Breaking

Wednesday 15 February 2023

হযরত মুয়াবিয়া (রা): পরিচিতি, উত্থান, রাজনৈতিক কর্মকান্ড এবং সংস্কারাবলী

 

হযরত মুয়াবিয়া (রা): 

পরিচিতি, উত্থান, রাজনৈতিক কর্মকান্ড এবং সংস্কারাবলী



মুয়াবিয়া (রা): এর পরিচিতি:

হযর মুয়াবিয়া ছিলেন উমাইয়া বংশের নেতা আবু সুফিয়ানের পুত্র। কুরাইশ বংশের অন্যতম শাখা উমাইয়া গোত্রে মুয়াবিয়ার জন্ম হয় ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর মাতা ছিলেন আবু জাহেলের কন্যা হিন্দা। তাঁর পিতা-মাতা উভয়ে ছিলেন প্রাথমিক যুগে ইসলামের ঘোর শত্রু। ৮ম হিজরি (৬৩০ খ্রি.) মক্কা বিজয়ের সময় তাঁর পিতা-মাতাসহ তিনিও ইসলাম গ্রহণ করেন। পিতার সাথে কুরাইশদের পক্ষে মুয়াবিয়া রাসূলের (স) বিরুদ্ধে বদর, উহুদ ও খন্দকের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। তাঁর মা হিন্দা ইসলামের বিপক্ষে বেশি তৎপর ছিলেন। ইসলামও গ্রহণ করেছিলেন তাদের অনেক পরে। উহুদের যুদ্ধে রাসূলের (স) চাচা বীরশ্রেষ্ঠ হযরত হামযা (রা) শহীদ হলে হিন্দা তাঁর বুক চিরে কলিজা বের করে চিবিয়ে চরম পৈশাচিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। অবশ্য এজন্য তিনি ইসলামগ্রহণের পর খুবই অনুতপ্ত ছিলেন। রাসুল (স) তাকে তাঁর সামনে না আসার জন্য বলেছিলেন। 






ইসলাম গ্রহণ:

মুয়াবিয়া ইসলাম গ্রহণ করেন মক্কা বিজয়ের পরে। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ২৪ বছর। তারপর রাসূলের (স) ইনতিকাল পর্যন্ত তাঁর সাথেই ছিলেন। হুনাইন যুদ্ধে ও তায়েফ অবরোধে তিনি রাসূলের সঙ্গে ছিলেন।


অহী লেখক: 

ইসলাম গ্রহণের পর থেকে মুয়াবিয়া নিজেকে ইসলামের সেবায় নিয়োজিত রাখেন। রাসূল (স) মক্কা থেকে মদীনায় চলে এলে তিনিও রাসূলের সাথে মদীনায় চলে আসেন। হযরত মুহাম্মদ (স) মুয়াবিয়ার বোন উম্মে হাবীবাকে বিয়ে করেন। মুয়াবিয়া সম্বন্ধে তার ধারণা ভাল ছিল। রাসূলুল্লাহ (স) মুয়াবিয়াকে বেশ আদর করতেন। আবু সুফিয়ানের অনুরোধে রাসূল (স) মুয়াবিয়াকে (রা) অহী লেখক হিসেবে নিযুক্ত করেন। অহী লেখা ছাড়াও তিনি দূর-দূরান্ত থেকে আগতদের অভ্যর্থনা, থাকা-খাওয়া এবং তত্ত্বাবধায়নের দায়িত্ব পালন করতেন। তিনি সমস্ত কাজ অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে সুষ্ঠুভাবে পালন করতেন। বাল্যকাল লোকেই মুয়াবিয়া, অত্যন্ত ধৈর্য-সহ্য, জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেচনার অধিকারী ছিলেন, সকলেই তাঁর বিচক্ষণতায় মুগ্ধ ছিল। 



আরও পড়ুন-

মুহাম্মদ (স.) এর হিজরত: কারণ ও ফলাফল





মুয়াবিয়া (রা): এর রাজনৈতিক উত্থান:

আবু বকর (রা) মুয়াবিয়ার বড় ভাই ইয়াযীদকে একদল সেনার দায়িত্ব দিয়ে সিরিয়ায় পাঠান। সাথে তিনিও ছিলেন। তখন মুয়াবিয়া নিজেও স্বতন্ত্রভাবে কখনও কখনও সেনাবাহিনী দেখাশুনা ও অভিযান পরিচালনায় অবদান রাখতেন। মুয়াবিয়া ছিলেন খুবই বুদ্ধিমান বিচক্ষণ ও সুকৌশলী। ১৩ হিজরিতে তিনি ইয়ারমুকের যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন। 


প্রাদেশিক গর্ভনর মুযাবিয়া (রা.):

হযরত উমর (রা) তাঁর কর্মতৎপরতা ও বিচক্ষণতা বিবেচনা করে- তাঁকে জর্ডানের গভর্নর নিযুক্ত করেন। তখন থেকেই তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। যখন হযরত আবু ওবায়দা ও তাঁর বড় ভাই ইয়াযীদ মারা যান, তখন উমর (রা) তাঁকে দামেশকের গভর্নর নিযুক্ত করেন। জর্ডান ও তার আশে পাশের এলাকাও তাঁরই নিয়ন্ত্রণে ছিল। হযরত উমরের (রা) ইনতিকালের পর যখন হযরত উসমান (রা) খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন সিরিয়া ও এর আশপাশের সমস্ত অঞ্চলের দায়িত্ব মুয়াবিয়ার উপর ন্যস্ত হয়। কর্মচারী নিয়োগ ও বরখাস্ত করার ক্ষমতাও তাঁর হাতে ছিল। সর্বক্ষেত্রে তিনি বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দেন। সমস্ত সিরিয়ায় ইসলামের শান্তি পতাকা উড্ডীন হয়। মুয়াবিয়া তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দ্বারা রোমান ও পারসিকদের আগ্রাসন ইচ্ছা চিরতরে বন্ধ করে দেন। 


খিলাফত লাভ:

সিরিয়ার শাসনকর্তা থাকাকালে মুয়াবিয়া (রা) বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের উপর ইসলামি শাসন প্রসারিত করেন। হযরত উসমান (রা)-এর সময় তিনি একটি নৌ বাহিনী গঠন করে। দীপাঞ্চলে মুসলিম প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা করেন। হযরত উসমান (রা)-এর শাহাদাতের পর মদীনায় নৈরাজ্য বিস্তার লাভ করতে থাকে। খলিফা-নির্বাচন নিয়ে বিশৃ´খল অবস্থার সৃষ্টি হয়। অবশেষে সিরিয়া প্রদেশ ছাড়া সমগ্র মুসলিম জাহানই হযরত আলীর (রা) প্রতি সমর্থন জানায়। তবে সিরিয়ার শাসনকর্তা মুয়াবিয়া ও আলী (রা)-এর মধ্যে মনোমালিন্য দেখা দেয়। মুয়াবিয়া নিহত খলিফা হযরত উসমান (রা)-এর রক্তমাখা জামা এবং তাঁর স্ত্রী নায়লার কর্তিত আঙ্গুল দেখিয়ে বনু উমাইয়া এবং সিরিয়াবাসীদেরকে আলী (রা)-এর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে থাকেন। এরই মধ্যে খিলাফত লাভের কৌশল প্রয়োগ হতে থাকে। হযরত আলী (রা) যখন প্রাদেশিক গভর্নরদেরকে বরখাস্ত করে নতুন গভর্নর নিযুক্ত করেন তখন সিরিয়ার শাসনকর্তা মুয়াবিয়া ছাড়া সকলেই এ সিদ্ধান্ত মেনে নেন। মুয়াবিয়ার (রা) দাবি ছিল আগে হযরত উসমান (রা) হত্যার বিচার হোক, তারপর খিলাফতের প্রশ্ন। অবশেষে মুয়াবিয়া ও আলী (রা)-এর মধ্যে বেশ কিছু যুদ্ধ সংঘঠিত হয় এবং অনেক প্রাণহানীও ঘটে। সিফফিনের যুদ্ধের পর দুমার সালিশিতে কুটনৈতিক বিজয় লাভ করে মুয়াবিয়া সমগ্র সিরিয়া ও মিশরের উপর তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। হযরত আলী (রা)-এর শাহাদাতের পর হিজরি ৪১ সালে ইমাম হাসান (রা)-এর খিলাফত ত্যাগের মাধ্যমে মুয়াবিয়া (রা) ইসলামি দুনিয়ার একচ্ছত্র শাসক হয়ে বসেন। 


মুয়াবিয়ার (রা)-এর খিলাফত লাভের পদ্ধতি প্রশ্নবিদ্ধ হলেও তাঁর যোগ্যতার ব্যাপারে করো কোন দ্বিমত নেই। হযরত উসমান (রা)-এর খিলাফতের শেষার্ধ হতেই মুসলিম সাম্রাজ্যে বিশৃংখলা শুরু হয়। মুয়াবিয়া বিশৃংখলার মধ্য দিয়েই মুসলিম জাহানের শাসনভার হাতে নেন। কিন্তু তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণতার মাধ্যমে এসব গোলযোগের মোকাবেলা করেন। তাঁর ২০ বছরের শাসনামলে সাম্রাজ্যে কোন গৃহ-বিবাদ এবং আভ্যন্তরীণ বিশৃ´খলা ছিল না বললেই চলে। শাসনকার্যে যেখানে কঠোর হওয়ার প্রয়োজন হত সেখানে তিনি কঠোরতা প্রদর্শন করেছেন। যেখানে তলোয়ার নেওয়া প্রয়োজন হত সেখানে তলোয়ার নিতেও কুণ্ঠাবোধ করতেন না। 



দামেস্কে রাজধানী স্থাপন:

মুয়াবিয়া শাসনকার্যে ছিলেন অত্যন্ত অভিজ্ঞ। কুটনীতিবিদ, ধৈর্যশীল ও নির্ভীক যোদ্ধা হিসেবে উমাইয়াদের শ্রেষ্ঠ শাসকের মর্যাদায় ভূষিত হয়েছেন। নিজের শক্তি ও ক্ষমতাকে সুসংহত করার জন্য কুফা হতে রাজধানী দামেস্কে স্থানান্তরিত করেন। দামেস্ক ছিল প্রাদেশিক রাজধানী। এখানেই উমাইয়াগণ তাদের শক্তির প্রধান কেন্দ্র স্থাপন করেছিল। বিচক্ষণ মুয়াবিয়া (রা) নিজের শক্তিকে আরো বৃদ্ধি ও সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে এবং রাষ্ট্রীয় কোন বিদ্রোহীদের বিদ্রোহ দমনের সুবিধার্থে দামেস্ককে কেন্দ্রীয় রাজধানী করার উপযুক্ত স্থান বলে বিবেচনা করেন। রাজতন্ত্র বিশেষত উমাইয়া শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মুয়াবিয়ার এই রাজধানী পরিবর্তন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।


আভ্যন্তরীণ শৃ´খলা ও সংহতি স্থাপন:

খারিজীগণ ইরানের উমাইয়া খিলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হলে তিনি তাদেরকে কঠোরভাবে দমন করেন। খারিজীরা মরুভূমিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এভাবে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে যেমন বসরা, আহওয়াজ প্রভৃতি এলাকায় বিশৃ´খলা দেখা দিল তিনি কঠোর হাতে তাও দমন করে শৃ´খলা ফিরিয়ে আনেন।


মুদারীয় ও হিমারীয়দের বিরোধ:

হিজাজের অধিবাসী মাদের পৌত্র মুদারের নাম থেকে মুদারীয় গোত্রের উৎপত্তি। আর হিমারীয় নামটি উৎসারিত হয়েছে কাহতান বংশীয় আবদে শামসের পুত্র হিনারের নাম থেকে। মুদারীয় বংশের শাখাগুলোর মধ্যে কুরাইশ, বনু বকর, বনু তাগলিব ও বনু তামীম প্রসিদ্ধ। রাসূলুল−াহ (স)-এর শিক্ষার ফলে এ গোষ্ঠীর কলহ দূরীভূত হয় এবং পরবর্তীকালে হযরত ওমরের ইন্তিকাল পর্যন্ত অবস্থা শান্ত ছিল। তারপর আবার বিরোধ নতুন করে জেগে উঠে এবং প্রবল আকার ধারণ করে। মুয়াবিয়ার আমলে বিরোধ সংযত হলেও তার মূলোৎপাটিত হয়নি। মুয়াবিয়া বংশীয় বিরোধ কৌশলে নিয়ন্ত্রণে রাখেন। এভাবে মুসলিম সম্রাজ্যে দীর্ঘ দিনের বিরাজমান বিশৃ´খলা, অরাজকতা ও গোলযোগ দূর করে মুয়াবিয়া অভ্যন্তরীণ শৃ´খলা ঐক্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। তারপর তিনি রাজ্য বিস্তার ও শাসন কাঠামো সংস্কারে মন দেন। 








হযরত মুয়াবিয়ার (রা) রাজ্য বিস্তার

হযরত মুয়াবিয়া সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে অভ্যন্তরীণ শান্তি, শৃ´খলা ও সংহতি প্রতিষ্ঠা করেন। তারপর তিনি রাজ্য বিস্তার ও প্রসারের দিকে মনোনিবেশ করেন। তিনি ছিলেন রণ কৌশলী - বীরযোদ্ধা এবং দুরদর্শী রাজনৈতিক নেতা। তাই তিনি উন্নত সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী গঠন করেন। তার সেনাবাহিনী প্রাচ্য ও প্রতীচ্যে অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করে। অধ্যাপক হিট্টি বলেন- মুয়াবিয়ার রাজত্বকালে মুসলিম সাম্রাজ্য শুধু সুদূর ও সুসংহতই হয়নি, বরং এর আঞ্চলিক সীমারেখাও বৃদ্ধি পায়।


1. পূর্বাঞ্চল জয়:

হযরত মুয়াবিয়া (রা) জিয়াদকে পূর্বাঞ্চলের সেনাপতি করে প্রেরণ করেছিলেন। ৬৭৩ খ্রিস্টাব্দে জিয়াদের মুত্যু হলে তার পুত্র ওবায়দুল−াহ প্রাচ্য বা পূর্বদেশের প্রতিনিধি হন। তিনিও পিতার ন্যায় যোগ্য ছিলেন। এভাবে মুয়াবিয়া (রা) আফগানিস্তান ও পারস্যের অধিকৃত অঞ্চলে অভিয়ান চালিয়ে সীমান্তের উপজাতিদের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন। ৬৬২ খ্রিস্টাব্দে হীরায় বিদ্রোহ দেখা দিলে কঠোর ভাব তা দমন করা হয়। এর দু বছর পরে গজনী, কাবুল, বলখ, কান্দাহার প্রভৃতি এলাকায় বিদ্রোহ দমন অভিযান চালিয়ে উমাইয়া প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন। মুহাল−াবের নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী সিন্দু নদের তীর পর্যন্ত অগ্রসর হয়। ৬৭৪ খ্রিস্টাব্দে যিয়াদের এক পুত্র বুখারা দখল করেন। তারপর সময়কন্দ ও তিবরিজ উমাইয়া খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত হয়। এভাবে পূর্বদিকে সমরকন্দ ও বুখারা এবং দক্ষিণ সিন্ধুনদ

পর্যন্ত উমাইয়া রাজত্বের বিস্তার ঘটে।


2. পশ্চিমাঞ্চল জয়

পূর্বদিকের মত মুয়াবিয়ার খিলাফত পশ্চিম দিকেও প্রসারিত হয়। উত্তর আফ্রিকা বিজয়ের ফলে মুসলিম সাম্রাজ্যে নতুন অঞ্চল সংযোজিত হয়। মুয়াবিয়া ১০০০ সৈন্যসহ ওকবা ইবনে নাফে-এর নেতৃত্বে উত্তর আফ্রিকায় সৈন্য প্রেরণ করেন। ওকবা শৌর্যবীর্যের পরাকাষ্ঠা  দেখিয়ে রোমানদেরকে পরাজিত করে সমস্ত উত্তর আফ্রিকা মুসলিম সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। বাবরিগণ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং কায়রোয়ান নামে একটি শহর একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। কায়রোয়ান উত্তর আফ্রিকার রাজধানীতে পরিণত হয়। এর পর তিনি পশ্চিমাঞ্চলের দিকে অগ্রসর হয়ে একের পর এক শহর বন্দর জয় করতে থাকেন। এভাবে সমগ্র পশ্চিমাঞ্চল জয় করে ওকবা আটলান্টিক সাগর পর্যন্ত পৌছেন। ওকবার গৌরবময় অভিযান এবং রোমান ও বার্বারদের শোচনীয় পরাজয়ের ফলে দীর্ঘ দিন যাবত এ এলাকা শান্ত ছিল। মুয়াবিয়া ওকবাকে উত্তর আফ্রিকার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। কিন্তু বিজিত রাজ্যগুলি সুসংহত করার পূর্বে রোমান এবং বাবরিদের যৌথ আক্রমণে ওকবা পরাজিত ও নিহত হন। তাঁর আকষ্মিক মৃত্যুর কারণে মুসলমানগণ বার্কায় চলে আসে এবং উত্তর আফ্রিকার মুসলিম অভিযান থেমে যায়।


3. কানস্টান্টিনোপলের বিরুদ্ধে নৌ-অভিযান

খলিফা উসমানের আমলে মুয়াবিয়া সর্বপ্রথম নৌ-বাহিনী গঠন করে সিসিল ও রোডস দখল করেন। বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের শক্তিশালী নৌ-বহরের মোকাবেলা করবার জন্য তাঁকে নৌ-বাহিনী গঠন করতে হয়। আরবদের প্রথম নৌ-ৎসেনাপতি আব্দুল−াহ-ইবনে কায়েস রোমানদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। মুয়াবিয়াও নৌ-বহর গঠন করে সিরিয়ার উপকূলভাগ রক্ষা করার প্রয়াস পান। ৬৬২ খ্রিস্টাব্দে মুয়াবিয়া আর্মেনিয়ার রোমানদের পর্যুদস্ত করে আর্মেনিয়া দখল করেন এবং আকব নামক স্থানে একটি পোতাশ্রয় স্থাপন করেন।


৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে মুয়াবিয়া এ পোতাশ্রয় হতে বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে নৌ-অভিযান চালান। এ অভিযানে নেতৃত্ব দান করেন মুয়াবিয়ার পুত্র ইয়াযীদ। তা ছাড়া জার্নাদাহ ইবনে আবী উমাইয়া আব্দুর রহমান ইবনে খালিদ ইবনে ওয়ালীদ ও অন্যান্য সেনাপতিদের দ্বারা প্রতিবার রোমকদের বিরুদ্ধে নৌ-বাহিনী প্রেরণ করা হত। এভাবে কয়েক বছর এথেকে তাদের সাথে নৌ যুদ্ধ চলে কিন্তু উলে−খযোগ্য কোন ফলাফল আসেনি। কনস্টান্টিনোপল সেকালে পূর্ব ইউরোপের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হত। মুয়াবিয়া (রা) অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে সেখানে সুফিয়ান ইবনে আউফের নেতৃত্বে এক বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন। এ অভিযানের প্রতি রাসূলুল−াহ (স)-এর ইঙ্গিত ছিল, তাই অনেক বড় বড় সাহাবী অতি আগ্রহে এ অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। হযরত আবু আইউব আনসারী (রা), আবদুল−াহ ইবনে ওমর (রা) ও আবদুল−াহ ইবনে (রা) এ অভিযানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (রা) এ অভিযান কালে ইন্তিকাল করেন।



ইয়াযীদের মনোনয়ন:

মুয়াবিয়ার (রা) পুত্র ইয়াযীদ ছিলেন একজন উশৃ´খল যুবক। খেল-তামাশা, ভ্রমণ ও শিকারেই তার সময় অতিবাহিত হত। কুফার শাসনকর্তা মুগীরাহ এই বলে মুয়াবিয়াকে প্ররোচনা দিলেন যে তার ইন্তিকালের পর তার পুত্র ইয়াযীদই খলিফা হওয়ার একমাত্র উপযুক্ত ব্যক্তি। অবশ্য মুয়াবিয়া (রা) প্রথম তা মেনে নিতে পারেননি। কেননা ইয়াযীদের চরিত্র খলিফা হওয়ার উপযুক্ত মুয়াবিয়া (রা) কখনো মনে করেননি। কিন্তু মুগীরা ওয়াদা করলেন যে, “আমি কুফাবাসীকে প্রস্তুত করব, যিয়াদ ইবনে আবু সুফিয়ান বসরাবাসীকে এবং মারওয়ান ইবনে হাকাম মক্কাও মদীনাবাসীকে ইয়াযীদের খিলাফতের অনুকুলে তৈরি করবেন। অন্যদিকে সিরিয়ার মুসলমানগণ কখনো বিরোধিতা করবে না। কাজেই ইয়াযীদের খিলাফতে কোন বাধা নেই, এমনিভাবে কুফার শাসনকর্তা মুগীরার প্ররোচনায় তিনি

ইমাম হাসানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিনামার অবমাননা করে নিজ ও গোত্রীয় স্বার্থে ইয়াযীদকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। এ ব্যাপারে তিনি ইরাকীদের সমর্থন লাভ করেন। গণতন্ত্রের আদর্শকে জলাঞ্জলী দিয়ে মুয়াবিয়া বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে গেলেন। মক্কার ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ এর তীব্র বিরোধিতা করেন। বিশেষ করে ইমাম হুসাইন (রা), আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর এবং আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর বিরোধীদের অন্যতম ছিলেন। তাদের বিরোধিতার কতগুলো কারণও ছিল। প্রথমত খুলাফায়ে রাশেদীনের নির্বাচনে মনোনয়নের কোন নজির ছিল না। দ্বিতীয়ত খলিফা নির্বাচন মদীনার লোকদের একটি বিশেষ অধিকার বলে গণ্য হত এবং তা তারা ত্যাগ করতে কখনো রাজী ছিল না। তৃতীয়ত মুয়াবিয়া (রা) তার নিজ পরিবারের মধ্যেই খিলাফত সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছিলেন। চতুর্থত ইয়াযীদ ছিলেন অসৎ চরিত্রের অধিকারী। এ সমস্ত কারণে তাদের বিরোধিতাও যুক্তিযুক্ত ছিল। 


খলিফা মুয়াবিয়ার ওফাত: 

খলিফা মুাবিয়া ২৩ বছর সিরিয়া শাসন এবং ১৯ বছর সমগ্র ইসলামি বিশ্ব শাসন করার পর ৬০ হিজরি ১ রজব, অর্থাৎ ৭ই এপ্রিল, ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। দামেস্কের বাবুল জাবিয়া ও বাবুস্সগীর এর মধ্যখানে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। 



আরও পড়ুন-
মুহাম্মদ (স.) এর নবুওয়াত লাভ এবং ঘটনাবহুল মক্কী জীবন



মুয়াবিয়া (রা)-এর শাসনতান্ত্রিক সংস্কার:


খলিফা মুয়াবিয়া একজন সুদক্ষ ও প্রতিভাবান শাসক ছিলেন। তিনি খোলাফায়ে রাশেদুনের গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী নীতি পরিহার করে পারসিক ও বাইজান্টাইন শাসন পদ্ধতি অনুসারে শাসনকাঠামো গড়ে তোলেন। নিম্নে তাঁর শাসন ব্যবস্থা আলোনা করা হলো।


  1. রেজিস্ট্রী বিভাগ:

হযরত মুয়াবিয়া (রা) সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে শাসনকার্য পরিচালনায় এক বিরাট পরিবর্তন আনেন, খলিফা এবং প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের মধ্যে লিখিত সংযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্য তিনি ‘দিওয়ান-উল-খাতেম, (বা মোহরাঙ্কন বিভাগ) নামক একটি রাজকীয় চ্যান্সারী পরিষদ বা রেজেস্ট্রী বিভাগ স্থাপন করেন। খলিফা কর্তৃক ঘোষিত প্রতিটি বিধান রেজেস্ট্রীকরণ করা হত, অতঃপর আসল আদেশটি খলিফা মোহরাঙ্কিত করে গন্তব্যস্থলে প্রেরণ করতেন।


  1. ডাক বিভাগ:

মুয়াবিয়া (রা) ‘দিওয়ানুল বারীদ' বা ডাক বিভাগের স্থাপন করেন। ‘সাহিবুল বারীদ' বা পোস্ট মাস্টার কেন্দ্রীয় সরকারকে অর্থাৎ খলিফাকে প্রদেশের উলে−খযোগ্য খবরা-খবর সম্বন্ধে অবগত করাতেন। এভাবে মুয়াবিয়া (রা) প্রাদেশিক শাসন ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা ও প্রভাব অক্ষুণœ রাখতেন।


  1. কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সচিবালয়:

মুয়াবিয়া কর্তৃক প্রবর্তিত কেন্দ্রীয় শাসনের ফলে প্রাদেশিক এবং কেন্দ্রীয় রাজধানীসমূহে সচিবালয় স্থাপিত হয়। তাঁর শাসনকালে দু'টি সচিবালয় বর্তমান ছিল। একটি রাজকীয় বা কেন্দ্রীয় অপরটি প্রাদেশিক। কেন্দ্রীয় সচিবালয় আরবি ভাষার মাধ্যমে শাসনকার্য নির্বাহ করা হত। অর্থনৈতিক শাসন ব্যাপারে প্রাদেশিক সচিবালয় গ্রিক এবং ফরাসি (পাহলবি) ভাষার ব্যবহার করত। গ্রিক ভাষা ব্যবহৃত হত খিলাফতের পশ্চিমদিকস্থ দেশসমূহ যথামিসর, সিরিয়া প্যালেস্টাইনে আর আরবি ভাষা প্রচলিত ছিল খিলাফতের পূর্বদিকস্থ দেশসমূহে, যথা-ইরাক, (পারস্য) ও সমগ্র মধ্য এশিয়ায়।


  1. অর্থনৈতিক নীতি:

অর্থ বিভাগের প্রতি মুয়াবিয়া (রা) এর যথেষ্ট নজর ছিল। অর্থ সংগ্রহের সাথে সাথে তিনি তা আবার অকাতরে দানও করতেন। তাঁর শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিগণের সমর্থন লাভের জন্য অকাতরে অর্থ ব্যয় করতে দ্বিধাবোধ করতেন না। রাজস্ব ব্যাপারে তিনি উলে−খযোগ্য উন্নতির সূত্রপাত করেন। তিনি প্রশাসনিক বিভাগ হতে রাজস্ব বিভাগ আলাদা করে প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের হস্তক্ষেপ হতে এ বিভাগকে মুক্ত রাখেন। রাজস্ব আদায়ের জন্য ‘সাহিবুল খারাজ' নামে উচ্চপদস্থ রাজস্ব কর্মকর্তা নিয়োগ করেন। খলিফা উমরের নীতি অনুসারে যে বার্ষিক নির্দিষ্ট পরিমাণ বৃত্তি মুসলমানদের মধ্যে বিতরণ করা হত তা থেকে তিনি দরিদ্র কর (যাকাত) কেটে রাখতেন। এতে মোট দেয় অর্থ হতে শতকরা আড়াই ভাগ কমে যেত। এমনিভাবে তিনি রাজস্ব বিভাগে উন্নতি ও সমৃদ্ধি আনয়ন করেন।


  1. ক্ষমতা পৃথকীকরণ:

দূরদর্শী শাসনকর্তা মুয়াবিয়া (রা) রাজনৈতিক শাসন হতে অর্থনৈতিক শাসনকে পৃথক করে ফেলেন। রাজনৈতিক শাসনের নিমিত্তে তিনি প্রত্যেক প্রদেশে একজন করে শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। সামরিক ব্যাপার এবং জুমার নামাজে ইমামতি করাই ছিল প্রাদেশিক শাসনকর্তার প্রধান দায়িত্ব। অর্থের জন্য প্রাদেশিক শাসনকর্তাকে সাহিবুল খারাজের উপর নির্ভর করতে হত। 


  1. মুসলিম নৌ-বাহিনী প্রতিষ্ঠা:

সিরিয়ার শাসনকর্তারূপে মুয়াবিয়ার প্রচেষ্টায় খলিফা উসমান (রা)-এর সময় মুসলিম নৌ বাহিনী সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। খিলাফত লাভের পর মুয়াবিয়া (রা) একে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নৌ-শক্তিতে পরিণত করেছিলেন। মুসলিম নৌবাহিনী তৎকালীন রোম সাম্রাজ্যকে ভীত কম্পিত করে তুলেছিল। এরূপে মুয়াবিয়া (রা) মুসলিম সাম্রাজ্যকে আদি রোমান শাসনের কাঠামোর উপর একটি স্থায়ী সুসংহত রাষ্ট্ররূপে গড়ে তুলেছিলেন। বিশৃ´খলা ও অরাজকতার ভিতরে তিনি একটি গৌরব দীপ্ত ও সুশৃ´খল মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্রের পত্তন করেন। সুতরাং এটা সত্য যে, মুয়াবিয়া (রা)-এর শাসনামলে মুসলিম সাম্রাজ্য কেবল সুদৃঢ় ও সুসংহত হয়নি। উপরন্তু তা আরো সম্প্রসারিত হয়। 



আরও পড়ুন-
খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজ।। ইসলামের পঞ্চম খলিফা 

আরও পড়ুন- 


Md. Billal Hossain

B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka

BCS General Education

Lecturer

Department of Islamic History & Culture

Chandpur Govt. College, Chandpur.




No comments:

Post a Comment