খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগ অবসানের পর ৬৬১ খ্রিস্টাব্দে উমাইয়া বংশের শাসন শুরু হয়। উমাইয়া বংশের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন মুয়াবিয়া (রা:)। সিরিয়ার দামেস্ক ছিল তাঁর রাজধানী। উমাইয়া খলিফাদের শাসন ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। উমাইয়া বংশের মোট ১৪ জন খলিফা রাজত্ব করেন। এই ব্যবস্থাকে খিলাফত বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে খোলাফায়ে রাশেদীনের সাথে এর রয়েছে বিপুল পার্থক্য। উমাইয়া খিলাফত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে ইসলামের সর্বপ্রথম বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের ধারাবাহিকতা শুরু হয় এবং মজলিশে শুরার পরিবর্তে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার আবির্ভাব ঘটে।
উমাইয়াদের পরিচিতি:
উমাইয়া বংশ কুরাইশ গোত্রের একটি শাখা। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর পঞ্চম ঊর্ধ্বতন পুরুষ ছিলেন। আবদে মানাফা আবদে মানাফের ৬ পুত্রের মধ্যে হাশেম, মুত্তালিব ও আবদুশ শামস ছিলেন সহোদর ভাই। হযরত মুহাম্মদ (স) ছিলেন হাশেমের বংশধর। আবদুশ শামসের এক পুত্রের নাম উমাইয়া। তাঁর সন্তানরাই উমাইয়া বা বনী উমাইয়া বলে পরিচিতি লাভ করে।
উমাইয়া হাশেমি দ্বন্দ্ব:
হাশেম তাঁর বদান্যতা, জ্ঞান বুদ্ধি ও বিচক্ষণতার জন্য কুরাইশদের নেতা হিসেবে পরিচিত। এই নেতৃত্ব ছিল মূলত কাবাঘরের রক্ষণাবেক্ষণ কে কেন্দ্র করে। কিন্তু তাঁর ভাতিজা উমাইয়া তাঁর নেতৃত্ব মেনে নেয়নি। ভাতিজা চাচা হাশিমের সাথে নেতৃত্ব নিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং তিনি যুদ্ধে পরাস্ত হন। ফলে জাহেলী যুগ হতেই তাদের মধ্যে বিদ্বেষের সৃষ্টি হয় এবং দ্বন্দ চলে।
হযরত মুহাম্মদ নবুওয়াত প্রাপ্ত হলে উমাইয়া বংশ রেষারেষির কারণে তা সহজে মেনে নেয়নি। উমাইয়া নেতা আবু সুফিয়ান হাশেমী বংশের মর্যাদা বেড়ে যাবে ভেবে নবীর বিরোধিতা করেন। হযরত মুহাম্মদ তাদের মধ্যে ঐক্যের বন্ধন গড়ে তুলতে সক্ষম হন।
পরবর্তী পর্যায়ে উমাইয়া বংশোদ্ভুত হযরত উসমান (রা) ক্ষমতায় আসলে উমাইয়ারা এটাকে তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য এক সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে এবং এ সময় তারা তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে। উমাইয়ারা রাষ্ট্রের বিভিন্ন বড় বড় পদে নিয়োগ পায়, খলিফার সরলতার সুযোগে তার চাচাত ভাই মারওয়ান চক্রান্ত ও অন্যায় ক্ষমতার চর্চা করে। ২০ বছর ধরে সিরিয়ার প্রাদেশিক শাসনকর্তা হযরত মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন তাদের ক্ষমতার অন্যতম ভিত্তি।
খলিফা ওসমান (রা:)এর শাহাদাতের পর হাশেমী বংশোদ্ভুত খলিফা আলীর (রা) সময়ে পূর্বের বংশগত উমাইয়া হাশেমি দ্বন্দ্ব দ্বন্দ্ব-সংঘাত মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং পারস্পরিক ঘৃণা - বিদ্বেষ ও শত্রুতা চূড়ান্ত আকার ধারণ করে। তারই জের ধরে হযরত আলী (রা)-এর খিলাফতের পরিসমাপ্তির পর ৪১ হিজরিতে উমাইয়া শাসনের ভিত্তি রচনা করে।
আরও পড়ুন-
হযরত মুয়াবিয়া/ উমাইয়াদের ক্ষমতায় আসার প্রক্রিয়া
খলিফা উসমান (রা:) এর হত্যা
ইবনে সাবা এর নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা হযরত উসমানকে হত্যা করার পর হযরত আলী খলিফা নির্বাচিত হন । হযরত তালহা, জুবায়ের, আয়েশা (রা:) এবং উমাইয়া নেতৃবৃন্দ প্রথমেই হযরত উসমান হত্যার বিচার দাবি করেন এবং জনসাধারণকে উত্তেজিত করে তোলেন। কিন্তু খলিফা হযরত আলী সারা দেশে স্থিতিশীলতা এনে অতঃপর হযরত উসমান হত্যার বিচার করতে আগ্রহী হন । এত করে হযরত আলী (রা:) সাথে অন্যান্যদের মতবিরোধ তৈরি হয় এবং উমাইয়ারা এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আলীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
মুয়াবিয়া (রা:) এর দৃশ্যপটে আগমন:
এদিকে হযরত মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু নিহত খলিফা হযরত ওসমানের রক্তমাখা জামা এবং তার স্ত্রীকে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে নিয়ে যান । সেখানে জনসম্মুক্ষে উসমান (রা:) এর রক্তমাখা জামা এবং তার স্ত্রী নায়লার কর্তিত আংগুল জনসম্মুক্ষে প্রদর্শনের মাধ্যমে তিনি জনসাধারণের সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করেন এবং হযরত আলীর বিরুদ্ধে এক ধরনের উত্তেজনা তৈরি করেন।
আলী -মুয়াবিয়া (রা:) দ্বন্দ্ব:
হযরত আলী খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল ত্রি-বার্ষিক গভর্নরদের পরিবর্তন করেন। সেই সময় তিনি সিরিয়ায় 20 বছর ধরে থাকা গভর্নর হযরত মুয়াবিয়া রা কে বরখাস্ত করেন । অন্যান্য গভর্নররা আদেশ পালন করলেও হযরত মুয়াবিয়া রা: এই আদেশ অমান্য করেন। হযরত মুয়াবিয়া হযরত আলীর প্রতীয়মান হত্যাকাণ্ডের বিচার করার আহ্বান জানান এতে হযরত আলী এবং মব এর মধ্যকার দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে।
সিফফিনের যুদ্ধ ৬৫৬
কেন্দ্রীয় খলিফার আদেশ অমান্য করা সহ নানাবিধ কারণে হযরত আলীর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন হযরত আলীর বিরুদ্ধে সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং ৬56 সালে উভয় বাহিনী সিফফিনের যুদ্ধ মুখোমুখি হয় । যুদ্ধের এক পর্যায়ে হযরত মুয়াবিয়ার পরাজয় আসন্ন দেখে আমর আমর ইবনুল আস এর পরামর্শে কুরআন শরীফের পাতা বর্ষার অগ্রভাগে তুলে ধরে আল-কুরআনের ভিত্তিতে জয়-পরাজয় ছাড়াই সালিশের মাধ্যমে মীমাংসা করার প্রস্তাবে যুদ্ধ শেষ হয়। যদিও আলী এটাকে প্রতারণা বলে বুঝতে পারেন কিন্তু আলীর পক্ষের কিছু লোকের চাপাচাপিতে আলী যুদ্ধ বন্ধ করতে বাধ্য হন।
দুমাতুল জান্দাল এর সালিশ- ৬৫৯
659 সালের জানুয়ারি মাসে দুমাতুল জান্দাল বিশাল সমাবেশ হয় সেখানে সহজ-সরল আবু মুসা আশআরীর সাথে সুচতুর আমর ইবনুল আস যে প্রতারণাপূর্ণ কৌশল গ্রহণ করেন তাতে আলীর কূটনৈতিক পরাজয় ঘটে। প্রায় প্রায় তিন হাজার লোকের উপস্থিতিতে আলোচনার জন্য উভয় পক্ষ থেকে একজন করে প্রতিনিধি নিযুক্ত করা হয়। হযরত আলী পক্ষে প্রতিনিধি নিযুক্ত হন সহজ-সরল আবু মুসা আশআরি, অন্যদিকে হযরত মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু এর পক্ষে প্রতিনিধি নিযুক্ত হন অত্যন্ত চতুর ও কুটকৌশলী আমার ইবনে আস। আবু মুসা আল আশআরী এবং আমর ইবনুল আস প্রথম স্থীর করলেন যে খিলাফতের স্বার্থে হযরত আলী এবং মুয়াবিয়া উভয়কেই সরিয়ে দিতে হবে অতপর উপস্থিত জনতার মতামতের ভিত্তিতে একজনকে খলিফা নির্বাচন করা হবে। প্রবীণ ব্যক্তি হিসেবে আমর ইবনুল আস প্রথমে আবু মুসা আশআরিকে প্রস্তাব করার অনুরোধ করেন। আবু মুসা আশআরী ঘোষণা করেন যে, খিলাফতের স্বার্থে আমি আলীকে খিলাফতের পদ থেকে অবসারণ করলাম। অতঃপর আমার ইবনুল আস দাঁড়িয়ে বললেন যে, মুসলিম বিশ্ব এখন খিলাফত শূন্য রয়েছে। আর মুসলিম বিশ্ব খিলাফত শূন্য থাকতে পারে না আমি খিলাফতের শূন্য পদে মুয়াবিয়াকে নিযুক্ত করলাম।বস্তুত মুয়াবিয়া তো কখনো খলিফাই মনোনীত হননি সুতরাং আমর কর্তৃক তাঁর অপসারনের প্রশ্নই আসে না। এ বিষয়টি আবু মুসা আশআরি বুঝতে পারেননি। এই বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য রায়কে আলী প্রত্যাখ্যান করেন ফলে উভয় দল তীব্র শত্রুতাবশত পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
খেলাফতের ভাগাভাগি:
এরপর খেলাফত আলী এবং হযরত মুয়াবিয়া এর মধ্যে ভাগ হয়ে পড়ে। হযরত মুয়াবিয়া সিরিয়া এবং মিশরের কর্তৃত্ব ধরে রাখেন, এদিকে হযরত আলী মক্কা-মদিনা, পারস্য, ইরাক এ খলিফা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত রাখেন । তিনি মদিনা থেকে কুফাকে রাজধানী স্থানান্তর করেন। 660 সালে হযরত মুয়াবিয়া মদিনা অভিযান করলে হযরত আলী পাল্টা অভিযানের মাধ্যমে মদিনার কর্তৃত্ব বজায় রাখেন। ৬৬০ সালে চুক্তির মাধ্যমে খেলাফতের ভাগাভাগি নিশ্চিত হয় এবং সিরিয়া এবং মিসরের সার্বভৌমত্ব মুয়াবিয়া রা: কে ছেড়ে দেওয়ার শর্তে শান্তি চুক্তিতে আবদ্ধ হন। তাঁরা উভয় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে থাকার অঙ্গীকার করেন ।
আরও পড়ুন-
খলিফা আব্দুল মালিক।। Abdul Malik the Umayyad Caliph.
আলী রা: এর হত্যা ও হাসান রা: এর খেলাফত লাভ :
৬৬১ সালের ২৭ জানুয়ারি চলতি খলিফা হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু রাজধানী কুফায় এক আততায়ী কর্তৃক শাহাদাত বরণ করেন । অতঃপর কুফাবাসী হযরত আলীর পুত্র হাসানকে পরবর্তী খলিফা হিসাবে মনোনীত করে। মক্কা ও মদিনার অধিবাসীরা হযরত হাসান আনুগত্য স্বীকার করে।
হাসান - মুয়াবিয়া রা: চুক্তি এবং মুয়াবিয়া রা: এর চূড়ান্ত খেলাফত লাভ-৬৬১:
খলিফা হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু এর মৃত্যুর পর হযরত হাসান খলিফা মনোনীত হলে হযরত মুয়াবিয়া তার বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। যুদ্ধে হযরত হাসান পরাজিত হন এবং তার সামরিক বাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহ দেখা দিলে তিনি হযরত মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধি করেন । এই সন্ধি অনুযায়ী হযরত মুয়াবিয়া কে তার জীবনের জন্য খেলাফত দেওয়া হয় এবং এটাও উল্লেখ থাকে যে হযরত মুয়াবিয়ার ইন্তেকালের পরে হাসানের ছোটভাই হোসাইন পরবর্তী খলীফা হবেন এবং হাসান রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ভাতা প্রাপ্ত হবেন এবং তিনি রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করবেন । এই চুক্তির মাধ্যমে হযরত মুয়াবিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলিম বিশ্বের খলিফা নির্বাচিত হন এবং এখান থেকেই উমাইয়া খিলাফতের যাত্রা শুরু হয়।
উমাইয়া খিলাফতের বৈশিষ্ট্যসমূহ
উমাইয়াদের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে শাসননীতি ও রাষ্ট্রের আদর্শের মধ্যে বেশ কিছু মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হয়। তা হলঃ
ইসলামি গণতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্রের পরিবর্তে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের প্রবর্তন হয়।
বায়তুল মাল জনগণের পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিণত হয়।
মজলিসে শূরার বিলোপ ঘটে। খলিফাই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়। জনগণ সরকারের সমালোচনা করার অধিকার হারায়। একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরাচারের প্রতিষ্ঠা হয়। নির্বাচনের পরিবর্তে মনোয়ন দ্বারা খলিফা নির্ধারণ করা হয়।
গোত্রীয় দলাদলি, কলহ ও বংশগত হিংসা-বিদ্বেষের পুনরুত্থান ঘটে।
খিলাফত ছিল ধর্মীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান কিন্তু এখন থেকে তা কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হয়। খলিফার ধর্মীয় মর্যাদা লোপ পায়।
খলিফাদের আড়ম্বরপূর্ণ জীবন যাপন শুরু হয়।
প্রশাসনিক কেন্দ্ররূপে মদীনার গুরুত্ব লোপ পায়। দামেস্কের গুরুত্ব বেড়ে যায়।
আরব-অনারবি জাতিগত ও বর্ণগত বৈষম্য মাথা চাড়া দিয়ে উঠার সুযোগ পায়।
Md. Billal Hossain
B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka
BCS General Education
Lecturer
Department of Islamic History & Culture
Chandpur Govt. College, Chandpur.
No comments:
Post a Comment