মুঘল আমলের ইতিহাসের উৎসসমূহ
(Sources of Mughal History)
বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে উৎস বা উপাদান গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য বলা হয় History is based on sources। উৎসের ভিত্তই ইতিহাসের নির্ভরযোগ্যতা নির্ধারিত হয়। তথ্য-উপাত্ত না থাকলে সঠিক ইতিহাস রচনা সম্ভব হয়না। এজন্য ঐতিহাসিকগণ ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে উপাদানের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। বিভিন্ন দলিল-দস্তাবেজ, লিপিমালা, শিলালিপি, মুদ্রা এবং সমসাময়িক গ্রন্থ ইত্যাদি একজন ঐতিহাসিকের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দিল্লি সালতানাত এবং মুঘল আমলের ইতিহাস রচনার জন্য ঐতিহাসিকগণ যথেষ্ট প্রমাণাদি উপস্থাপন করেছেন। নিম্নে মুঘল আমলের ইতিহাস রচনার উৎস সমূহ আলোচনা করা হলো।
মুঘল আমলের ইতিহাস রচনার উৎস সমূহকে আমরা কয়েকটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করতে পারি। যেমন-
সমসাময়িককালে রচিত গ্রন্থাবলী
পান্ডুলিপি
সরকারি চিঠিপত্র ও নথিপত্র
জীবনচরিত
বিদেশি পর্যটকদের বিবরণী এবং
আইন ও রাজনীতিমুলক গ্রন্থ
মুদ্রা শিল্পকর্মসাম্প্রতিককালের প্রস্তকাদি ইত্যাদি
সমসাময়িককালে রচিত গ্রন্থাবলী:
মুঘল আমলের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকগণ সমসাময়িক যে সমস্ত গ্রন্থের সহায়তা দিয়েছেন সেগুলো হলো-
আবুল ফজল রচিত আইন-ই-আকবরী এবং
আকবরনামা। এই দুটি গ্রন্থ সম্রাট আকবরের রাজত্বকালের কেন্দ্রীয় প্রশাসন ও আইন কানুন সম্পর্কে বিশদ বিবরণ রয়েছে।
আব্দুল হামিদ লাহোরীর বাদশাহনামা। এতে শাহজাহানের রাজত্বকাল সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে।
নিজাম উদ্দীন রচিত তবকাত ই আকবরী;
আব্দুল কাদের বাদায়ুনি রচিত মুন্তাখাব উত তাওয়ারিখ; উল্লেখিত দুটি গ্রন্থে আকবরের রাজত্বকাল সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে।
মুতামিদ খানের ইকবাল নামা;
তারিখ ই শাহজাহানি;
চন্দ্রাভন ব্রাহ্মণ রচিত চাহার চামন
উল্লেখিত তিনটি গ্রন্থে সম্রাট শাহজাহানের শাসন ব্যবস্থার বর্ণনা রয়েছে।
গোলাম হোসেন তাবাতাবাই রচিত সিয়ার-উল-মুতাখখিরিন;
দানিশমান্দ খানের বাহাদুরশাহনামা;
মুহাম্মদ কাজিম রচিত আলমগীরনামা;
আবুল কাশেম হিন্দুশাহ ফিরিস্তা রচিত গুলশানিই ইব্রাহিমী;
মির্জা নাথান (সিতাব খান) বিরচিত বাহারিস্তান-ই-গাইবী;
মির্জা মাহাদী রচিত জাহানকুশায়ে নাদিরী;
শাকি মুস্তায়িদ খানের মা’সির ই আলমগিরী;
কাফি খান রচিত মুন্তাখাব উল্ লুবাব;
মোহাম্মদ হোসাইন রচিত দরবার-ই আকবরী;
রুস্তম আলী রচিত তারিখ ই হিন্দ;
হামিদ উদ্দিনের আহকাম ই আলমগীরী;
হাসান আল সাজ্জি রচিত ফাওয়ায়েদুল ফুয়াদ;
জীবনচরিত:
মুঘল আমলের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে তিনটি বিখ্যাত এবং অথেন্টিক জীবনী গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায় সেগুলো হলো-
সম্রাট বাবর কর্তৃক রচিত আত্মজীবনী তুজুক-ই-বাবুরী বা বাবরনামা;
আমরা জাহাঙ্গীর অসীত আত্মজীবনী তুজুক ই জাহাঙ্গীরী জাহাঙ্গীরনামা;
গুলবদন বেগম কর্তৃক রচিত হুমায়ুননামা।
পান্ডুলিপি
মুঘল আমলের ইতিহাস সংক্রান্ত যে সমস্ত পান্ডুলিপি আবিষ্কৃত হয়েছে কিন্তু গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি সেগুলো হচ্ছে-
শাকির খানের খানের তারিখ শাহজাহানী;
দস্তুরুল আমল ই আওরঙ্গজেবী;
মিরাট উল ইস্তিলা (ফার্সি পান্ডুলিপি);
শাকির খান রচিত তারিখ ই শাকিরখানী;
আলী মুহাম্মদ খানের মিরাট ই আহমদী;
আব্দুল্লাহ রচিত তারিখ ই দাউদী;
জিয়াউদ্দিন বারানী রচিত ফতোয়া-ই-জাহান্দারি;
জওহর আফতাবচি রচিত তারিখে ই হুমায়ুন শাহী;
ইত্যাদি পান্ডুলিপি পাওয়াগেছে যেগুলোতে মুঘল আমলের ইতিহাস সংক্রান্ত তথ্য উপাত্ত রয়েছে।
আরও পড়ুন-
বক্সারের যুদ্ধ এবং নবাব থেকে ফকির হওয়া মীর মুহাম্মদ কাশীম আলী খান
সরকারি চিঠিপত্র ও নথিপত্র:
সরকার ও প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে কেন্দ্র থেকে প্রদেশের পর্যটন কেন্দ্রের চিঠিপত্র আদান প্রদান করা হয় মুঘল আমলের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সরকারি চিঠিপত্র ও নথিপত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়। মুঘল আমলের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক চিঠিপত্রের বেশিরভাগই বিলুপ্ত হয়ে গেছে যে সমস্ত চিঠিপত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল
আখবারাত: এতে সরকারি কর্মচারী নিয়োগ পদ্ধতি বেতনের হার, ছুটি মঞ্জুরী রাজস্ব হিসাব প্রশাসনিক সংস্কার ইত্যাদি তথ্য আছে
ইনশা ই হরকরান: মুন্সি হরকরান লেখা, এতে মুঘল রাজস্ব বিষয়ক আলোচনা রয়েছে
আরজেদাশত: একই শাহজাহান এর নিকট প্রেরিত মুজাফফর খানের চিঠিপত্রের সংকলন এতে সম্রাট শাহজাহানের বিচার ব্যবস্থার বর্ণনা রয়েছে
রুকাত ই আলমগীরী এতে আরঙ্গজেব এর 181 টি চিঠিপত্রের পাওয়া যায় এতে মোগল শাসন ব্যবস্থার বর্ণনা রয়েছে
বিদেশি পর্যটকদের বিবরণী
মুঘল আমলের ইতিহাসের উৎস হিসেবে বিদেশি পর্যটকদের বিবরণী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। মুঘল আমলে বহু বিদেশী পর্যটক ভারতে এসেছিলেন। ভারত সফর করে তারা তাদের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তাদের বর্ণনাতে মুঘল আমলের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান তথ্য উপাত্ত রয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিদেশি পর্যটক হলেন-
ফাদার মনসারেট আকবরের আমলে;
হকিন্স জাহাঙ্গীরের আমলে;
স্যার টমাসরো (1615-18);
এডওয়ার্ড টেরি (1616-19);
দ্যালিয়েট (1625);
পোলসারেট (1622);
বার্নিয়ার (1856)
মানুচি
রেলফ ফিচ প্রমুখ
আইন ও রাজনীতিমুলক গ্রন্থ ও পান্ডুলিপি
ফজল ইস্পাহানি রচিত সুলুক উল মুলক
আলী বিন শাহাব হামলানী রচিত জাখিরাতুল মূলক
গাজ্জালীর সুলুকুল সালতানাত
আল মাওয়ারদি রচিত আহকাম ই সুলতানিয়া
ইবনে খালদুনের আল মুকাদ্দিমা
মুদ্রা ও শিল্পকর্ম
মুঘল আমলের বিভিন্ন সম্রাটের প্রচলিত মুদ্রা এবং শিল্পকর্ম মুঘল আমলের অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাসের উপাদান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করে থাকে।
সাম্প্রতিককালের প্রস্তকাদি ইত্যাদি
উল্লিখিত মধ্যযুগের উৎসসমূহের উপর ভিত্তি করে আধুনিক যুগে এশীয় এবং ইউরোপিয়ান বহু ঐতিহাসিক ইংরেজি, বাংলা এবং ফারসি ভাষায় বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। যেগুলু বর্তমান শিক্ষার্থী ও গবেষকদের অধ্যয়ন ও গবেষণার উৎস।
ইতিহাস সাহিত্য তথা গল্প কবিতা বা উপন্যাস নয়। ইতিহাস হচ্ছে অতীতের ঘটে যাওয়া বিশেষ কিছু ঘটনার বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনা। ইতিহাসের প্রতিটি বক্তব্যের পেছনে তথ্য-প্রমাণ থাকতে হয়। তথ্য প্রমাণ ব্যতিত ইতিহাস লিখা হলে সেটি ইতিহাস নয়, সেটি বটতলার পুঁথি।
আরও পড়ুন-
আরও পড়ুন-
.
Md. Billal Hossain
B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka
BCS General Education
Lecturer
Department of Islamic History & Culture
Chandpur Govt. College, Chandpur.
No comments:
Post a Comment