বৈরাচারী শাসনমেনে নিতে পারছিল না। আলেম সমাজ ছিল শাহের প্রতি বীতশ্রদ্ধ। তাই সকল শ্রেণীর মধ্যে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ তাদেরকে আন্দোলনের দিকে ধাবিত করে। এ সময় বেশ কয়েকটি ঘটনা জন বিক্ষোভকে আরও উসকে দেয় । যেমন-


  1. স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ 

বিক্ষোভকে দমন করার জন্য হঠাৎ করেই মুজাফফরুদ্দীন শাহ স্বৈরাচারী আইনুদ্দৌলাকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। আইনুদ্দৌলা এবং তার পরিষদ স্বৈরাচারী কায়দায়  বিক্ষুব্ধ জনতাকে দমনের চেষ্টা করে। কিন্তুে এতে বিক্ষোভ আরো বেড়ে যায়। 

  1. ধর্মীয় অবমাননা:

এ সময় ইরানে পত্রিকায় মেসিউঞ্জ নামক একজন ব্রিটিশ ব্যক্তির ছবি প্রকাশিত হয়। এতে দেখা যায় তিনি পারস্যের ধর্মীয় পোশাক পড়ে নৃত্যানুষ্ঠানে বসে আছেন, নর্তকীরা নাচতেছে। আলেম সমাজ এটাকে তাদের জন্য অপমান এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বলে উল্লেখ করে। তারা বলে এটা পরিকল্পিত এবং এর পেছনে শাহের ইন্দন রয়েছে। 

  1. গোরস্থান ভেঙ্গে ফেলা:

এদিকে রাশিয়া কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত Discount Bank of Persia  এর ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে একটি গুরুস্থানের কিছু অংশ ভেঙে ফেলা হয়।  এতে কতগুলো লাশ বেরিয়ে পড়ে। এ ঘটনায় জনমনে মারাত্মক রোগের সৃষ্টি করে।


  1. ব্যবসায়ীদের বেত্রাঘাত:

এ সময় ইরানের হঠাৎ করে চিনির দাম বৃদ্ধি পায় এতে জনগণ বিক্ষোভ করলে আলাউদ্দৌলা চিনির দাম বাড়ার কারণ অনুসন্ধানের করার নির্দেশ দেন।অনুসন্ধান করে তারা অনুষদ অনুসন্ধান করে তারা কয়েকজন সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ীকে দায়ী করেন এবং তাদেরকে ধরে বেত্রাঘাত করা হয়। এই অপমান জনক ঘটনা ব্যবসায়ী মহলে দারুন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং এর মাধ্যমেই আনুষ্ঠানিক বিক্ষোভের সূত্রপাত ঘটে। 


সাংবিধানিক আন্দোলনের নেতৃত্ব:


কোন রাজনৈতিক দল বা একক কোনো সংগঠনের প্রচেষ্টায় পারস্যের সাংবিধানিক আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। বরং ইরানি বুদ্ধিজীবী ব্যবসায়ী উলেমা শ্রেণি এবং পশ্চিমা পুষ্ট আধুনিক ছাত্রসমাজ সমাজের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফসল ছিল ইরানের সংবিধান 


  1. আলেম শ্রেণি

  2. শ্রেণীর ব্যবসায়ী

  3. বুদ্ধিজীবী শ্রেণী

  4. আধুনিক ভাবধারা পুষ্ট ইরানি ছাত্রসমাজ







১ম  স্তর বা ছোট বাস্ত:

উপরিউল্লিখিত অবস্থার প্রেক্ষিতে 1905 সালের জুন মাসে পারস্যের আলেম সমাজের নেতৃত্বে ব্যবসায়ী সমাজ শাহ আব্দুল আলীমের মাজারে একত্রিত হয়ে এর প্রতিবাদ জানাতে থাকে। এসময় অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সরকার স্বনামধন্য আলেম সৈয়দ আব্দুল্লাহ  বিহানীর সহায়তায় আন্দোলন প্রশমিত করে এবং দায়ীদের শাস্তি দেওয়ার অঙ্গীকার করে।


কিন্তু বাস্তবে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাই আলেমদের নেতৃত্বে ব্যবসায়ীরা 1905 সালের ডিসেম্বরে মসজিদে শাহ তে একত্রিত হয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। এসময় আব্দুল্লাহ বিহানি এবং সাঈয়েদ মোহাম্মদভাই তাবাতাবাঈ জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে তোলেন। কিন্তু সরকারের ভাড়াটে আলেমরা হট্টগোল করে বিদ্রোহীদের সভা পন্ড করে দেয়। জনতা শাহ আব্দুল আজিম এর মাজারে অবস্থান নেয় এবং সেখানে তারা কর বৃদ্ধি, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা এবং নিপিড়নমূলক কাজের প্রতিবাদে তিনটি দাবি পেশ করে। 


  1. প্রধানমন্ত্রী আইনুদ্দৌলার পদত্যাগ

  2. তেহরানের গভর্নরের আলাউদ্দৌলার পদত্যাগ

  3. House of Justice বা আদালত খানা  প্রতিষ্ঠা 


এখানে House of Justice বা আদালত খানা বলতে মূলত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কথা বুঝানো হয়েছে। সরকার দাবি বাস্তবায়ন করার প্রতিশ্রুতি দিলে জনতা শান্ত হয়। ইতিহাসে এই আন্দোলন ছোট বাস্ত বলে পরিচিত। 


দ্বিতীয় স্তর বা বড় বাস্ত: 

সরকার দাবি পূরণে বাস্তব কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।1906 সালে সরকারবিরোধীরা স্মারকলিপিতে তাদের দাবিগুলো পুনরায় শাহ এর কাছে উপস্থাপন করে। কিন্তু শাহ এতে কর্ণপাত করেন নি। উলেমা শ্রেণি ও শাহপন্থিদের মধ্যে চারিদিকে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে। 10 জুলাই একজন প্রখ্যাত আলেম তেহরানে সরকার বিরোধী বক্তব্য দিলে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়।


গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে মাদ্রাসার ছাত্ররা বিক্ষোভ ও বাধা দিলে সৈন্যরা গুলি চালায়, এতে একজন ছাত্র মারা যায়। এর প্রতিবাদে ইরানের শীর্ষস্থানীয় 1000 আলেম 15 জুলাই রাজধানী ত্যাগ করে শিয়াদের নিকট পবিত্র পাহাড় কুমে হিজরত করে। তারা ঘোষণা করেছে সরকার তাদের দাবি না মানলে এবং বন্দীদের মুক্তি না দিলে তারা দেশ ত্যাগ করবেন।এই বিষয়টি ইরানি জনমনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। 

এর চার দিন পর 19 জুলাই রাজধানীর ব্যবসায়ী ও মধ্যবিত্ত মান্নার রাজধানীর ব্যবসায়ী মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত নাগরিক এবং ছাত্র সমাজ গ্রীষ্মকালীন ব্রিটিশ দূতাবাস চত্বরে অবস্থান ধর্মঘট শুরু করে এদের সংখ্যা প্রায় 12 থেকে 13 হাজার তারা সেখান থেকে তিনটি দাবি পেশ করে

  1. প্রধানমন্ত্রী আইন উদ্দৌলার পদত্যাগ

  2. কুমে হিজরতরত আলেমদের ফিরিয়ে আনা 

  3. আইন বিধি প্রণয়ন


এখানে আইন বিধি বলতে শাসনতান্ত্রিক বিধিবিধানের কথা বলা হয়েছে। এ আন্দোলনকে বলা হয় বড় বাস্ত।


সংবিধান প্রণয়ন:

পরিস্থিতির চাপে সরকার জনগণের কাছে নতি স্বীকার করে তাদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। আইনউদ্দৌলাকে বরখাস্ত করা হয় এবং 1906 সালের অক্টোবর মাসে শাহ রাজকীয় ফরমান জার করে সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণপরিষদ গঠনের ঘোষনা দেন। অক্টোবরে গণপরিষদ গঠন করে পার্লামেন্টের(মজলিশ) উদ্বোধন করেন ।


গণপরিষদ 51 ধারা বিশিষ্ট খসড়া সংবিধান প্রণয়ন করে তা পার্লামেন্টে উত্থাপন করে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও শাহ 1906 সালে 30 ডিসেম্বর সংবিধানে স্বাক্ষর করেন । ফলে ইরানবাসী একটি সংবিধান লাভ করে।


এর কিছুকাল পরই মুজাফফরুদ্দীন শাহ মারা যান। 1907 সালে তাঁর পুত্র মুহাম্মদ আলী শাহ 107টি  ধারা যুক্ত করে মোট 158 ধারা বিশিষ্ট সংবিধান প্রবর্তন করেন। এতে পরসিকদের মৌলিক অধিকার সহ নানা অধিকার সংরক্ষিত হয়।


তৃতীয় স্তর: 

সংবিধান শাহ এর ক্ষমতার লাগাম টেনে ধরে ছিল। মুহাম্মদ আলী শাহ ছিলেন স্বৈরাচারী এবং অযোগ্য শাসক। তিনি সংবিধান বানচাল করার জন্য চেষ্টা করেন। বৈদেশিক চুক্তি, করবৃদ্ধি, ঋণচুক্তি এগুলোর ক্ষেত্রে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের অনুমোদন নিতে হতো, যা শাহ এর অর্থ লাভের পথকে রুদ্ধ করেছিল।তাই তিনি সংবিধানের প্রতি ক্ষিপ্ত ছিলেন। রাশিয়া তৎপরতায তাকে উৎসাহিত করে।কারণ সংবিধান রাশিয়ার স্বার্থে আঘাত করেছিল। সংবাদপত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকায় পত্রিকাগুলো সরকারের সমালোচনা এবং অপকর্মের চিত্র তুলে ধরে। তাই শাহ সংবিধান নস্যাৎ করতে চেষ্টা করেন।1907 সালে তিনি সংবিধান বানচাল করার ষড়যন্ত্র করে ব্যর্থ হন। কিন্তু 1908 সালে শাসনতন্ত্র পন্থীদের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সাহায্য চাইলে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল লিয়াকভ এর নেতৃত্বে একটি বাহিনী প্রেরিত হয়। তারা পার্লামেন্ট বোমা হামলা করে, মজলিসের সদস্যদের গ্রেফতার করে এবং নির্বানসে পাঠায়।কিন্তু এ সময়ে জনগণ তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং বখতিয়ারী গোত্রের দুই নেতা সরদার আসাদ এবং জেনারেল ওয়ালি খান স্থানীয়দের নিয়ে রুশদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শুরু করেন। শাসনতন্ত্র পন্থীদের সাথে সরকারি বাহিনীর সংঘাত হলে সরকারি বাহিনী পরাস্ত হয়। শাহ রাশিয়াতে পলায়ন করেন এবং শাসনতন্ত্র রক্ষা পায়। 1909 সালের 15 ডিসেম্বর শাসনতন্ত্র পন্থীরা মোহাম্মদ আলী শাহের পুত্র আহমদ আলী শাহকে ক্ষমতায় বসায়। কেননা সংবিধানে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র স্বীকার করা হয়েছিল। সরদার আসাদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ওয়ালি খান প্রতিরক্ষা মন্ত্রী নিযুক্ত হন। এভাবেই পারস্যের সংবিধানের দ্বিতীয় স্তর সমাপ্ত হয় যদিও মাত্র দুই বছর পর 1911 সালে তারা পুনরায় সংবিধান হারায়। 


আরও পড়ুন-

তানজিমাত কী ? তানজিমাত যুগে অটোমান তুরস্কে গৃহীত সংষ্কারাবলী




পারস্যের সংবিধানের প্রতি পরাশক্তিগুলোর প্রতিক্রিয়া

পারস্যের সংবিধান অর্জন করার সফলতা পরাশক্তিগুলোর মেনে নিতে পারেনি। রাশিয়া শুরু থেকেই এর বিরোধী ছিল এবং সংবিধান বানচালের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। অন্যদিকে ব্রিটেন প্রথমদিকে পরিস্থিতির চাপে সংবিধানের প্রতি সমর্থন দিলেও তাদের স্বার্থ নষ্ট হতে থাকলে তারা এর বিরুদ্ধে চলে যায়। শাহকোনমতেই সংবিধান বা মজলিশকে সহ্য করতে পারছিলেন না। কেননা এটা তার ক্ষমতার লাগাম টেনে ধরে ছিল। বৈদেশিক চুক্তি, ঋণচুক্তি, কন্সেশন ইত্যাদির ক্ষেত্রে মজলিসের অনুমোদন নিতে হতো। এতে শাহ যেমন নিজের ইচ্ছামত অর্থ উপার্জনে ব্যর্থ হন তেমনি পরাশক্তিগুলোও কোন সুবিধা আদায় করতে পারল না। তাই শাহ রাশিয়ার প্ররোচনায় সংবিধান বানচালের চেষ্টা করতে থাকেন। 


অন্যদিকে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য ব্রিটেন তার এতদিনকার শত্রু রাশিয়ার সাথে মিত্রতা স্থাপন করে সংবিধান বানচালের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। 1907 সালে তারা উভয়ে মিলে  ‘Anglo-Russian Convention’ নামক গোপন চুক্তির মাধ্যমে পারস্যকে ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়। উত্তরে রাশিয়া এবং দক্ষিণে বৃটেনের কর্তৃত্ব স্বীকার করা হয়। দক্ষিণ-পশ্চিম এবং উত্তর-পূর্ব এলাকা হবে নিরপেক্ষ এলাকা। এ ব্যাপারে মজলিশ কিছুই জানতে পারেনি। যখন খবর প্রকাশিত হয় তখন গোটা ইরানের জনগণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। পত্রিকাগুলো এর তীব্র সমালোচনা করে। শাহের গাড়ীর উপর বোমা নিক্ষেপ করা হয়। এসময় শাহ কসাক ব্রিগেডের কিছু উশৃংখল যুবকদের সহায়তায় মজলিশে হামলা চালালে স্বেচ্ছাসেবকদের প্রতিরোধের মুখে তারা ব্যর্থ হয়ে যায়। শাহ ব্রিটেন ও রাশিয়ার নিকট থেকে চার লক্ষ পাউন্ড ঋণ নিতে চাইলে মজলিশ তা প্রত্যাখ্যান করে। ফলে রাশিয়া ও বৃটেনের কনসাল মজলিশকে হুমকি দেয় যে, শাহরে প্রতি বিরোধীতা চলতে থাকলে এই দুই দেশ শক্তি প্রয়োগ করতে বাধ্য হবে। 


মূলত এই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই 1908 সালে শাহ শাসনতন্ত্র পন্থীদের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সাহায্য চাইলে কসাক ব্রিগেডের কর্নেল লিয়াকভের নেতৃত্বে একটি বাহিনী পার্লামেন্ট আক্রমণ করে এবং শাসনতন্ত্র পন্থীদের গ্রেপ্তার, হত্যা এবং নির্বাসনে পাঠায়।  কিন্তু প্রদেশগুলো সংবিধানের পক্ষে অনঢ় ছিল। তাই তারা জনগণকে সাথে নিয়ে রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সরকার বিরোধীদের সঙ্গে শাসনতন্ত্র পন্থীদের সংঘর্ষ চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত সরকারি বাহিনী পরাস্ত হয়। শাহ রাশিয়াতে পলায়ন করেন। মজলিশ মোহাম্মদ আলী শাহের 12 বছরের ছেলে আহমদ আলীকে কাযার বংশের শাহ হিসেবে ঘোষণা করে। কেননা সংবিধানে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র স্বীকৃত ছিল। এভাবে 1909 সালে সংবিধান পুনপ্রতিষ্ঠিত হয়।


1909 সালের পর পরাশক্তিগুলো সাংবিধানিক সরকারকে মেনে নিলেও তারা ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে। তারা কখনোই সহায়তার হাত বাড়ায়নি। এ সময় মজলিশ বৃটেনের নিকট থেকে 25 লাখ ডলারের ঋণচুক্তি গ্রহণ করতে চাইলে তাদের দেওয়া শর্তের কারণে মজলিস তা প্রত্যাখ্যান করে। সরকার ইংল্যান্ডের একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে চাইলে দুই শক্তির বিরোধীতায় সেটাও সম্ভব হয়নি।


সরকার অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য 1911 সালে মে মাসে আমেরিকার অর্থনীতিবিদ মর্গান সুস্তারকে অর্থ উপদেষ্টা নিয়োগ করে। মর্গান সুস্তারের সিদ্ধান্তসমূহ রাশিয়ার বিপক্ষে গেলে রাশিয়া ক্ষিপ্ত হয়। রাশিয়া মর্গান সুস্তারের পদত্যাগ ও বহিষ্কার দাবি করে। কিন্তু মজলিস তা প্রত্যাখ্যান করলে 1911 সালে রাশিয়া পারস্য আক্রমণ করে। এই আক্রমণ ঠেকানোর ক্ষমতা তখন মজলিসের ছিল না। তাই বাধ্য হয়েই মজলিস মর্গান সুস্তারকে বরখাস্ত করে। রাশিয়ান সৈন্যদের উপস্থিতির ফলে সংবিধান ও মজলিশ অকার্যকর হয়ে যায়। তাই পরাশক্তিগুলো 1911 সালে শাসনতন্ত্র বানচাল করার  ষড়যন্ত্রে সফল হয়। 



আরও পড়ুন-

গ্রিসের স্বাধীনতা যুদ্ধ।। Greek War of Independence



আরও পড়ুন-

আমির দোস্ত মুহাম্মদ খান ।। Amir Dost Mohammad Khan





আরও পড়ুন-

দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় গণধর্মান্তর বা দ্রুত ইসলাম বিস্তারের কারণসমূহ


আরও পড়ুন-

রেজা শাহ পাহলভী এবং ইরানের আধুনিকায়নে তাঁর অবদান



আরও পড়ুন-

বাদশাহ আমানুল্লাহ ! আধুনিক আফগানিস্তানের পথিকৃৎ



ইরানের সাংবিধানিক আন্দোলন 
ইরানের সাংবিধানিক আন্দোলন 
ইরানের সাংবিধানিক আন্দোলন 
ইরানের সাংবিধানিক আন্দোলন 
ইরানের সাংবিধানিক আন্দোলন 




তথ্যসূত্র:

  1. সফিউদ্দিন জোয়ারদার,  আধুনিক মধ্যপ্রাচ্য (২য় খন্ড)

  2. প্রফেসর মোঃ আব্দুল করিম ও ড. মোঃ আব্দুল কালাম,আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের ইতিহাস

  3. ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান, আধুনিক মুসলিম বিশ্ব: তুরস্ক-ইরান-আফগানিস্তান





Md. Billal Hossain

B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka

BCS (General Education)

Lecturer

Department of Islamic History Culture




No comments:

Post a Comment