Breaking

Friday 27 January 2023

Sir T. S. Raffles কর্তৃক সিঙ্গাপুর প্রতিষ্ঠা, তাঁর সংস্কার সমূহ এবং বিশ্ববানিজ্যে সিঙ্গাপুরের গুরুত্ব



 Sir T. S. Raffles কর্তৃক সিঙ্গাপুর প্রতিষ্ঠা, তাঁর সংস্কার সমূহ এবং বিশ্ববানিজ্যে সিঙ্গাপুরের গুরুত্ব

(The founding of Singapore by Sir T. S. Raffles and its Reforms)


Sir T. S. Raffles আধুনিক সিঙ্গাপুরের গোড়াপত্তনকারী। ১৮১৯ সালে থমাস স্টামফোর্ড রেফেলস কর্তৃক সিংগাপুর প্রতিষ্ঠা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্য ক্ষেত্রে বৃটিশ আধিপত্যবাদের শুভ সূচনা করে। 1819 সালে বর্তমান সিঙ্গাপুরের এই স্থানটি দখল করার পর সিঙ্গাপুর হয়ে উঠে সমগ্র প্রাচ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ও  বৃটিশ নৌ ঘাঁটি। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ব্রিটিশ শক্তির প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠে সিঙ্গাপুর।  ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সিঙ্গাপুর ছিল এই অঞ্চলের বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক লেনদেনের প্রধান ঘাঁটি, সামরিক শক্তির প্রধান কেন্দ্র। সিঙ্গাপুরের প্রাচীন নাম তুমাসিক।  স্টামফোর্ড রাফেলস তুমাসিক অবতরন  করার পর সেখানকার শাসকের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে বেশ কিছু সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করেন যা আধুনিক সিঙ্গাপুর এর ভিত্তি স্থাপন করেছে। 









টি. এস. রেফেলস এর পরিচয়:

পুরো নাম Sir Thomas Stamford Bingley Raffles। তার জন্ম 6 জুলাই, 1781। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংল্যান্ড অফিসে ১৪ বছর বয়সে টি. এস. রেফেলস কাজে যোগদান করেন। ১৮০৫ সালে ২৪ বছর বয়সে সহকারী সচিব হিসেবে তিনি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ব্রিটিশ কলোনী  পেনাং এ যোগ দেন। নেপোলিয়ন যুগে যুদ্ধের সময় হস্তান্তরিত ডাচ উপনিবেশ জাভায় তিনি  ১৮১১-১৮১৬ সাল পর্যন্ত লেফটেন্যান্ট গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।  তিনি ব্রিটিশ পূর্ব ভারতীয় প্রশাসক এবং বন্দর রাষ্ট্র সিঙ্গাপুরের  প্রতিষ্ঠাতা। ১৮১৯ সালে তিনি সিঙ্গাপুর প্রতিষ্ঠা করেন। সিঙ্গাপুর প্রতিষ্ঠার পর ১৮২৪ পর্যন্ত তিনি এখানে দায়িত্ব পালন করেন তিনি একজন প্রাচ্যবিদ হিসেবে সুপরিচিত।মালয়ে অবস্থানকালে তা অর্জিত জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা মালয়ের প্রকৃত ইতিহাস সংক্রান্ত অনেক উপাদান তিনি লন্ডনে প্রকাশ করেন। ব্রিটিশদের প্রাচ্য বাণিজ্যে তার অবদান অবিস্মরনীয়। পাশাপাশি তিনি একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বও ছিলেন। তিনি লন্ডন চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠাতায় প্রত্যক্ষ সহায়তা প্রদান করেন  এবং এর প্রথম প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হয়েছিলেন। 1816 সালে তিনি নাইট উপাধি লাভ করেন। 1826 সালে মস্তিষ্কের টিউমার রোগে তিনি মারা যান।  






সিঙ্গাপুরের পরিচিতি: 

সিঙ্গাপুর শব্দের অর্থ হচ্ছে সিংহের শহর। সিঙ্গাপুর শব্দটি মালয়েশিয়ান শব্দ সিঙ্গাপুরা (Singapura) থেকে এসেছে। এর মধ্যে Singa শব্দটি সংস্কৃত Simah  থেকে এসেছে যার অর্থ সিংহ আর Pura শব্দটির অর্থ হচ্ছে শহর বা সিটি। সুতরাং সিঙ্গাপুর শব্দের অর্থ হচ্ছে সিংহের শহর। সিঙ্গাপুরের প্রাচীন নাম ছিল তুমাসিক। স্যাঙ নিলা উতামা এর নাম তুমাসিক থেকে সিঙ্গাপুর রাখেন 1299 সালে। 


মালয় কাহিনী অনুসারে শ্রী বিজয়া রাজ্যের রাজপুত্র স্যাঙ নিলা উতামা বিনটান দ্বীপে পশু শিকারে বের হলে পাহাড়ে উঠে তিনি একটি  দ্বীপ দেখতে পান। সাথে থাকা মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে তিনি জানতে পারেন দ্বীপটির নাম তুমাসিক। পরবর্তীতে তিনি জাহাজ নিয়ে তুমাসিকের দিকে যাত্রা করেন। ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে তুমাসিক পৌঁছার পর তিনি প্রথমে সিংহের মত একটি প্রাণী দেখতে পান। তিনি এখানে বসবাস শুরু করেন এবং তিনি এই জায়গার নাম রাখেন সিঙ্গাপুর বা সিংহের শহর। কিন্তু বাস্তবে সিঙ্গাপুরে কোন সিংহ নেই । সেহেতু তিনি যা দেখেছিলেন সেটি ছিল মূলত মালয়িয়ান বাঘ। 




রেফেলস কর্তৃক সিঙ্গাপুর প্রতিষ্ঠার পটভূমি



দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় রেফেলসের আগমন:

24 বছর বয়সে 1805 সালে  রেফেলস পেনাংয়ে কাজ শুরু করেন। ১৮৭৮ সালের অসুস্থতা হেতু তিনি মালাক্কায় আগমন করেন। মালাক্কা সম্পর্কে একটি বিশদ প্রতিবেদন তৈরি করে তিনি তা পেনাং এর  ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সিতে পাঠান। তিনি এ কথা বুঝাতে সক্ষম যে মালাক্কা দখলে না রাখলে এখানে অন্য কোন ইউরোপীয় শক্তি তা দখল করবে। ফলে পেনাং এর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে।  ১৮১১ সালে ব্রিটিশরা যাবা দখল করলে স্টামফোর্ড রেফেলস কে জভার লেফটেন্যান্ট গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তিনি সেখানে বেশ বৈপ্লবিক সংস্থার চালু করেছিলেন। 1815 সালে ভিয়েনা চুক্তির ভিত্তিতে জাভা  ডাচদেরকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। অতঃপর রেফেলস নতুন বন্দর প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেন। 



নতুন বন্দরের প্রয়োজনীয়তা:

চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্রিটিশ বাণিজ্য স্বার্থ রক্ষার জন্য অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্রিটিশদের একটি উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় 1786 সালে ব্রিটিশরা পেনাং দখল করে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করে। এটি ছিল মালয় অঞ্চলে ব্রিটিশদের প্রথম সফল ও সক্রিয় পদক্ষেপ। এই অঞ্চলে বাণিজ্যিক গুরুত্বের কারণে ১৮০৫ সালে কোম্পানি সরকার পেনাংকে চতুর্থ পেসিডেন্সির মর্যাদা দেয়। কিন্তু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সক্রিয় বাণিজ্য কেন্দ্র জাভা এবং জাভার পূর্বাঞ্চলের দ্বীপপুঞ্জ থেকে পেনাং এর দূরত্ব অনেক বেশি হওয়ার কারণে পেনাং কে কেন্দ্র করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ ছিল অসম্ভব। ১৮০৮ সালে রেফেলস শিকার করেছিলেন যে বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে মালাক্কার গুরুত্ব অনেক বেশি। তাছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ডাচদের আধিপত্য খর্ব করা এবং বাণিজ্যে ঘনিষ্ঠভাবে অংশগ্রহণ করার জন্য একটি নতুন বন্দরের প্রয়োজন ছিল। 


নতুন বন্দরের অনুসন্ধান:

নতুন বন্ধুর অন্বেষণের কাজের উদ্যোগ গ্রহণ করেন স্ট্যামফোর্ড র‌্যাফেলস। 1818 সালে স্ট্যামফোর্ড রেফেলস কলকাতার গভর্নর জেনারেল লর্ড হেস্টিংসের এর সাথে দেখা করেন। আচহ তে একটি ঘাটি এবং জাভার দক্ষিণতম অঞ্চলে একটি নতুন বসতি বিস্তারে র‌্যাফেলস এর  পরিকল্পনায় হেস্টিংস অনুমোদন দেন। মালাক্কা প্রণালীতে ব্রিটিশ বাণিজ্য জাহাজের অবাধ বিচরণ এবং কোম্পানির পক্ষে একটি সুবিধা জনক বাণিজ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এই দুই উদ্দেশ্যে পরিকল্পনাটি গৃহীত হয়েছিল। 


র‌্যাফেলসকে কলকাতা থেকে একটি ছোট রণতরি বাহিনী দেওয়া হয়েছিল। 1818 সালের ডিসেম্বরে র‌্যাফেলস কলকাতা থেকে পেনাং এর দিকে রওয়ানা হন। পেলানের তৎকালীন গভর্নর রেফেলসের এই সম্প্রসারণবাদী নীতির বিরোধী হওয়ায় রেফেলস আচেহ তে যেতে পারেন। তিনি রিও তে যাত্রা করেন। । এ সময় রেফেলস এর সাথে পেনাং এর  বিদায়ী রেসিডেন্ট ফারকুহারের সাথে সাক্ষাৎ হয়। এদিকে কলকাতার গভর্নর হেস্টিংস রেফেলস কে নতুন বসতি স্থাপনের অবাধ স্বাধীনতা  দিয়ে ভুল করেছেন বলে মনে করেন। তিনি  নতুন কোন বসতি গড়ে না তোলার নির্দেশ পাঠান।  কিন্তু তা র‌্যাফেসের  কাছে পৌঁছে অনেক বিলম্বে। 


সিঙ্গাপুর প্রতিষ্ঠা ও চুক্তি: 

স্ট্যামফোর্ড রেফেলস তার রণতরী বাহিনী নিয়ে শিয়াকের (Siak) তীর অতিক্রম করে ক্যারিমন  দ্বীপপুঞ্জে এসে পৌঁছান। কিন্তু এই অঞ্চলটি তার মনঃপুত হয়নি।  তখন তিনি যাত্রা শুরু করেন তুমাসিক তথা সিঙ্গাপুরের দিকে। রেফেলস এবং তার সহযাত্রী ফারকুহার সিঙ্গাপুর দ্বীপের দক্ষিণ উপকূলে অবতরণ করেন ১৮১৯ সালের ২৯ শে জানুয়ারি৷ তখনো তুমাসিক ছিল যোহরের সুলতান এর অধীনস্ত এলাকা ৷ এখানে তেমেংগং এর শাসন চালু ছিল৷




১ম দফা চুক্তি

১৮১৯ সালের ৩০ শে জানুয়ারি তেমেংগং ও রেফেলসের মধ্যে একটি প্রাথমিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।  চুক্তির শর্ত অনুযায়ী 


  1. তেমেংগং ইংরেজ কোম্পানিকে সিঙ্গাপুরে বাণিজ্য কুঠি স্থাপনের অনুমতি দেবেন;

  2. তিনি আরো প্রতিশ্রুতি দিলেন যে অন্য কোন দেশের সাথে তিনি চুক্তিবদ্ধ হবেন না; 

  3. অন্য কোন দেশকে তিনি সিঙ্গাপুরে বসতি স্থাপন করতে দেবেন না;

  4. বিনিময়ে কোম্পানি তাকে নিরাপত্তা দিব ;

  5. কোম্পানি তাকে বাৎসরিক 3000 ডলার  পেনশন দিবে



২য় দফা চুক্তি:

র‌্যাফেলস এটা জানতেন যে জোহর সুলতানের অনুমোদন ব্যতীত এই চুক্তির কোন মূল্য নেই। কেননা তেমেংগং স্বাধীন সার্বভৌম ছিলেন না। তিনি ছিলেন জোহর সুলতানের অধীনস্থ শাসক। কিন্তু জোহর তখন তিনটি ভাগে বিভক্ত ছিল। তাই যোহরের প্রকৃত সুলতান কে এ নিয়ে সংকট তৈরি হয়। অনেক নাটকীয়তার পর 6 ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় মাহমুদের জ্যেষ্ঠ পুত্র হোসেন র‌্যাফেলস এর সহযোগিতায় সিঙ্গাপুরে এসে নিজেকে জোহরের সুলতান বলে দাবি করেন। একই দিনে ৬ই ফেব্রুয়ারি জোহর সুলতানের সঙ্গে রেফেলসের দ্বিতীয় দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১ম টি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হলেও এটি ছিল ত্রিপাক্ষিক চুক্তি। এখানে জোহরের সুলতান, তেমেংগং এবং রেফেলস স্বাক্ষরকারী ছিলেন।  পূর্বের চুক্তির মতো এখানেও সুলতান প্রতিশ্রুতি দিলেন যে- 


  1. তারা আর অন্য কোন ইউরোপীয় বা আমেরিকান শক্তির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হবেন না; 

  2. ইংরেজ কোম্পানিকে সিঙ্গাপুরে বানিজ্য কুঠি স্থাপনের অধিকার দেবেন; 

  3. সুলতান এবং তেমংগংকে ইংরেজরা রক্ষা করবেন ও নিরাপত্তা দিবেন;

  4. পেনশন সুলতানের বার্ষিক সম্মানী হবে 5000 ডলার। 

  5. আঞ্চলিক বানিজ্য জাহাজ সিঙ্গাপুরে যে কর দিত তার অর্ধেক পাবেন তেমেংগং। 


কিন্তু উভয় চুক্তিতে কোম্পানি জোহরের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে কোন হস্তক্ষেপ করবে না বা আপদ বিপদে সুলতানের ক্ষমতাকে সামরিক সহযোগীতা দিয়ে টিকিয়ে রাখবে এমন কোন প্রতিশ্রুতি দেয়নি। 


এভাবে মালয় জগতে রেফেলস কর্তৃক সিঙ্গাপুর প্রতিষ্ঠিত হয়। পেনাং মালাক্কা এবং সিঙ্গাপুর (তুমাসিক)  এই তিনটি উপনিবেশ নিয়ে মালয়ে ব্রিটিশ আধিপত্যবাদের জয়যাত্রা অব্যাহত থাকে। কিন্তু সিঙ্গাপুর নিয়ে ডাচদের আপত্তি ছিল। সিঙ্গাপুর থেকে তারা ব্রিটিশ কর্তৃত্ব প্রত্যাহারের দাবী করেছিল বার বার।  ১৮২৪ সালের চুক্তির মাধ্যমে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ইংল্যান্ড  ও ডাচদের মধ্যকার বাণিজ্যিক দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে। অতঃপর সিঙ্গাপুর এগুতে থাকে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। সিঙ্গাপুর ব্রিটিশ প্রণালী উপনিবেশের রাজধানীতে পরিণত হয়।



সম্ভাবনাময় সিঙ্গাপুর:

শিল্প বিপ্লবউত্তর ইংল্যান্ড ও তার বনিক সম্প্রদায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপপুঞ্জে বাণিজ্যের প্রসার চেয়েছিল। চা এবং আফিমকে কেন্দ্র করে চীন বাণিজ্য আগ্রহ বেড়েছিল। বৃটেনের বণিক গোষ্ঠী ইংল্যান্ডের কারখানায় তৈরি হওয়া সস্তা বস্ত্র বিক্রির জন্য বাজার খুঁজতেছিল। উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও আফ্রিকার বাজার ইংল্যান্ডের হাতছাড়া হয়ে গেলে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল বলে তাদের মনে হয়েছে। আর চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের প্রধান  চাবিকাঠি  ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। কিন্তু চীন সরকারের মতিগতি সম্পর্কে কোন নিশ্চয়তা ছিল না। এজন্য ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপপুঞ্জকে বাণিজ্যের নির্ভরযোগ্য ঘাঁটি বলে মনে করেছিল। এদিকে ব্রিটিশ সরকার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অবসান ঘটালে এবং দূরপ্রাচ্যের বাণিজ্য অবাধ ও নিয়ন্ত্রণ মুক্ত ঘোষণা করলে ব্রিটিশ বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যবাদের যুগ শুরু হয়।  


এসব সম্ভাবনা মাথায় রেখেই রেফেলস সিঙ্গাপুর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই ব্রিটিশ উপনিবেশটির দ্রুত উত্থানে সবাই বিস্মিত হয়। বেসরকারি ব্রিটিশ বাণিজ্য সম্প্রসারণের সুযোগ পেয়েছিল এই বন্দরের মাধ্যমে। সিঙ্গাপুরের ভৌগোলিক অবস্থান, স্থিতিশীল প্রশাসন, অবাধ বাণিজ্য, ভারতীয় বন্দর হিসেবে এর মর্যাদা এবং ডাচদের বন্দরে শুল্কহার বৃদ্ধি প্রভৃতি সিঙ্গাপুরের অভাবনীয় উন্নতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সিঙ্গাপুরই সর্বপ্রথম অবাধ বানিজ্যনীতি কার্যকর করেছিল যা এর উত্থানের অন্যতম কারন। 



সিঙ্গাপুরের উন্নয়নে রেফেলস কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ/ সংস্কার:

সিঙ্গাপুরের প্রথম রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন ফারকুহার। প্রথম দুই তিন বছরের মধ্যে এখানে জনবসতির বিস্তার ঘটেছে। লোক সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ব্যবসা বেড়েছে। অবাধ অবাধ, বাণিজ্য প্রচুর জমি, ব্রিটিশ পদত্ত নিরাপত্তা, বন্দরের উপযোগী বিচিত্র রকমের কর্মসংস্থানের সুযোগ এসব কারণে সিঙ্গাপুরে প্রচুর লোক সমাগম হয়েছিল। 


১৮২২  সালের অক্টোবর থেকে ২৩ সালের জুন পর্যন্ত রাফেলস সিঙ্গাপুরে ছিলেন। সেখানকার সার্বিক বিকাশের জন্য যে সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন বা সংস্কার সাধন করেছিলেন তা নিম্ন রুপ। 


  1. স্থানীয় প্রথাকে স্বীকৃতি ও মর্যাদা দিয়ে ইংরেজ আইন কে ভিত্তি করে আইন প্রণয়ন করেন। 

  2. ১২ জন বণিককে সাময়িকভাবে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা প্রদান করেন।

  3. নিরাপত্তার জন্য পুলিশ বাহিনীর সৃষ্টি করেন।  

  4. জমির তালিকা প্রণয়নের পরিকল্পনা এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ইজারা দেবার বন্দোবস্ত করেন। 

  5. বন্দর পরিচালনার জন্য নিয়ম নীতি প্রণয়ন করেন।  

  6. ক্রীতদাস প্রথা ও জুয়া খেলার বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান চালু করেন।  

  7. তিনি একটি বহুজাতিক সমিতির উপর প্রধান প্রধান সম্প্রদায়ের বাসগৃহ নির্মাণের স্থান নির্বাচনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। 

  8. তিনিই প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্কুল, কলেজ, বোটানিক্যাল গার্ডেন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করেন।

  9. রেফেলস তেমেংগং ও সুলতানের পেনশনের পরিমাণ বৃদ্ধি করে সমগ্র সিঙ্গাপুরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন।


তার এ সমস্ত সংস্কার সাধনের মাধ্যমে পেনাল থেকে সিঙ্গাপুরের মর্যাদা  ও গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। 



তৎকালীন সময়ের বিশ্ব বাণিজ্যে সিঙ্গাপুরের গুরুত্ব:

মুক্তবাণিজ্যের বৈশিষ্ট্যের কারণে সিঙ্গাপুরের দ্রুত উত্থান ঘটে। তৎকালীন বিশ্ব বাণিজ্যে সিঙ্গাপুর প্রাচ্য এবং পশ্চিমের বাণিজ্যের মধ্যে প্রধান ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সিঙ্গাপুরের কর্মযজ্ঞ বৃদ্ধি পায়। DGE হলের মতে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ভারত মহাসাগরে এক বাণিজ্যিক বিপ্লব সংঘটিত হয়। আর এই বাণিজ্য ছিল চীনের সাথে। সুতরাং চীন-বাংলা-ভারত বাণিজ্য পথের গুরুত্বপূর্ণ  স্থানে ছিল সিঙ্গাপুরের অবস্থান। বোম্বে থেকে ক্যান্টনের পথে যে সমস্ত বাণিজ্যিক বহর চলাচল করত তার সবগুলো জাহাজেই সিঙ্গাপুর ছুয়ে যেত। এখানে আসতো চিনা জাঙ্ক,  শ্যাম ও ত্রেংগানুর নৌকা এবং কখনো কখনো বাটাবিয়ার ওলন্দাজ তরী। মালয় উপদ্বীপের ও অন্যান্য দ্বীপের ছোট নৌকা এখানে নিয়ে আসতো টিন, মসলা, গোলমরিচ, হাতে বোনা সারাঙ্গ, রজন বা জাতু, চাউল, বেতের ছড়ি, পাখির বাসা ও নারিকেল। ১৮২০ সালে সিঙ্গাপুরে যে রাজস্ব আদায় হতো তা দিয়ে শাসনের ব্যয় নির্বাহ হতো। ১৮২২ সাল নাগাদ বাণিজ্যে সিঙ্গাপুর পেনাংকে ছাড়িয়ে যায়।  শ্যাম, মালয়, চীন, জাভা সুমাত্রার বড় বড় জাহাজ পেনাং এর পরিবর্তে সিঙ্গাপুরকেই বেশি পছন্দ করতো। 


সিঙ্গাপুর প্রতিষ্ঠার পর সিঙ্গাপুরের গুরুত্ব সম্পর্কে স্ট্যামফোর্ড র‌্যাফেলস প্রথম রেসিডেন্ট ফারকুহারকে লিখেছিলেন যে- 

“What Malta is in the west that may Singapore become in the East” ( ‍See- DGE Hall, P. 542,)


পরিশেষে স্ট্যামফোর্ড রেফেলসের দূরদৃষ্টি অত্যন্ত কার্যকরী ছিল। উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে স্ট্যামফোর্ড কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সিঙ্গাপুর কালক্রমে পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে ব্রিটিশ আধিপত্য বিস্তারের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। মুলত সিঙ্গাপুর কে কেন্দ্র করেই দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় বিকশিত হয়েছিল ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ।  আর বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।


According to Richard Winstedt- 

Singapore From its foundation down to the time of the Japanese invention was a sense of peaceful commercial development (See- Richard Winstedt, Malaya and his history, Hutchinson's University Library, London, 1951 P. 61)




গ্রন্থপঞ্জি

  1. জহর সেন, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তকপর্ষদ, কালকাতা ,১৯৮৫

  2. ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ এবং ড. আবু নোমান, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলমানদের ইতিহাস, এম আব্দুল্লাহ এন্ড সংন্স, তৃতীয় প্রকাশ, ঢাকা, ২০১৭

  3. সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া,  মিত্রম, কলকাতা, ২০১৫

  4. (See- https://www.britannica.com/biography/Stamford-Raffles)







Md. Billal Hossain

B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka

BCS (General Education)

Lecturer

Department of Islamic History Culture



No comments:

Post a Comment