ছয় দফা আন্দোলন:
পটভুমি, ধারাসমূহ, গুরুত্ব ও তাৎপর্য
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘোষিত ১৯৬৬ সালের ছয় দফা কর্মসূচি বাঙালি জাতির ম্যাগনাকার্টা হিসেবে পরিচিত। পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলার জনগণের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং সামরিক বৈষম্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে ৬ দফা ছিল এক দুঃসাহসিক কর্মসূচি। ছয় দফা কর্মসূচির প্রতি এদেশের মানুষের ছিল অকুণ্ঠ সমর্থন । ৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ৭০ সালে নির্বাচন এবং ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ছয় দফার প্রভাব ছিল অপরিসীম। লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে যেমন পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল তেমনি ছয় দফার ভিত্তিতেই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এক কথায় ৬ দফা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ।
আন্দোলনের পটভূমি
ছয় দফা কর্মসূচির পেছনে রয়েছে ঐতিহাসিক পটভূমি । এটি আকস্মিক গজে উঠা কোন ঘটনা নয়। পূর্ব বাংলার মানুষের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের অন্যায় আচরণ, সীমাহীন অত্যাচার ও বৈষম্যমূলক নীতির কারণেই শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা ঘোষণা করেছিলেন। ছয় দফার প্রেক্ষাপট নিম্নরূপ-
রাজৈনতিক পটভূমি
লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তানের জন্ম হয়েছে। লাহোর প্রস্তাবেই পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশে স্বায়ত্তশাসন থাকার কথা ছিল। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পশ্চিমারা বরাবরই স্বায়ত্ত শাসনের বিষয়টি অগ্রাহ্য করে। ১৯৫৪ সালে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রাদেশিক সরকারকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তারা উৎখাত করে। ১৯৫৯ সালে সামরিক শাসক আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্র প্রবর্তন করে এ দেশের গণমানুষের ভোটাধিকার হরণ করেন। ১৯৬০ এবং ৬৫ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রবল প্রভাব ঘাটিয়ে আইয়ুব খান জয়লাভ করেন। ১৯৬৫ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহর প্রতি গণজোয়ার তৈরি হলেও তখন ভোটাধিকার জনগণের হাতে ছিল না। আইয়ুব খানের প্রবর্তিত তথাকথিত আশি হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী ভোট দিয়েছিলেন। এই নির্বাচনেও আইয়ুব খান প্রবল প্রভাব খাটিয়ে অল্প ভোটে জয়লাভ করেন। এই অবস্থায় গন প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা এবং স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ঘোষণা করেন।
অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এর পূর্বাংশ স্বায়ত্তশাসন লাভের পরিবর্তে বরং উপনিবেশে পরিণত হয়। পাকিস্তানি শাসকদের এক চোখা নীতির কারণে পূর্ব পাকিস্তান ব্যাপক বৈষম্যের শিকার হয়। সামগ্রীক বিচারে অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল প্রবল। এ সময় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার উন্নয়নের অনুপাত ছিল 34:66। ১৯৬০-৬১ থেকে ১৯৬৪-৬৫ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যয় হয়েছিল মাত্র ৯৭০ কোটি টাকা। আর পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যয় হয়েছে ২১৫০ কোটি টাকা। অথচ পূর্ব পাকিস্তান কেন্দ্রীয় ট্রেজারিতে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় 200 কোটি টাকা বেশি বৈদেশিক মুদ্রা জমা দেয়। তা সত্ত্বেও আমদানির ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানকে বঞ্চিত করা হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের 60% রাজস্ব জমা হতো পূর্ব পাকিস্তান থেকে। অথচ পূর্ব পাকিস্তান উন্নয়ন বরাদ্দ পেত মাত্র ২৫%। পূর্ব পাকিস্তান থেকে সংগৃহীত অর্থ দিয়েই পশ্চিম পাকিস্তানের ঋণ পরিশোধ করা হতো। এরকম অর্থনৈতিক বঞ্চনার পরিপ্রেক্ষিতেই এর থেকে মুক্তি লাভের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা ঘোষণা করেছিলেন।
আরও পড়ুন-
বাঙ্গালি জাতির নৃতাত্ত্বিক পরিচিতি, Ethnographic identity of the Bengali nation
প্রশাসনিক পটভূমি
রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বৈষমের পাশাপাশি প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও পূর্ব পাকিস্তানিদেরকে বঞ্চিত করা হয় । কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিসের ৮৪% ছিল পশ্চিমাদের দখলে। সেনাবাহিনীর অধিকাংশ সদস্য ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি। সামরিক বড় বড় পদ বরাবরই তাদের দখলে ছিল। এছাড়া সেনা,নৌ ও বিমান বাহিনীর সকল সদর দপ্তর করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হাসান আসকারী রিজভির এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, আইয়ুব খানের আমলের ৬২ জন মন্ত্রীর মধ্যে মাত্র ২২ জন ছিলেন বাঙালি। যাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ কোন মন্ত্রণালয় দেওয়া হয়নি। এরকম বঞ্চনার অবসান ঘটানোর জন্যই দফা ঘোষণা করা হয়েছিল।
সাংবিধানিক প্রেক্ষাপট
সামরিক শাসনের ছাত্রছায়ায় ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান পাকিস্তানের দ্বিতীয় সংবিধান প্রণয়ন করেন। এখানে পাকিস্তানকে সাংবিধানিকভাবে একটি এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রের পরিণত করা হয়, যার সমস্ত ক্ষমতা ভোগ করবেন রাষ্ট্রপতি। জাতীয় সংসদকে রাষ্ট্রপতির অধস্তন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়। এখানে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা হয়। প্রাদেশিক শাসক ছিলেন রাষ্ট্রপতির আজ্ঞাবহ এজেন্টের মাত্র। রাষ্ট্রপতি ইচ্ছার বাহিরে কোন কথাই তিনি বলতেন না।
সামরিক পটভূমি
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণরূপে অরক্ষিত থাকে। কাশ্মীরকে নিয়ে সংঘটিত ১৭ দিন ব্যাপী এ যুদ্ধে পশ্চিমফন্টে যুদ্ধ হলেও পূর্ব পাকিস্তানে কোন প্রকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি । কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানকে নিরাপত্তা নিতে ব্যর্থ হয়। ভৌগোলিকভাবে পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় পূর্ব পাকিস্তান নিরাপত্তাহীনতা এবং সামরিক অসহায়ত্ব অনুভব করে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই বঙ্গবন্ধু ছয় দফার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আধা সামরিক বাহিনী গঠনের প্রস্তাব করেন।
ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা
পাক-ভারত যুদ্ধ শেষ হলে ১৯৬৬ সালের ৫-৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলোর জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মোট ২১ সদস্যের প্রতিনিধি দল অংশগ্রহণ করেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসনসহ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা বিষয়ক দাবি সম্বলিত ‘ছয় দফা কর্মসূচি’ সম্মেলনে পেশ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। অনুষ্ঠানের বাহিরে এসে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি তা ঘোষণা করেন। যা ঐতিহাসিক ছয় দফা নামে পরিচিত। ছয় দফার প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন পাওয়া যায়। আওয়ামী লীগ ঢাকাসহ সারাদেশে প্রচারপত্র ছড়িয়ে দেয়। ১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে তৎকালীন আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি ‘আমাদের বাঁচার দাবি ছয় দফা’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে এবং ১৯ মার্চের কাউন্সিল অধিবেশনে ‘ছয় দফা কর্মসূচি’ অনুমোদন লাভ করে।
আরও পড়ুন-
বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান, সীমানা ও ভূপ্রকৃতির বৈশিষ্ট্যসমূহ
ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচির ধারাসমূহ:
দফা-১, শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় প্রকৃতি:
এই ধারায় বলা হয় পাকিস্তান হবে একটি যুক্তরাষ্ট্র। এর ভিত্তি হবে লাহোর প্রস্তাব। এর প্রদেশসমূহকে পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। সরকার হবে সংসদীয় পদ্ধতির এবং প্রাপ্তবয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে সার্বভৌম আইনসভা গঠিত হবে।
দফা-২, কেন্দীয় সরকারের ক্ষমতা:
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে দুটি বিষয়ের ক্ষমতা থাকবে তথা প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি । এছাড়া অন্য সব বিষয়ে প্রদেশগুলোর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা থাকবে।
দফা-৩, মুদ্রা ও অর্থ বিষয়ক ক্ষমতা:
এই দফাতে বলা হয় মুদ্রা বিষয়ে নিম্নের যে কোন একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা যেতে পারে-
পাকিস্তানের দুটি অংশে দুটি পৃথক কিন্তু অবাধে বিনিময় যোগ্য মুদ্রা চালু থাকবে অথবা
সমগ্র দেশে একটি মুদ্রা থাকবে তবে সেক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচার বন্ধ করার কার্যকর ব্যবস্থা থাকতে হবে। এজন্য স্টেট ব্যাংকের অধীনে ২ অঞ্চলে দুটি রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে।
দফা-৪, রাজস্ব কর ও শুল্ক বিষয়ক ক্ষমতা:
প্রদেশগুলোর কর নির্ধারণের সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকার কোন প্রকার কর আরোপ করতে পারবে না। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রদেশগুলোর আয়ের একটি অংশ কেন্দ্রীয় সরকার প্রাপ্য হবে।
দফা-৫, বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা:
পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পৃথক হিসাব থাকতে হবে। অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা স্ব স্ব প্রদেশের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা প্রদেশগুলো সমানভাবে মিটাবে। কেন্দ্রের সাথে সঙ্গতি রেখে প্রাদেশিক সরকার যেকোনো বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদন করতে পারবে।
দফা-৬, আধা সামরিক বাহিনী গঠনের ক্ষমতা:
আঞ্চলিক সংহতি ও সংবিধান রক্ষার জন্য সংবিধানে প্রদেশগুলোকে স্বীয় কর্তৃত্বে প্যারামেলেটারি বা আধা সামরিক বাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে।
৬ দফার পক্ষে প্রচারণা
পুস্তিকা প্রকাশ-আমাদের বাঁচার দাবি ৬ দফা
শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগ ছয় দফার পক্ষে ব্যাপক প্রচারণা চালায়। আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি ৬ দফার পক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য ‘আমাদের বাাঁচার দাবি ৬ দফা’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে সারাদেশে বিলি করে। এতে ছয় হাজার পক্ষে ব্যাপক জনমত তৈরি হয়।
সভা সমাবেশ:
প্রচারপত্র বিতরণের পাশাপাশি ছয় দফার পক্ষে জনমত তৈরির জন্য শেখ মুজিবুর রহমান সারাদেশে চষে বেড়ান। ১৯৬৬ সালের ২৩ মার্চ থেকে ৮ ই মে পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা কেন্দ্রিক ৩২ টি জনসভায় ভাষণ দেন। ১৯৬৬ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘির ময়দানে সমাবেশের মাধ্যমে ছয় দফা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়
ছয় দফার প্রতিক্রিয়া
ছয় দফা আন্দোলন অল্প সময়ের মধ্যেই জনপ্রিয়তা লাভ করে। আইয়ুব খান ছয় দফা আন্দোলনকে রাষ্ট্রবিরোধী বলে আখ্যা দেন। প্রাদেশিক গভর্নর মোনায়েম খান ৬ দফা আন্দোলন নস্যাৎ করার জন্য দমন নীতি গ্রহণ করেন। পাকিস্তানের অনেক রাজনৈতিক দল বিশেষ করে ধর্মভিত্তিক এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো ৬ দফার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। এদিকে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ছয় দফা কে সমর্থন দেয়নি।এমনকি আওয়ামী লীগের অনেক নেতৃবৃন্দ ৬ দফার প্রশ্নে দিধাবিভক্ত ছিলেন।
ছয় দফা আন্দোলন বন্ধ না করলে আইয়ুব খান শেখ মুজিব এবং পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধের আভাস দেন। তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলেখিকার আলী ভুট্টু ছয় দফার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিতে থাকেন। এত বিরোধিতা সত্ত্বেও শেখ মুজিবুর রহমানের অসাধারণ নেতৃত্ব এবং সাংগঠনিক দক্ষতা বলে তিনি ছয় দফা কে জনপ্রিয় আন্দোলনে রূপদান করতে সক্ষম হন।
হামলা মামলা এবং গ্রেফতার:
ছয় দফা আন্দোলনকে জোরদার করতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর নেতা কর্মীরা ব্যাপক নিপীড়ন, নির্যাতন, হামলা, মামলা এবং গ্রেপ্তারের শিকার হন। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনের প্রথম তিন মাসেই শেখ মুজিবুর রহমানকে আটবার গ্রেফতার করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে যশোর, ময়মনসিংহ, সিলেটসহ বিভিন্ন জেলায় মামলা দায়ের করা হয় এবং তাকে সেখানে হাজির করা হয়। আন্দোলন নস্যাৎ করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে শত শত নেতাকর্মী প্রাণ হারায়। সরকারের ধরপাকরের কারণে ছয় দফা আন্দোলনের নেতৃত দেওয়ার মতো কোনো নেতা ই জেলের বাইরে ছিলেন না। কিন্তু সাধারণ মানুষের মাঝে এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ছয় দফা এবং এর প্রেক্ষিতে স্বায়ত্তশাসনকে আইয়ুব খান দেশদ্রোহী এবং এর নেতৃবৃন্দকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে অভিহিত করেন। পাকিস্তানের ঐক্যে ফাটল ধরানোর জন্য তিনি ছয় দফা আন্দোলনকে দায়ী করেন।
ছয় দফা আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
স্বায়ত্তশাসনের যৌক্তিক দাবি:
ছয় দফার মাধ্যমে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের অধিবতর স্বায়ত্তশাসন দাবি করা হয়েছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর স্বায়ত্তশাসনকে যেভাবে উপেক্ষা করা হয়েছিল ৬ দফার মাধ্যমে পূর্ব বাংলায় স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে জোরালো জনমত তৈরি হয়েছিল। পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার যুক্তরাষ্ট্রের পরিণত করার জন্য স্বায়ত্তশাসনের বিকল্প ছিল না।
জাতীয়তাবাদের ভীত মজবুত হয়:
ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটেছিল ছয় দফা আন্দোলন সেটাকে আরো শক্তিশালী করে এবং রাজনৈতিক প্রাণশক্তি দান করে। ছয় দফা ঘোষণার পর বাঙালিরা বুঝতে পারে বাঙালি জাতিসত্তাকে কতটা অবহিত করে রাখা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদ রাজনৈতিকভাবে সুদৃঢ় হয়। ব্যাপক নিপীড়ন নির্যাতন সত্বেও বাঙালিরা ছয় দফা থেকে পিছপা হয়নি।
আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ:
ছয় দফা ছিল পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর নিপীড়ন নির্যাতন আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রথম আনুষ্ঠানিক বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। যে আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পূর্ব বাংলার জনগণ পাকিস্তান আন্দোলনে যোগদান করেছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তা দুরাশায় পরিণত হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান হয়ে পড়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ। এই পরিস্থিতিতে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে জাতীয় প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা ঘোষণা করেছিলেন।
আন্দোলন-মুখী জনমত গঠন:
যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা দরখাস্ত করণ, সামরিক শাসন জারি,সংবিধান বাতিল করুন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিষিদ্ধকরণ, ক্ষমতার একচেটিয়া প্রয়োগ করে সংবিধান প্রণয়ন এবং শিক্ষানীতি ইত্যাদি কারণে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে একটি গণআন্দোলনের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছিল। ৬২ সালের পর জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠিত হলেও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর তা স্তিমিত হয়ে গেলে শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফার মাধ্যমে জনমতকে সংঘটিত করে সংগ্রামী চেতনা সৃষ্টি করতে সক্ষম হন।
অধিকার সম্পর্কে সচেতনতার সৃষ্টি:
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তানকে সামাজিক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছিল ছয় দফা কর্মসূচির মাধ্যমে সে সকল বিষয়গুলোই প্রতিফলিত হয়েছে। ছয় দফা কর্মসূচির প্রচার ও প্রসারের ফলে এদেশের মানুষ তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়েছে।
বাঙ্গালীদের ঐক্যবদ্ধকরণ:
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন যেমন এদেশের মানুষকে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। তেমনি ছয় দফা আন্দোলন মানুষকে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করেছে।
স্বধীনতার চেতনার সৃষ্টি:
লাহোর প্রস্তাবে যেমন পাকিস্তান সৃষ্টির কথা বলা হয়েছিল তেমনি ৬ দফাতে প্রচ্ছন্নভাবে হলেও একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সূত্র নিহিত ছিল। আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে গিয়ে আইয়ুব খান যে দমন নিপীড়ন শুরু করেছিল তার বিরুদ্ধে জনমনে যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল তা এদেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছে এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে পরিচালিত করেছে।
গণঅভ্যুত্থানে ভূমিকা পালন:
৬ দফা আন্দোলনের সূত্র ধরেই ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হলে এর প্রেক্ষিতেই সংঘটিত হয় ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান। ছয় দফা আন্দোলন সাময়িক স্তিমিত হলেও ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ছিল একটি সফল আন্দোলন, যার পেছনে ছয় দফা আন্দোলনের প্রভাব ছিল প্রবল। কেননা শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা এবং ছাত্রদের ১১ দফা ছিল ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের মূল চালিকাশক্তি।
৭০ এর নির্বাচনে জয়লাভ:
ছয় দফা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে যে সচেতনতাবোধ তৈরি হয়েছিল তার দারুন প্রভাব পড়েছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচনে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতিহারে ছয় দফা কে সংযুক্ত করা হয় এবং ছয় দফা কার্যকর করে বৈষম্য বিলোপ ও বাঙালি জাতির মুক্তির আশ্বাস দেয়া হয়। যার পরিস্থিতিতে ১৯৭০ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দারুন ভাবে জয়লাভ করে।
স্বাধীনতা আন্দোলন:
৬ দফার অন্যতম লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের অধিকতর ও স্বায়ত্তশাসন। ছয় দফার মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসন না পেলেও বাঙালিরা পেয়েছে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা। লাহোর প্রস্তাব যেমন পাকিস্তানের জন্ম দিয়েছিল তেমনি ছয় দফা স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে।
সুতরাং বাঙ্গালীদের জাতীয় জীবনে ছয় দফার গুরুত্ব তাৎপর্য অপরিসীম
আরও পড়ুন-
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বৃহৎ শক্তিবর্গের ভূমিকা
আরও পড়ুন-
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান
আরও পড়ুন-
ঔপনিবেশিক শাসনামলে ভারতে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভবঃ কারণ, বিকাশ, গতি-প্রকৃতি ও ফলাফল
গ্রন্থপঞ্জি:
ড.আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন, বাংলাদেশের ইতিহাস ১৯০৫-১৯৭১, তৃতীয় সংস্করণ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনী, ঢাকা ২০১৮,
ড. এ কে এম শওকত আলী খান ও অন্যান্য, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস, গ্রন্থ কুটির পাবলিকেশন, ঢাকা, ২০১৪।
No comments:
Post a Comment