ইরান-ইরাক যুদ্ধ (1980-88):
কারণ,গতি-প্রকৃতি, প্রতিক্রিয়া ও ফলাফল
(Iran-Iraq war)
গত শতাব্দীতে মধ্যপ্রাচ্যের সংগঠিত দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ হচ্ছে ইরান-ইরাক যুদ্ধ। শাত-ইল-আরব এর সীমানা কে কেন্দ্র করেই মূলত ইরান-ইরাক যুদ্ধের সূত্রপাত হয়।সামরিক ব্যক্তিত্ব প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের উচ্চাভীলাষ, বিপ্লবউত্তর ইরানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ধর্মীয় মতাদর্শগত ভিন্নতা এই যুদ্ধকে ত্বরান্বিত করেছে। শাতিল আরব নিয়ে বিরোধ থাকলেও বিপ্লবউত্তর ইরানকে দুর্বল মনে করে সাদ্দাম হোসেন ইরানের একটি বিরাট অংশ দখল করার জন্য এই যুদ্ধ বাঁধিয়েছেন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ মনে করেন। তবে সাদ্দাম হোসেনের সেই ধারণা ভুল ছিল। যুদ্ধের শুরুর দিকে ইরাক আক্রমণাত্মক ও ভালো অবস্থানে থাকলেও পরবর্তীতে ইরান ঘুরে দাঁড়ায় এবং ইরাক পিছু করতে বাধ্য হয়। ১৯৮০ থেকে ৮৮ সাল পর্যন্তই সংঘঠিত এই যুদ্ধে কেউ কাউকে ছাড় দিতে প্রস্তুত ছিল না। সর্বোপরি পরাশক্তিগুলোর দ্বিচারিতা এই যুদ্ধ কে দীর্ঘায়িত করেছে। ১৯৮৮ সালে জাতি সংঘের মধ্যস্থতায় আলজিয়ার্স চুক্তির মাধ্যমে এই যুদ্ধের পরিমাপ্তি ঘটে। এই যুদ্ধে প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ নিহত হয় এবং প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ আহত হয়।
দুটি দেশের অবস্থানগত ভিন্নতা:
এভাবে নানাবিধ দিক থেকে এই দুটি দেশের সরকার প্রধান ও জনগণের মধ্যে বৈরীভাব বিরাজ করছিল।
ইরান-ইরাক যুদ্ধের কারণ /প্রেক্ষাপট
(উপসাগরীয় যুদ্ধ)
ইরান-ইরাক যুদ্ধের কারণ
শাত-ইল-আরব:
শাত-ইল-আরব এর মালিকানা এবং এর সীমানার প্রশ্নে ইরান-ইরাকের মধ্যকার বিরোধ অনেক পুরনো। এই বিরোধ মীমাংসার লক্ষ্যে ইতিপূর্বে বেশ কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এগুলোর মধ্যে ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে সম্পাদিত এরজিরাম চুক্তি। 1913 সালের চুক্তি,১৯৩৭ সালের চুক্তি এবং ১৯৭৫ সালের চুক্তি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এরজিরামের চুক্তির ২ নং ধারায় বলা হয়েছিল যে সমগ্র শাত-ইল-আরব ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
তৈল আবিষ্কার ও মুহাম্মরা বন্দর:
কালক্রমে মসজিদ-ই-সুলাইমান এলাকায় তেল আবিষ্কার হলে এবং শাত-ইল-আরবের পূর্ব উপকূলে মুহাম্মারা বন্দর নগরের উদ্ভব ঘটলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তাতে শাত-ইল-আরবের মালিকানা নিয়ে নতুন চুক্তির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
১৯১৩ সালের চুক্তি
১৯১৩ সালের নভেম্বর মাসে ওসমানীয় সাম্রাজ্য, পারস্য, ব্রিটেন ও রাশিয়ার প্রতিনিধিবর্গ কনস্টান্টিনোপলে মিলিত হয়ে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন এবং এই মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, শাত-ইল-আরব উসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্তই থাকবে। তবে ছোট ছোট কয়েকটি চড় ও মোহাম্মারা শহর পারস্যের দখলে থাকবে। অতঃপর চতুঃশক্তির একটি যুক্ত কমিশন মোহাম্মরা বরাবর দুই দেশের সীমানা পশ্চিমে সরিয়ে থলওয়েগ রেখা বারাবর স্থাপন করে। প্রতিদানে পারস্য উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কিছু ভূখণ্ড ওসমানীয় সাম্রাজ্যকে ছেড়ে দেয়।
১৯৩৭ সালের চুক্তি
১৯১৩ সালে দেওয়া সিদ্ধান্ত বেশিদিন স্থায়ী হয়নি প্রথম। বিশ্বযুদ্ধের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বিশেষত ইরাকের উপর ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ফলে 1930 সালে স্বাক্ষরিত এক চুক্তিতে পূর্ববর্তী চুক্তির কিছুটা পরিবর্তন সাধন করা হয় এবং আবাদানের ক্ষেত্রেও থলওয়েল রেখা সীমানা হিসেবে গৃহীত হয়।
১৯৭৫ সালের চুক্তি
কুর্দি সম্প্রদায় ইরান এবং ইরাক উভয় দেশেই ছিল৷ বিভিন্ন কারণে কুর্দিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সমর্থন করতে গিয়ে উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে৷ ১৯৬৯ সালে ইরান অভিযোগ করে যে, 1937 সালের চুক্তির বেশ কয়েকটি ধারা লঙ্ঘন করা হয়েছে৷ তাই শাতিল আরবের সীমানা নির্ধারণের জন্য নতুন একটি চুক্তির প্রয়োজন৷ এরই প্রেক্ষিতে ১৯৭৫ সালের ৬ মার্চ আলজিয়ার্সে বিষদ আলোচনা পর একটি খসড়া প্রস্তুত করা হয়৷ এবং এর ভিত্তিতে ঐ বছরই বাগদাদে নিষ্পত্তিমূলক একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়৷ এই চুক্তি অনুযায়ী সমগ্র শাতিল আরব সীমান্তে 'থলওয়েগ রেখা' দুই দেশের মধ্যে সীমানা হিসেবে নির্দিষ্ট হয়৷
চুক্তি বিরোধী প্রচারণা
এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর এতে ইরাকের স্বার্থ নষ্ট হয়েছে বলে এর বিরুদ্ধে ইরাকে প্রচারণা চলতে থাকে । চুক্তিতে অন্যতম স্বাক্ষরকারী সাদ্দাম হোসেন ক্ষমতা আসার পর এই প্রচারনা আরো তীব্র হয়৷ অন্যদিকে ইরানে শাহ বিরোধী আন্দোলন, শাহের দেশত্যাগ এবং ইরানের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এ সমস্যাকে অধিকতর তীব্রতা দান করে ৷ ফলে দুই দেশের মধ্যে অতি দ্রুত সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে৷
ইরাক কর্তৃক তিনটি দাবি উত্থাপন
১৯৭৯ সালে অক্টোবর মাসে লেবাননে ইরাকি রাষ্ট্রদূত প্রদত্ত্ব এক বক্তৃতায় ইরাক সরকার তিনটি দাবি পেশ করে-
১৯৭৫ সালের চুক্তি বাতিল করা
ইরান কর্তৃক ১৯৭১ সালের দখলকৃত আবুমুসা ও টুনাব দ্বীপসমূহ প্রত্যার্পন এবং
ইরানের বেলুচ, কুর্দ ও আরবদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দান
অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ
১৯৭৯ সালের নভেম্বর মাসে ইরাক অভিযোগ করে যে, ইরানের বিপ্লবী রক্ষীবাহিনী তেহরানস্থ ইরাকি কুটনীতিবিদদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করতেছে৷ অন্যদিকে ডিসেম্বর মাসে ইরান অভিযোগ করে যে, ইরাকী বাহিনী কয়েকবার ইরানের সীমানা লংঘন করেছে৷
রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার
১৯৮০ সালের মার্চ মাসে দুই দেশ তাদের স্ব-স্ব রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে দেশে ফিরিয়ে নেয়। এটি দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক অবনতির চূড়ান্ত ইঙ্গিত।
বাক-বিতণ্ডা:
১৯৮০ সালের এপ্রিল মাসে ইরাকি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাতিসংঘের মহাসচিব কে এক লিখিত পত্রে বলেন যে, জাতিসংঘের উচিত ইরানের উপর চাপ প্রয়োগ করে দখলকৃত উপসাগরীয় দ্বীপসমূহ ত্যাগ করতে বাধ্য করা। এর পরপরই এই কথার জবাবে ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক বিবৃতিতে বলেন যে, ইরাক সরকার সম্পূর্ণভাবে সাম্রাজ্যবাদী ও জায়নবাদীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত রয়েছে।
তেল শোধনাগারে অগ্নি সংযোগ
১৯৮০ সালের এপ্রিল মাসে ইরানের একটি তৈল রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্রে অগ্রি সংযোগ ঘটে এবং এক বিস্ফোরনে আবাদান শোধনাগারের তৈল-গ্যাস বহনকারী পাইপ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়৷ ইরান এই ঘটনার জন্য সরাসরি ইরাককে দায়ী করে৷
সামরিক বাহিনীর প্রস্তুতি
এপ্রিল মাসের 7 তারিখে ইরানের সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেয়া হয় এবং ইমাম খুমিনি ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন কে ইসলাম ও মুসলমানের শত্রু আখ্যায়িত করে তার উৎখাত কামনা করেন। এর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ইরাক ও সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে।
শিয়া ও কুর্দিদের বহিষ্কার
এরকম পরিস্থিতিতে ইরাক সরকার ইরাক থেকে হাজার হাজার শিয়া ও কুর্দিদের বহিষ্কার করে৷ তারা ইরানে আশ্রয় গ্রহণ করে৷
সীমান্ত সংঘর্ষ
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সীমান্ত সংঘর্ষ দুই দেশকে যুদ্ধের দিকে দ্রুত ধাবিত করে৷ ৬ জুলাই ১৯৮০ সালের দিকে সীমান্তের কয়েক স্থানে সংঘর্ষ হয়। এসব সংঘর্ষে ইরাক বিমানও ব্যবহার করে৷ সেপ্টেম্বর মাসে সাদ্দাম হোসেন ও ইরাকি বায়াত দলের মুখপাত্র আস-সাওরা ঘোষণা করেন যে- ইরাকি বাহিনী জাহান-ই-কাউস এলাকা মুক্ত করেছে এবং ইরান শিকার করে যে তাদের দুটি ফ্যান্টম জঙ্গি বিমান ভূপতিত করা হয়েছে৷
আলজিয়ার্স চুক্তি বাতিলকরণ:
১৯৮০ সালের ১৭ ই সেপ্টেম্বর সাদ্দাম হোসেন সংসদে এক বক্তৃতায় একতরফাভাবে ১৯৭৫ সালের আলজিয়ার্স চুক্তি বাতিল বলে ঘোষণা করেন এবং মন্তব্য করেন যে, সমগ্র শাতিল আরবের উপর ইরাকের সার্বভৌমত্ব পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে৷
এই ঘোষণার পরপরই ইরান-ইরাক চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়৷
আরও পড়ুন-
মুহাম্মদ আলী পাশা এবং আধুনিক মিসর
ইরাকের উদ্দেশ্য:
যুদ্ধের পেছনে ইরাকের যেসব উদ্দেশ্য ছিল-
শাতিল আরব নদীর মোহনা সম্পূর্ণভাবে নিজেদের দখলে নেয়া
সংযুক্ত আরব আমিরাতের পক্ষ থেকে তিনটি ইরানী দ্বীপ আবু মুসা , গ্রেটার টুনব এবং লেসার টুনব দখল করে নেয়া
ইরানের খুজেস্তান প্রদেশ ইরাকের অন্তর্ভূক্ত করে নেয়া
তেহরানের ইসলামী সরকারকে উৎখাত করা ।
এবং ওই অঞ্চলে ইসলামী বিপ্লব ছড়িয়ে যাবার সম্ভাবনাকে প্রশমিত করা ।
সামরিক সক্ষমতা:
ইরান-ইরাক (উপসাগরীয়) যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি:
ইরান-ইরাক যুদ্ধ ছিল একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ। স্থল নৌ ও বিমান পথে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। পাশাপাশি এই যুদ্ধে ভয়ানক রাসায়নিক গ্যাস ও ব্যবহার করা হয়েছিল। ইরানি ইরাক যুদ্ধের ঘটনা প্রবাহকে মোটামুটি তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়।
প্রথম পর্যায়ঃ
ইরাকের অগ্রযাত্রা (সেপ্টেম্বর ১৯৮০- জুলাই ১৯৮১)
পূর্ব থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ করায় ইরাক যুদ্ধের শুরুতেই সাফল্য লাভ করে। ইরানকে বিভ্রান্ত করে নানাবিধভাবে ইরানের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে এবং বেশ কিছু এলাকা দখল করে নেয়। ইরাক ইরানের বিভিন্ন শহরগুলোতে বোমাবর্ষণ শুরু করে। ইরান এ সময় 50 টির বেশি জঙ্গি বিমান হারায়। তবে প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন সেনাবাহিনীকে যুদ্ধ শুরুর ১০ দিনের মধ্যে যেসব এলাকার দল করতে বলছিলে ইরাকি সেনাবাহিনী তা দখল করতে সক্ষম হয়নি।
দ্বিতীয় পর্যায়ঃ
পাল্টা আক্রমনে ইরানের সাফল্য (আগস্ট ১৯৮১-সেপ্টেম্বর ১৯৮২)
বিপ্লবউত্তর ইরান প্রথমদিকে অগোছালো থাকলেও এক বছরের মাথায় তারা ঘুরে দাঁড়ায়। পাল্টা আক্রমণে তারা ইরাকি বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করে। এ সময়ে ইরানের অধিক সংখ্যক জনবল ও সেনাবাহিনী এবং স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর দৃঢ় বিশ্বাসে তারা এগোতে থাকে। ইরাকি বাহিনী কর্তৃক দখলকৃত অঞ্চল পুনরুদ্ধার করে এবার ইরান ইরাকের অভ্যন্তরে অভিযান শুরু করে।
তৃতীয় পর্যায়ঃ
নিষ্ফল ও প্রতিশোধ মূলক আক্রমণ (অক্টোবর ১৯৮২-১৯৮৮)
এরপর উভয় দেশ নিজ নিজ অবস্থান সুদৃঢ় করে প্রতিপক্ষের উপর ধ্বংসাত্মক আক্রমণ চালাতে থাকে। ইরাক বিমান শক্তিতে শক্তিশালী হওয়ায় ইরানের বড় বড় শহরের উপরে আক্রমণ পরিচালনা করে। একইভাবে ইরান ইরাকের বড় বড় স্থাপনাগুলোর উপর হামলা চালাতে থাকে। 1988 সাল পর্যন্ত উভয়পক্ষ হিংসাত্মক ও প্রতিশোধ মূলক আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ পরিচালনা করতে থাকে।
আরও পড়ুন-
তানজিমাত কী ? তানজিমাত যুগে অটোমান তুরস্কে গৃহীত সংষ্কারাবলী
ইরান-ইরাক যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া
ইরান-ইরাক যুদ্ধে আরব দেশসমূহের প্রতিক্রিয়া
যুদ্ধ শুরুর পরপরই জর্ডানের বাদশা ইরাককে সমর্থন দেন। তিনি আরব দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে ইরাককে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান। এছাড়া তিনি ইরানকে ইসরাইলের মতই আরবদের শত্রু বলে আখ্যায়িত করেন। জর্ডান তারপরই ইরাককে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করতে থাকে। মরক্কোর বাদশা হাসান ইরাকের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেন। ইরান-ইরাক যুদ্ধের কিছুদিন পর কুয়েত তার সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত থাকা নির্দেশ দেয় এবং কুয়েতে অবস্থানরত সমস্ত ইরানীদেরকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালযয়ে নাম লিপিবদ্ধ করার নির্দেশ দেয়।
সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আর,ব মৌরিতানিয়া উত্তর ইয়েমেন ইরাকের প্রতি সমর্থন জানায়। মিশর প্রথম দিকে ইরাককে যুদ্ধ শুরুর জন্য অভিযুক্ত করলেও পরবর্তীতে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে। তেল সমৃদ্ধ আরব দেশগুলো ইরাককে অস্ত্র শস্ত্র দেওয়ার পাশাপাশি আর্থিকভাবেও সহযোগিতা করে। উপসাগরের দেশগুলো ইরাক কে ১৪ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেয়। এর বাইরে কুয়েত বিনা সুদে দুই বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রদান করে। অন্যদিকে সিরিয়া ও লেবানন ইরানকে সমর্থন দেয়। সিরিয়া থেকে ইরান কিছু অস্ত্র লাভ করে। তিনোসিয়া ও আলজেরিয়া মোটামুটি নিরপেক্ষ থাকে।
ইরান-ইরাক যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভূমিকা:
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উপসাগরীয় যুদ্ধে নিরপেক্ষতা নীতি ঘোষণা করে। তবে ইরানের বিপ্লবী সরকারের প্রতি মার্কিন বিরোধিতা এবং মার্কিন জিম্মি সমস্যার কথা স্মরণ করে মার্কিন সরকার নিরপেক্ষতার অন্তরালে ইরানের পরাজয় ও দুর্দশা দেখতে আগ্রহী ছিল। ১৯৮৩ সালের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয় দেশের মাধ্যমে ইরাককে অস্ত্র সরবরাহ করতে থাকে। আরব সাগরে মার্কিন রণতরীর সংখ্যা বৃদ্ধি করে যুক্তরাষ্ট্র।
কিন্তু ইরান-ইরাক যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত নিরপেক্ষতার মূলে ছিল অস্ত্র বিক্রি করার ধান্দা। কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একইসাথে ইরাককে অস্ত্র দেয়ার পাশাপাশি গোপনে তাদের শত্রু ইরানের কাছেও অস্ত্র বিক্রি করেছে। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান প্রশাসন এবং কংগ্রেসের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে গোপনে ইরানের কাছে অস্ত্র বিক্রি করেন। এ অস্ত্র বিক্রির অর্থ নিকারাগুয়ার কমিউনিস্টদের ঠেকাতে বিদ্রোহীদেরকে সহায়তা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়।
ইরান-ইরাক যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন:
তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধের শুরুতে নিরপেক্ষতা নীতি ঘোষণা করে। যদিও ইরাকের সঙ্গে তার বেশ কিছু সামরিক সহযোগিতামূলক চুক্তি অব্যাহত ছিল এবং যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরও বেশ কিছুদিন চুক্তি অনুযায়ী অস্ত্রশস্ত্র ইরাকে আসতে থাকে। কিন্তু ইরানের কাছে রাশিয়া কিছু পরিমাণ অস্ত্র বিক্রি করে। প্রতিক্রিয়াশীল আরব দেশগুলো ইরাককে সাহায্য করতে থাকায় ইরাক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্লকে ঢুকে পড়ায় রাশিয়া কিছুটা ইরান ঘেষানীতি অবলম্বন করে।
ইউরোপের অন্যান্য দেশ ব্রিটেন ফ্রান্স মৌখিকভাবে যুদ্ধ বন্ধ করার আহ্বান জানালেও অস্ত্র বিক্রি করার জন্য তারা একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের পক্ষে ছিল ৷
আরও পড়ুন-
সুয়েজ খালের ইতিহাস এবং মিসরের স্বাধীনতা ও জাতীয় জীবনে সুয়েজ খালের প্রভাব
যুদ্ধ বিরতি:
আক্রমণ আর পাল্টা আক্রমণের মাধ্যমে যুদ্ধ চলতে থাকে। উভয় দেশকে যুদ্ধ বিরোধীতে রাজি করানোর জন্য প্রথমে জাতিসংঘ অতঃপর ওআইসি এবং জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। ১৯৮৮ সালের দিকে এসে অবস্থা গুরুতর আকার ধারণ করে। 1988 সালের মাঝামাঝি সময়ে ইরান কুর্দিদের সহায়তায় ইরাক অধ্যুষিত হালাবজা দখল করে নিলে সাদ্দাম হোসেন ইরান এবং কুর্দিদের শায়েস্তা করার জন্য রাসায়নিক বিষাক্ত গ্যাস সমৃদ্ধ বোমা নিক্ষেপ করেন। এর ফলে প্রায় পাঁচ হাজার বেসামরিক লোক নিহত হয় এই ঘটনায় বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। ইমাম খোমেনী বিষয়টি নিয়ে সংকিত হয়ে উঠেন। ভবিষ্যতে ইরাক এই ধরনের রাসায়নিক গ্যাস ইরানে ব্যবহার করতে পারে এ আশঙ্কায় ইরান যুদ্ধ বিরতিতে সাড়াদেয়। অতঃপর উভয়পক্ষ ১৯৮৮ সালের ২০শে আগস্ট আলজিয়ার্স চুক্তির মাধ্যমে জাতিসংঘের ৫৯৮ নম্বর সিদ্ধান্তে স্বাক্ষর করে যুদ্ধ বিরোধী কার্যকর করে।
ইরান-ইরাক (উপসাগরীয়) যুদ্ধের ফলাফল
অমীমাংসিত যুদ্ধ
ইরান-ইরাক যুদ্ধ এমন একটি যুদ্ধ যে যুদ্ধে কেউ হারেনি কেউ জিতেনি। এটি একটি অমীমাংসিত যুদ্ধ। উভয় দেশ যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল এবং উভয়েই শেষ পর্যন্ত যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হলে এ যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু চূড়ান্ত সফলতা কারোরই হয়নি।
হতাহত ও ধ্বংসযজ্ঞ
ইরান-ইরাক যুদ্ধে প্রায় ৫ লক্ষ সামরিক বেসামরিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে এবং প্রায় ১০ লক্ষ সামরিক এবং বেসামরিক মানুষ হতাহত হয়। মধ্যপ্রাচ্যে এটি ছিল একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ এবং ব্যাপক ধ্বংসাত্মক একটি যুদ্ধ। লোক সংখ্যার দিক দিয়ে ইরানিরাই বেশি হতাহত হয়েছিল। অন্যদিকে ইরাকের অবকাঠামো, শিল্প কারখানা প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। বড় বড় শহরগুলোতে উভয় দেশ হামলা চালিয়েছিল বলে এটি বড় শহরের যুদ্ধ নামেও পরিচিত
আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি
সামরিক বেসামরিক এবং অবকাঠামগত ক্ষয়ক্ষতি পাশাপাশি উভয় দেশের বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল। ৮ বছর ব্যাপী এই যুদ্ধে প্রায় ৩৫০ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়। উভয় পক্ষই রাষ্ট্রীয় সঞ্চিত অর্থ খরচ করে প্রায় দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হয়। ইরান বড় দেশ হওয়ার কারণে অল্প সময়েই তারা যুদ্ধের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়। কিন্তু ইরাকের পক্ষে তেমনটা সম্ভব হয়নি। উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে ইরাক যে ঋণ গ্রহণ করেছিল সেই ঋনের জালে জর্জরিত হয়ে শেষ পর্যন্ত কুয়েত দখল করে সেই ঋণ শোধ করার জন্য সাদ্দাম হোসেন চেষ্টা করেছিলেন। যা আরেকটি উপসাগরীয় যুদ্ধের সূত্রপাত করে।
Iran-Iraq war,
Iran-Iraq war,
Iran-Iraq war,
আরও পড়ুন-
গ্রিসের স্বাধীনতা যুদ্ধ।। Greek War of Independence
আরও পড়ুন-
বাদশাহ আমানুল্লাহ ! আধুনিক আফগানিস্তানের পথিকৃৎ
আরও পড়ুন-
প্রাক-মুসলিম মালয় জগতের উপর ভারতীয় ও চৈনিক প্রভাব: স্বরূপ ও তাৎপর্য
গ্রন্থপঞ্জি
- অধ্যাপক ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান, আধুনিক মুসলিম বিশ্ব:তুরস্ক-ইরান- আফগানিস্তান, নভেল পাবলিশিং হাউস, ঢাকা, 2006
- সফিউদ্দিন জোয়ারদার, আধুনিক মধ্যপ্রাচ্য (১ম খন্ড)
- প্রফেসর মোঃ আব্দুল করিম ও ড. মোঃ আব্দুল কালাম, আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের ইতিহাস এম আব্দুল্লাহ সন্স, ঢাকা, 2015
Md. Billal Hossain
B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka
BCS General Education
Lecturer
Department of Islamic History & Culture
Chandpur Govt. College, Chandpur.
No comments:
Post a Comment